#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৪
#খাদিজা_আক্তার
রাত্রির ক্রমশ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এখন আদীর সাথে তর্ক করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই অগত্যা সে ইনবক্সে চোখ বুলিয়ে আদীকে বলল,
—দেখেছি।
—কেমন?
—খুব ভালো।
—এইত্ত, তা বুঝলা ছবিডা?
—না।
রাত্রি গম্ভীর গলায় একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। এর বেশি কোনো প্রতিক্রিয়া তার গলার স্বরে ভাসছে না। এদিকে আদী নেশায় বিভোর হয়ে ক্ষণে হাসছে তো ক্ষণে রেগে কথা বলছে। তার কণ্ঠস্বর নেশায় গাঢ় হয়ে ওঠছে।
—গাঁ””জা। নাম শুনছ তো না কি? আজকেই প্রথম খাইলাম। ভালোই নেশা নেশা লাগতাছে। তবে এহন অন্য নেশায়ও টানতাছে।
এ বলে আদী একটুখানি চুপ থেকে রাত্রিকে ডাকল,
—রাত্রি?
—হুঁ।
—হুঁ কী? সুন্দর কইরা উত্তর দিতে পারো না?
—পারলে তো তোমাকে উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ দিতাম না।
—পারো না কেরে? তুমি বুঝো না এখন আমার অন্য কিছু মন চাইতাছে? তোমার কণ্ঠ শুনে আমার নেশা গাঢ় হচ্ছে। এই রাত্রি, আমার বউ হবে? আমি তোমার কোমল হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের হাতের আঙুল মিলিয়ে নিতে চাই। এরপর বলো তো কী করব?
আদী কথা শুনে রাত্রি অবাক আর ভয় পেয়ে রীতিমতো কাঁপছে। নেশা করলে মানুষের আচরণের বিশ্রী হয়ে যায়। কিন্তু আদীকে এমন অবস্থায় দেখবে তা সে জীবনেও ভাবেনি। রাত্রির মনে হচ্ছে এসবই স্বপ্ন আর একটু বাদেই ঘুম ভেঙে যাবে। সে মনে মনে খুব চাইছে এসব যেন স্বপ্ন হয়।
—এই রাত্রি, শোনা না। এই আমার প্রেমিকা। এই এই আমার মুখভার করা বউ।
—আদী, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কাকে কী বলছ তা হয়তো তুমি বুঝতে পারছ না।
আদী অট্টহাসি দিয়ে বলল,
—বুঝতে পারছি কাকে কী বলছি। যার হাতে চুড়ি পরিয়ে টুক করে হাতের উলটো পিঠে প্রেম এঁকে দিবো, যার মাথায় ঘোমটা টেনে তারই কপালের মাঠে আমি প্রেমের লাঙ্গল চালাব, যার হরিণী চোখে নিজ হাতে কাজল পরিয়ে আমার নিকোটিনে জ্বলা ওষ্ঠ ছোঁয়াব; তাকে এসব বলতে নতুন করে কী বুঝতে হবে?
এক মুহূর্তের জন্য রাত্রি হিম হয়ে গেল। তার সমস্ত শরীরের ক্রিয়াকলাপ যেন নিমিষেই স্থির হয়ে গেল। সারা মস্তিষ্ক জুড়ে বিস্ময়ের ঢেউ খেলে গেল আর হৃৎপিণ্ড নামক জিনিসে ক্রমাগত ছন্দপাত শুরু হলো। এ অস্বাভাবিক ছন্দপতনেও রাত্রিকে এক ভয় ঘিরে ধরল আর সে ভয়ের ঘোরেই ঠোঁট নাড়াল,
—আমি এখন ফোন রাখতে চাই।
—আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার প্রেমিকাকে আমি এসবই করতে চাই। করব এখন? ছুটে আসব তোমার কাছে?
—আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো আদী। আমি তোমার পায়ে পড়ছি। তোমার দিকবিদিকশুন্য অবস্থা এখন। নেশা করে নিজের মস্তিষ্ক তুমি বিকিয়ে এসেছ। তাই এমন কথা বলে নিজের আত্মসম্মান আমার কাছে ক্ষয় করছ।
রাত্রি প্রতিবাদ করল; তীব্র প্রতিবাদ। কিন্তু এসব যেন আদীর কানেই যাচ্ছে না। তার নেশা ক্রমাগত তীব্র হচ্ছে। চোখ জুড়ে ঘুম আসছে আর এক অজানা ঘোরে আদী এখন সুর করে গাইছে,
কি নেশা ছড়ালে!
