#আরোও_একবার_বসন্ত
#২৪তম_পর্ব
হঠাৎ অনুভূত হলো কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। হুট করে এমন অনুভূতি হতেই বুকটা ভয়ে শিটিয়ে গেলো। বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করে ক্লান্ত সে। বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে আরাফাত দাঁড়িয়ে আছে। আরাফাতকে দেখামাত্র বিরক্তির মাত্রা যেনো আরোও বেড়ে গেলো প্রিয়ন্তীর। তার হাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়াতে আরোও বেশি যুদ্ধ করতে লাগলো। কিন্তু কিসের কি এই গন্ডার প্রকৃতি লোকের থেকে নিজেকে ছাড়ানো যেনো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে শান্ত হয়ে গেলে আরাফাত ঠেস দিয়ে বলে,
– অহেতুক এনার্জিটা নষ্ট করলেন। আমি মানুষটা অত্যধিক ট্যারা। আমাকে দেখে না বুঝা গেলেও এটাই সত্যি। আমি যেহেতু আপনাকে একবার নিজের মাঝে নিয়েই নিয়েছি সুতরাং আমার থেকে আপনার নিস্তার নেই।
– জোর করে আটকে রাখবেন?
– এতোদিন চাইনি কিন্তু এখন চাইছি। যদি জোর হয় তবে তাই। জোর করেই আটকে রাখবো আপনাকে।
– কেনো? আমি তো আপনাকে নিজের দুনিয়ায় আমন্ত্রণ দেই নি তাহলে?
– জোর যার মুল্লুক তার।
– আমি মুল্লুক?
– উহু আপনি আমার বিবাহিত বউ। আমার ভালোবাসা। আমার জেদ। আমার জীবনের প্রথম নারী।
নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাগুলো বললো আরাফাত। প্রিয়ন্তী দৃষ্টি আরাফাতের চোখে স্থির। এতোটা মায়াবী কোনো পুরুষের চোখ হতে পারে! এই মায়ার তরীতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ভয় হয় যদি তাল সামলাতে না পারে। যদি ডুবে যায়! আরাফাত তখন হাসতে হাসতে বললো,
– ডুববেন না, আমি আছি তো
– আপনি কি মন পড়তে পারেন?
– পারি তো। মানুষের চোখ তার মনের আয়না হয়। আমি আপনার চোখ পড়তে পারি।
– তাই বুঝি? তবে বিকেলে ওই কথাগুলো কেনো বলছিলেন?
– মাথাটা কাজ করছিলো না, একটু ইগোতেও হামলা হয়েছিলো কিনা! আর হবে না। “সরি” আমি বলবো না কিন্তু।
আরাফাতের কথায় খিলখিল করে হেসে দিলো প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তীর প্রাণবন্ত হাসিটা যেনো তপ্ত হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় ছিলো আরাফাতের জন্য। সবকিছু মিলিয়ে এতোটা বিষিয়ে ছিলো আরাফাত। মনটা যেনো একটা জালে আটকে গিয়েছিলো। দম বন্ধ লাগছিলো। যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছিলো সে। এটা ঠিক এই ক্ষত কাউকে দেখানো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন প্রিয়ন্তীর প্রাণবন্ত হাসিটা যেনো নতুনভাবে লড়াই করার প্রেরণা দিচ্ছে। লড়াই তো কেবল শুরু। এই জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে হলে কারোর অনুপ্রেরণা যে চাই, আর প্রিয়ন্তী সেই অনুপ্রেরণা। হাসি থামিয়ে প্রিয়ন্তী বললো,
– চলুন
– কোথায়?
– গয়না বেঁচতে!
– আপনি এতোগুলো গয়না আমার মার জন্য বেঁচে দিবেন?
– বেশি না তো লাখ দুয়েক হবে কি না সন্দেহ।
– এটাও কম কিসের?
