ইচ্ছেমতি পর্ব -২১+২২+২৩

#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_২১
#শামছুন্নাহার

মিহির বিয়েটা শেষমেশ হয়েই গেল । শশুড়বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত তখন দশটা। সেই সন্ধ্যার পর যে গাড়িতে উঠেছে সবে ঢাকাতে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নামিয়ে মিহির শাশুড়ি সায়লা বেগম মিহিকে বরণ করে ঘরে তুলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল মিহিকে ঘরে তুলার সাথে সাথেই তাদের নিজস্ব রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। যেটা বলা হয় বাসরঘর। ঘরটা গোলাপফুলে ভরা।চারদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে নিল মিহি। ফ্লোরেও গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখা,সাথে কয়েকটা বেলুনও। অবাক চাহনিতেও ফুলের মিষ্টি সুবাস তাকে ভীষণ টানছে, কারন সে যে ফুলপ্রেমী!
কিন্তু মনে মনে ভাবছে “এগুলো সাজালো কে?”

মিহির স্বামী রোমান আহমেদ ব্যাংকের চাকরি করে। পরিবারে সদস্য বলতে রোমান আর তার বাবা-মা। এক বাপের এক ছেলে রোমান। ছোটবেলা থেকেই শহরে থাকে তারা। মিহির শশুর সুলতান আহমেদ একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ম্যানাজার। ঢাকাতে তারা যে বাসাটায় থাকে ওটা তাদের নিজেদেরই। এক ফ্লাট রেখে বাকিগুলো সব ভাড়া দেওয়া। বড়লোকের বিরাট কারবার বলা যায়।
_

অফিস থেকে এসেই মোবাইলটা চার্জে দিয়ে তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ফ্রেশ হতে যায় ওয়াসিফ। মিনিট পাঁচেক পর বেরও হয়ে আসে। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মায়ের সাথে দুষ্টুমি করে রুমে আসে। ততক্ষণে মোবাইল দিব্যি চার্জ হয়ে গেছে। মোবাইলটা অন করতেই মেসেজ আসা শুরু। ঈশা কল করেছিল তার মেসেজ। সিন করে দেখল বায়ান্নটা কল। এতগুলো কল দেওয়াতে অনেকটা অবাক হল ওয়াসিফ। তৎক্ষণাৎ ঈশাকে কল বেক করে খাটে বসে ওয়াসিফ।লাউডস্পিকার দিয়ে মোবাইলটা খাটে রেখে আপেল খাচ্ছিল ওয়াসিফ। একটার পর আরেকটা কল দিতেই ঈশা ফোন ধরে। ততক্ষণে আপেল খাওয়াও শেষ। ফোন ধরার সাথে সাথেই ওয়াসিফ মোবাইলটা কানে তুলে নেয়।
–“হ্যা ঢুবলি কল করেছিলি?”
———–
–“হ্যালো!…
কিরে কথা বলছিস না কেন?”