কি মায়ায় জড়ালে?… হাবিব ওয়াহিদের এ গান রাত্রি বহুবার শুনেছে। কিন্তু আজকের মতো এত বিশ্রী অনুভূতি তার কখনো হয়নি। রাত্রির ইচ্ছে করছে এ গানটিকে সাবান সোডা দিয়ে ধুয়ে দিতে সাথে আদীকেও। প্রথমে আদীর কথাগুলো রাত্রির কানে অন্যরকম ঠেকেছিল, কিন্তু এখন মনে পড়তেই ঘা ঘিনঘিন করছে তার। চোখও ঝাপসা হয়ে আসছে। তাই বিনা নোটিশে কল কেটে রাত্রি দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠল সাথে সাথেই বজ্রপাত হলো।
*
বাইরে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। একমনে সে শব্দ শুনে যাচ্ছে আদী৷ তার মন আজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এ অট্টালিকায় আসতে গিয়ে সে একদম ভিজে গেছে। বৃষ্টিতে ভেজার মতো অদ্ভুত এবং অকাজ কখনোই আদী পছন্দ করে না। এসব নেকামি ছাড়া অন্য কিছু তার মনেও হয় না। কিন্তু আজ সে ইচ্ছেমতো ভিজেছে। সে জানে এতে তার অসুস্থ শরীর আরও অসুস্থ হতে পারে। জেনেও এমন করেছে কারণ আজ তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। যে রাত্রিকে এত দিন ধরে ২৪ ঘণ্টার জন্য গার্লফ্রেন্ড হিসাবে চাওয়া সুপ্ত বাসনা মনে লুকিয়ে রেখেছিল আজ তা পূরণ হয়েছে। কিন্তু আদী এ বিশাল প্রাপ্তিতেও খুশি হতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে কিছু করার আগেই একটু একটু করে জমানো সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
শার্ট আর প্যান্ট বদলে আদী এখন টাউজার আর টিশার্ট পরেছে। এ বাড়িতে আদী আজ তিন দিন ধরেই আছে। ফলে তার পোশাকআশাক সব এখানে মজুদ করা আছে। বাড়ির মালিক আর কেউ নয়, তার পুলিশ বন্ধু সাজ্জাদ। ধনসম্পদে সাজ্জাদের অবস্থা সম্পর্কে আদী অবগত নয়। তবে এ বাড়ি দেখে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
—এ বাড়ি তোর?
জবাব সাজ্জাদ কেবল মিটমিট করে হেসেছিল। এ বিষয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে সাজ্জাদ বলেছিল,
—তোর একটি ফাঁকা বাড়ি প্রয়োজন। এখন এটি কাজে লাগা। বাড়ি আমার না কার তা দিয়ে তোর কাজ কী? কাজ ঠিকমতো করিস।
আদী জবাব দেয়নি৷ সাজ্জাদকে সে রাত্রির বিষয়ে বললেও খোলাসা করে কিছু বলেনি। আদী বসার ঘরে কিছু প্যাকেট নাড়াচাড়া করছে। হঠাৎ পায়ের শব্দ হতেই ধীরে ধীরে তাকাল। চোখ মেলে সে যা দেখল, তাতে তার বিশ্বজোড়া নড়েচড়ে ওঠল। চোখের সামনে এক রমণীকে দেখছে সে যার পরনে খয়েরী রঙের শাড়ি। এলোমেলো ভেজা চুল পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। গৌর মুখে গম্ভীরতা কী নিপুণ ভাবে লেপ্টে আছে! চোখে লজ্জা আর নাকের ডগায় রাগ যেন লুকোচুরি খেলছে। এমন রূপে রাত্রিকে আগে কখনো দেখেনি আদী। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে আদী বেশ কিছু সময় ব্যয় করে ফেলল। হয়তো এখনো তাকিয়ে থাকত যদি না মেঘ গর্জে আদীর ধ্যান ভঙ্গ করত।
—সোফায় বোসো।
মাত্র দু’টি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে আদী টের পেল তার বুকের ভেতরের ছোট্ট যন্ত্রে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু সেটি হলেও কি প্রকাশ করা এখন উচিত হবে? এ চিন্তা মাথায় আসতেই আদী প্রাণপণে নিজেকে শক্ত করে হাতের প্যাকেট নিয়ে নিজের জন্য নির্ধারণ করা একটি রুমে ঢুকে গেল। এরপর মিনিট পাঁচেক ব্যয় করে যখন ফিরল, তখন দেখল রাত্রি চুপচাপ সোফায় বসে আছে। আজকে রাত্রির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই রাত্রি কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। অবাক, রাগ, কান্না তার চোখে মুখে ভাসলেও রাত্রি মুখ ফুটে কিচ্ছু বলছে না আদীকে। আদী বুঝতে পারছে রাত্রি তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। এটি ভাবতে গিয়ে আদী নিজের মাঝে ভালো লাগা অনুভব করলেও পরক্ষণেই তার মনে হচ্ছে সে যেন এক স্বার্থপর এবং লোভী মানুষ। যে জোর করে তার পাওয়া আদায় করছে।
—চুল মোছার গামছা কি ছিল না?