– পরিবারে বিপদ আসলে হাতের কাছে যা আছে তাই নিয়ে নেমে পড়তে হয়। তখন আমি আমি করতে হয় না।
আরাফাত মুগ্ধ নয়নে প্রিয়ন্তীকে দেখছে। নারী মানেই রহস্য। এই নারীটি একদিন তার মার মুখের উপর প্রতিবাদের দুটো উক্তি বলে অপমানের রেখা টেনে ছিলো৷ অথচ আজ এই নারীটি তার সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছে তারই মায়ে সুস্থ করতে। কি অদ্ভুত না!!
___________________________________________________________________________________________________
সময় বহমান, এই সময়ের চাকা কখনো থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে দুটো সপ্তাহ কেঁটে গেছে। রাফিজা বেগমকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দু-মাস বেড রেস্টে থাকতে হবে। চিৎ হয়ে ঘুমোতে পারবেন না। কোলেস্টেরল জাতীয় কিছুই খেতে পারবেন না। সব কিছু মেপে খেতে হবে এমনকি পানিটাও। তার ঘর সবসময় পরিস্কার থাকতে হবে। অপরিষ্কার থাকা মানে ইনফেকশনের ভয়। হাড় কাঁটা পড়েছে বিধায় সেটা জোড়া লাগতে ছয় মাস তো লাগবেই। পায়ের ব্যান্ডেজ বদলাতে হয় ঘনঘন। খুব ঝামেলা। কিন্তু রাফিজা বেগমের চিন্তা নেই। কারণ তার তিনটি সৈন্য রয়েছে। তারাই সব করে, সকালে প্রিয়ন্তী, রাতে আরশাদ। আর আরাফাতের ডিউটির যেহেতু কোনো মা-বাপ নেই। তাই সে যখন সময় পায় তখনই হাত লাগায়। প্রিয়ন্তীকে আজকাল একেবারে অপছন্দ হচ্ছে না রাফিজা বেগমের। মেয়েটি এতো কিছু করছে যে অকৃতজ্ঞতা দেখাতে পারছেন না।
রুমের এক কোনে বসেছিলেন রাফিজা বেগম। দৃষ্টি জানালার বাহিরে। জীবনের সতেরোটা বছর স্বামী ব্যাতীত কাটিয়ে দিলেন। আল্লাহ আবার মৃত্যুর দোয়ার থেকে ফিরিয়ে আনলেন। যদি অপারেশনের থিয়েটার থেকে ফিরে না আসতেন কি হতো! আরাফাতের বিয়ে তো কোনো একভাবে হয়ে গেছে, কিন্তু আরশাদ? ওর একটা হিল্লে না করে গেলে কি মাটির নিচে শান্তিতে থাকতে পারতেন? তখনই রুমে খাবার নিয়ে প্রবেশ করে প্রিয়ন্তী। রাফিজা বেগমের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি নিজের চিন্তায় মগ্ন। গলা খাকারি নিয়ে প্রিয়ন্তী বলে,
– আন্টি কি করছেন?
প্রিয়ন্তীর ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে রাফিজা বেগমের। প্রিয়ন্তীকে খাবারের প্লেট হাতে দেখে জানালার ধার থেকে ধীর পায়ে হেটে বিছানায় বসেন তিনি। হাতে ক্যানোলা বলে প্রিয়ন্তী ই তাকে খাওয়িয়ে দিচ্ছিলো। খাওয়ার মাঝেই ধীর কন্ঠে রাফিজা বেগম বলেন,
– আজ ডিউটি নেই?
– না আন্টি, আজ ডিউটি নেই নি।
– আর কত দিন আন্টি বলবে?
– জ্বী?
– বউ হয়ে বাসায় এসেছো বিশ দিন হয়ে গেছে। এখনো আন্টি আন্টি। মা, আম্মা, আম্মু, মামনী বলতে কি হয় তোমার?
– অনুমতি দিচ্ছেন তবে?