ওয়াসিফের কন্ঠ শুনে ঈশা শব্দ করে কেঁদে দিল।হাউমাউ করে কাঁদার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ওয়াসিফ। সে ফের বলে–“কি হয়েছে বল? হাসান কিছু বলেছে? গায়ে হাত তো….’
–“আমি বাড়িতে ভাইয়া,মিহি আপুদের বাড়িতে। ”
–“হ্যা তো কাঁদছিস কেন? প্র্যাংক করছিস নাকি?”
–“ভাইয়া… মিহি আপুর বিয়ে হয়ে গেছে(বলেই আরও জোড়েসুড়ে কাঁদতে লাগলো ঈশা)
–“হ্যা তো কি হয়ে…… What?”
আনমনে তো কি হয়েছে বলতে গেলেও ঈশার বলা কথাটা হঠাৎ বুঝতে পেরে ওয়াসিফ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আশ্চর্য হয়ে উচ্চস্বরে ‘what?’ বলে দু’পা পিছিয়ে যায়।
–“হ্যা ভাইয়া এটাই সত্যি। তোমাকে কত কল করেছি ধরোনি। দেখতে এসেই হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল(আবার কান্না করে তারপর একটু থেমে) একটু আগে কল করেছে তারা ঢাকা পৌছে গেছে। এমন করলে কেন তুমি? আমি চেয়েছিলাম মিষ্টি আপু যেন তোমার বউ হয়,কেন কল ধরলে না ভাইয়া…. তোমার জন্য আজকে মিষ্টি আপু অনেক কান্না করছে জানো?”
বলেই ঈশা কান্না শুরু করে দিল আবার। ওয়াসিফ তখন নির্জীব,নির্বাক। মনে হচ্ছে আসমান ভেঙ্গে তার মাথার উপর এসে পড়েছে। মিহির বিয়ের কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারছেনা সে। ঈশার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কলটা কেটে দিল ওয়াসিফ। নিশ্বাসটা গলায় এসে যেন আটকে যাচ্ছে। বুকের বা পাশের ধুকপুকানি যেন থেমে থেমে উঠানামা করছে। সেখানে চিনচিনে একটা ব্যাথাও হচ্ছে। এ ব্যাথাটা একদম সহ্য করতে পারছে না ওয়াসিফ। অতি কষ্টে শুকনো গলাটা ঠোঁটের লালা দিয়ে ভিজিয়ে নিল সে। ঢোক গিলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। চোয়াল শক্ত করে বলে–” এটা হতে পারে না,কিছুতেই না। আমি ছাড়া তুমি কারও হতে পারো না ইচ্ছেমতি। কারও নয়!”
বলেই হাতের মোবাইলটা স্বজোরে ফেলে চিৎকার দিয়ে খাটের ওপরে ধব করে বসে পড়লো সে। টাইলসের ফ্লোরে পরে যন্ত্রটা স্বজোরে শব্দ হল, ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল মোবাইলটা। সে শব্দ শুনে ফরিনা বেগম দৌড়ে আসেন। ওয়াসিফের কাছে এসে উৎকৃষ্ট কন্ঠে শুধালো –“কি হয়েছে বাবা?”
মাকে কাছে পেয়ে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে দিল।

