আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব -২৪+২৫+২৬

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২৪]

নিঝুম রাত্রির প্রহর। রাস্তাঘাট নিস্থব্ধতায় একাকার। ল্যাম্পপোস্টের কৃতিম আলোর নিচে বসে কর্কষ কন্ঠে ডাকছে কুকুর। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক চারপাশ থেকে ভেসে আসছে। খাবারের পর প্রত্যেক সদস্য ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে কেবল। দীবা বারান্দার দরজার কাছাকাছি ফ্লোরে বসে মেঘে ঢাকা আকাশকে দেখছে। চাঁদটা স্পষ্ট ভাস্যমান। সে ভাবছে আবরারকে নিয়ে। সম্প্রতি আবরারের এমন ব্যবহার তাকে ভাবাচ্ছে। আসলেই কি আবরার এই বিয়ে মন থেকে মেনে নিয়েছে? দীবাকে অন্যান্য বিবাহিত মেয়েদের মতো স্ত্রীর মর্যাদা দিবে? নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। সকালে আবরার বলেছিলো রাতে আবার আসবে সেই ভয়ে দীবা খাবার খাওয়ার পর থেকেই দরজা লাগিয়ে বসে আছে। সে দরজা খুলবে না! কিছুতেই না।
.
আবরার রিমির রুমে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে বুকে দুই হাত গুঁজে বসে আছে। রিমি ভাব নিয়ে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চুল আচঁড়াচ্ছে ডেসিংটেবিলের সামনে বসে। আবরার বিরক্ত হলো। ধমকে উঠলো, ‘ফা*জিল এতো রাতে সেজে কি করবি তুই?’

রিমি চুল গুলো উঁচিয়ে খোঁপা করলো। হাতে নাইট ক্রিম লাগাতে লাগাতে বললো, ‘এতো তাড়াহুড়ো করো কেন বলো তো ভাই? দাঁড়াও না একটু। মানে বসে থাকো।’

আবরার অধৈর্য হয়ে বললো, ‘তুই আসবি নাকি আমি যাবো?’

রিমি আবরারের দিকে ফিরে তাকালো। তারপর বললো, ‘বিনিময়ে আমি কি পাবো?’

‘ভাই ভাবি এক হবে এতে তুই খুশি না? আর কি লাগবে?’

‘আলবাত আমি খুশি। তবে এটা মনের দিক দিয়ে। আমি তো পেটের কথা বলছি।’

আবরার হেসে ফেললো রিমির কথা শুনে। বললো, ‘কাচ্চি ট্রিট রইলো। হ্যাপি? এবার আয় বোন আমার।’

রিমির হাস্যউজ্জল চেহারায় এগিয়ে আবরারের গা ঘেঁষে বসলো। তারপর ভ্রুঁ নাচিয়ে বললো, ‘ভাই সত্যি তুমি দীবাকে ভালোবাসো? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি অনেক অনেক খুশি।’

আবরার প্রত্যুত্তরে হাসলো। তারপর বললো, ‘কিন্তু দীবার দিক দিয়ে তো কোনো পজিটিভ সাইন পাচ্ছি না। আই থিংক সি ডোন্ট লাইক মি।’

‘ফিকার নট ব্রাদার। দীবাও তোমার প্রতি উইক। একটু সময় নাও দেখবে ভাবি পটে যাবে।’ আবরার হাসলো রিমির কথায়। অতঃপর রিমিকে সাথে নিয়ে দীবার রুমের সামনে আসলো। আবরার রিমিকে চোখে ইশারা দিয়ে দরজার এক পাশে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালো। রিমি দরজা ধাক্কা দিয়ে দীবাকে ডাকতে লাগলো।

‘দীবা ঘুমিয়ে গেছিস?’

কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর দীবা দরজা খুললো। তাকে এখানে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো, ‘তুই? কিছু বলবি?’

দাঁত কেলিয়ে হাসলো রিমি। দীবাকে ঠেলে ভিতরে নিয়ে বিছানায় বসালো। তারপর গাল দুটো টেনে আদুরে কন্ঠে বললো, ‘হ্যাভ আ সুইট ড্রিম বেবি। গুড নাইট।’

দীবা বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রিমি রুম থেকে বেরুলেই আবরার রুমে ঢুকলো। তাকে দেখেই দীবা বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে তাকালো। রিমি বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো। দীবা দরজার কাছে গিয়ে দু’বার ধা ক্কা দিয়ে চেঁ’চা’ল, ‘রিমোটের বাচ্চা! কাজ টা ঠিক করলি না!’

দরজার বাহির থেকে দীবার কন্ঠ শুনে হাসলো রিমি। চলে যাবার জন্য পিছু ফিরে পা বাড়াতেই নিশিতা কে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো। নিশিতা রিমিকে প্রশ্ন করলো, ‘আবরার দীবার রুমে কি করছে?’

রিমি হেসে প্রত্যুত্তর করল,’খুব শীঘ্রই সুখবর আসবে আম্মু। তুমি হবে দাদি ; আমি হবো খালামনি।’

রিমির এমন লাগাম ছাড়া কথা, আর নিজের করা অহেতুক প্রশ্নতে নিজেই বিব্রতবোধ করলো নিশিতা। রিমিকে নিজের রুমে যেতে বললে রিমি হেলেদুলে চলে গেলো। নিশিতা দীবার রুমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রশান্তির হাসি দিলো একটা। সব কিছু ভালোই ভালোই মিটে গেলে ভালো।
_______________

রাত্রির মধ্যভাগ প্রায়। ব্যালকনির দরজা খোলা। শীতল বাতাস ভেসে আসছে বাহির থেকে। হালকা শীতের আমেজ চারপাশে। এমন পরিবেশে রোমান্টিক রোমান্টিক একটা ভাব আসে। কিন্তু আবরার রোমান্টিক হওয়ার বদলে বি’রক্ত হচ্ছে। বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে তী-ক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে দীবার দিকে। আর এইদিকে দীবা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। আফসোস হচ্ছে তার। বড় মাপের আফসোস হচ্ছে কেবলমাত্র রুমে কোনো সোফা নেই বলে। সোফা থাকলে হয়তো সেখানে শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারতো। তার পক্ষে সম্ভব না আবরারের সাথে এক বিছানায় থাকা। লোকটা অনেক অ’সভ্য। ভাবতে ভাবতে ঘুমে মাথা দুলে টেবিলের সাথে বারি খেলো একটা। ধরফড়িয়ে উঠলো দীবা। বি’রক্তি নিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। আবরার নিজের এই বি’রক্তি আর নিতে না পেরে ধ-ম-কে উঠলো, ‘বিছানায় আসছো না কেন? ঘুমাবে না? তাড়াতাড়ি আসো।’

দীবা মুখ কালো করে তাকালো। মিনমিনে গলায় বললো, ‘আপনার সাথে ঘুমানো অসম্ভব।’

‘তাহলে কোথায় ঘুমাবে? মেঝেতে? নাকি টেবিলের উপর? কোথায়?’