– না দেবার কি আছে? ছেলের বউ যখন হয়েই গেলো তাহলে তো আমি তোমার শ্বাশুড়ি মাই হলাম তাই না?
– তাতো অবশ্যই
– শোনো, শ্বাশুড়ি মা দের একটি স্বভাব আছে। বউদের হুকুম চালানো। আরাফাত হবার পর এটা আমার মানবাধিকারে পরিণত হয়েছে। তুমি যেহেতু আমার বউ মা। তোমার উপর ও হুকুম চালাবো। আমার ছেলের উপর তোমার আগে আমার অধিকার। মাথায় বসিয়ে দাও।
– যথা আজ্ঞা। এমনিতেও আপনার ছেলের উপর অধিকার খাটাবার শখ নেই আমার।
– কেনো? খাটাবে না কেনো? অবশ্যই খাটাবে কিন্তু আমার পরে৷
– আচ্ছা। তা আরশাদের বিয়েটা দিয়ে আরেকটা বউ এনে নিলেই তো পারেন। তাহলে একই সাথে ডাবল হুকুম চালানো হবে। বলি কি রুপন্তীকে বউ করে নিয়ে আসুন। আমি তো মানুষটা ট্যারা। আমার উপর হুকুম চালিয়ে লাভ হবে না। মেজাজ খারাপ হলে সব ছেড়ে চলেও যেতে পারি। তবে রুপন্তী এমন না৷ ওর উপর দুজন মিলে হুকুম চালাতে পারবো।
– এহ! আমি বুঝি না ভাবছো? দুই বোন মিলে আমাকে বের করে দিলে?
– এতো মুরোদ আছে আমাদের? আর আমি এরকম চিন্তা করলেও রুপন্তী এমনটা না। নিজের জমানো টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলো আপনার অপারেশনের সময়। আমার বোন তো। খুব নরম প্রকৃতির। আর আপনার মনে হয় আমার মতো হলে আরশাদ ওকে পছন্দ করতো?
– এই কথায় লজিক আছে। আচ্ছা ভেবে দেখি।
রাফিজা বেগমের কথায় মুচকি হাসে প্রিয়ন্তী। মানুষটাকে প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন অতটা খারাপ লাগছে না। বরং তার সাথে ঝগড়া করতেও ভালো লাগে। আবার তাদের চিন্তাধারাতে মিল ও আছে। রাফিজা বেগমের খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে নিজ রুমে যায় প্রিয়ন্তী। রুমে প্রবেশ করতেই পেছন থেকে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে। এই কাজটা হরহামেশাই একটা মানুষই করে। এটা যেনো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে প্রিয়ন্তীর। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে প্রিয়ন্তী,
– কি চাই?
– কিছু না। শান্তি লাগে আপনার কাছে আসলে।
– ওহ, তাই বুঝি?
– হু, আপনি তো বেশ চালু
– কি জন্য মনে হলো
– ঠিকই মার মাথায় রুপন্তীর কথাটা ঢুকিয়ে দিলেন?
– হু, বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিলো আমি কেমন! কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?
– মার রুমে যাচ্ছিলাম। তখনই কানে আসলো। আপনি কথা বলছিলেন দেখে ঢুকি নি।
– এভাবে কানপাতা কিন্তু ভালো না।
– তাই বুঝি?
– হু, আপনি তো পুলিশ। এটা জানেন না। প্রাইভেসি নষ্ট হয়।
– তাই?