ছেলেরা বুঝি কাঁদে? হ্যা কাঁদে। অতিকষ্ট পেলে তারাও শব্দ করে কাঁদে। তবে তাদের হাসিটা প্রকাশিত হলেও কান্নটুকু ব্যক্তিগত।

ওয়াসিফের চোখে পানি দেখে ফরিনা বেগম কি করবেন বুঝতে পারছেন না। চেহারায় কান্না সংবরণ করে শুধালো –” কি হয়েছে খোকা কিছু তো বল!”
মাকে জড়িয়ে ধরে ওয়াসিফ বলে–“আমার ইচ্ছেমতির বিয়ে গেছে মা। সে আর আমার হল না।”
–“কার কথা বলছিস মিহির? মিহির বিয়ে হয়ে গেছে?”
ওয়াসিফের কথা শুনে ফরিনা বেগমও বিস্ময়ে আঁচলে মুখ চেপে ধরেন। তিনিও নির্বাক হয়ে গেলেন। মিনিট দুয়েক পরে বলেন–“তোর না মিহির সাথে কথা হয়না? খবর পেলি কই?”
–“ঢুবলি কল করেছিল। ”

সেই কখন থেকে মেয়েটা একা বসে আছে। থেমে থেমে কান্না করছে মিহি। মানুষের সব ইচ্ছে,শখ,আহ্লাদ, সপ্ন পূরন হয়না। হতে নেই। ওয়াসিফ কি এখনও শুনেনি আমার বিয়ের কথা? নিয়তি সত্যিই আমাদের এক হতে দিল না ওয়াসিফ। আমাকে ক্ষমা করবেন। যেই আপনাকে আমি পছন্দই করতাম না,ইগনোর করতাম সবসময়। তার কথা,তার করা আচরণগুলো ভাবতে ভাবতে তাকে ভালোই বেসে ফেললাম। এ ভালোবাসা এক অপ্রকাশিত ভালোবাসা! কথাগুলো মিহির মাথায় কিলবিল করে ঘুরতে থাকে। ভাবতে ভাবতে চোখ বেয়ে পড়ে নোনাজল। একটু পরেই দরজা খুলার শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি করে চোখেরজলটুকু মুছে দরজার দিকে তাকায় সে। রোমান এসেছে। হাতে একটা প্লেট। মিহির দিকে তাকিয়ে মুচকিহেসে দরজাটা লক করে দিল ভিতর থেকে। মিহিকে ভয় ও অসস্তি ঘিরে ধরেছে।হাত-পা ক্রমশ কাঁপাকাপি করতে শুরু করলো। রোমান এসে মিহির সামনে প্লেট ধরে বললো–“নিশ্চয়ই খিদে লেগেছে? খেয়ে নাও। ভয় নেই, রিলাক্স।”
বললেই হল? অচেনা মানুষ কাছে থাকলে এত সহজেই রিলাক্স হওয়া যায়? মিহি চোখ সরিয়ে নিল। শাড়ীর আঁচল চেপে ধরে নিজেকে ধারস্থ করতে চাইলো। কিন্তু কোনোমতেই সম্ভব হচ্ছে না। বারবার ওয়াসিফের মুখশ্রীটা সামনে ভাসছে।
–“আমার সামনে খাবে না? বললাম তো রিলাক্স! ”
নরম গলায় রোমান ফের শুধালো। কিন্তু মিহির গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। পুরো রাস্তায় কেঁদেছে মেয়েটা। এখন মাথায় ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। আস্তে করে শুধালো –“খাবো না। আমার খিদে নেই।”
–“আমি খাইয়ে দেই?”
নিষ্সংকোচ আবদার। কিন্তু মিহির ভাল্লাগলোনা। ঝাঁঝালো কন্ঠে শুধালো –“বললাম তো খাবো না। জোড় করছেন কেন?”

রোমান কিছু বললো না। বুঝে নিল মেয়েটার মন খারাপ। তাকে দেখে হয়তো অসস্তি হচ্ছে তাই এমন করছে। সে উঠে বারান্দায় চলে গেল। এদিকে মিহি পেটে খিদে থাকলেও না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত তখন তিনটা ছুঁইছুঁই। বারান্দায় বসে আছে রোমান। ঘুম নেই চোখে। মেয়েটাকে বিয়ে করে তার জীবনটাকে নষ্ট করে দিলাম। কয়দিন আর বাঁচবো আমি? অথচ তাকে নিষঙ্গ করে দিতে প্রস্তুত হতে হবে। আকাশের তারারা আমাকে ডাকতে আসে রোজ। মা বাবাকে বুঝানোর পরও বুঝলো না। মিহিকে সবটা জানাতে হবে আমার! ভেবেই ভেতর থেকে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে রোমান। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দর্শন করছে সে।

প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে বাহিরে। বর্ষার সময় এই এক কান্ড। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। কখনও বড় বড় ফোঁটায়,তবে ধীরেধীরে। কখনও হুড়মুড় করে। কখনও পড়ে ঝিরঝির করে, খুব হালকা। এ ধরনের বৃষ্টির অবশ্য একটা নাম আছে। ছোট বেলায় বইয়ে পড়েছিলাম। নাম হল ইলশেগুঁড়ি। আর বড় বড় ফোঁটায় প্রচুর বৃষ্টির নাম মুষলধারে বৃষ্টি। কখনও আবার পড়ে ঝমঝম বৃষ্টি।

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা শীতলতর বাতাসও বইছে। ঘাঁ শিরশির করে উঠতেই মিহির কথা মনে পড়লো রোমানের। দ্রুত রুমে গেল সে। মিহির গায়ে একটা কাথা জড়িয়ে দিল। তারপর রুমের একপাশে থাকা সোফায় শুয়ে পড়লো নিজেও।