চিন্তায় পরে গেল দীবা। ঠোঁট কা’মড়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে বিছানার মাঝে একটা বালিশ রেখে বললো, ‘খবর-দার এই দেয়াল টপকে এই পাশে আসবেন না।’

আবরার দীবার কান্ডে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পরোক্ষনে ত্যাঁছড়া ভাবে বলল, ‘ঠ্যা’কা পরে নাই তো আমার।’

দীবা কটমট চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে টেবিলের ল্যাম্প লাইট অফ ধপাস করে এক পাশে শুয়ে পরলো। আবরার হাসলো মনে মনে। বেশকিছু সময় অতিবাহিত হবার পর আবরার মাঝের বালিশ সরিয়ে দীবাকে পিছন দিক দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। হকচকিয়ে গেলো দীবা। আবরার শুধাল, ‘নিজেকে কেমন প্রবাসী প্রবাসী লাগছিলো। বউ আছে কিন্তু কাছে নাই। এইসব বালিশ টালিশ দিয়ে কাজ হবে না। আমি আমার বউকে ছাড়া থাকছি না।’

আবরারের কথা শুনে দীবা হেসে ফেললো। আবরারও নিঃশব্দে হেসে দীবার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে বললো, ‘তুমি চুলে কি শ্যাম্পু ইউজ করো?’

দীবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন?’

আবরার নেশালো কন্ঠে বললো, ‘তোমার চুলের ঘ্রানে কেমন যেনো প্রেম প্রেম পায়।’

নিশ্চুপ হলো দীবা। লজ্জায় লাল হয়ে এলো গাল দুটো। কোনো প্রকার নড়াচড়া করলো না। প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে শুয়ে রইলো। আবরার দীবার ঘাড়ে আলতো ভাবে একটা চুমু খেলো। জড়িয়ে ধরেই ঘুমানোর প্রয়াস করলো।
________________

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যেস থাকলেও আজ ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হলো। তবুও যেন চোখের ঘুম এখনো শেষ হয় নি। দীবা পিটপিট করে চোখ খুললো। নড়াচড়া করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। ঘুম জড়ানো চোখে খেয়াল করলো আবরার তাকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিজের অতি সন্নিকটে আবরারকে দেখে অনুভূতি গুলো ভালোবাসায় অভিভূত হলো। আনমনে মুচকি হেসে উঠলো দীবা। আবরারের এলোমেলো চুল গুলোতে আঙ্গুল চালিয়ে ঠিক করে দিলো। তারপর আলতো হাতে গাল ধরে টেনে দিলো। আবরার একটু নড়েচড়ে আবারো ঘুমে মশগুল হলো। দীবা মুচকি হাসলো। তখুনি কানে আসলো রোহানার কণ্ঠস্বর। হকচকিয়ে গেলও দীবা। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল সাড়ে আটটা বাজে। আজ শুক্রবার তাই কলেজের প্যা*রা নেই। মাথা উঠিয়ে দরজার দিকে তাকালো। রোহানা অনবরত দরজা ধা-ক্কাচ্ছে আর ডাকছে। দরজা থেকে চোখ ঘুরিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। দীবাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে বিভোর আবরার। দীবা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তাই আবরারকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু আবরার উঠছে না। দীবা অস্থির কন্ঠে ডাকলে আবরার দীবার সাথে আরো নিবিড় হয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘ডিস্টার্ব করো না প্লিজ। ঘুমাতে দাও।’

দীবা আবরারকে নিজেকে থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আপনার ঘুম এক সাইডে রাখেন। রুম থেকে বের হোন তাড়াতাড়ি। আম্মু ডাকছে। উঠেন প্লিজ।’

নিজের আরামদায়ক ঘুমের ব্যাহাত ঘটতেই বিরক্ত হলো আবরার। অপ্রসন্ন মনে অপর পাশ ফিরে শুয়ে বলল, ‘ডাকলে দরজা খুলো গিয়ে।’

দীবা শুয়া থেকে উঠে বসলো। আবরারের বাহু টেনে নিজের দিকে ফিরালো। তারপর বলল, ‘দরজা খুলবো মানে? আম্মু আপনাকে এখানে দেখে ফেললে কি ভাববে বলুন তো।’

ঘুমের কারণে আবরারের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো। দীবার কথায় সে ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিল, ‘তাতে আমার কি? ভাবা-ভাবির কিছু নাই। জামাই তার বউয়ের রুমে ঘুমাচ্ছে। ব্যাপার না। তুমিও ঘুমাও। আসো একসাথে ঘুমাই।’

দীবা আবরারের বাহুতে একটা ঘু*ষি বসিয়ে দিলো। যদিও আবরারের দেহে এই ব্যাথার পরিমান একদম তুচ্ছ। দীবা তার হাত ধরে টেনে শুয়া থেকে তুললো। বিছানা থেকে নামারে চাইলে অজ্ঞাত আবরার বাধ্য হয়ে নামলো। দীবা উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, ‘তাড়াতাড়ি বের হোন রুম থেকে।’

আবরার দরজা দেখিয়ে বলল, ‘এই দিক দিয়ে যাবো? আচ্ছা যাচ্ছি।’ বলেই দরজার দিকে যেতে নিলে দীবা বাহু ধরে আবারো আ’ট’কে ফেললো। আবরারকে বা’ধা দিয়ে উদ্বেগজনক হয়ে বলল, ‘দরজা দিয়ে যাওয়া যাবে না। আপনি! আপনি রুমেই লুকিয়ে পরেন। তাড়াতাড়ি করেন প্লিজ।’

আবরার ভ্রুঁ কুঁচকে বলল, ‘এতো হাইপার হচ্ছো কেন বলো তো? আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ। এক ঘরে থাকতেই পারি। এখানে কারোর কোনো সমস্যা হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না।’

দীবা একটু রাগি গলায় বলল, ‘সমস্যা আপনার না হলেও আমার হবে। আমি আপনার মতো নির্লজ্জ না।’

রোহানা বাহির থেকে দরজা ধাক্কা দিয়ে আবারো ডাকলো, ‘কিরে দীবা? এখনো ঘুম ভাঙ্গে নি তোর? শরির খারাপ? দরজা খোল।’

দীবা আবরারের দিকে করুণ চোখে তাকালো। আবরার তার এমন চাহনীর কারণ বুঝলো। তাই সুযোগ বুঝে কো’প মা’র’লো। বলল, ‘ঠিক আছে লুকাচ্ছি। কাঁদতে হবে না। কিন্তু তার আগে একটা কিস দাও গালে।’

কথাটা বলে দুই হাত পিছনে নিয়ে দীবার দিকে ঝুকে দাঁড়ালো আবরার। বিব্রতবোধ করলো দীবা। চোখমুখ কুঁচকে নাকচ করে বলে উঠলো, ‘ইম্পসিবল! আপনি ওয়াশরুমে যান।’

আবরার তার কথায় অনড় রইলো,’কিস না দিলে যাবো না।’

