আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ১২+১৩

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১২
#খাদিজা_আক্তার

দিন যেন হাওয়াই মিঠাই। ছুঁয়ে দেখতে গেলেই মিইয়ে যায়। সেদিন সবে চৈত্র মাস ছিল। দেখতে না দেখতে বর্ষাকাল চলে এলো। আগে বৃষ্টিতে ভিজতে রাত্রির বড়ো ভালো লাগত, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ভালো লাগায় যেন ভাঁটা পড়ে গেছে। এতদিন হয়ে গেছে অথচ স্বর্ণালির মৃত্যুর রহস্য যেন রহস্যই রয়ে গেল। রাত্রি নিজের মাথায় হাজার চিন্তা নিয়ে বেঁচে থাকলেও স্বর্ণালির এমন অপমৃত্যু সে মানতে পারছে না। অথচ স্বর্ণালির সাথে ভালো করে তার কখনো কথাই হয়নি।

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে হয়তো আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি ভালো লাগার পাশাপাশি মনে ভয়ও সৃষ্টি করে। কিন্তু সিএনজিতে বসে এসব ভাবার অবকাশ রাত্রির নেই। গতকাল রাতে ইব্রাহিমের ওপর রাত্রির ভীষণ রাগ হয়েছিল। তাই ঠিকবেঠিক চিন্তা না করেই সে আদীকে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছে। কিন্তু এ ‘হ্যাঁ’ বলার পরিণতি কেমন হতে পারে তা ভাবতে গিয়ে রাত্রি বারবার ভয়ে কেঁপে ওঠছে।

বছর দুয়েক আগেকার কথা। ইংরেজি পরীক্ষা শেষে রাত্রি বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি এসে দেখে আদী বসে আছে আর আম্মার সাথে গল্প করছে। রাত্রি পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে যেতে নিলে আদী তার পিছু নেয়। পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে,

—রাত্রি, কী হয়েছে তোমার? আমাকে লক্ষ্যই করলে না আবার মুখখানাও কেমন ভার করে রেখেছ।

রাত্রি ঘুরে দাঁড়াল আর পরক্ষণেই মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। রাত্রির এহেন অবস্থা দেখে আদী ঘাবড়ে গেল। দূরত্ব কমিয়ে এনে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল,

—এই, এমন করে কাঁদছ কেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে আমাকে বলো।

রাত্রি কেঁদেই চলেছে। কান্নার ঢেউে ভাসতে গিয়ে সে কিছুই বলতে পারছে না। তবে তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কিছু বলার চেষ্টা করছে। আদীও রাত্রি মুখপানে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে কিছু শুনবে বলে।

—আ… আদী আ… আমার পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছে। আ… আমি এ… এবার ফেল করব।

এ বলে রাত্রি আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। আদী বিষয়টি বুঝতে পেরে রাত্রিকে নানাভাবে বোঝাতে শুরু করে দিলো।

—বোকা মেয়ে, ফেল কেন করবে? তুমি কি ফেল করার মতো ছাত্রী। আল্লাহর রহমতে সবসময়ই তুমি ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে এসেছ। তাহলে এসব ফেলের কথা আসছে কেন?

রাত্রি কান্না জড়ানো কণ্ঠে প্রতিবাদ করল,

—আমি পাশ নম্বর পর্যন্তও লিখতে পারিনি। তাহলে তুমি কীভাবে বলছ আমি ফেল করব না?

—অ্যা…

আদী হতভম্ব হয়ে গেল আর সেদিকে তাকিয়ে রাত্রির আরও কান্না পেল। হঠাৎ করেই রাত্রির বয়েস যেন কমে শিশুসুলভ আচরণ প্রকাশ পেল। সে আদীকে ফেলে এক ছুটে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। তবে দরজা বন্ধ করার আগে শুনতে পেল তার আম্মা আদীকে জিজ্ঞাসা করছে,

—রাত্রির কী হয়েছে? কান্নাকাটি করছে কেন?

আদীর জবাব রাত্রি শুনতে পায়নি কারণ সে অশ্রু ঝরাতে অতি ব্যস্ত।

প্রায় আধঘণ্টা পর রাত্রি নিজের রুমের দরজায় কীসব শব্দ শুনতে পেল। কান্না এখন কমে এলেও পুরোপুরি থামেনি, কিন্তু হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া শব্দে তার কান্না আচমকাই থেমে গেল। রাত্রি বালিশের ওপর উপুড় হয়েছিল। এখন শব্দের সন্ধানে সোজা হয়ে বসলো আর পরক্ষণেই খোলা দরজায় আদীকে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। কান্নায় ভারী হওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,

—এভাবে কারো ঘরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। তুমি এমন করে কেন আমার ঘরে ঢুকে পড়ো?

আদী দ্রুত রাত্রির পাশে বসে বলল,

—অন্য কারো ঘরে তো ঢুকি না। তাছাড়া ভেতর থেকে লক করে রেখেছ। ডুপ্লিকেট চাবির সুবাদে ঢুকতে পেরেছি। এখন তো তুমি জীবনেও দরজা খুলতে না।

—তুমি এখন যাও আদী। আমার কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না।

—রাত্রি, তুমি এমন করে থাকলে আমার কি ভালো লাগবে? উফ, কী যে কষ্ট হয়। মনে হয় যেন প্রেমিকা আমায় ছেড়ে পালিয়ে।

—আদী…

কিঞ্চিৎ রাগী কণ্ঠে রাত্রি আদীর নাম নিতেই আদী স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

—মজা নয়, সত্যি হৃদয় পোড়ে। একটু শান্ত হও। শান্ত হয়ে একটু ভেবে দেখো। আমার মনে হচ্ছে তুমি পাশ করবে। একটু নম্বর হিসাব করে দেখো না।

রাত্রি নিচু স্বরে জবাব দিলো,

—দেখেছি।

—দেখছ? কত নম্বর পর্যন্ত উত্তর করলে?

—পাশ নম্বর থেকে ১০ বেশি।

—দেখলে তো। আমি বলেছিলাম। শোনো, আল্লাহর রহমতে দেখবে পাশ করে গেছ। এখন বাধ্য মেয়ের মতো এগুলো খেয়ে নাও। মামী বলল তুমি না কি সকালেও খেয়ে যাওনি। এই নাও।

এ বলে আদী একটি প্যাকেট এগিয়ে দিলো। রাত্রি প্যাকেট দেখে বুঝতে পারল এতে কেক রয়েছে। রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—কেক কেন? আজ তো কারো জন্মদিন নয়।

—জন্মদিন হলেই কি লোকে কেক কাটে? তোমার মন খারাপ তাই কথা কম বলে এখন কেক কাটো শীগগির। আমার ক্ষিধা লেগেছে।

রাত্রি নাক টেনে হালকা হেসে বলল,

—তুমি বড়ো অদ্ভুত।

—তা জানি, কিন্তু তোমার মন খারাপ সত্যি নিতে পারি না।

এ বলেই আদী প্যাকেট থেকে কেক বের করে রাত্রির হাতে দিলো। কেকের ওপর কিছু লেখা আছে যা দেখে রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—এসব কী লেখা?

—কী করব বলো? তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা করে। তাই কেকের ওপর লিখে দিলাম যেন আমাকে একটি বিয়ে করিয়ে দাও।

রাত্রি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,

—এ আবার কেমন ইচ্ছা। তাছাড়া তুমি এখন বললে আমার মন খারাপ নিতে পারো না। আর এখন বলছ বিয়ে করতে ইচ্ছা করে? আমার কান্নার সাথে বিয়ে করার সম্পর্ক কী?

—I don’t know. But trust me. আমার না তোমার মতো একটি মেয়ে লাগবে; সত্যিই লাগবে।

রাত্রি চোখ নামিয়ে হাসছে নীরবে আর কেক কাটছে মনের সুখে। একটুখানি কেক হাতে নিয়ে আদীর দিকে বাড়িয়ে রাত্রি বলল,

—পরীক্ষা নিয়ে এখনো চিন্তা হচ্ছে। তবে কষ্ট কমে এসেছে। তোমার এসব বিটলামি আমাকে বড়ো হাসায়।

—আমার বিয়ে করতে চাওয়া তোমার বিটলামি মনে হচ্ছে? অদ্ভুত!

—আদী, আমি আজকে অনেক খুশি। আমার মন খারাপে কারো চিন্তা হয় দেখে বড়ো ভালো লাগছে। তাই আজকে যদি তোমার কিছু চাওয়ার থাকে আমার কাছে তবে তুমি চাইতে পারো আদী।

—তাই? এমন জম্পেশ অফার দিচ্ছ?

—হুঁ।

—পরে চাওয়া শুনে পালিয়ে যাবে না তো?

রাত্রি মৃদু হেসে গাঢ় গলায় বলল,

—আমার জীবন নিশ্চয়ই চাইবে না। অবশ্য চাইলেও আপত্তি নেই।

—সর্বনাশ! কী বলছ এসব? আজকে এত বড়ো অফার দেওয়া হচ্ছে আমাকে? আঃ! নিজেকে কেমন ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তাহলে চেয়ে ফেলি?

রাত্রি কেক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আদী রাত্রির মুখপানে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বলল,

—তোমার জীবন থেকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আমাকে দিবে? এ চব্বিশ ঘণ্টা আমি তোমাকে নিজের গার্লফ্রেন্ডের মতো খুব বেশি আগলে রাখতে চাই।

আদীর কথা শুনে রাত্রি অবাক হয়ে বলল,

—এ কেমন অদ্ভুত চাওয়া?

—রাত্রি, তোমাকে বললে তো তুমি বিশ্বাস করো না। কিন্তু তোমার মতো একটি মেয়ে পেলে আমি ধন্য হতাম। তা এখন যেহেতু তোমার ডুপ্লিকেট নেই। তাই একটি দিনের জন্য তোমাকেই গার্লফ্রেন্ড হিসাবে চাইছি। আমার এ সামান্য চাওয়াটি কি তুমি রাখবে না রাত্রি?

—আমার সব এলোমেলো লাগছে।

—এত ভেবো না। তোমাকে অসম্মান করব না। শুধু মন উজাড় করে একটি দিন গার্লফ্রেন্ড ভেবে নিজের সবটুকু তুলে দিতে চাই।

—ঠিক আছে। কোনো একসময় তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা দিয়ে দিবো।

হঠাৎ সিএনজি থেমে গেল আর রাত্রির ভাবনায় ছেদ পড়ল। কালকে রাতেই আদী মেসেজ করে সব জানিয়ে দিয়েছিল আর সে অনুযায়ী রাত্রি এসে হাজির হয়েছে।
(চলবে)#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৩
#খাদিজা_আক্তার

আদী বলেছিল সে দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে। আর তার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত্রি বাসায় বলেছে সে তার বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছে যার আম্মা দুই দিন আগে মারা গেছে। ঘটনা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। শর্মির আম্মা সত্যিই মারা গেছেন। তবে সেটি দুই দিন আগে নয়, পনেরো দিন আগে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আর শর্মিদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। ফলে অকালে শর্মির আম্মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।

এখন সকাল আটটা। বৃষ্টিস্নাত আকাশের দিকে এক পলক দেখে রাত্রি তাকাল আদীর দিকে। আদী গম্ভীর মুখে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে চলছে। ভেজা পথে দাঁড়িয়ে রাত্রি মনের মধ্যে উষ্ণ বেদনা অনুভব করল, কিন্তু এখন নির্বিকার হওয়া ছাড়া যে অন্য উপায় নেই।আদী শরীর নুইয়ে রাত্রির ব্যাগ হাতে নিলো। একটিবারও রাত্রির চোখে চোখ রাখল না। তার এমন আচরণ রাত্রির চোখে পড়লেও সে অন্য চিন্তায় এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

—এসো।

এ বলে আদী হাঁটতে শুরু করল আর তার পিছু পিছু হাঁটছে রাত্রি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে অথচ আদী তাকে ভিজিয়ে নিয়ে চলেছে। রাত্রী আজ থ্রিপিস পরে মুখ ঢেকেছে মাস্কের আড়ালে। মাথায় হিজাবও পরেছে, কিন্তু এ ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সব যেন ভিজে যাচ্ছে। এদিকে আদীও ভিজে ঝপঝপ হয়ে আছে। এমন বেখেয়ালি আচরণ কেন করছে আদী? এ চিন্তা মাথায় আসতেই রাত্রির পা কোনো এক শঙ্কায় ভারী হয়ে গেল। চলার পথে আদীর সাথে দূরত্ব বেড়ে গেল। যখন প্রায় থেমে দাঁড়িয়ে রইল, তখন আদী এসে এক হাত ধরে বলল,

—বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলো শীগগির।

এ বলে আদী টানতে টানতে রাত্রিকে নিয়ে একটি হসপিটালে ঢুকে পড়ল। কালকে রাতে যখন আদী বলেছিল, সকাল আটটায় অমুক হসপিটালে চলে আসবে। রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,

—এত সকালে হসপিটালে গিয়ে কী করব?

—No question. যখন যাবে, তখন দেখতেই পাবে। আর শর্ত অনুযায়ী তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা বা বারণ করতে পারবে না।

এরপর আর রাত্রি কোনো কথা বলেনি। এখনো চুপচাপ একটি ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছে। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পর একটি কেবিনের কাছে এসে আদী থামল। ডাকল,

—বুশরা?

নামটি শুনে রাত্রির মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। তড়াক করে সে সাদা চাদরের তলায় অবস্থান করা মেয়েটির দিকে তাকাল। কিন্তু তেমন করে চিনতে পারল না।

—বুশরা?

মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। ফলে দ্বিতীয়বার ডাকল আদী। এতেই কাজ হলো। মেয়েটি চোখ পিটপিট করে একবার রাত্রিকে দেখে নিলো। এরপর আদীর দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল,

—কখন এলে?

—এখনই। তোমার অবস্থা…

—আমার কথা বাদ দাও। লাস্ট স্টেজে আছি। তোমার কথা বলো।

—রাত্রিকে নিয়ে এসেছি। তুমি তো জানোই ওর সম্পর্কে। কিছু বলার থাকলে বলো।

মেয়েটি আদীর কথা শুনে একটু উঠে বসার চেষ্টা করল। রাত্রি এদিকে ভেবেই পাচ্ছে না এটি বুশরা না কি অন্য কেউ। এত কম সময়ে একটি মেয়ের চেহারা এভাবে খারাপ হয় কীভাবে? বুশরা হাত বাড়িয়ে রাত্রির একটি হাত ধরে কাছে টানল। বলল,

—খুব ভাগ্য না হলে আদীর মতো কাউকে জীবনে পাওয়া যায় না। আমিও ভাগ্যবতী ছিলাম। তবে ওকে বিয়ে করতে পারলে বেশি খুশি হতাম। আমি ওকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে মানা করে দিয়েছে। স্পষ্ট করে কী বলেছে জানো? রাত্রির মতো কাউকে না পেলে আমি বিয়ে করব না। এটি শুনে আমার এত রাগ হলো। আমি ভাবলাম হয়তো তোমাকে ভালোবাসে। তাই তো সেদিন তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম তোমাকে কথা শোনাতে। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পর জানতে পারলাম অনেক আগেই না কি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এরপরই আমার ভুল ভাঙল যে আদী তোমার মতো মেয়েকে ভালোবাসতে চায়, তোমাকে নয়। কিন্তু ভুল ভাঙলে গিয়ে হবে? আমার যে মরণব্যাধি হয়ে গেল।

এ বলে একটু যেন হাসতে চেষ্টা করল বুশরা। এ হাসিতে সুখ নেই তা রাত্রি বুঝতে পারছে। কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না।

—আমি জেনে না জেনে তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি। আমার কথায় দুঃখ পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিয়ো। বাঁচব না আর বেশি দিন। পাপ তো কম করিনি জীবনে। তোমার কাছে ক্ষমা পেলে মনে হয় একটুখানি পাপের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি।

*

সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে আর একাধিক বাতিতে ঝলমল করছে বাথরুম। এত নামীদামী বাথরুমে এর আগে কখনো ঢোকেনি রাত্রি। ফলে অবাকের সীমা নেই তার। বুশরার সাথে দেখা করার পর আদী সোজা তাকে নিয়ে এসেছে এক বিশাল অট্টালিকায়। এটি ভাড়া করা নয়, পরিচিত কারোর বাড়ি। কারণ এ বাড়ির চাবি আদীর কাছেই ছিল আর সে নিজে মেইম ফটক খুলে রাত্রিকে নিয়ে প্রবেশ করেছে। কৌতূহলে মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও রাত্রি চুপচাপ থেকে এসেছে।

সকাল ফুরিয়ে দিন বাড়ছে, কিন্তু বৃষ্টি কমার নাম নেই।শহরের এককোণে অবস্থিত এ বাড়িতে আসতে সিএনজি নিয়েছিল আদী। আর তাতেও বৃষ্টি উপেক্ষা করা যায়নি। ফলে ভিজে একসা হতে হয়েছে রাত্রিকে। অবশ্য বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই কাপড়ের প্যাকেট দিয়ে আদী বলেছিল,

—ভিজে গিয়েছ। এটি পরে নাও।

খয়েরী রঙের একখানা শাড়ি হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল রাত্রি আদীর পানে। আদী বুঝতে পেরে বলেছিল,

—আমি জানি তুমি শাড়ি অপছন্দ করো। কিন্তু আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে শাড়িতেই দেখতে চাই। Is it understand?

রাত্রি কোনো তর্ক করেনি। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর যে শাড়ি পরেনি। হুট করে শাড়ি পরার বিষয়টি তার কাছে অস্বস্তির লাগতেই পারে। আর এ অস্বস্তি নিয়ে রাত্রি চুপচাপ ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে এবং ভেজা গায়ের ঠাণ্ডায় সে বারবার কেঁপে ওঠল। তার কেবলই মনে হচ্ছে,

—তুমি কি নেশা করেছ? তোমার আচরণ আমার স্বাভাবিক ঠেকছে না আদী। আমি যেচে কোন বিপদ ডেকে আনলাম?

আচমকা বিদ্যুৎ চমকে ওঠল আর পরক্ষণেই রাত্রির চোখের তারায় সেই বিশ্রী রাতের দৃশ্য ফুটে ওঠল। খুব ঝড়বৃষ্টি সে রাতে। ঘরময় অন্ধকার ছড়িয়ে রাত্রি ফোন নিয়ে বসে ছিল। আনমনে একটি গানের সুরে বিভোর ছিল।

ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁইয়ো না…

এ গানে হারিয়ে গিয়ে রাত্রি মুগ্ধ হয়ে মেঘের গর্জনও শুনছিল। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠল। রিসিভ করে বলল,

—বলো।

—বলো মানে? এমন ভাব লইয়া আমার লগে কথা কও ক্যা? তোমার বাপেরটা খাই না পিন্দি?

—এমন করে কথা বলছ কেন? কল করলে বলে ভাবলাম হয়তো কিছু বলার জন্য কল করেছ।

—হ। বলমুই তো। আমি নেশা করছি।

এ কথা শুনে রাত্রি মন কেমন করে ওঠল, কিন্তু সে তার মনের ব্যাকুলতা গোপন করে ছোট্ট জবাব দিলো,

—ও

—ও মানে কী? বিশ্বাস হয় নাই?

—হয়েছে।

—হইলে তো হইব না। খাঁড়াও তোমারে ছবি দেই।

—লাগবে না।

এ বলতে গিয়ে রাত্রির গলার স্বর কেঁপে ওঠল।

—না লাগলেও দেখতে হইব। ইনবক্সে গিয়া দেহো ছবি দিছি। তুমি মনে হয় ভাবতাছ আমি সিগারেট খাইয়া নেশা করছি— এটা বুঝাইতাছি। আরে এ উস্টার নেশা আমি প্রত্যেক দিনই করি। আর সিগারেট খাইলে নেশা হয় না। নেশা করতে হয় অন্য চিজ দিয়া। তুমি ইনবক্সে দেহো।

—ইচ্ছে করছে।

এটি শুনে আদী গর্জে ওঠল,

—তোমার ইচ্ছে আমি উস্টা মারি। যেডা কইলাম, হেডা করো। এক কথা বারবার কইতে আমার ভাল্লাগে না।
(চলবে)আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here