মিহিকে নিজের করে না পাওয়ার আফসোস ওয়াসিফকে দিনেদিনে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মিহির বিয়ের আজ বিশদিন। মেয়েটার বিয়ের পরদিন থেকে যে ওয়াসিফের খানাদানা বন্ধ হয়েছে তা না বললেই নয়। সেদিনের পর থেকে অফিসে যায় না ওয়াসিফ। ছেলের পাশাপাশি মাও কান্না করে অনবরত। ফরিনা বেগমের কান্না অবশ্য মিহির বিয়ে হয়ে যাওয়ার জন্য নয় বরং নিজের ছেলের জন্য। ছেলেটা সপ্তাহখানেক ধরে হসপিটাল ভর্তি। সুদর্শন ছেলেটার চেহারা হয়ে গেছে জীর্ণশীর্ণ। শুকিয়ে গেছে একদম। অফিসের কলিকরা, বস সবাই দেখে গেছে একদিন। দুইতিন হয়ে যাচ্ছে ওয়াসিফ অফিসে না যাওয়াতে অফিসের বস কল করে খোঁজখবর জানতে চায়। কিন্তু বরাবরের মতোই ওয়াসিফের নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। শেষে ফরিনা বেগমের কাছে কল করলে জানতে পারে ওয়াসিফ অসুস্থ। এর দুদিন পরেই তাকে হসপিটালে এডমিট করানো হয়। সবার একি প্রশ্ন হঠাৎ কি এমন হল তার যে একরাতেই এরকম অবস্থা? ফরিনা বেগম তো আর মুখ ফুটে বলে না ছেলের না পাওয়া বেদনার্তের কথা।

____________
চলবে…..#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_২২
#শামছুন্নাহার

দীর্ঘ বাইশ দিন পর হসপিটাল থেকে ওয়াসিফকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। ছেলেটা মেয়েটার জন্য প্রায় আধপাগল হয়ে গেছিল। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল সে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ওয়াসিফ এখন সুস্থ। পুরোপুরিভাবে নয় তবে অনেকটা।

মিহি তার জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। অন্য মেয়েদের মতোই স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করছে সে। বাহিরে সবার সাথে ভালো আচারণ করলেও ভিতরে সে অসহায়ত্বের এক জলজন্তু আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ভিতরকার অবস্থা কাউকে না পারছে বলতে আর না পারছে সইতে। বলেই বা কি হবে! এখন যে তার বিয়ে হয়ে গেছে। তবে বিবাহিত জীবন তার সুখীই বটে যদি সে মন থেকে মানে। রোমানের বাবা-মা যেমন ভালো তার চেয়ে অধিক ভালো রোমান। মিহিকে সে বুজতে চেষ্টা করে। তবে দিনশেষে রোমান ব্যর্থ কারন মিহির মনে ওয়াসিফের জন্য জ্বলে যাওয়া অবস্থা তাকে বলেনি।তাই সেও অতটা বুঝতে পারেনি।
মিহি আগে থেকেই রুটিন অনুযায়ী চলতে পছন্দ করে।বিয়ের পর থেকে এপর্যন্ত কলেজ যাওয়া হয়নি তার।তবে দেড়মাসে দু’বার কুমিল্লাতে এসেছিল। বাবার বাড়িতে বেড়াতে। নতুন জীবনের পাশাপাশি রুটিনও নতুন হয়েছে তার। সকাল সাতটায় রোমান ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু মিহির তো আগেরকারই অভ্যাস সকালে না ঘুমানোর। তাই সে সকালে সবার জন্য নাস্তা,চা তৈরি করে। তারপর শশুড়-শাশুড়িকে নাস্তা দেয়। রোমান উঠলে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে অফিস চলে যায়। ব্যাস, এরপর মিহি একদম ফ্রি থাকে এগারোটা পর্যন্ত। তারপর রান্না করে,গোছল, নামজ। তারপর আবার অবসর। বিকেলে বা সন্ধ্যায় নাস্তা বানায়। এরপর রোমান অফিস থেকে আসে এবং বাকি সময়টা মিহি তার সাথেই সময় কাটায়। এভাবেই এতটা দিন চলে এসেছে।