– হু
প্রিয়ন্তীর কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আরাফাত। অনেকদিন পর মন খুলে হাসছে সে। এতোদিন কম ঝড় যায় নি তার উপরে। প্রিয়ন্তীও তাকে ধীরে ধীরে আপন করে নিয়েছে। সম্পর্কটা এখন আর বেনামী নেই। একজন স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতোই তাদের সম্পর্ক। শুধু ভালোবাসার দুয়ারটাই খুলতে বাকি তাদের মাঝে। হয়তো তা খুলতে বেশি দেরি নেই। আরাফাত অপেক্ষায় আছে কবে প্রিয়ন্তী তার জন্য ভালোবাসার দুয়ারটা খুলে দিবে। প্রিয়ন্তী তখনো আরাফাতের বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ, তখনই ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের আওয়াজে আরাফাত প্রিয়ন্তীকে ছেড়ে দেয়। ফোনটি হাতে নিতে অজানা একটা নাম্বার ভেসে উঠে। ফোনটি রিসিভ করলে…….………..
চলবে
[ আমি কখনো টার্গেট দেই না। কিন্তু আজ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই পর্বে যদি ৬০০+ রিয়েক্ট হয় তবে আগামীকাল দুটো পর্ব পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ। আর যদি না হয়, তবে পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি
আরোও_একবার_বসন্ত
#২৫তম_পর্ব
প্রিয়ন্তী তখনো আরাফাতের বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ, তখনই ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের আওয়াজে আরাফাত প্রিয়ন্তীকে ছেড়ে দেয়। ফোনটি হাতে নিতে অজানা একটা নাম্বার ভেসে উঠে। ফোনটি রিসিভ করলে একটি পরিচিত কন্ঠ কানে ভেসে উঠে প্রিয়ন্তীর।
– হ্যালো, প্রিয়ু!
কন্ঠটি শুনতেই বুকটা ধক করে উঠে। কন্ঠটি আর কারোর নয় বরং ইরফান নামক লোকটির। সেই ইরফান যার স্মৃতিগুলোকে ভুলতে পারলে হয়তো তার জীবনটা একটা জায়গায় আটতে থাকতো না। হয়তো আরাফাতের সামনে নিজেকে মেলে দিতে চৌদ্দবার চিন্তা করতে হতো না তার। তার আর আরফাতের মাঝে হয়তো অদৃশ্য দেয়ালটা থাকতো না। কানের কাছে ফোনটি ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ন্তী। ফোনের অপরপাশের লোকটি শুধু “হ্যালো” “হ্যালো” করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রিয়ন্তীর মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। আরাফাত ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে। প্রিয়ন্তীর মুখ যেনো পাথরের ন্যায় হয়ে আছে। একবার চেয়েছিলো তার কাছে যেতে; কিন্তু পরমূহুর্তে ভাবলো প্রিয়ন্তী যদি তার অতীতের সাথে এই মূহুর্তে মুখোমুখি না হয় তবে সারাটা জীবন এই অতীতের ছায়া থেকে নিজেকে এড়িয়ে চলবে। এটা তো ভুললে চলবে না পৃথিবীটা গোল। মিনিট দুয়েক বাদে নিজেকে সামলে নিলো প্রিয়ন্তী। অপরপাশের মানুষটি কোনো রেসপন্স না পেয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে গেলো। এর পর ধীর কন্ঠে বললো,
– আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করো। তাই হয়তো কথাটাও বলতে চাও না। বলো না, তবে ফোনটা কেটো না প্রিয়ু। দুই মিনিট দাও আমি ফোন নিজে রেখে দিচ্ছি। তুমি হয়তো ভাবছো আমি তোমার নাম্বার কিভাবে পেয়েছি! কিংবা আমি তোমার কাছে কেনো ফোন করেছি। প্রিয়ু আমি কিছুই চাই না। শুধু চাই তোমার সাথে শেষবারের মতো একটু দেখা করতে। শেষ বার। কথা দিচ্ছি এর পর আমার ছায়াও তুমি পাবে না। অনেক কষ্টে তোমার নাম্বারটা পেয়েছি। প্লিজ একটা বার। আমি আগামী পরশু মিরপুর এক এর ক্যাফেতে তোমার অপেক্ষা করবো। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। তুমি যদি মনে করো আমার মতো জানোয়ারের সাথে দেখা করা যায় তবে প্লিজ এসো। আমি অপেক্ষা করবো। রাখছি।
বলেই খট করে ফোনটা কেটে গেলো। প্রিয়ন্তী এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথাটা যেনো কাজ করছে না। সে নিজের মাঝে নেই। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ কানে এলো,
– কে ফোন করেছিলো
আরাফাতের কন্ঠে স্বম্বিত ফিরে প্রিয়ন্তীর। আরাফাত তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফাতের চাহনী দেখে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না প্রিয়ন্তী। মিথ্যে বলার অভ্যেসটা আয়ত্তে নেই তার। আবার ইরফানের কথাটা বলতেও বেশ ইতস্ততবোধ হচ্ছে। আমতা আমতা করে বললো,
– আ….আসলে
– আমি কি বাঘ? নাকি সিংহ
– হ্যা?
