আমি তারে দেখেছি পর্ব -০৩

#আমি_তারে_দেখেছি (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#৩য়_পর্ব

শান্ত মোবাইলের লক খুলতেই একটি মেইলের নোটিফিকেশন পেলো। মেইলটি একটি ভিডিও। ইমেইল আইডিটি খুব এলোমেলো, [email protected]। ভিডিও ওপেন করতেই চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো শান্তর। এটা কি করে সম্ভব! এটি দোলার বাড়ির সিসি টিভি ফুটেজ। এই ক্যামেরাটি ঠিক এন্ট্রি পথে মাথা উচিয়ে নিজেকে জাহির করেছিলো। সর্বপ্রথম এই সিসি টিভিটাই চেক করেছিলো বিচক্ষণ পুলিশের দল। কিন্তু কোনো সন্দেহজনক কিছুই পায় নি। অথচ ভিডিওটি সেই ক্যামেরার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভিডিও তে নবনীতাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দোলার বিল্ডিং এ প্রবেশ করেছে এবং বের হচ্ছে। দারোয়ান রেজিস্টার দিলে তাতে সাইন ও করেছে। অথচ যখন মৃত্যুর পর রেজিস্টার চেক করা হয়েছে তখন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। রেজিস্টারটারের কোনো পাতা ছেড়াও ছিলো না। দারোয়ানকে নবনীতার ছবিও দেখানো হয়েছিলো কিন্তু তার একটাই বাক্য ছিলো,
“এই মহিলাকে সে দেখে নি”

অথচ সেই বিল্ডিং এই নবনীতার প্রবেশ ঘটেছে। তার সামনে রেজিস্টার সাইন ও করেছে। অবাককর ব্যাপার হল, এই সিসি টিভি ফুটেজগুলো শান্ত ও বেশ কিছুবার দেখেছে। এমন কি রাস্তার দিকেরটাও দেখেছে। কিন্তু সেখানে সন্দেহজনক কারোর প্রবেশ বা নির্গমণ ছিলো না। সিসি টিভি রিচেক করার উদ্দেশ্য ছিলো নবনীতার ভাষ্যমত কোনো কালো মাস্কধারী কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কি না। কিন্তু আফসোস এমন কাউকেই পাওয়া যায় নি। শান্তর কপালে ভাঁজ প্রগাঢ় হচ্ছে। তখন ই সম্বিত ফিরলো নবনীতার কণ্ঠে,
“কি হয়েছে? আটকে গেলেন কেন? গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি?”

নবনীতার কোমল কণ্ঠের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকালো শান্ত। ঠোঁটে অমলিন হাসি। মোবাইলটা পকেটে পুরে নিলো। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“আসলে চো/র ছ্যা/চড়ে ঘেরা জীবন তো, হুটহাট অদ্ভুতুড়ে সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। তেমন ই কিছু”

বলেই বাইক এ স্টার্ট দিল। নবনীতা পেছনে বসলো। সামনের সাইড মিররে শান্ত তাকে গাঢ় দৃষ্টিতে দেখছে। অনেকগুলো প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে। শান্তর মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে ঘিরে একটি গোলকধাঁধার মাঝে সে পড়ে গিয়েছে। যখন ই মনে হয় সুতোগুলো এক এক করে ছাড়ছে, সে মুক্তদ্বারের কাছে চলে এসেছে তখন ই মরীচিকার মত সব আউলিয়ে যাচ্ছে। সুতোর প্যাঁচ বেড়েই চলেছে ক্রমশ। এর মাঝেই নরম হাতের স্পর্শ পেলো পেটের কাছটাতে। নবনীতা নিজ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মাথা এলিয়ে দিয়েছে তার বলিষ্ট পিঠে। তার বিষন্ন মুখে জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে। অবিন্যস্ত কোকড়ানো চুলগুলো উড়ছে মৃদুমন্দা বাতাসে। মেয়েটির কোমল মুখখানা দেখে কি তাকে আ সা মী ভাবা যায়? তার মাঝে নিষ্ঠুরতার ছাপ কি কল্পনা করা যায়?

********

জসীম সাহেব মেঝে থেকে খুব কষ্টে উঠে দাঁড়িয়েছেন। মাজা ব্যাথা করছে, তবুও লাঠির সাহায্য তিনি পায়চারী করছে। মুখে আকাশসম উদ্বিগ্নতা। মেয়ে এখনো বাড়ি ফিরে নি। রাত যে দশটার উপর হয়ে গেছে। সেই সন্ধ্যাতে বের হয়েছে। আ/হা/ম্ম/ক পুলিশটা কোথায়? সে কি আক্কেল সব ভেজে খেয়েছে? ভালো পরিবারের মেয়েরা কি এত রাত অবধি বাহিরে থাকে! নষ্ট মেয়েরা থাকে। আর তার মেয়ে সর্বসেরা? আচ্ছা পুলিশের কোনো বদ মতলব নেই তো? মেয়ের প্রতি উদ্বিগ্নতা হুমড়ি তুমড়ির সাথে মিনিট পাচেক পর পর ই জাহির করছেন তিনি। স্ত্রীর মুখে প্রচন্ড বিরক্তি, কিন্তু অসুস্থ বর বিধায় কিছুই বলতে পারছেন না। এদিকে নিশাদের উপর চলছে বুলডোজার। একটু পর পর তাকেই শাষাচ্ছেন জসীম সাহেব। চিৎকার করছেন, উত্তেজিত হচ্ছেন। সেই উত্তেজনায় নিশাদ চিরে চ্যাপ্টা হচ্ছে। একটু পর পর ই তাকে শুনতে হচ্ছে,
“আরে রামছা/গ/ল দেখ না তোর বোন আসলো কি না, ফোন দে না। সারাক্ষণ মোবাইল আর ল্যাপটপ। গেম গেম। ব/গা হয়ে যাচ্ছিস তুমি। বুদ্ধিগুলো কর্পুরের মত উবে গেছে। তোকে থা/প্প/ড় থ্যাড়াপি দিতে হবে। উঠতে বসতে থা/প্প/ড়। দুটো করে প্রতিবার খাবার পরে। তুই রাম/ছা/গ/লের সর্দার হবার যোগ্যতাও হারিয়েছিস”

নিশাদ চুপ করে তার কটুবাক্য গিলছে। কিচ্ছুটি বলা মানেই বিপদ। ডোজ বেড়ে গেলে সহ্য ক্ষমতাও হাটু ভেঙ্গে পড়বে। শারমিন বেগম এবার হার মানলেন। শানিত স্বরে বললেন,
“এতো চিন্তা তুমি ফোন করো”
“এহ, বুদ্ধিশুদ্ধি কি তুমিও বেঁচে মুড়িমাখা খেয়েছো? মেয়ে হবু স্বামীর সাথে আছে আর আমি ফোন করবো! দেখাবে কেমন?”

জসীম সাহেবের কথা শেষ হবার পূর্বেই দরজার বেল বাজলো। তিনি চোপা থামালেন। এখন বউকে গালমন্দ করার চেয়ে দরজা খোলা বেশি জরুরি। তাই সবাইকে অগ্রাহ্য করে তিনি দরজা খুললেন। দরজা খুলতেই অন্তস্থল থেকে চাপা উৎকন্ঠাটি মুক্ত পেলো। মুখে ছলকে পড়া হাসিটা গোপন করে বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এতো দেরি কেন”

প্রতিউত্তরে শান্ত বলল,
“আমার বাইকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো”

বেমালুম মিথ্যে বলাটা শান্তর থেকে শিখা উচিত। এত নিপুনতার সাথে মিথ্যে বলে যে সত্য মিথ্যের তফাৎ ঘুচে যায়। নবনীতা অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। শুধু মাথা নাড়ালো। এদিকে জসীম সাহেবের লম্ফজম্ফ বাড়লো। তিনি তার চড়া কন্ঠে বললেন,
“কিপ্টে পুলিশ কি বাইকটার দেখভালো করো না? ঘু/ষ খাও না, তাই বলে একেবারে ফকির তো না”
“কিপ্টে আমি নই আংকেল, সেটা আপনিও জানেন। আসলে বাইকটা অনেক পুরাতন। নতুন কেনার মত টাকা আপাতত নেই। বিয়ে করবো তো, সেজন্য নবনীতার পোশাক, গয়না কিনতে তুলে রেখেছি। অবশ্য আপনি মেয়ের সাথে যদি যৌতুক হিসেবে একটি নতুন বাইক দিন আমি আপত্তি করবো না”
“তুমি পুলিশ হয়ে যৌতুক চাচ্ছো?”

জসীম সাহেবের রাগ তার কণ্ঠে ছলকে উঠলো। শান্ত সেই ক্রোধে পানি ঢেলে বলল,
“ছি ছি, তা কেনো। আমি জামাই হিসেবে উপঢৌকন চাইলাম। এটা আমার জন্মগত অধিকার”
“নির্লজ্জ ছেলে”
“লাজলজ্জের কথায় মনে পড়লো। আমি নবনীতা এই সপ্তাহেই বিয়ে করতে চাই। আসলে আর তর সচ্ছে না। কোলবালিশ নিয়ে আর কতদিন ঘুমাবো বলুন”

জসীম সাহেবের দাঁত কিড়মিড় করছে। হাতের লাঠিটা দিয়েই শান্তকে উত্তম মধ্যম করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তার চরিত্রের সাথে ব্যাপারটা শোভা পায় না। তাই রাগ গিলে বললেন,
“আমার মাজাটা এখনো ঠিক হয় নি”
“জানি, কিন্তু মেয়ের বিয়েতে তো আপনি “তৈ তৈ” গানে নাচবেন না। তাই ব্যাপারগুলো বসে কিংবা শুয়েও করা যাবে। আসলে বয়স তো কম হলো না, মাদার বাংলাদেশের ভাষ্যে এখন আমার ছেলের স্কুলে পড়ার কথা। আমারো একই মত। তাই দেরি করতে চাই না”

নবনীতা ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে শান্তর দিকে এই লোকটির মাথার তারগুলো কি আবারো ছিড়ে গেছে? একটু আগের বিচক্ষণ, স্থির মানুষটাকে এখন নিতান্তই ছেলেমানুষ লাগছে। জসীম সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে ভস্ম করতে চাচ্ছেন শান্তকে কিন্তু অপারগতা স্বীকার করে বললেন,
“তোমার সাথে আমার কথা আছে”
“আমারো আছে, একাকীত্ব প্রয়োজন। আপত্তি না থাকলে আপনার রুমে যাই?”

জসীম সাহেব মাথা দোলালেন। শান্ত তাকে সাহায্য করতে চাইলে তিনি সরাসরি বাঁধ সাধলেন। তিনি পঙ্গু নন। তারপর লাঠির ভরেই নিজ ঘরে গেলেন। শান্ত ও তার পিছু নিলো। নবনীতা পানির গ্লাসে পানি ঢালতে নিলেই নিশাদ বলল
“প্রেম করবি কর, মোবাইল তো ধরবি। আজ তোর জন্য বাবা আমাকে ছাগলের সর্দার পদ থেকে বহিস্কার করেছে”

নবনীতার তখন মনে পড়লো ফোনটা সে পার্কেই ফেলে এসেছে। ধুর, তখন একটু বেশি ঘাবড়েছিল। তা না হলে এখন এই ঝামেলা হত না।

*****

দীর্ঘ আধাঘন্টার কথোপকথন শেষে ঘর থেকে শান্ত বের হল। তার মুখখানা স্থির। জসীম সাহেব বের হলেন তার পর পর। স্ত্রী শারমিন বেগম কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তিনি বললেন,
“আগামী শুক্রবার ই শান্ত আর নবনীতার বিয়ে”

কথাটা বজ্রঘাতের মতো লাগলো নবনীতার কাছে। সত্যি ই বিয়েটা হবে? সে নিরুপায় নয়নে চাইলো শান্তর দিকে। শান্তর মুখে স্মিত হাসি। সে যাবার সময় বলে গেল,
“পরশু একবার বের হবো, সময় রেখ আমার জন্য”

*******

বাসায় খুশির বন্যা বইলো। হেনা বেগমের মুখ দুইশত বিশ ভোল্টের বাতির মতো চকচক করছে। অবশেষে ছেলের বিয়ে হবে। সামিয়া দেবরের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
“মা পারলে আজকেই মিষ্টি বিলি করতে যান”
“তুমি তৈরি থাকো, দ্বন্দিতা আসছে কিন্তু”
“একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে আমি লড়বো?”
“সে বাচ্চা নয় ভাবী। চতুর মহিলা”

বলেই নিজের ঘরে গেল শান্ত। জামাকাপড় ছাড়লো। তারপর হোয়াইট বোর্ড নিয়ে বসলো। ফোন বের করেই ইমেইল আইডিটা লিখলো। মিনিট বিশেক বাদে, অনেক কাটাকুটি করে আবার গুছিয়ে লিখলো “amitushar200720” তুষার, নামটি আজ ই এই কেসে জড়িয়েছে। আজ ই তার নামের ইমেইল চলে এসেছে। তাও যে সে ইমেইল নয়। নবনীতাকে সাসপেক্ট প্রমাণ করতে পারে এমন ইমেইল। এই ভিডিও ইরশাদের হাতে লাগলে সে তো আবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। শান্ত মার্কার দিয়ে সংখ্যাটাকে গোল করলো। ২০০৭২০ এটা কিসের নম্বর। আচ্ছা কোনো তারিখ কি? হতে পারে। জুলাই বিশ, ২০২০। তুষারের জন্মদিন? এখানে বিশ সাল, জন্মদিন হবার প্রশ্ন ই নয়। নাকি এই তারিখেই তুষার নিখোঁজ হয়েছিলো? গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো শান্ত। তার চোখ স্থির। তুষার কি বেঁচে আছে? আড়ালে প্রতিশোধ নিচ্ছে? নাকি কেউ তুষারকে ঢাল বানিয়ে তার সুপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছে? শান্ত কিছু একটা ভেবে একটি নাম্বারে ফোন করলো। গাঢ় স্বরে বলল,
“তুমি কাল আমার সাথে দেখা করবে” ……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here