–“ওয়াসিফ বাবা খাঁ না! দেখ এমন করলে কিন্তু তুই আবার অসুস্থ হয়ে যাবি।”
–“আমাকে একা থাকতে দাও মা। আমার ভালো লাগছে না।”
–” একাই তো থাকিস সারাদিন। আমাকে আসতে দিস? যা হবার হয়ে গেছে তা নিয়ে পরে থাকলে চলবে? তোর ভবিষৎ নেই? মিহির জন্য তুই কেন কষ্ট পাবি বল আমাকে?”
–” আব্বু এখনও আসেনি আম্মু। আসতে আসতে এ মাসের শেষে। অথচ দেখো আব্বুকে বলবে বলবে বলে বললে না। (একটা বড় করে নিশ্বাস ফেলে) আমার জীবনটা অন্যরকমও হতে পারতো!
–“আমি তো বুঝতে পারি নাই খোকা। আমাকে মাফ করে দে!”
বলে ফরিনা বেগম কেঁদে দিলেই। ওয়াসিফ তখন একগালে হাসে। এ হাসি দুষ্টু হাসি কিংবা খুশিতে নয় বরং কষ্ট যন্ত্রনাদায়ক হাসি। ফরিনা বেগম আচঁল দিয়ে মুখটা মুছে ওয়াসিফের গালে হাত রেখে বলে
–” কলি আসার কথা। তোর সাথে দুপুরে খাবে বললো।এখনও আসছে না কেন?”
এমন সময় কলিংবেলের শব্দ হল। ফরিনা বেগম দ্রুত উঠে গেলের দরজা খুলতে।
কলি হচ্ছে ওয়াসিফের অফিসের কলিক। বেস্টফ্রেন্ডও। সেই স্কুল থেকে দুজন একসাথে। এখন একি অফিসে জবও করে। মিহির ব্যাপারটা সে জানে।ওয়াসিফ বলেছিলো তাকে। শুধু তাই নয় ওয়াসিফের এ টু জেড সব কলি জানে এবং কলির সব ওয়াসিফ জানে। হসপিটাল থেকে বাড়িতে আসার পর ওয়াসিফ ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করে না, রাতে কম ঘুমায়, বেশিরভাগ সময় আনমনা হয়ে থাকে। ফরিনা বেগম ছেলের এসব কাজ নিজের চোখে দেখে সহ্য করতে পারছেন না। তাই কলিকে খবর দিয়েছেন যেন ওর উছিলায় হলেও ওয়াসিফ কিছু মুখে তুলে।

খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ওয়াসিফ। কলি দরজা খুলে ভিতরে আসে।
–” কি ব্রো কেমন আছো?”(কলি)
ওয়াসিফ কলির দিকে তাকায়। কলির তখন বন্ধুর জন্য কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। শুকনো সাদামাঠা মুখ ওয়াসিফকে সে চিনতেই পারছেনা। আগের সেই স্মার্ট, সুদর্শন ছেলেটার চেহারা আর চেহারা নেই। চোখ দুটো মূহুর্তেই ঝাপসা হয়ে গেল কলির। ঘাড় ঘুড়িয়ে চোখ দুটো মুছে ওয়াসিফের পাশে এসে বসলো। ওয়াসিফকে হাসানোর জন্য নানা কথা বলে যাচ্ছে অথচ ওয়াসিফের মুখে বিন্দুমাত্র হাসি নেই।
–” আচ্ছা বল অফিস যাবি কবে?”
–“তুই কি আমার মাথা খেতে এসেছিস কলি?
–“না তোর সাথে lunch করতে এসেছি। so let’s go bro.. দুজন একসাথে খাবো।”
–“কলি যা এখান থেকে। আমি খাবো না।”
–“অনশন করলে তোর এক তরফা প্রেমিকা ফিরে আসবে?”
–” এক তরফা না কলি,আমার ইচ্ছেমতিও আমাকে ভালোবাসে ।”
–“কিভাবে বুঝলি তুই, ও তোকে কোনোদিন বলছে?”
–“না। আমি ওর চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। নাহয় এত অপমানের পরও ওর পিছু নিতাম বল?”
–” এসব ছাড় ওয়াসিফ ও তোর জন্য থেমে নেই।”
–” এটাতো বললি না ও যে আমাকে ছাড়া ভালো নেই!”
–” দোস্ত এটা মায়া। দেখ,আমরা ভালোবেসে মায়া তৈরী করি আর মায়া কাটাই কষ্টে।”
— “আমি বাচ্চা নই কলি তুই আমাকে বুঝাতে আসিস না।”
–“তোকে আমি বুঝাতে আসিনি দোস্ত। আচ্ছা শুন,তুইই বল ভালোবাসা কখনও চেষ্টা করে হয়? হয় না তো! ভালোবাসতে গেলে অন্তরের গভীরতা প্রয়োজন। বুঝতে হয় অনুভূতি হৃদয় দিয়ে। ভালোবাসা খুব কঠিন দোস্ত যা সহজে বাসা যায় না!”
–” আমি জানি সে আমাকে ভালোবাসে। এটা আমার বিশ্বাস নয় বরং আত্মবিশ্বাস। ”

ওয়াসিফকে বুঝাতে কলি অক্ষম হল। দুপুরের খাবারটা মেয়েটা একাই করে গেল।
ছেলে খায়না বলে নিজের গলা দিয়েও খাবার নামছে না ফরিনা বেগমের। ছেলেটা দিনদিন আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। চোখের সামনে ছেলের এই অবস্থা দেখে ফরিনা বেগম যেন চুপ থাকতে পারলেন না। পারলেন না বসে থাকতেও। বাধ্য হয়ে নিজে থেকেই মিহিকে কল করলেন তিনি।

সকাল নয়’টা বাইশ মিনিট। মিহির কোনো কাজ নেই বলে সোফায় বসে ফোন ঘাঁটতেছিল। ওর আগের ফোনটাই এখন ইউজ করে। তবে রোমান নতুন সিম কিনে দেওয়ায় সেটাই চালায়। হঠাৎ আননোন নাম্বারে কল আসায় ভ্রু কুঁচকালো সে। কারন এ নাম্বারটা ঈশা পর্যন্ত জানে না। কিছু না ভেবেই কলটা রিসিভ করে কানে তুলে–“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”
ফোন ধরেই ফরিনা বেগম কান্নাস্বরে বলেন–“কেমন আছিস মিহি,আমি ফরিনা। তোর ফরিনা আন্টি। ”
–” ওহ আচ্ছা আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন আন্টি ? ”
–“ভালোই আছিস তাই না? আমার ছেলেটাকে মেরে তুই শান্তিতে সংসার করসিস…হেরে… কিভাবে পারলি আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলতে?”
একমূহুর্তের জন্য মিহি যেন থমকালো। ভরকে গেল খুব। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না তার। ওয়াসিফের নাম শুনে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল তার। কান্নটুকু গিলে শুধালো–“ওয়াসিফ মারা….
–“হ্যা মরে গেছে। জীবিত থেকেও মরা। জীবন্ত লাশ বানিয়ে ফেলেছিস খোকাকে!”

মিহি মনে করেছিল ওয়াসিফ বোধহয় সত্যিই মারা গেছে। ফরিনা বেগম পরেরবার বলাতে বুঝতে পারলো ছেলেটা মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার কি দোষ? সবকিছু হঠাৎ করেই হয়ে গেল। আমি নিজেই তো প্রস্তুত ছিলাম না। কতবার কল দিয়েছি ওয়াসিফকে সে তো কল ধরেনি আন্টি। তবে আমার অন্যায়টা কোথায়? মনেমনে আওড়ালো মিহি।ফরিনা বেগমের কথায় সে চুপ করে ছিল। শুনছিল ওনি আর কি কি বলে। মিহি চুপ বলে ফরিনা বেগম ফের বলে
–“কিরে কথা বলিস না ক্যান? জানিস, তোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেরদিন থেকে ছেলেটা হসপিটালে ভর্তি ছিল। গত সপ্তাহখানেক আগে মাত্র বাসায় এনেছি । বাসায় আসার পর থেকে আবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিছে। একলা অন্ধকার রুমে সারাদিন পড়ে থাকে ছেলেটা।”