– বলি আমি কি মানুষ নই?
– কিসের মধ্যে কি?
– পানতা ভাতে ঘি। বলি একটা নরমাল কথা বলতে এতো ভয় হয় কেনো আপনার? আমার আপনার অতীতে কোনো যায় আসে না। অতীত সবার থাকে, কোনো অতীত বেদনাময়, কোনো অতীত সুখময়। তাই বলে সেই অতীতের জন্য বর্তমানে গুমড়ে থাকতে হবে এমনটা তো কোনো নেই। আমি চাই আপনি যেনো মন খুলে আমাকে সব বলতে পারেন। আমি আপনাকে সেই স্পেসটা সবসময় দিয়েছি। তবে কেনো আমার সামনে নিজেকে তুলে ধরতে এতো ভয় আপনার? আমি কি মানুষটা আপনার বিশ্বাসের অযোগ্য?
আরাফাতের কথাগুলো চুপ করে শুনলো প্রিয়ন্তী। আরাফাতের প্রতিটি কথা যেনো প্রিয়ন্তীর মনের ভেতরে বদ্ধ দরজাটা ভাঙ্গতে শুরু করে। একটা লোকের কথায় এতোটা মায়া কি করে থাকতে পারে! মনের মাঝের দ্বিধাদ্বন্দের গিটগুলো যেনো একটা একটা করে খুলছে। মনের জমায়েত কালো মেঘের আস্তরণ যেনো সরছে। অনেক সাহস করে বলে,
– ইরফান ফোন দিয়েছিলো।
– কি বললো সে?
– বললো, দেখা করতে
– তবে করুন
– জ্বী?
– বললাম দেখা করুন, দেখুন তেতো ওষুধের উপর কিন্তু কার্যকরী ওষুধ হয় না। ঠিক তেমন, এই কালো অতীতের সম্মুখীন যতদিন না আপনি হবেন ততদিন এই অতীতের থেকে মুক্তি পাওয়াটা সম্ভব নয়। কতদিন এভাবে এড়িয়ে চলবেন? দেখা করুন, প্রশ্ন করুন, জানুন কি বলার আছে তার। এমন হতেই পারে তার কথাগুলো শুনে আপনার মনের ঝট খুলে গেলো। শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারলেন। পিছুটানের সুক্ষ্ণ দড়িটা ছিড়ে গেলো।
– আর যদি না ছিড়ে, যদি আমি তার প্রতি পুনরায় দূর্বল হয়ে যাই। মানুষের মন তো গলতে সময় লাগে না।
– আমি বেধে রাখবো না। ভালোবাসা বেধে রাখার জিনিস নয়। যদি এটা আমার হয় তবে আমার কাছে ফিরবেই। আর যদি না ফিরে তবে সে আমার নয়।
কথাটা শুনতেই একটা শূন্যতা ছেয়ে যায় প্রিয়ন্তীর মনে। কেনো যেনো অজান্তেই আর্তনাদ করতে থাকে এই মন। তবে কি মন চাইছে যাতে আরাফাত তাকে আটকে রাখে। সে কি তবে আরাফাত নামক জালে বাধা পড়েছে! কে জানে!
