#আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১
— আপনাদের বাসার ছাদটা একটু খুলে দেওয়া যাবে প্লিজ?
— কী ব্যাপার কে আপনি? আমাদের বাসার ছাদে আপনার কী কাজ?
— আসলে আমার পায়রা গুলো আপনাদের বাসার ছাঁদের উপরে গিয়ে বসেছে। অনেকক্ষন ধরে ডাকাডাকি করার পর ও আসছে না। আপনি একটু আপনাদের ছাদের চাবিটা যদি দিতেন তবে আমি একটু আমার পায়রা গুলোকে নিয়ে যেতে পারতাম।
আম্মা ঘুমে আমি পড়তে বসেছিলাম। হঠাৎ করে কলিংবেল বেজে উঠায় তাড়াতাড়ি করে এসে। গেট খুললেই দেখলাম, একটা টি শার্ট পড়া ছেলে দাঁড়িয়ে।
— কীরে মেহুল, কলিংবেলের আওয়াজ শুনলাম মনে হলো। কে এসেছে?
— একজন এসেছে কী যেন বলছে আম্মা। তুমি একটু দেখ তো।
— আচ্ছা, তুই যা আমি দেখছি।
এরপর আমি আমার রুমে গিয়ে আবার পড়তে বসলাম। হুট করে আম্মা আমার রুমে এসে আমাকে বললেন,
— এভাবে অপরিচিত কোনো ছেলে দেখলে কথা বলবি না মেহুল। দরকার হলে আমাকে ডাক দিবি।
আমি মাঝখানের কোনো ঘটনা না জেনেই আম্মাকে বললাম,
— আচ্ছা আম্মু।
— তুই পড়তে বস। আমি গেলাম তাহলে।
— আচ্ছা।
— আর খবরদার ঘরের দরজা লাগাবি না।
— জি আম্মু।
বিকালে আব্বা বাইরে থেকে আসলেন। আমি তখন পাশের রুমে বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম আম্মা আব্বাকে বলছেন,
–আজকে আমি দুপুরে ঘুমাচ্ছিলাম। পরে দেখি একটা ছেলে এসে ছাদের চাবি চাইছে।
— আমাদের বাসার ছাঁদের চাবি?
— হ্যাঁ।
— পরে?
— পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ছাদের চাবি দিয়ে কী করবে। পরে বললো আমাদের ছাদে না কি ওর পায়রা এসে বসেছে। এখন পায়রা গুলোকে নিতে এসেছে।
— ওহ, ছেলেটা কেমন দেখতে?
— লম্বা, টিশার্ট পরা ছিল।
— ওহ, এটা তো আরাফাত ভাইয়ের ছেলে। আমাদের বাসা বরাবর আরেকটা বাসা আছে না? ওই বাসার বাড়িওয়ালার ছেলে।
— ওহ, এতদিন তো দেখিনি। আজ হঠাৎ কোথা থেকে আসলো?
— ছেলেটা ঢাকার বাইরে থাকে। ওর বোনের কাছে থেকে পড়াশোনা করে। গতকাল ছেলেটা এখানে এসেছে। কতদিন না কি থাকবে বলল।
— ওহ,
এরপর আব্বা আবার অন্য প্রসঙ্গে কথা ঘুরিয়ে ফেললো আর আম্মা ও আব্বার কথা শুনতে লাগল। আমি এতক্ষন ধরে আব্বা আম্মার কথা আড়ি পেতে শুনছিলাম। কারন, আমার ও জানার খুব কৌতূহল আসলে ছেলেটা কে ছিল।
যেহেতু যা জানার তা জেনেই ফেলেছি সেহেতু আর ওই বিষয়টা নিয়ে বেশি ঘাটলাম না।
বিকালবেলা ছাদের গাছ গুলোতে পানি দিতে গিয়ে;দেখি আবার ওই ছেলেটা ছাদে বসা। পায়রা গুলো তাঁর পাশের খাঁচায় বন্দি। হঠাৎ ওই ছেলেটা পিছনে ফিরে তাকাতেই আমি আবার আমার মতো গাছে পানি দিতে শুরু করলাম। তাড়াতাড়ি গাছ গুলোতে পানি দিয়েই ছাঁদ থেকে নেমে পড়লাম। কারন আম্মা বা আব্বা কেউ যদি দেখে যে আমি ছাদে উঠেছি আবার; পাশের ছাদে ও একটা ছেলে বসে আছে। তাহলে আমাকে বোধহয় কখনো আর ছাঁদে যেতেই দেবে না। এই দিক থেকে আব্বা আম্মা দুজনেই খুব কড়া। কোনো বাইরের ছেলের সাথে ও আমার কথা বলা নিষেধ। বড় আপা যখন এই বাসায় ছিলেন তখন আপার জন্য ও একই রকম নিয়ম ছিল। এখন তো আবার আপার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর কোনো সমস্যা নেই। আমার তেমন বন্ধু -বান্ধবী ও নেই। যারা আছে তাদেরকেও আব্বা আম্মা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন। যদি ভালো পরিবারের মেয়ে হয় তবেই আমাকে তাঁর সাথে মিশতে দেওয়া হয়। নাহলে নয়।
সন্ধ্যা বেলায় বড় আপা ফোন দিলেন। ফোন দিয়েই নানা রকমের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। যেমনঃ পড়াশোনা করছিস তো ঠিকমত? পড়াশোনা কেমন চলছে? এইসব প্রশ্ন করা শেষই হয় না আপার। আপার সাথে যে মন খুলে দুটো কথা বলবো সেই সুযোগ ও নেই। আব্বা বলেছেন আপার সাথে শুধু প্রয়োজনীয় কথা বলতে। আপার এখন ঘর সংসার আছে। আমার মনের কথা শোনার জন্য আর বসে নেই আপা। আমিও মেনে নিয়েছি আব্বার কথা। বাড়িতে কোনো মেহমান আসলে তাঁর সাথে যেরকম কথা বলি। আপার সাথে ও সেভাবেই কথা বলি।
আপা যখন এখানে থাকতো তখন ও একই রকমই ছিল। আপার সাথে এজন্য বরাবরই আমার দুরত্বের সম্পর্ক। সত্যি বলতে আমার এমন কেউ নেই ও যার সাথে একটু মন প্রান খুলে কথা বলবো৷ আম্মা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন কাজকর্মে। আব্বা ও কাজের জন্য সারাদিন বাইরেই থাকেন। তেমন বন্ধু বান্ধব ও নেই আমার। একা একা নিজের মতোই থাকি আমি। তবে মাঝে মধ্যে মনের মধ্যে একটু খারাপ লাগা কাজ করে। মনে হয় আমার কেউ নেই। দু’টো কথা বলার মানুষ ও নেই। এমন না যে আমি কারো সাথে মিশতে পারি না। কিন্তু আমি মিশতে পারলে ও আব্বা আম্মা মিশতে দেন। কারো সাথে একটু বেশি কথা বললেই আম্মা বকা দিয়ে বলেন,
— এই মেহুলিকা তোর এত কথা কীসের ওর সাথে?
আমিও তখন না চাইতেও চুপ হয়ে যাই।
রাতে ঘুমানোর সময় জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, আমাদের পাশের বাসার ওই জানালাটা খোলা। আমি সব সময় এই জানালাটা বন্ধ থাকতেই দেখেছি। তাই আজ এই জানালাটা খোলা দেখে বেশ অবাক-ই হলাম। তারপর আস্তে করে জানালাটা অফ করে শুয়ে পড়লাম।
আমি এই জানালাটা খুলি সবার গোপনে। কারন আমার ঘরের জানালাও আমার অনুমতি ছাড়া খোলা নিষেধ। রাতে ঘুমানোর সময় ঘর ঠান্ডা করার জন্য জানালাটা একটু খোলা রাখি। তারপর আবার কিছুক্ষন পরে বন্ধ করে দেই। আমার ঘরের বারান্দাতে দাঁড়ালেই খুব সুন্দর রাস্তা দেখা যায়। মানুষজনের চলাফেরা, গাড়ি-ঘোড়া চলার আওয়াজ ও পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আম্মা আমাকে একা একা বারান্দায় ও যেতে দেন না।
সকালে আমাকে আব্বা ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলেন। আজকে যদিও আমার ক্লাস নেই। আব্বা কাজে বের হোন এই সময়ে। আমাদের বাসায় নিয়ম হলো আমাদেরকে ভোরেই ঘুম থেকে উঠতে হবে। আবার বেশি রাত ও জাগা যাবে না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলে না কি শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। এজন্য আমরা সবাই খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে যাই। আম্মা নাস্তা তৈরি করেন আমিও ওনাকে নাস্তা তৈরি করতে সাহায্য করি।
নাস্তা খাবার পর যখন আব্বা বাসা থেকে বেরিয়ে যান। আম্মা তখন ঘরের টুকিটাকি কাজ করেন। আমি তখন টিভি দেখি নয়তো পড়তে বসি।
আমি বরাবরই ভালো স্টুডেন্ট। সারাদিন পড়াশোনা করি বিধায় সবাই মনে করে আমি হয়তো পড়তে ভালোবাসি। কিন্তু সত্যি বলতে আমার পড়াশোনা করতে মোটেও ভালো লাগে না!কিন্তু পড়াশোনা করা, টিভিতে কার্টুন দেখা ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই পড়াশোনা করতে হয় আমাকে। মাঝে মধ্যে আমি বিরক্ত হয়ে যাই এই যান্ত্রিক জীবন নিয়ে। কিন্তু কিছু করার নেই আমাকে এভাবেই থাকতে হবে।
আমি আজকেও বিকালের দিকে আবার ছাদে গেলাম। আম্মা তখন ও ঘুম। আমি ছাঁদের গাছ গুলোতে যখন পানি দিচ্ছিলাম। তখন হুট করে কোনো কিছুর ডানা ঝাপটানোর শব্দ পেলাম। আমি ভয় পেয়ে পিছনে তাকাতেই দেখি, একটা পায়রা বসে আছে ছাঁদের এই কিনারাটাতে। আমি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে পায়রাটাকে হাত দিয়ে খপ করে ধরলাম। আমি কখনোই এরকম হাত দিয়ে পায়রা ধরিনি। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগলেও পরে অনেক ভালো লাগছিল পায়রাটাকে হাতে নিয়ে। হঠাৎ করে কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলো,
— ওকে কিছু করবেন না দয়া করে! ওই পায়রাটা আমার। প্লিজ ওকে কিছু করবেন না।
আমি চমকে পিছনে তাকিয়েই দেখি ওইপাশের ছাঁদে আগের দিনের ওই ছেলেটা। আমি এবার সরাসরি ওনার দিকে তাকাতেই আমাকে উদ্দেশ্য করে আবার বললেন,
— ওই পায়রাটা আমার। ওকে কিছু করবেন না প্লিজ।
আমি এবার এটা শুনে পায়রাটাকে উড়িয়ে দিলাম। পায়রাটা ওনার মালিকের সামনে গিয়ে বসলো। এবার উনি আমাকে উদ্দেশ্য করে আবার বললেন,
— ধন্যবাদ।
আমি আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম। খুব ভয় পাচ্ছিলাম যে আম্মা যদি টের পায়। যে আমি ওনাকে না বলে ছাঁদ উঠেছি। তাহলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় এসে আম্মার রুমে গিয়ে দেখি, আম্মা এখন ও ঘুম। আমি তখন হালকা করে একটা শান্তির নিশ্বাস ফেললাম।
চলবে….