আলো আঁধারের লুকোচুরি পর্ব -১২

#আলো_আঁধারের_লুকোচুরি
#Part_12
#Writer_NOVA

বারান্দায় উদাস হয়ে বসে আছে পলাশ হায়দার। পাশে এসে দাঁড়ালেন মিশি বেগম। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়েও তার অন্যমনস্ক ভাব কমলো না। মিশি বেগমের বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে গেলো। নিজেকে শান্ত করে স্বামীর কাঁধে হাত রেখে বললেন,

‘তুমি এতো চিন্তা কেন করছো বলো তো? শুধু শুধু নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি ছাড়া কি আর কিছু হচ্ছে? তোমার মেয়ে ঠিক আছে।’

ঘোলাটে চোখে তাকালেন পলাশ হায়দার। স্ত্রীর মনভুলানো কথা তার মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারিনি। স্ত্রীর হাতের ওপর হাত রেখে মৃদুস্বরে বললো,

‘প্রতিদিন মৃত্যুর সাথে খেলা করে। আমার ভীষণ ভয় করে মিশি। মনে হয় এই বুঝি মেয়েটার মৃত্যুর খবর পেলাম। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে জেগে উঠি। আগে তাও মাস অন্তর বাড়িতে আসতো। কিছু দিন বেড়াতো। এখন তাও হয় না।’

‘তুমি নিজেই ওকে আইন নিয়ে পড়তে বললে। ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। এখন ভয় পেলে কি চলবে?’

‘আমি এইক্ষেত্রে বিরাট ভুল করেছি। মেয়েটাকে জেনেশুনে এই চাকরিতে যোগ দিতে দেওয়া ঠিক হয়নি।’

‘তুমি একটু ঠান্ডা হও। হয়তো ওর চাকরি ক্ষেত্রে থেকে ওকে কোন অপারেশনে পাঠানো হয়েছে।’

পলাশ হায়দারের মাঝে উদাস ভঙ্গিটা আবার ফিরে এলো। সামনের ধূ ধূ মাঠের দিকে তাকিয়ে তার মনে হতাশার করুন সুর বেজে উঠলো। স্ত্রীকে বিষয়টা জানাবে না ভেবেছিলো। কিন্তু আর লুকিয়ে রেখে লাভ নেই। তাই কাটা কাটা সুরে বললো,

‘তোমার মেয়ে মাস খানিক আগে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছে।’

‘কি বলছো?’

মিশি বেগম চমকে উঠলেন। বিস্মিত নয়নে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজের কানে শোনা কথাকে সে বিশ্বাস করতে রাজী নন। পলাশ হায়দার চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করায় সে মুষড়ে পরলো। পলাশ হায়দার নীরবে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। তখনও মিশি বেগম বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে। পলাশ হায়দার ভীরু পায়ে মেয়ের রুমে ঢুকলেন। মেয়ের এটা সেটা ছুঁয়ে দেখছিলেন। ল্যাম্প শেটের সাথে থাকা ছোট ফ্রেমের ছবিটা হাতে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। ছবির দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন,

‘রুহানি মা আমার! কোথায় তুই?’

মেয়েকে কবর দেওয়ার পর থেকে শুভা খানকে কিছু খাওয়ানোই যাচ্ছে না। সারাদিন শুধু কান্না করেন। রুম থেকে বের হোন না। ঠিকমতো গোসল, রান্না কিছুই করেন না। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে মুষড়ে পরেছেন। রায়হান খানের হয়েছে যত জ্বালা। মেয়ে হারিয়েছেন এখন স্ত্রীও হারিয়ে যাওয়ার বন্দবস্ত করছে। মাঝে সে পরে গেছেন মাইনকা চিপায়। বুকের ভেতরটা চিনচিন করে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। দু চোখের পাতা উল্টে আসে। তবুও সে কাঁদতে পারেন না। সে কাঁদলে স্ত্রীকে সামলাবে কে?

‘ফ্লোরার মা, একটু খেয়ে নাও। এভাবে নিজের ক্ষতি করলে কি হবে? তুমি কাঁদলে মেয়ে ফিরে আসবে? যদি ফিরে আসতো তাহলে দুজনে মিলে গলাগলি ধরে কাঁদতাম।’

খাটের ওপর খাবারের প্লেট রাখতে রাখতে বললেন রায়হান খান। শুভা খান তখনও একঘেয়ে সুরে বালিশের ওপর আছড়ে পরে কেঁদে যাচ্ছেন।

বিয়ের তিন বছর পর মেয়েটা হয়েছিলো। প্রথম প্রথম সে যখন কনসিভ করতে পারছিলেন না তখন শাশুড়ী তো বলেই দিয়েছিলেন তার স্বামীকে আরেকটা বিয়ে করাবেন। সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। রায়হান খান অবশ্য তার পাশে ছিলেন। ডাক্তার, কবিরাজ কোন কিছু বাদ রাখেননি। কত তাহাজ্জুদের নামাজ পরে মোনাজাতে কেঁদেছেন। বান্দার কান্না আল্লাহ সহয করতে পারেন না। তাই তার ঘরে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান দান করলেন। আল্লাহ যখন তার বান্দার ওপর খুশি হোন তখন কন্যা সন্তান দান করেন। এতো সুন্দরী মেয়ে খান বংশে একটাও ছিলো না। দুধে আলতা গায়ের রং, হরিণ টানা চোখ, সরু পাতলা ঠোঁটে রিনরিনে হাসি যে কোন পুরুষের মনে কামুকতার ঝড় তুলতে প্রস্তুত।

একমাত্র মেয়েকে অনেক যত্ন, আদরে লালনপালন করেছে খান দম্পতি। অনেক সাধনার ফল। মেয়েকে বাহিরের কলুষিত দুনিয়া থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর মেয়ে জিদ করলো লন্ডনে পড়াশোনা করবে। খান দম্পতি কিছুতেই রাজী নন। তাদের মেয়ে আরো বেশি জেদী। সে লন্ডনেই পড়াশোনা করবে৷ খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে নিজেকে রুমে বন্দী করে ফেললো। যতক্ষণ পর্যন্ত তার বাবা-মা রাজী না হচ্ছে ততক্ষণ অব্দি সে এক ফোঁটা পানিও মুখে দিবে না। একদিন গেলো, দুই দিন গেলো। তিনদিনের দিন বাবা-মা সহ্য করতে না পেরে অনুমতি দিয়ে দিলেন। জেদী ফ্লোরা খুশিতে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরেছিলো।কিন্তু কে জানতো তার এই জেদ তাকে নিঃশেষ করে দিবে। মাঝে মধ্যে রায়হান খান ভাবেন মেয়েকে লন্ডনে যেতে দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন। যেতে না দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। মেয়েটা তো বেঁচে থাকতো।

চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কতশত পরিমাণ ভারী তা অন্য কেউ জানবে না। ভেতরেটা তার কুঁকড়ে যাচ্ছে তবুও সে স্বাভাবিক। সে যে বাবা, তার তো চিৎকার করে কাঁদার অধিকার নেই। চোখ মুছে স্ত্রীর পিঠে হাত রেখে বললো,

‘আমি না আমাদের আরেক মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। অনেকটা আমাদের ফ্লোরার মতো দেখতে। তুমি চাইলে আমি ওর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারি।’

কথাটা মিরাকেলের মতো কাজ করলো। বিস্ময় নিয়ে শুভা খান উঠে বসলো। ফোলা চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

‘তুমি সত্যি বলছো? মেয়েটা অনেকটা আমাদের ফ্লোরার মতো?’

‘হ্যাঁ!’

‘তুমি ওর সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিবে?’

বাচ্চাদের মতো অনুনয় করলেন শুভা খান। রায়হান খান হাত ধুয়ে ভাতের প্লেট হাতে নিলেন। তরকারি মেখে স্ত্রীর মুখে এক লোকমা তুলে দিতে দিতে বললেন,

‘অবশ্যই দিবো। তবে এর জন্য তোমাকে আগে পুরো প্লেটের খাবার খেতে হবে।’

সারা রুম জুড়ে পায়চারি করছে সে। চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আজ আট দিন হতে চললো রুহানি ইয়াসফির বাসায় গেছে। সেখান থেকে প্রথম পাঁচ দিন নিয়মিত আপডেট এলেও গত তিনদিন ধরে কোন খবর আসছে না। ইয়াসফি ভীষণ ধূর্ত। রুহানি ধরা পরে গেলে ওকে আস্ত রাখবে না।

মাসুম পা চালিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। ভেতরে ঢুকে দেখলো সে অস্থির চিত্তে সারা রুমে পায়চারি করছে। কার্ণিশে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। তার এই একটা দোষ। কোন উত্তর না পেলে মাথা ভীষণ চুলকায়।

‘রুহের খবর পেলে?’

‘না, ভাই।’

‘মেয়েটার কি কোন বিপদ হলো? কোন খবর না পেলে আমরা যে এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো না তা কি ও জানে না?’

তার কন্ঠস্বর হালকা ঝাঁঝালো শুনালো। মাসুম বিব্রত বোধ করলো৷ সে কি উত্তর দিবে? সে নিজেই যেখানে কিছু জানে না।

‘ভাই, একবার কি ঐ বাসায় যাবেন?’

সে চোখ তুলে তাকালো। ঠান্ডা দৃষ্টি। তবে গা কাঁপিয়ে দেয়। কি তেজ, কি উত্তাপ সেই চাহনির। বেশি সময় তাকিয়ে থাকার জো নেই। মাসুম চোখ নামিয়ে ফেললো। সে আরো কিছু সময় এদিক সেদিক পায়চারি করলো। হঠাৎ পায়চারি থামিয়ে গমগমে গলায় বললো,

‘আগামীকাল রাতে একবার ঢুঁ মারতে যাবো৷ তৈরি থেকো। আমি চুপচাপ বসে থাকতে পারবো না। সবার আগে আমার কাছে রুহ ইম্পরট্যান্ট।’

এখন খাবার-দাবার নিয়ে ওমরকে কোন চিন্তা করতে হয় না। যা করার রুবি নামের মেয়েটা করে। ওমর এতে হাফ ছেড়ে বেচেছে। মেয়েদের মতো রান্না নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগে না। মেয়েটা বেশ চটপটে। সব কাজ আগ্রহ নিয়ে করে। বলার সাথে সাথে সব হাজির। ইয়াসফিও মনে মনে খুশি। আগ্রহ নিয়ে নির্ভূল কাজ করলে কে না পছন্দ করবে! তবে একটা সমস্যা। আঞ্চলিক ভাষায় টেনে টেনে কথা বলে। যদিও তাকে বেশ কয়েকবার কড়া করে নিষেধ করা হয়েছে এভাবে কথা না বলতে। সে মানতে নারাজ। সে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবে। তাই ইয়াসফি, ওমর দুজনেই হাল ছেড়ে দিয়েছে।

‘টেবিলে খাওন দিছি। মন্ত্রী সাব রে ডাইকা আনেন।’

ওমরের ঘোর ভাঙলো রুবির কথায়। মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি লজ্জা পায় সে। ওমর বিষয়টা বেশ উপভোগ করে। মনে মনে তো এমন একটা বউয়ের কল্পনা করে সে। যে সবসময়েই লাজুক মুখ নিয়ে তার আশেপাশে ঘুরে বেড়াবে। মেয়েটাকে ওমরের মনে ধরেছে প্রথম দিন দেখার পর থেকে। কি সুন্দর চাহনী! বুকের ভেতরটাকে ঝড় তুলে দেয়। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে একদমে কথা বলার ভঙ্গি দারুণ। দীঘল কালো চুলগুলো নজরকাড়া। মাঝে মধ্যে লাজ শরম ভুলে ওমর তাকিয়ে থাকে। রুবি চোখের সামনে তুড়ি বাজালে তার ঘোর ভাঙে। এই যে এখন যেমন লাজলজ্জা ভুলে এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। রুবি চোখের সামনে হাত নাড়াতেই তার ধ্যান ভাঙলো। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো ওমর।

‘এমতে চাইয়া কি দেখেন?’

ইতস্তত করে বললো,
‘কি কিছু না। তুমি টেবিলে খাবার দাও। আমি ইয়াসফি ভাইকে ডেকে আনি।’

ওমর এক প্রকার পালিয়ে গেলো সেখান থেকে। রুবি ওরফে রুহানি কিট কিটিয়ে হেসে উঠলো। মুখটা পানসে করে বিরবির করে বললো,

‘শালা!’

এরপর লম্বা চুলগুলো খোঁপা করতে করতে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো।

রাতে খাবারের সময় কেউ তেমন কথা বললো না। ইয়াসফি ওমরের সাথে নিচুস্বরে দু-চারটা রাজনৈতিক আলাপ করলো। তারপর সব চুপচাপ। রুবি ওরফে রুহানি এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে, নিজে খেয়ে বাকি খাবার ফ্রীজে রেখে দিলো। সবকিছু গুছিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। অপেক্ষা করতে লাগলো রাত গভীর হওয়ার জন্য। আজ তার একটা ছোট অপারেশন আছে ইয়াসফির রুমে।

গভীর রাত। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। রাতের আঁধার কমে জোস্নার আলো উঁকি ঝুঁকি মারছে। আলো আঁধার লুকোচুরি খেলছে। নিজের ব্যাগ থেকে রিভলভারটা নিয়ে পা টিপে টিপে ইয়াসফির রুমের দিকে এগুচ্ছে রুহানি। চোখে তার সাবধানি দৃষ্টি। নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। বিছানার দিকে রিভলবার তাক করে এগিয়ে গেলো। একি! বিছানা খালি কেনো? তখুনি রুমের আলো জ্বলে উঠলো। রুহানির মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে ইয়াসফি বলে উঠলো,

‘কি খবর মিসেস মাহবুব?’

রুহানি পাল্টা নিজের হাতের রিভলবার ইয়াসফির দিকে তাক করে উত্তর দিলো,

‘আমার খবর তো ভালো, আপনার কি খবর মিস্টার মাহ…..

#চলবে

যত ঝামেলা এই মাহ.. তে। তাই ধামাকা আজকে দিতে পারলাম না। কালকে দিয়ে দিবো💁‍♀️।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here