_____________________________________________________________________________________________
রাফিজা বেগমকে দেখতে এসেছেন তার বড় বোন রেহানা বেগম। মহিলার একটু বাই পোলার ডিসওর্ডার রয়েছে। কোনো এক অজানা কারণে তার প্রিয়ন্তীকে বিস্তর অপছন্দ। সুন্দর মতো চা খাওয়িয়ে বাহিরে গেলো প্রিয়ন্তী তাতেও তার আপত্তি। রাফিজা বেগম চুপ করে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন। আরশাদ, আরাফাত কাজে গেছে। রেহানা বেগম আসাতে প্রিয়ন্তী একটু বাহিরে যাবার কথা বলেছে। এছাড়া একটা কাজের মেয়ে ঠিক করেছে প্রিয়ন্তী দুদিন হলো। বয়স আঠারোর কম, নাম শেফালী। সে ২৪ ঘন্টা রাফিজা বেগমের সাথে থাকে। চায়ের কাপের চুমুক দিতে দিতে রেহানা বেগম বললেন,
– তোর বড় বউটা হয়েছে আস্ত বেয়াদব। বুঝলি?
– কেনো আপা?
– কেনো আবার? আমি এসেছি আর অমনি চলে গেলো বাইরে। জিজ্ঞেস করলো ও না আমি কি খাবো না খাবো?
– নাস্তা বানিয়ে দিয়েই তো গেলো!
– তো? থাকবে না সে? তোকে একা রেখে চলে গেলো? কিসের দুনিয়া উদ্ধারে গেছে রে সে?
উনার কথায় বেশ বিরক্ত হলেন রাফিজা বেগম। মেয়েটি সারাদিন করে। আজ একটু ডিউটি থেকে ছুটি নিয়েছে। হয়তো পড়ে গেছে কোনো কাজ, কেনো তার সব কিছু ফেলে তার কাছেই বসে থাকতে হবে? তার কি নিজস্ব জীবন নেই নাকি। বিরক্তির স্বরে বলে উঠলেন,
– আপা, তুমি কি আমাকে দেখতে এসেছো নাকি আমার বউমার খুত ধরতে এসেছো? বাহিরে আজ ওর এমনিও যাবার কথা ছিলো। তাও তো তোমার নাস্তার ব্যবস্থা করেই গেছে। তাতেও তোমার সমস্যা। আর শেফালী তো আছেই আমার সাথে। তুমিও আছো। আমার যদি কোনো প্রয়োজন হয় তুমি সাহায্য করতে পারবে না?
– বাহ বাহ বউ এর ওকালতি করছিস নাকি? অই ডিভোর্সী বুড়ো মেয়েকে দেখি তোর মনে ধরেছে।
– এখানে মনে ধরার কি আছে আপা? একটা মেয়ের কোনো দোষ না থাকার পরও তার দোষ ধরা টা আমার অন্তত স্বভাবে নেই। বলি স্বভাবটা পাল্টাও নয়তো এখন তো বউ মা মাসে একবার দেখা দেয়। পরে সেটাও হবে না।
– হাহ! বেশি বকিস না। তা তোর বউ মা কোনো খবর টবর দিলো?
– কিসের খবর?
– এই বাচ্চা টাচ্চা?
– পাগল তুমি আপা? মাত্র বাইশ দিন হলো বিয়ের। এখন কিসের খবর? আর আমার ছেলের তো বয়স কম নাকি?
– তাতে কি মেয়ের বয়স তো বেশি!