রাত্রির ভেজা চুল চুইয়ে পানি পড়ছে বিধায় আদী জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু রাত্রি চুপ করে বসে আছে। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বা আগ্রহ কোনো কিছুই সে প্রকাশ করল না।
রুম থেকে আসার সময় আদী গামছা আর কিছু জিনিস সাথে করে নিয়ে এসেছে। এখন সে গামছা দিয়ে রাত্রির ভেজা চুলে চালিয়ে যাচ্ছে। বলছে,
—আজ তোমাকে নিজ হাতে সাজাব। ভেবেছিলাম চুলও বেঁধে দিবো। ইউটিউবে বেনী করা শিখেছিলাম। কিন্তু খোলা চুলেই তোমাকে মানিয়েছে। তাই আর কষ্ট করার ইচ্ছে নেই।
রাত্রি আগের মতোই চুপ করে আছে। আদী চুল মোছা শেষ করে এবার রাত্রির পাশে এসে বসল। রাত্রির বাম হাত টেনে নিয়ে যখন এক এক চুড়ি পরাতে শুরু করল, তখন রাত্রির মাথায় সে রাতের কথাগুলো ক্রমাগত ঘুরতে শুরু করল,
—যার হাতে চুড়ি পরিয়ে টুক করে হাতের উলটো পিঠে প্রেম এঁকে দিবো।
(চলবে)#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৫
#খাদিজা_আক্তার
রাত্রির ভয় হচ্ছে। মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করছে। আদী উলটো পালটা কিছু করব কিনা তা নিয়ে মস্তিষ্কে ঝড় বইছে। কিন্তু একবার যখন রাজি হয়েছে, তখন মৃত্যু এলেও রাত্রির কিছু বলার থাকবে না। তাই নিজেকে প্রাণপণে সংযত রেখে রাত্রি চোখ নামিয়ে বসে আছে।
—এবার কাজল পরিয়ে দিই?
আদী জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু রাত্রি জবাব দেওয়ার পরিবর্তে একবার চেয়ে দেখে আবারও একই ভঙ্গিতে বসে রইল।
কাজল আর আয়না এগিয়ে দিয়ে আদী বিষাদের হাসি হাসল। বলল,
—তুমি পরে নাও। আমার অভ্যেস নেই।
রাত্রি বাধ্য মেয়ের মতো কাজল পরে নিলো। এটি করতে গিয়ে তার চোখে জল এসেছে যা আদী টের পায়নি৷ এ জল কাজল দিয়ে সৃষ্টি নয় বরং অন্য এক আদীকে দেখতে পেয়ে রাত্রির বুকের কষ্ট কালো হয়ে ওঠছে আর তা চোখের অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে।
একে একে আদী রাত্রির পায়ে নূপুর আর কানে দুল পরিয়ে দিলো। দুল পরানো শেষে আদী অতি যত্নে রাত্রি মুখ দু’হাতে সামনে এনে কপালের মাঠে গাঢ় প্রেম এঁকে দিলো। রাত্রি হতভম্ব হলো, কিন্তু আরও বেশি অবাক হলো যখন আদী তার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে কেঁদে ওঠল। বলল,
—রাত্রি, আমাকে একটু ভালোবাসবে? আমার মতো খারাপ ছেলেকে না কেউ ভালোবাসে না। তুমি… তুমি আমাকে…
আদী কাঁদছে; ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এর আগে রাত্রি কখনো আদীকে এমন করে কাঁদতে দেখেনি। আদী কাঁদত। তবে সামান্য জল এলেই হাতের উলটো পিঠে মুছে ঠিক হয়ে যেত, কিন্তু আজ এমন বুকফাটা কান্নায় কেন ভেঙে পড়েছে আদী? এমন চিন্তায় ব্যস্ত রাত্রি। সে কী করব আর বলব তা চিন্তা করতে করতেই আদী উঠে অন্য রুমে চলে গেল। রাত্রি নির্জীব হয়ে বসে রইল।
*
আকাশে একফালি চাঁদ। আকাশ আজ জ্যোৎস্নায় স্নান করছে অবিরত। মস্ত আকাশের স্নিগ্ধতা পৌছে গেছে বসার ঘরে। যে ঘরে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সোফায় পড়ে আছে রাত্রি। হঠাৎ রাত্রির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সামান্য দ্বিধান্বিত হলো। কিন্তু হঠাৎ ডান পায়ের পাতায় কীসের যেন নাড়াচাড়া অনুভব করল। ভয় পেয়ে আচমকা সোজা হয়ে বসল। সম্মুখে আদীকে দেখতে দেখতে পেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
—আদী… তুমি…
আদী মেঝেতে বসে রাত্রির পায়ের নূপুর নিয়ে খেলছে যেন এ খেলায় সে দারুণ ভাবে মত্ত হয়ে আছে। চোখজোড়া তার রাত্রির পায়ে আবদ্ধ। সমস্ত মুখে ছেয়ে আছে অপরিসীম ক্লান্তি। তবে মুখে কোথাও রাগ ছায়াটিও নেই।
—অবশেষে তোমার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। আজ সারাদিনে আমার সাথে একটি কথাও বলোনি। আপত্তি নেই। যাকে ঘৃণা করো, তার সাথে কথা বলতে তো সমস্যা হতেই পারে, তাই না?
এ বলে আদী তাকাল রাত্রির দিকে। চোখে চোখ পড়তেই রাত্রি তৎক্ষনাৎ নিজের চোখ সরিয়ে নিলো। মুহূর্তেই তার মুখে যেন অভিমানের সাতরং খেলা করে গেল। রাত্রির এমন মুখ দেখে আদী অন্য হাসি হেসে বলল,
চোখে ঘুম নেই আমার
বোধহয় তোমার ছবি অঙ্কিত আছে বলে।
দুই চোখ বুজে দিলে তাই ঘুম নয়,
শয়নেস্বপনে তুমি আসো ক্ষণে ক্ষণে।
শ্রেয়সী, তুমি কি তবে আমার চোখের ঘুম কেঁড়ে নিলে?
বুকের ভেতরে জ্বালা ঢেলে দিলে?
কেন করলে এমন শ্রেয়সী?
তুমি কি জানো না ঘুমহীন মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে না?
এমন সুপরিকল্পিত হ””ত্যা কেন করতে চাইছ শ্রেয়সী?
আমি তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলাম,
শুনিয়েছিলাম বুক পকেটে জমা একগুচ্ছ প্রেমের প্রলাপ,
কিন্তু তুমি হেসে উড়িয়ে দিলে।
আমায় খুব যত্ন করে আঘাত দিলে।
কেন করলে এমন শ্রেয়সী?
শ্রেয়সী, তুমি কি আমার চোখের ঘুম হবে?
তুমি ঘুম হলে আমি যে বেঁচে যেতাম।
নির্ঘুম রাত্রি যে আর করতে পারি না পার।
শ্রেয়সী, হবে কি আমার এক রাত্তির ঘুম?
এসব শুনে রাত্রি অবাক হলো, কিন্তু নিজের পায়ে আদীর টুকরো টুকরো স্পর্শে রাত্রির ভীষণ রাগ হচ্ছে। তাই সে ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু অন্য রুমে প্রবেশ করার আগেই আদীর বাহুডোরে বন্দী হলো। রাত্রি সামান্য চিৎকার করে জানান দিলো তার হাতে সে ব্যথা পেয়েছে। কারণ আদীর বুকে আছড়ে পড়ার মূহুর্তে কাচের চুড়িতে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ব্যথায় কাতর কণ্ঠে নিসৃত হলো যে চিৎকার তা যেন আদী শুনতে পেল না। রাগত স্বরে বলল,
—আমাকে কী ভাবো তুমি?
—কিছুই ভাবি না।
কান্নায় ধরে আসছে রাত্রির গলা তবুও সে রাগ ফুটিয়ে আদীকে জবাব দিলো। এসব নিরপেক্ষতার প্রভাব বিস্তার করে রাত্রি যে জবাব দিলো, তাতে আদীর মনে হিংস্রতা জ্বলে ওঠল,
—তুমি আমাকে নরপিশাচ ভাবো রাত্রি। এমন চিন্তা কেমন করে করলে তুমি? তোমাকে একদিনের জন্য গার্লফ্রেন্ড হিসাবে চাওয়া, ভালোবাসতে চাওয়ার মানে কি আমি তোমায় ভক্ষণ করতাম?
—আমাকে… আমাকে যেতে দাও। আমার হাত জ্বলছে।
—জুলুক তোমার হাত।
আদী চিৎকার করে ওঠল। নিস্তব্ধ রাতে ফাঁকা বাড়িতে আদীর কণ্ঠ ভীষণ ভয়ংকর শোনালো। রাত্রি ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু কী করবে এখন সে?
—তোমারে কইছে আমার লাইগা একদিনের প্রেমিকা হইতে। আরে তোমারে নিয়া যদি আমার অন্য চিন্তা থাকত। তাইলে দেড় বছর আগেই আমি উলটা পালটা কিছু করতে পারতাম। তোমাগো বাড়িতে সেই দিন কেউ আছিল না। সন্ধ্যার পরে আমি তোমার ঘরে ঢুকছিলাম। তুমি ঘুমায় ছিলা। আমার অন্য ফন্দি থাকলে একলা ঘরে তোমার গায়ে কাঁথা টাইনা আমি চইলা যাইতাম না। আমি তোমারে একলা এত দূরে একটা বাড়িত আনছি বইলা তুমি আমারে এইটুকু বিশ্বাস করতে পারলা না?
—আমি… আমি তোমাকে অবিশ্বাস…
—কথা কইয়ো না তুমি। তোমার উস্টা মার্কা কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। আমারে যদি অবিশ্বাস না করতা তাইলে তোমার বান্ধবীরে দিয়া বিষ আনাইছ ক্যা? কোন কারণে আজকা তুমি তোমার লগে বিষ লইয়া আইছ?
রাত্রি চুপ করে আছে। হ্যাঁ, রাত্রি এখানে আসার আগে বিষের ব্যবস্থা করে এসেছে। ভেবেছে আদী যদি মস্তিষ্ক বিকিয়ে কোনো কাজ করে। তবে আব্বা আম্মার সামনে না দাঁড়িয়ে বিষ গলাধঃকরণ করবে। কিন্তু এটি যে আদী টের পেয়ে যাবে তা রাত্রি ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি।
—আমারে ঘৃণা করো— এটা আমু মাইনা নিতাম। কিন্তু এমন চিন্তা কেমনে করলা তুমি? বুশরা তো তোমারে সব কইছে। তাও তুমি এমন চিন্তা করতে পারলে?
রাত্রি শুরু থেকেই আদীর টিশার্ট দু’হাতে খামচে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এখন একের পর এক আদীর বলা কথাগুলো শুনে রাত্রির হাতের মুঠো থেকে টিশার্ট আলগা হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ আদীর বুকের ভেতরকার যে ছন্দপাত রাত্রি ডান হাতে অনুভব করছিল, তা ক্রমশ দূরত্বে চলে যাচ্ছে বলে রাত্রির অজানা কষ্ট হচ্ছে। রাত্রির ইচ্ছে করছে আদীকে চিৎকার করে বলতে,
—আমি তোমাকে নরপিশাচ ভাবিনি আদী। তোমার মন বড়ো বেশি ভালো। কিন্তু নেশা করলে তুমি যা বলো তা আমি সহ্য করতে পারি না। ওই নোংরা কথাগুলো বাস্তবে যদি তোমারই অজান্তে আমার সাথে ঘটে যায়। তাহলে আমার যে মরণ ছাড়া গতি হবে না। আমি তোমাকে দোষ দিতে পারি না অথচ এসব সৃষ্টিকারী তুমি নিশ্চয়ই নির্দোষী হবে না।
—কথা কও না ক্যা? আমি তোমার লগে কী এমন করছি যে তুমি আজকা আমার মনডা এমন কইরা ভাইঙা দিলা? আমার খোয়াব ছিল তোমারে খয়েরি রঙের শাড়িতে দেখমু। তাই কত খোঁজাখুঁজি কইরা নিজে তোমার লাইগা শাড়ি কিনা আনছি। তোমারে নিজ হাতে সাজাইয়া চাইছিলাম তোমার কোলে মাথা দিয়া ঘুমাইতে। তোমার লগে রাত জাইগা চাঁদ দেখতাম। আমার এসব চাওয়ারে তুমি এমন নোংরা কলঙ্ক দিয়া দিলা? আমরা পুরুষ জাত কি এতই খারাপ রাত্রি?
(চলবে)