বাহিরে রোহানার ডাকাডাকি ; আর এই দিকে আবরারের এমন আকুতি। হতাশ হলো দীবা। অতঃপর বাধ্য হয়ে আবরারের গালে আলতো ভাবে ছোট করে একটা কিস দিলো। কিন্তু এতে পুষলো না আবরারের। তাই বললো, ‘তুমি দেখতে যেমন পিচ্চি। কিসটা দিলেও তেমন পিচ্চি। আরেকটু বড়োসড়ো করে কিস দাও তো। যেন ফিল নিতে পারি। হারি আপ।’

দীবা নিরবে দাঁতে দাঁত পিষলো। মায়ের ডাক আর সহ্য হলো না তার। এই বুঝি দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পরবে। তাই আবরারের কথা অনুযায়ী বড়োসড়ো কিস দেবার জন্য তার দিকে এগিয়ে গেলো। আবরার দীবার দিকে ঝুকে আসতেই দীবা তার এক গালে এক হাত রেখে, অপর গালে প্রগাঢ়ভাবে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে চুমু দিল একটা। আবরার ঠোঁট বিস্তৃতি করে হাসি দিলো। চুমু দেওয়া শেষে আবরারের ফরসা গালের নরম মাংসপিণ্ডে জোরে একটা কা’মড় বসিয়ে দিলো দীবা। আবরার ব্যাথা পেলেও শব্দ করলো না। এক হাত গালে রেখে ভ্রুঁ কুঁচকে দীবার দিকে তাকালো। দীবা শ’য়’তানি হাসি দিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। তখুনি দীবার ঘাড়ের পিছনে হাত রেখে দীবাকে কাছে টেনে উষ্ঠধয়ে চুমু খেয়ে নিলো আবরার! ঘটনা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে দীবা টেরও পেলো না। চোখ বড় বড় করে আবরারের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবরার বাঁকা হেসে দীবার ঠোঁটে তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে বলল, ‘এটা ভালো ছিলো।’

দীবার টাওয়াল টা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দীবা আহাম্মকের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হলো টা কি? ভাবতেই দরজায় আবারো ধা*ক্কা পরলো। চমকে উঠলো দীবা। দরজার কাছে এসে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। এক হাতে চুল গুলো ঠিক করে দরজা খুলতেই রোহানা ক’র্ক’ষ কন্ঠে বলে উঠলো, ‘এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে? কি করছিলি রুমে?’

দীবা কিছুটা ইতস্তত করে বলল, ‘ওয়াশরুমে ছিলাম। কেন?’

‘কেন মানে? কয়টা বাজে দেখেছিস? এখনো রুম থেকে বের হলি না। শরির ঠিক আছে তোর?’

‘আম্মু আজ শুক্রবার। কলেজ নেই তাই ঘুমিয়েছিলাম। কাল রাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছে।’

দীবার অস্বস্তিদায়ক চেহারা দেখে রোহানার সন্দেহ হলো। মাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পরা মেয়েটা দরজা খুলে দুই হাতে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। রোহানা বুঝেছে যেন সে ভিতরে যেতে না পারে তাই এভাবে দাঁড়ানো। সন্দিহান দৃষ্টি রেখেই বললো, ‘তোর কলেজ ড্রেসটা দে। ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিবো।’

কলেজ ড্রেস তো ওয়ায়াশরুমের ঝুড়িতে। আবরারও সেখানে। তাহলে কিভাবে আনবে? দীবা ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোহানা আবারো বলল, ‘তাড়াতাড়ি দে! কাজ আছে আমার।’

‘ওয়েট’ বলে দীবা রুমের ভিতরে গেলো। বারবার পিছু ফিরে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে গেলে দেখলো আবরার ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে রেখেছে। দীবা এবার পরলো বিপাকে। ভয়ার্ত চোখে পিছু ফিরে মায়ের দিকে একবার তাকালো। যদিও দরজার বাহির থেকে ওয়াশরুম অব্ধি দৃষ্টি যায় না। তবুও দীবা ভয়ে আছে। যদি একবার টের পায় তাহলে কি হবে? ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। তারপর মৃদু শব্দে দরজা ধা’ক্কা দিলো। কয়েকবার ধা’ক্কা দেবার পর আবরার দরজা খুলে দিলে দীবা তড়িঘড়ি করে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগালো। জোরে জোরে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে দেখলো আবরার ভিজে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এমন অবস্থায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো দীবা। তাৎক্ষনাৎ ঘুরে দাঁড়ালো। বিরক্তিতে এক হাতে কপাল চা’প’ড়ালো। বলল, ‘আপনার কি এখানেই গোসল করা লাগছে? নিজের ওয়াশরুমে গিয়েও তো করতে পারতেন।’

আবরার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে শুধাল, ‘আমি যেখানে খুশি সেখানে শাওয়াল নিবো। তাতে তোমার কি?’

দীবা চরম হতাশ হয়ে ‘উফফ’ বলে নিশ্বাস ছুড়লো। লম্বা দম নিয়ে নিজেকে সামলে ঝুড়ির দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আবরার পিছন থেকে নিঃশব্দে তাকে জড়িয়ে ধরলো। হকচকিয়ে গেলো দীবা। চোখ বড়বড় হয়ে গেলো তার। আবরার জড়িয়ে ধরে কোমলায়ন কন্ঠে বলল, ‘তুমি অনেক কিউট দীবা। তোমাকে দেখলেই আ’দর করতে ইচ্ছে করে।’

চলমান….#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২৫]

আবরারের এমন কথা শুনে লজ্জাভূতি হলো দীবা। কুনই দিয়ে আবরারের পেটে আ’ঘা’ত করলো। ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো আবরার। দীবা নিজেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘অ’সভ্য লোক।’

অল্প শব্দে হাসলো আবরার। দীবা ঝুড়ি থেকে কলেজ ড্রেস নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হলো ওয়াশরুম থেকে।

দীবার উপর বিরক্ত হলো নিশিতা। এতোক্ষণ লাগে কাপড় নিয়ে আসতে। দীবাকে ডাকতে রুমের ভিতরে তাকাতেই বিছানার উপর আবরারের শার্ট নজরে আসলো তার। এই শার্টটাই আবরার গতকাল পরেছিল। এটা দীবার রুমে এলো কিভাবে? কারণটা বুঝার জন্য খুব বেশি সময় লাগে নি তার। দীবার এই অস্বস্তির কারণ খুব সহজেই ধরে ফেলল। নিজেরই লজ্জা লাগলো হঠাৎ এমন আগমনে। দীবা দরজার কাছে আসতে রোহানা মৌনতার সঙ্গে ড্রেস নিয়ে চলে গেলো। কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। দীবা চটজলদি দরজা লাগিয়ে ফুঁশ করে একটা নিশ্বাস ফেললো। এবার যেন সে হাঁফ ছেঁড়ে বেঁচেছে। স্বস্তির সাথে বিছানায় বসে আবরারের অপেক্ষা করতে লাগলো।

আষাঢ়মাসের আবহাওয়া সম্পর্কে আন্তাজ করা অড্ড মুশকিল। কিছুসময় পূর্বেও অম্বর ছিলো স্বচ্ছ নীল। আর কিছুসময়ের মাঝেই ঘোলাটে হলো আকাশ। প্রভঞ্জনে ভারী হলো চারপাশ। দীবা বারান্দার দরজা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিলো। অন্তরিক্ষের হঠাৎ বিবর্ণ অবস্থা দেখে কপাল কুঁচকালো। আবরারের সাথে তুলনা করে নিলো তাৎক্ষনাৎ। ঠিক তিন মাস আগেও আবরার ছিলো বড্ড জেদি, একরোখা! আর তিন মাস পরেই লোকটা মাঝে প্রকাশ পেল কোমলায়ন! প্রকাশ পেলো দীবার প্রতি তার ভালোবাসা। বুঝলো বিয়ের গুরুত্ব। আকাশ টাও এমন। একটু আগে ভালো তো এখন খারাপ। আকাশ আর ভদ্রলোক, দুটোই এক প্রকৃতির। তখুনি দরজা খোলার শব্দ কর্ণগোচর হতেই পিছু ফিরে ওয়াশরুমের দিকে তাকালো দীবা। মুহূর্তেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। চটজলদি দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। বিহ্বল হয়ে বলে উঠলো, ‘লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফেলছেন? এভাবে বের হয়েছেন কেন?’

ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো আবরার। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো খালি গায়ে সে। পরনে তার দীবার আকাশী রঙের টাওয়াল! তবে তাকে দেখে দীবার এভাবে মুখ ঢেকে ফেলার কোন মানে খুঁজে পেলো না। তাই কন্ঠস্বরে ক্ষুব্ধ প্রকাশ করে বলল, ‘এভাবে মুখ ঢাকার কি আছে? আজিব!’

দীবা মুখে হাত রেখেই বললো, ‘আমি আপনার মতো নি’র্ল’জ্জ না। এভাবে খালি গায়ে বেড়িয়েছেন কেন? ছিঃ’

আবরার ভ্রুঁ কুঁচকে বললো, ‘চোখে দেখো না তুমি? খালি গায়ে কোথায়? তোমার টাওয়াল পরে আছি আমি।’

‘ তোমার টাওয়াল ‘ কথাটা শুনেই চমকে উঠলো দীবা। মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়েই চোখ চড়কগাছে উঠে গেছে তার। নিজের প্রিয় টাওয়ালের এমতাবস্থায় দেখে মৃদু আওয়াজে চেঁ’চি’য়ে উঠলো, ‘এএএটা কি করলেন? আমার টাওয়াল পরলেন কেন?’

দীবার কথার পাত্তা না দিয়ে আবরার ত্যাঁছড়া ভাবে উত্তর দিল, ‘কেন পরেছি দেখতে পারছো না? টাওয়াল ছাড়া বাহিরে আসবো আমি? গাধা!’

আবরারের এমন প্রত্যুত্তর শুনে থমথমে খেলো দীবা। চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আবরার আয়নার সামনে গিয়ে দীবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমার রুম থেকে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট নিয়ে আসো। ‘

দীবা ঠোঁট গোল করে ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো, ‘আমার শার্ট প্যান্ট নিয়ে আসো। আপনার হাত পা নেই? নিজের কাজ নিজে করতে পারেন না? আমার রুম থেকে এখুনি বের হোন বলছি।’

আবরার বিরক্তির চোখে তাকালো দীবার দিকে। কন্ঠে কিছুটা ক্রোধ ফুটিয়ে বললো, ‘যাবে?’

দীবা বুকে হাত গুঁজে একরোখা ভাবে বললো, ‘নাহ!’

দীবার প্রত্যুত্তর শুনে বাঁকা হাসলো আবরার। অতিদ্রুত দীবার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। হকচকিয়ে গেলো দীবা। পিছিয়ে যেতে নিলেই আবরার এক হাতে দীবার কোমড় ধরে কাছে টেনে নিলো। দীবা এখনো আশ্চর্যান্বিত! আবরারের ঠোঁটে এখনো শয়তানি হাসি বিদ্যমান। দীবার মুখের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিতেই চেঁচিয়ে উঠলো দীবা, ‘আমি যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি ভাই সরেন আমার থেকে।’

ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আবরারকে। তারপর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। দীবার এই অবস্থা দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আবরার।
_________________

গলায় স্কার্ফ লাগাতে লাগাতে রুম থেকে বের হলো রিমি। গুনগুন করে হিন্দি গান গাইছে সে। মনটা তার বেশ ফুরফুরে। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখলো আয়েশা উপরে উঠছে। তাকে দেখেই আয়েশা কাজ দিয়ে দিলো, ‘রিমি তুই গিয়ে অভ্র কে ডেকে নিয়ে আয়। আমার কাজ আছে উপরে যেতে পারবো না।’

রিমি কাজের কথা শুনে মুখ কালো করে বললো, ‘আমি না আসলে তো ঠিকই উপরে যাইতা।’

রিমির আলসেমি দেখে এক গাল হাসলো আয়েশা। উপরে না গিয়ে নিচে যেতে যেতে বললো, ‘তাড়াতাড়ি যা!’

‘যাচ্ছি!’ বলে গটগট পায়ে আবারো ফিরতি পথের দিকে পা বাড়ালো রিমি। বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতে অভ্রের রুমের সামনে আসলো। দরজায় কয়েকবার টোকা দেবার পর অভ্র দরজা খুললো। রিমিকে এখানে এইসময় দেখে অভ্র প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এখানে?’

রিমি উগ্র কন্ঠে প্রত্যুত্তর করলো, ‘অকারণে নিশ্চয় আসি নি। এসেছি যেহেতু কাজ আছে। ছোট মা পাঠিয়েছে তাই বাধ্য হয়ে আপনার মুখখানি দেখিবার জন্য এসেছি।’

রিমির কথা শুনে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো অভ্র। মনে মনে তাকে মাত্রাধিক ত্যাড়া মেয়ে বলে উপাধি দিলো। কথায় কথায় ঝ’গ’ড়ার জন্য এক্সপার্ট এই মেয়ে। মনে মনে হাসলো অভ্র। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। তাকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে রিমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘বলছি সাহেব! একটু সময় হলে দয়া করে নিচে এসে নাস্তা খানা গিলে যান।’

অভ্র মাথা কিছুটা কাত করে বুঝালো ‘ঠিক আছে’! রিমি অভ্রের দিকে সূক্ষ্ম চোখে এক পলক তাকিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। কিছুটা সামনে যাবার পর অভ্র পিছু ডেকে উঠলো, ‘রিমি?’

ডাক শুনে পিছু ফিরে তাকালো রিমি। তাকে তাকাতে দেখে অভ্র মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো। তারপর ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল, ‘কিছু না!’ বলেই রুমে চলে গেলো।

অবাক হলো রিমি। প্রথমে বিস্মিত হলেও এখন রাগ উঠলো শরিরে। এক হাত উঠিয়ে রাগে গিজগিজ করতে করতে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আরে ভাইইই কিছু না হলে ডাকলি কেন?”