– ওদেরটা ওরা বুঝে বেড়াক। সময় হলে ইনশাআল্লাহ সব হবে। একটা জীবন তো আর ওদের হাতে না, আল্লাহর হাতে। উনি দিলেই হবে। ওরা চেষ্টা করতে পারে। এই যা। আর মাত্র তো বিয়ে হলো নাকি! এই তুমি বাড়ি যাও তো। আমার বিরক্ত লাগছে। তোমার আছে যত ফাও কথা। আমি বেঁচে আছি এটা দেখো। আমার বউ মাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।
বিরক্তিভরা কন্ঠে কথাগুলো বললেন রাফিজা বেগম। রাফিজা বেগমের কথা শুনে বেশ চটে গেলেন রেহানা বেগম। এক মূহুর্ত দেরি না করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। হিনহিনে কন্ঠে শেফালীকে বললেন,
– এই দরজা দে। আমি যাচ্ছি।
রেহানা বেগমের যাবার পর শেফালী হাসতে হাসতে বললো,
– খালাম্মা এক্কেরে উচিত কথা শুনায়া দেছেন। আর বড় খালাম্মা এই মুখো হইবো না।
রেহানা বেগম ম্লান হাসি হাসলেন। মনে মনে কিছু একটা ঠিক করলেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা_____________
বিকেল ৬টা,
সূর্য সম্পূর্ণ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আকাশটা লাল হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। দমকা হাওয়া বইছে, হয়তো কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। চৈত্রের শেষের সপ্তাহ। গরমের মাত্রা অত্যধিক। সারাদিন হাফছাড়া গরমের পর এখন বাতাস ছেড়েছে। কালবৈশাখী নামক ঝড়টা প্রবল না হলেও কিছুটা দেখা যায় ঢাকা শহরে। আজ হয়তো রাতে ঝড় হবে। ক্যাফের এক কোনে বসে আছে ইরফান। অপেক্ষা প্রিয়ন্তীর আগমনে। একটু পর মাগরিবের আযান দিবে। এখনো প্রিয়ন্তী আসে নি। হয়তো আসবে ও না। মনটা বসে গেলো ইরফানের। হয়তো কথাগুলো আর বলা হবে না। উদাস মনে উঠে দাঁড়ালো সে। ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে যাবে তখনই সেখানে উপস্থিত হয় প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তীকে দেখে যেনো আশার আলো পায় ইরফান। প্রিয়ন্তী এসে ইরফানের বিপরীতে বসে। তার মুখখানা শক্ত। ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
– আমার সময় নেই, ঠিক আধা ঘন্টা। যা বলার ভনিতা বাদেই বলে ফেলুন।
প্রিয়ন্তীর কথার ধরণ অনেকটাই আলাদা। চার বছর আগের প্রিয়ন্তী আর আজকের প্রিয়ন্তীতে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। ঠোঁটের কোনায় ম্লান হাসি একে ইরফান বলে,
– আজ রাতে ইন্ডিয়ার জন্য রওনা দিচ্ছি। তাই তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। দেশে ফেরা হবে কি না জানা নেই।
– মানে?
– সামিহার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো একমাসের বেশি তাকে বাঁচানো যাবে না……………..
চলবে
[আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ টার্গেট পূরণ করে দেবার জন্য। যেখানে গল্পের ৫০০+ লাইক টেনে টুনে আসতো সেখানে ৬৭০+ এটা যেনো অকল্পনীয় ব্যাপার। তবে একটা জিনিস বেশ ভালো ভাবে বুঝলাম। আমার পাঠক-পাঠিকাদের মাঝে এমন অনেকেই আছে যারা গল্পটা পড়েন কিংবা পড়ার জন্য আমার পেজে আসেন। কিন্তু কমেন্ট কিংবা রিয়েক্ট করেন না। আমার একটা অনুরোধ এটা করবেন না।স্বীকার না করলেও এই লাইকের সংখ্যাটা দেখলে লেখার ইচ্ছেটা যেনো দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই তো এতো ঝামেলার মাঝেও আজ ডাবল পর্ব দিচ্ছি। পরবর্তী পর্ব রাতে ইনশাল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি