#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_৪
#শামছুন্নাহার
ঈশাদের বাড়ি রসুলপুরেই। ওদের বাড়ি থেকে রসুলপুরের বড় মার্কেট কাছেই। পাঁচ টাকা গাড়িভাড়া, হেটে গেলে প্রায় বিশ মিনিট বা হাফ ঘণ্টা লাগবে। ঈশাদের পরিচিত একটা দোকান আছে,যেখান থেকে ওরা বেশির ভাগই মার্কেট করে। আর না হয় কুমিল্লা আড়ঙ্গ বা মার্কেটে চলে যায়। দোকানে এসে একটার পর একটা জামা দেখছে ওরা কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না।
মার্কেটে এসে মিহির সাথে ফরিনা বেগমের আরো সখ্যতা বেড়ে গেছে যেন! কথা বলতে বলতে ফরিনা বেগম এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন -“শুন মেয়ে তুই কিন্তু আমাদের ঈশার মতোই। আমি এত তুমি তুমি বলতে পারবোনা তোকে! আজকে থেকে আমি তুই তুকারি করেই ডাকবো, মাইন্ড করবি না তো?”
–“না আন্টি মাইন্ড করার কি আছে? তুই তো কাছের ভাষা’ই। আপনি আমার মায়ের মত,আপনার যা খুশি তাই ডাকুন আমি মাইন্ড করবো না।”
—” তাহলে আজ থেকে তুমিও আমাকে তুই করে বলবে মিহি আপু।” মুচকি হেসে ঈশা বললো।
মিহি হাসলো, কথা বলতে বলতে ওরা মার্কেটে পৌঁছালো। এটা ছিল মার্কেটে আসার সময়ের আলাপন। হঠাৎ মনে পড়ায় ভাবছিল মিহি। ভাবনার ছেদ পড়ে আন্টির ডাকে..
—” এ্যাই মিহি দেখতো এটা কেমন?”
—“ওইটা বিশ্রি দেখতে আম্মু।”
সবাই পিছন ফিরে তাকাতেই ওয়াসিফকে দেখা গেলো।এক হাত পকেটে রাখা আরেক হাতে চাবি ঘুরাচ্ছে,বাইকের চাবি। মিহি ও ফরিনা বেগম চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে,দুজনেই চমকালো যেন! ঈশা মিটিমিটি হাসছে কারন ওরা কোন মার্কেটে,কোন দোকানে আছে সব খবর ঈশাই মেসেজ করেছে। এর জন্য অবশ্য ফেরার পথে ঘুষ দিতে হবে ওয়াসিফ ঈশাকে। ওয়াসিফ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো- “এটা কার জন্য আম্মু? ”
–” আগে বল তুই এখানে?”
–“এদিকেই আসছিলাম,ঈশাকে মেসেজ করলাম ওর কিছু লাগবে কিনা… ওইই বললো লাগবে না কারন ও মার্কেটে আসছে তোমার সাথে। তাই আসলাম।”
ফরিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ওয়াসিফ একটু থেমে আবার শুধালো-” এভাবে তাকাচ্ছ কেন?ঈশার জন্য মার্কেটে নতুন এসেছি মনে হয়? ওর রুমের অর্ধেক টেডিবিয়ার আমার কেনা ভুলে গেলে নাকি?”
ছেলের কথায় মুচকি হাসলেন তিনি। ফের কাজে মনোযোগ দিলেন। মিহি চুপ করে ড্রেস দেখছে। কেউ যে তাকে আড়চোখে লক্ষ করছে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ড্রেস দেখাতে দেখাতে দোকানদার ক্লান্ত, ফরিনা বেগমও বিরক্তি বোধ করছেন। দোকান থেকে চলে যেতেই দোকানদার বললেন-” আপা লাস্ট একটা জামার ডিজাইন দেখে যান,তবে ওইটা এগুলোর থেকেও দামি হবে আরকি।” বলেই তিনি ভিতর থেকে একগাদা জামার বান্ডেল নিয়ে আসেন। একটা একটা করে দেখাতে লাগলেন।
ওয়াসিফের পছন্দ বরাবরই সুন্দর। ফরিনা বেগম মার্কেটে গেলে ওয়াসিফকে ছাড়া কখনওই যায় না। এই মুহূর্তে তিনি ক্লান্ত আর বিরক্ত। ওয়াসিফকে বললেন দুটু ড্রেস চয়েজ করতে। অবশেষে ওয়াসিফ দুইটা জামা পছন্দ করে মায়ের কানে ফিসফিস করলো- ” এই লালটা তোমার পূত্রবধূকে বেশ মানাবে,হিহি।”
ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন তিনি। মিহিকে উদ্দেশ্য করে বললো -“কোনটা নিবি বল?”
—” আপনি না বললেন ঈশা আর মিলি আপুর জন্য মার্কেট করবেন?”
মিহি মার্কেটে আসতে চাচ্ছিলোনা বলে ফরিনা বেগম মিথ্যা বলেছিলেন। কর্কশ কন্ঠে শুধালেন__
—” তোকে যা বললাম তার উত্তর দে। আচ্ছা বাদ দে আগে বল তোর পছন্দের রং কি?”
—” লাল আর সাদা।” মিনমিনিয়ে বললো মিহি।
মিহির উত্তর শুনে ছেলের দিকে তাকালেন তিনি।ওয়াসিফ যেন বিশ্বজয়ের হাসি দিলো। পরক্ষনেই ভাবলো- “আম্মু মিহিকে তুই করে বলছে?সকালেও তো তুমি ছিলো। যাকগে ঈশার থেকে জেনে নিব পরে।” ফরিনা বেগম মিহির দিকে তাকিয়ে বললো- ” নে এটা তোর,এটা আমার পক্ষ থেকে ঈশার”।
ঈশার জামা ঈশার হাতে ধরিয়া দিলেন ফরিনা বেগম।ঈশার মুখের হাসি দেখেই বুজা যাচ্ছে সে কতটা খুশি।উপহার পেলে সবাই একটু বেশিই খুশি হয়!দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন -” পছন্দ হওয়ার মত একটা ভালো শাড়ী পাওয়া যাবে তো নাকি?”
দোকানদার মুচকি হেসে শাড়ী দেখালেন। সবার পছন্দমত একটা লাল খয়েরী কালারের শাড়ী নেওয়া হল মিলির জন্য। ফর্সা গায়ের রঙে বেশ মানাবে তাকে।
মার্কেট করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মার্কেট থেকে বের হতেই ঘড়িতে দেখলো ৫:৫৫ বাজে। মাগরিবের আজান পড়তে আরো দশ মিনিট। এই সময়ে বাড়ি পৌঁছাতে পারবেন বলে ভারী নিঃশাস নিলেন ফরিনা বেগম। তৎক্ষণাৎ গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারা। ওয়াসিফ তার বাইক নিয়ে পরে আসবে বলেছে।
বাড়িতে পা রাখতেই মাগরিবের আজান শুনা গেলো।ফরিনা বেগম হাজার শুকরিয়া আদায় করলেন রবের দরবারে। তারও কারন আছে। কারন হল মাগরিবের পর ওই বড় মার্কেটে ছিনতাই, চুরি বেশি হয়। তাছাড়া যুবতী দুইটা মেয়ে ছিলো যদি কোনো বিপদ হয়?ওয়াসিফ এই এলাকার ছেলেও না যে সামলে নিবে।
ঈশা,মিহি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে ড্রয়িং রুমে আসল। মিলিসহ সবাই বসে আছে এখানে। মৃদুল গেছে বৌ ভাতের অনুষ্ঠানের সব ঠিক আছে কিনা দেখতে। সবাই বসে গল্প করছে। জবা এসে চা বিস্কিট দিয়ে গেছে। এমন সময় ওয়াসিফ আসল, হাতে লাল কালারের একটা টেডিবিয়ার। এগিয়ে এসে ঈশার হাতে দিয়ে চোখটিপ মেরে শুধালো- “থ্যাংকস বনু”।
ঈশা দাত কেলিয়ে হাসলো শুধু। গল্প করতে করতে একসময় ঈশার বিয়ের কথা উঠে। ঈশার মা বলেছে ইন্টার শেষ হোক তারপর দেখা যাবে। মায়ের কথায় ঈশা বেশ খুশি হলেন। তারপর মিহির বিয়ের কথা শুরু হয়। ফরিনা বেগম প্রশ্ন করলেন তার কেমন ছেলে পছন্দ? উত্তরে মিহি বললো বিদেশি ছেলে ছাড়া যেকোনো ছেলেই তার পছন্দ। মিহির কথায় সবাই হাসলো। ওয়াসিফ আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ক্ষানিকক্ষন পরেই মৃদুল আসলো। বাড়ির বড়রা রাতের খাবার আয়োজন করতে চলে গেছেন। ঈশা,মিহি,মিলি,মৃদুল,ওয়াসিফ,ইলমা আপু গল্প করছে এবার। মিহি ফেসবুকে নিউজফিড দেখছে। ওপাশ থেকে ফরিনা বেগম মিহিকে ডাকতেই টি টেবিলে মোবাইল রেখে ওনার কাছে গেলেন, ওর পিছু পিছু ঈশাও উঠে গেলো।
রাতে খাবারের পর সবাই ঘুমাতে চলে গেছেন। আজকে ঈশা ঈশার বোনের সাথে থাকবে। কারন ঈশার দুলাভাই আজকে বাড়িতে চলে গেছে জরুরী কাজে।ইলমার মেয়ে ঐশি ঈশার জন্য কান্না করছে তাই সে সেখানেই থাকবে। আগামীকাল অনুষ্ঠানে আসবেন ঈশার দুলাভাই আনোয়ার। ফরিনা বেগম এবং ফরিদা বেগম ফের দেখে গেছেন মিহিকে। একা ঘুমাতে ভয় বা কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? মিহি টেনশন করতে মানা করে তাদেরকেও ঘুমাতে বলে শুয়ে পরেছে।
রাত তখন চারটে বেজে সতেরো মিনিট। মিলি গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বের হল। মিলি বের হওয়ার সাথে সাথেই মৃদুল গেলো। ভেজা কাপরগুলো বারান্দার ধড়িটাতে দিয়ে ডেসিন্টেবিলের সামনে এসে দাড়ায় মিলি। মাথা থেকে তোয়ালেটা ছাড়িয়ে চুলগুলো একটু ঝেড়ে নিলো সে। একটু পরেই আজান শুনা যাবে,নামাজ পড়ে একবারে ঘুমাবে ভাবতেই মিলির কোমর পেছন থেকে জরিয়ে ধরেছে মৃদুল। ভাবনায় ছিলো বলে মৃদুল কখন বের হল টেরই পায়নি সে। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর আয়নার সামনে মিলিকে দেখে থমকে গিয়েছিল মৃদুল। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল মিলির দিকে। সাজগোজ ছাড়া , খোলা চুল কোমর অব্দি মিলিকে দেখে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না যেন! জড়িয়ে ধরে মিলির ঘাড়ে মুখ গুঁজলো মৃদুল।
মিলির ভীষন লজ্জা পাচ্ছে, ইচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পালিয়ে যাবেই কই? মৃদুল তার ঠোটের উষ্ণ ছোঁয়াতেই মিলির যেন হৃৎপিন্ড থমকে গেল। অজানা অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছে। মৃদুলের দিকে তাকাতে পারছে না পর্যন্ত! মৃদুল আয়নায় তাকালো এবার।মিলি চোখ বন্ধ করে আছে,ক্ষানিক
কাঁপছেও। মৃদুল মৃদু হাসলো। মিলির কাধে থুতুনি রেখে আয়নায় তাকিয়ে শুধালো – ” এখনো লজ্জা পাচ্ছো?”
—“আপনি লজ্জা দেন কেন?”
—“কই লজ্জা দিলাম? বউকে ভালবাসছি, আদর করছি এতেই যদি সে লজ্জা পায়,কাঁপাকাপি শুরু করে দেয় তাতে আমার কি দোষ বলো?”
মিলি চোখ খুললো, মুচকি হাসলোও,আবারও লজ্জা পেলো সে। মৃদুলের দিকে ঘুরে তাকালো সে। দুজনে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালো মৃদুলের প্রশস্ত বুকে। মৃদু হেসে হাতের বাধন শক্ত করল মৃদুলও। দূর থেকে আজানের সুর স্পষ্ট ভেসে আসছে যা শুনতে পেলো দুজনে।
ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করল মিহি। একা বলে আবারো শুয়ে পরলো সে। ঈশা রুমে থাকলে গল্প করা যেত। কখন যে চোখ লেগেছে বুঝতেই পারেনি।
মিহি ঘুমানোর মিনিট দশেক পরেই ঈশা রুমে আসে।মিহিকে ঘুমাতে দেখে পা টিপে টিপে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হল সে। ফজরের নামাজ পড়েই বই নিয়ে বারান্দায় চলে গেছে ঈশা। সপ্তাহখানেক পরেই ইন্টার বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা শুরু। ভাইয়ার বিয়ের উচিলায় ঠিকমতো পড়তে বসা হয় না। মিহি উঠে যাবে বলে বারান্দায় চলে এসেছে সে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে ওয়াসিফের। মায়ের হাতে চায়ের কাপ দেখে মুচকি হাসে সে। আড়মোড়া ভেঙ্গে চায়ে চুমুক দিলো ওয়াসিফ। এটা যেন আলাদা অনুভূতি তার কাছে। ছেলের মুখে হাসি দেখে স্মিত হাসলেন ফরিনা বেগম। আলাদা একটা ভাব নিয়ে মুচকি হেসে ওয়াসিফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন-“আজকে তো তোর জানের জিগার চলে যাচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে আর এ বাড়িতে পা রাখবে না। আটকাবি না?”