অভ্র রুমে চলে আসলেও দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। রিমির কথাটা শুনে নিঃশব্দে হেসে উঠলো। মেয়েটা একটু বেশি পাগলী! ভালোলাগা কাজ করলো মনে। আনমনে হেসে এক হাতে সিল্কি চুল গুলো এলোমেলো করে ফেললো সে।
_________________

মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশ! শীতল হাওয়া প্রভাহমান। ঘন কালো মেঘ জমে আছে আকাশে। কিয়ৎক্ষণ পর ঝিরঝির বৃষ্টিতে মুখরিত হলো আগ্রাবাদ শহরাঞ্চল। অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ মৃদু আলোকিত হতে লাগলো। ধমকা হাওয়ার কারণে বারান্দার পর্দা গুলো উড়ছে। কিছুটা বিরক্তবোধ করলো আবরার। এগিয়ে এসে বারান্দার দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তখুনি সেখানে উপস্থিত হলো দীবা। হাতে তার আবরারের শার্ট প্যান্ট। মুখখানি কালো রেখেই কাপড় দুটো আবরারের দিকে এগিয়ে দিলো। আবরার স্বাভাবিক ভাবে কাপড় হাতে নিয়ে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে আসো।’

আবরারকে দীবার এই মুহূর্তে আদেশকারী মনে হচ্ছে। বিরক্তিকর চোখেমুখে আবরারের দিকে এক পলক তাকিয়ে কাভার্ড থেকে আকাশী রঙের পিস জামা আর প্লাজু নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। এই ফাঁকে আবরার তৈরি হয়ে নিলো। তারপর বিছানায় বসে দীবার অপেক্ষা করতে লাগলো। দীবা ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আবরারকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি এখনো যান নি?’

আবরার মোবাইলের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, ‘না তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। এক সাথে নিচে যাবো।’

অসন্তুষ্ট হয়ে ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেললো দীবা। প্রতিক্রিয়া না করে চুপচাপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে বেনী করে নিলো। আবরার দাঁড়িয়ে মোবাইল পকেটে রাখলো। তারপর দীবার এক হাত ধরে বললো, ‘চলো।’

দীবা জানতে চাইলো, ‘কোথায়?’

‘এক সাথে নিচে যাবো নাস্তা করার জন্য।’

দীবার হাত ধরেই দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো আবরার। দীবা বলল, ‘ঠিক আছে কিন্তু হাত তো ছাড়ুন।’

‘না। এভাবেই যাবো।’

চোখ বড়বড় করে তাকালো দীবা। অস্থির হয়ে নিজের হাত ছাড়ানোর প্রয়াস করে বললো, ‘ইম্পসিবল! হাত ধরে নিচে যাওয়া সম্ভব না। হাত ছাড়ুন।’

ইতিমধ্যে দুইজন রুমের বাহিরে এসে পরেছে। আরেকটু সামনে গেলে সিঁড়ির কাছাকাছি চলে আসবে। দীবার কথা কর্ণপাত হতেই দাঁড়ালো আবরার। দীবার দিকে ফিরে বললো, ‘হাত ধরে যেতে না চাইলে কোলে তোলে নিয়ে যাবো। যাবে? কোনটাতে কমফোর্টেবল ফিল করবে? হাত ধরে নাকি কোলে উঠে?’

থমথমে খেলো দীবা। চোখমুখ কুঞ্চিত করে প্রথমের মতোই বললো, ‘হাত ছাড়ুন।’

আবরার দীবার দিকে কোলে নেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বললো, ‘তাহলে কোলে আসো।’

ভড়কে গেলো দীবা। স্তম্ভিত হয়ে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো তাৎক্ষনাৎ, ‘না না না। এভাবেই ঠিক আছি। কোলে নিতে হবে না।’

দীবার এমন হতভম্ব অবস্থা দেখে হেসে ফেললো আবরার। দীবার এক হাত খুব যত্ন সহকারে মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। হাতটা তুলে মুখের সামনে এনে প্রগাঢ় ভাবে একটা চুমু দিলো। মৃদু কন্ঠে বললো, ‘আমি হাত ধরলে ছাড়ার কথা কখনো বলবে না। আমার ভালো লাগে না।’

দীবা প্রত্যুত্তর করলো না। পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে। এই মুহূর্তে ভালো লাগা কাজ করলো তার মনে। লোকটার ব্যবহার, কথাবার্তা ও চালচলন সব কিছুতেই কেমন অদ্ভুত মায়া কাজ করে। অনুভূতি নামক নতুন কিছু অনুভব হয় মনে। দীবার চোখে আবরারের প্রতি একরাশ মুগ্ধতা প্রকাশ পেলো। আবরার দীবার হাত ধরে নিচে যেতে লাগলো। প্রথমে দীবা কিছু না বললেও সিঁড়ির দিয়ে নিচে নামার সময় অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো। বাসার সবার সামনে হাত ধরে যাবে? ইশ! ব্যাপারটা অপ্রীতিজনক। সিঁড়ি থেকে নামার পর দীবা ফিশফিশ গলায় বললো, ‘প্লিজ হাত ছাড়ুন। সবার সামনে এভাবে যাবো না। আমার লজ্জা লাগছে।’

‘কিছু হবে না!’ বলল আবরার। দীবা নিরবে চেষ্টা করলো ছাড়ানোর। কিন্তু আবরার শক্ত করে ধরে রাখায় ব্যর্থ হলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে আসার পর উপস্থিত সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে পরলো। নিশিতা, রোহানা, আয়েশা অবাক হলো অনেক। সাথে অবাক হলো অন্যরাও। দীবা অস্বস্তিতে একদম জমে গেছে। আবারো হাত ছাড়তে চাইলে আবরার শক্ত করলো বাঁধন। ক্ষান্ত হলো দীবা। হাল ছেড়ে দিলো। লজ্জায় নত হয়ে ইতস্তত করতে লাগলো। আবরার রোশানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঠিক তার সামনে চেয়ার টেনে নিজে বসলো ও দীবাকে তার পাশে বসালো। এখানে মূলত এভাবে আসার কারণ টা হচ্ছে রোশান! গতপরশু রোশানের করা কাজটার জন্যই আবরার দীবার হাত ধরে সবার সামনে এসেছে। বুঝানোর চেষ্টা করিয়েছে যে তার আর দীবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। ছেলের নিরব প্রত্যুত্তর দেখে সকলের অগোচরে মুচকি হাসলো রোশান। রিমি, নুরা চুপচাপ বসে আছে। রোশান ও হোসেন এখানে উপস্থিত থাকায় মজা করতে পারছে না। তবে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে মৃদু হাসি ঝুলে আছে সবার মুখে। আবরার নির্বিকার ভাবে নাস্তা শুরু করেছে। দীবা স্যান্ডউইচ হাতে নিয়ে বসে আছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। সবার সামনে বসে থাকার মতো স্বস্তি পাচ্ছে না।

বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পর রোশান মুখ খুললো, ‘আফজালের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমাদের সবাইকে ডিনারের জন্য ইনভাইট করেছে আজ।’

সাবিত বললো, ‘কোথায়? উনাদের বাসায়? কিন্তু বিয়ের আগে এভাবে..’

রোশান বললো, ‘রাজিবের একটা নিজস্ব রেস্টুরেন্টে আছে। সেখানেই ইনভাইট করেছে। যদিও প্রথমে তাদের বাড়িতে যাবার জন্য বলেছিলো। আমি বারণ করায় রাজিব তার রেস্টুরেন্টের কথা বলেছে।’

নিশিতা বললো, ‘ভালো করেছো। বিয়ের আগে এভাবে পরিবার সহ পাত্রের বাড়িতে যাওয়াটা বেমানান।’

আয়েশাও সম্মতি দিলো জা’য়ের কথায়। অতঃপর রোশান সবাইকে সন্ধ্যা তৈরি থাকতে বললো। দীবা কোনো রকমে খাবার শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তার সাথে সাথেই রিমি, নুরা উঠে গেলো। বাকিরা নিজেদের মতো করে খাবার খেতে লাগলো।

দীবা সিঁড়ির কাছাকাছি এসে পিছনে তাকিয়ে দেখলো নুরা আর রিমি তার পিছু আসছে। তাদের আসতে দেখেই দীবা তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে যেতে লাগলো। তাকে দৌড়াতে দেখে রিমি নুরাও পিছু দৌড়ালো। দীবা দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় নুরা আর রিমি এসে তাকে ধরে ফেললো। হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। বিরক্ত হয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ফেললো। নুরা দীবার হাত ধরেই বললো, ‘পালাচ্ছিলি কেন?’

দীবা কটমট করে বললো, ‘তোদের কাছে থাকলে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। তাই ইজ্জত বাঁচাতে পালাচ্ছি। হাত ছাড়।’

নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো দীবা। নুরা রিমি শক্ত করে ধরলো হাত দুটো। রিমি দীবার কথার প্রত্যুত্তর করলো, ‘ইজ্জতের ফালুদা করার মতো সিচুয়েশন ক্রিয়েট করছ কেন?’

নুরা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো, ‘তবে যাই বল। ইজ্জতের ফালুদা খেতে আমাদের অনেক ভালো লাগে। এখন তাই খাবো। ছাদে আয়।’

অনিচ্ছা থাকার পরেও দীবা তাদের সাথে ছাদে যাবার জন্য পা বাড়ালো। ছাদে যাওয়ার এইটুকু পথটাকেও রেহাই দেয় নি নুরা রিমি। নানান কথার ছলেবলে কৌশলে দীবাকে আচ্ছা মতো প’চা’নি দিয়েছে

চলমান..#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-২৬]

আষাঢ়মাসের তেইশতম দিন! সুবিশাল অম্বর ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন। তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে শীতল বাতাস প্রভাহমান। খুব ভোরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই পুরো ছাদ বৃষ্টির পানিতে ভিজে টুইটুম্বুর। ঘন মেঘের কারণে দিবাকরের দেখা নেই এখনো। বাড়ির পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছটার একাংশ ছাদের একপাশে হেলে পরে আছে। তার চিকন চিকন সবুজ নেত্রপল্লব বর্ষণের ফোটায় ভিজে চিকচিক করছে। কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম ফুল গুলো বৃষ্টির ফোটার সাথে না পেরে ঝরে পরেছে। ছাদের কার্নিশ থেকে অনেক টা অংশ জুড়ে পরে আছে তারা। এক এক করে অনেক গুলো পরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ফুল তুলে নিলো দীবা। তারপর রেলিংয়ের পাশে দাঁড়ালো। রিমি ছাদে জমে থাকা পানিতে পা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো, ‘বর্ষাকাল আমার এই জন্যই ভালো লাগে।’

দীবাও বললো, ‘আমারো।’

নুরা গালে এক হাত রেখে আনমনে বলে উঠলো, ‘আর আমার রাজকে।’

তার এমন কথা শুনে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো রিমি। দীবা অল্প শব্দে হেসে নুরার বাহুতে হালকা করে একটা থা প্প ড় দিলো। হকচকিয়ে গেলো নুরা। লজ্জা পেলো ভীষণ। ইতস্তত করে বললো, ‘কি বলেছি আমি? এভাবে তাকাচ্ছিস কেন?’

রিমি স্থির দৃষ্টিতে নুরার দিকে তাকালো। অবিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘তুই কি রাজ স্যারের ব্যাপারে সিরিয়াস? নাকি মজা করছিস শুধু?’

নুরা ফাজলামোর স্বরে বললো, ‘নেভার! আই’ম জাস্ট কিডিং!’

নুরা কথাটা মজার ছলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও দীবা ও রিমির কাছে পারলো না। তারা ঠিকই ধরে ফেললো। তবে নুরা অস্বীকার করায় রিমি কিছুটা ক্ষুব্ধ চোখে দীবার দিকে তাকালো। দীবা রিমিকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে নুরার দিকে তাকালো। নুরার চোখেমুখে অস্বস্তি লক্ষ্য করলো সে। গুরুগম্ভীর হয়ে নুরাকে তার দিকে ফিরালো। শান্ত গলায় জানতে চাইলো, ‘সত্যি করে বল। তুই স্যারের ব্যাপারে সিরিয়াস? মিথ্যে বলার চেষ্টা করবি না। আমরা দুইজন সব জানি। আমাদের থেকে লুকাতে যাবি না।’

নুরা তার মলিন চোখ দুটো ফিরিয়ে অন্যত্র তাকালো। দৃষ্টি তার স্থির নেই। উদ্বিগ্নচিত্ত চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চাইলেও পারলো না। কাদুকাদু চেহারায় মলিন কন্ঠে বললো, ‘আমি জানি না। উনার প্রতি আমার সফট কর্ণার রয়েছে। ভালোলাগা থেকে অনেক বেশি কিছু ফিল করি আমি। কিন্তু ভয় হয়! এটা আদৌ সম্ভব কিনা জানা নেই আমার। বাট আই ডিপলি লাভ হিম।’

দীবা নুরার বাহুতে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে শান্ত্বনা দিলো। রিমি চিন্তিত কন্ঠে বললো, ‘কিন্তু উনি তো আমাদের টিচার। তাহলে কিভাবে হবে?’

রিমির কথার অর্থোদ্ধান হলো কিভাবে রাজের সাথে নুরার সম্পর্ক তৈরি হবে? নুরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্মিতি হেসে বললো, ‘দেখা যাক!’

নুরার মন খারাপের কারণ হতে চায় না কেউ। তাই তাকে হাসাতে রিমি উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে উঠলো, ‘বাহ্, আমাদের নুরা মনি যে এভাবে কারোর প্রেমে পরতে পারে জানা ছিলো না।’

ছাদের আনাচ-কানাচ বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ। দীর্ঘসময় ছাদে পানি জমে থাকায় কিছু কিছু অংশে শ্যাওলা জমে গেছে। পিচ্ছিল হয়ে আছে ছাদ। বৃষ্টির পানি শীতল। দীবা পানিতে পা দুটো দুলিয়ে রিমির সঙ্গ দিতে বলে উঠলো, ‘পরেছে তো পরেছেই। একদম ডুব দিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।’

কথাটা বলতে দেরি, কিন্তু দীবার ধপাস করে আ’ছা’ড় পরতে দেরি হয়নি। শ্যাওলা জমে যাওয়া পিচ্ছিল ছাদের ভিজে অংশে পা দিয়ে নাড়াতে গিয়ে বড়োসড়ো একটা বোয়ালমাছ ধরলো। ছাদে জমে থাকা পানিতে দীবার শরিরের অর্ধভাগ ভিজে গেছে। তাকে এভাবে পরতে দেখে উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো রিমি ও নুরা। দীবা ঠোঁট উলটে তাকালো দুজনের দিকে। নুরা হাসতে হাসতে বললো, ‘আমি তো পরেছি, আর তুমি আ*ছা*ড় পরেছো।’

দীবা মুখ কালো করে আসন পেতে বসে রইলো নিচে। ভাগ্যবশত ব্যাথা লাগেনি। অম্বরে ঘন কালো মেঘ থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সূত্রপাত ঘটলো। পানির তাপমাত্রা শীতল। রিমি তাড়া দিলো ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য। নুরাও দীবাকে বলে দ্রুত হাঁটা ধরলো চলে যেতে। দীবা ‘আসছি’ বলে বসে রইলো সেখানে। রিমি নুরা ভেবেছে হয়তো একটু পর আসবে। তাই দুইজন গুরুত্ব না দিয়ে নিচে চলে গেলো। উঠলো না দীবা। মৌনতার সঙ্গে বসে থেকে আকাশের পানে মুখ তুলে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। অনুভব করলো আষাঢ়ের ইলশেগুঁড়ির বর্ষণ। হঠাৎ-ই ধরনী কাঁপিয়ে অম্বরে মেঘের গর্জন ভেসে আসলো। কেঁপে উঠলো দীবা। বুকটা ধুরুধুরু করতে লাগলো। তবুও ছাদ থেকে নামলো না। আজ বৃষ্টি ভিজার ইচ্ছে পোষণ করলো তার অবুঝ মন।
__________________

দীবার রুমে তাকে না পেয়ে ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করলো আবরার। উষ্ঠধয় কামড়ে ভাবতে লাগলো। নাস্তা শেষে মেয়েটা যে উপরে এসেছে তারপর থেকে তার দেখা নেই। গেলো কোথায়? রিমি ও নুরার কথা মনে পরলে দীবার রুম থেকে বের হলো আবরার। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলো ছাদের সিঁড়ি থেকে নুরা আর রিমি দৌড়ে আসছে। ঠিক দৌড়ে আসছে না। রিমিকে কোনো কারণে দৌড়াচ্ছে নুরা। তাদের এভাবে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো আবরার। রিমি দৌড়ে এসে আবরারের পিছু দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে চাইলো। নুরা রিমিকে ধরার চেষ্টা করে চেঁচাল, ‘রিমোট কোথাকার। তোর চু’ল গুলা আজ ছিঁ’ড়’বো আমি।’

দুইজনই আবরার কে ঘিরে আছে। নুরা রিমিকে ধরতে চাইলেই রিমি আবরারের অন্য পাশে চলে যাচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ কাড়াকাড়ি হলো। আবরার বেচারা কারণ বুঝতে না পেরে অবশেষে ধমকেই উঠলো, ‘হচ্ছে টা কি ভাই? ঝ’গ’ড়া করছিস কেন তোরা?’

নুরা রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, ‘এই মেয়ে আমার…!’ এইটুকু বলেই থেমে গেলো নুরা। মস্তিষ্ক সজাগ হলো তার। বড় ভাই যতোই হোক, সব কথা তো আর শেয়ার করা যায় না। ইশ কি করতে যাচ্ছিলো সে! আরেকটু হলে রাজ স্যারের ব্যাপারে সব জেনে যেতো আরব ভাই। নিজের বোকামিতে নিজেই বিরক্ত হলো। রিমি দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ভ্রুঁ জোড়া নাচিয়ে নাচিয়ে বললো, ‘কি হলো জান? বলো।’

নুরা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রাগে কটমট করতে করতে চলে গেলো। নুরা যেতেই আবরার বলে উঠলো, ‘কি হয়েছে?’

রিমি হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলো। নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাথা এপাশ থেকে এপরপাশ দুলিয়ে বললো, ‘কিছু না। এটা সিক্রেট। বলা যাবে না।’

ওদের ব্যাপারে আবরার আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। দীবার কথা জানতে চাইলেই রিমি বললো তারা তিনজন এতোক্ষণ ছাদে ছিলো। বৃষ্টি নামায় তারা নেমে এসেছে কিন্তু দীবা আসে নি। ব্যাস! আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না আবরার। দ্রুত ছাদে চলে আসলো। দরজার কাছে এসে দেখলো দীবা বৃষ্টি ভিজছে। পা দুটো উঁচু করে দুই হাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছাদের রেলিংয়ের পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়ার বড় ডাল টা ধরার। কিন্তু অল্প দূরত্বের কারণে হাতের নাগালে পাচ্ছে না।

কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি থাকলেও এখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কালো মেঘে ঢাকা বিশালাকৃতির অম্বর আলোকিত করে বিদুৎ চমকাচ্ছে। প্রবল বাতাসে গাছের সবুজ নেত্রপল্লব নড়বড়ে। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো আবরার। এক মনে দীবাকে দেখতে লাগলো। আকাশী রঙের কুর্তি পরে আছে। পুরো জামাটা ভিজে গায়ে লেপ্টে গেছে একদম। সাদা ওড়নাটা গলায় ঝুলানো। বেনী করা চুল গুলো থেকে চুপসে পানি ঝরছে। দীবার আপাতমস্তষ্ক পর্যবেক্ষণ করার সময় হঠাৎ-ই নিষিদ্ধ স্থানে চোখ যেতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। তবে দীবার থেকে চোখ ফিরালো না। বার বার লাফিয়ে ফুল পারার চেষ্টা করছে দীবা। মৃদু হাসলো আবরার। নিজেকে আর সংযত করতে পারলো না। ধীর পায়ে দীবার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে দীবা টের পেলো না। আবরার দীবার পিছনে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণচূড়ার ডালটা টেনে দীবার নাগালে এনে দিলো। দীবা প্রবৃত্তি হয়ে ঘাড় পিছু ফিরে তাকালো। আবরারকে নিজের অতি সন্নিকটে দেখে অসাড় হলো শরির। এতোক্ষণে আবরারের শরির বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। কৃষ্ণচূড়ার একটা ফুল ছিঁড়ে দীবার কানে গুঁজে দিলো আবরার। কপালে লেপ্টে থাকা কিছু চুল এক হাতে যত্ন সহকারে মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। দীবা নিশ্চুপ! নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আবরারের দিকে। দুজনের মধ্যিখান দূরত্ব ঘুচিয়ে একদম নিবিড় হলো আবরার। দীবার কোমড়ে এক হাত রেখে অপর হাত গালে রেখে চোখে চোখ রাখলো। ঠোঁট প্রসারিত করে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘কালো মেঘের মাঝে জমে থাকা অভিমান বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরুক। স্বচ্চ হোক ভালোবাসার আকাশ।’

দীবা আবরারের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে গভীরত্ব বুঝলো। চোখের মায়ায় পরলো। আনমনে নিজের এক হাত উঠিয়ে আবরারের হাতের উপরে রাখলো। দৃষ্টি অনুন্নত করলো না কেউ। আবরার নিজের মুখটা দীবার দিকে এগিয়ে নিলো। তাৎক্ষনাৎ চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো দীবা। আবরারের একদম কাছাকাছি আসায় ভয়ে উষ্ঠধয় থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার। কম্পিত এই উষ্ঠধয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো আবরার। নেশা লাগলো তার মনে। মুগ্ধ হলো চোখ। ধীর গতিতে এগিয়ে দীবার ঠোঁটের ভাজে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল। গভীর ভাবে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে চুমু খেলো একটা। তারপর দীবার কানের কাছে মুখ এনে ফিশফিশ করে বললো, ‘ভালোবাসি সুহাসিনী!’

লজ্জাভূতি হলো দীবা। দুই গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে এলো। লজ্জায় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে ফেললো। লজ্জায় নত হওয়া দীবার মুখশ্রী দেখে মৃদু শব্দে হাসলো আবরার। আরো লজ্জা পেলো দীবা। আবরারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো স্বস্তি পেল না আর। তাই নিজে থেকে আবরারকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। ছাদের দরজার কাছে গিয়ে একবার পিছু ফিরে আবরারের দিকে তাকালো। মিষ্টি করে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। দীবার এই হাসিটা আবরারের বুকে গিয়ে বিঁধল। দীবার প্রেমে নতুন করে মাতোয়ারা হলো। ‘আহঃ’ বলে বুকে এক হাত রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে রেলিংয়ে হেলান দিলো।

রুমে এসে দরজা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো দীবা। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। লজ্জায় লাল হয়ে আসা গাল দুটোর দিকে তাকালো। ডান হাত উঠিয়ে ঠোঁটের কাছে আনলো। নিজের ঠোঁটে আবরারের ভালোবাসার স্পর্শের কথা মনে পরতেই আনমনে লাজুক হাসলো। মনে পরলো আবরারের ফিশফিশ করে বলা কথাটা। ‘ভালোবাসি সুহাসিনী! ‘

খুশি হলো দীবার মন। আবরার তাকে ভালোবাসে জানিয়ে দিয়েছে আজ। খুশিতে আত্মহারা হলো মন। দীবা বাংলা ক্যালেন্ডার বের করলো। আষাঢ়মাসের তেইশ তারিখ বরাবর লাল কলম দিয়ে দাগ টেনে দিলো। চার পাঁচ শব্দের ইংরেজিতে একটা লাইন লিখলো। ক্যালেন্ডার টা ড্রয়ারে রেখে মুচকি হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে গেলো কাপড় বদলাতে।
____________________

পুরোটা দিন ভারি বর্ষণে কেটেছে। সাঁঝ বেলায় বর্ষণ শেষে কালো মেঘ কাটিয়ে উজ্জ্বল আকাশ উঁকি দিয়েছে। দিবাকর সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিম আকাশে ডুব দিয়ে পরিবেশ করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। মৃদু মৃদু আবছায়া আলোতে আগ্রাবাদ শহরাঞ্চল মোহনীয় করে তুলেছে। মাগরিবের নামাজ শেষে রোশান সবাইকে তৈরি হওয়ার জন্য বললো। রাইমার চাইতেও বেশি এক্সাইটেড হয়ে আছে রিমি, নুরা আর দীবা। ‘কি পরবে’ ‘কি পরবে’ বলে রাইমার মাথা খেয়ে ফেলছে তিনজন। অবশেষে রাইমা তাদের একই ডিজাইনের গ্রাউনের সাথে হিজাব পরার কথা বললো। রাইমার কথা অনুযায়ী তারা তিনজন সেম ডিজাইনের গ্রাউন পরে তৈরি হয়ে নিলো। নিশিতা পরলো শাড়ি। রোহানার শরির তেমন একটা ভালো নেই তাই যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলো না। জোর করলো না কেউ। রোহানার শরির খারাপ তাই আয়েশাও থেকে গেলো। নিশিতা যেতে চায় নি প্রথম। বাড়ির কর্তি হিসেবে তার যাওয়া বাধ্যতামূলক করলো আয়েশা!
.

বাহিরের আকাশ জ্যোৎস্নাময়। অন্তরিক্ষে বিশালাকৃতির চাঁদ থেকে এক ফালি আলো দীবার রুমের বারান্দায় এসে পরেছে। রুমের বিছানায় শুয়ে থেকেও স্পষ্ট বারান্দা জুড়ে থাকা জ্যোৎস্না দেখছে দীবা। চোখ দুটো ব্যাথা করছে ভীষণ। মাথাটা ভার হয়ে আছে। কারণটা দীবার বুঝতে বাকি নেই। সকালে বৃষ্টি ভেজার কারণে মাথা ভার হয়ে আছে এখন। ক্লান্ত চোখ দুটো ধীরে বন্ধ করলো দীবা। তখুনি রিমির কণ্ঠস্বর কানে আসলো তার।

‘কিরে? ঘুমাচ্ছিস কেন? এখন না বের হবো আমরা?’

অনিচ্ছা থাকার পরেও মাথা তুলে রিমির দিকে তাকালো দীবা। দেখলো রিমি তৈরি হয়ে তার রুমে এসেছে। সে নিজেও বাহিরে যাবার জন্য তৈরি। শরির দুর্বল দুর্বল লাগছিলো তাই একটু বিশ্রামের জন্য শুয়েছে। জোরপূর্বক শুয়া থেকে উঠে বসে মলিন কন্ঠে বললো, ‘রিমি আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।’

রিমি তো আর কারণ জানে না! তাই দীবার কথার পাত্তা দিলো না। হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামাতে নামাতে বললো, ‘কোথাও যাওয়ার আগে এতো এতো প্ল্যান করার পর ভালো লাগছে না বলা তোর কাজ। এটা তোর জন্মগত অভ্যাস। চুপচাপ চল। কোনো কথা বলবি না। নুরা আমাদের অপেক্ষা করছে। ‘

দীবা বাধা দিলো না। কারণ সে জানে! তাকে ছাড়া এই দুই শ’য়’তা’ন কখনোই নিচে যাবে না। তাই নিরবে রিমির সাথে নিচে গেলো।

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here