একটু থেমে বলে
–“আমার ছেলেটাকে বাঁচা মিহি। ওরে আর মারিস না।একটু কথা বল ওয়াসিফের সাথে। দেখ ছেলেটাকে কিছু খাওয়াতে পারিস কিনা। দেখ না মিহি… মা’রে তোর কাছে আমার অনুরোধ। হাত জোড় করে বলতেছি একটু কথা বল প্লিজ!”
বলেই তিনি কেঁদে দিলেন। ফোনের ওপাশে মিহিও শব্দ করে কেঁদে দিল। কেঁদেই বললো –“আমি কথা বলতে চাই আন্টি। দয়া করে একটু ফোনটা দিবেন ওনার কাছে?”

ফরিনা বেগমের চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করছে।তিনি দৌড়ে ওয়াসিফের রুমে যান। দরজায় নক করে ভিতরে গিয়ে লাইট অন করেন। ছেলের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরমস্বরে বললেন–“নে কথা বল।”
–“মাথা গরম করিও না আম্মু এখান থেকে যাও আর কলিকে বলো যেন আর কল না করে।”
–“এটা কলি না ওয়াসিফ কথা বলে দেখ।”
–“কে?”
–“মিহি। নে ধর। আমি রান্নাঘরে গেলাম।”

বলেই তিনি বেড়িয়ে গেলেন। বাহির থেকে ছিটকিনি দিয়ে নিচে চলে গেলেন।
ওয়াসিফ ফোন ধরতেই মিহি সালাম দিল। ওয়াসিফ ফিচেল হেসে বললো–“কেমন আছেন মিহি?”
আপনি করে বলাতে মিহি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।নিজেকে সামলিয়ে বলে–“ভালো। কি করছেন?”
–“জিজ্ঞেস করবেন না কেমন আছি?”
–“না। আমি জানি আপনি ভালো নেই। নাস্তা করেছেন সকালে?
–“না। খিদে নেই।”
–” এমন করছেন কেন আপনি? আপনার জন্য আন্টি কতটা কষ্ট পাচ্ছে জানেন,বোঝেন?”

ওয়াসিফ নিশ্চুপ। মিহি ফের বলে
–“আমি কলে আছি আপনি এখন নাস্তা করবেন। ঠিক আছে?”
–“না। খাবো না।”
–“আন্টিকে ডাকুন। বলুন আপনাকে খাইয়ে দিতে।”
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি মিহি। তোমাকেই ভালোবাসি।”
বলে ওয়াসিফ শব্দ করে কেঁদে দিল। ওদিকে মিহিরও চোখ ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সে কাঁদছে শব্দহীনভাবে। অনেকদিন পর ওয়াসিফের মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শুনে মিহির হৃদপিন্ড যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

চলবে…..
_____________#ইচ্ছেমতি
#পর্ব_২৩
#শামছুন্নাহার

আপনি যাকে খুব বেশিই ভালোবাসবেন তার কাছে আপনাকে হার মানতেই হবে। অন্তত সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও আপনি তার কথা শুনতে হবে। পাগল ওয়াসিফ খাবেনা খাবেনা বলেও মিহিকে ফোনে রেখেই বাধ্য ছেলের মতো সকালের খাবারটা খেয়ে নিল। ফরিনা বেগমের মুখে সেকি হাসি!খুশি ও আনন্দের হাসি।

মিহি প্রতিদিন ওয়াসিফকে সকালে অবসর সময়ে কল দেয়। কথা বলে। তারপর সারাদিনে আর কথা হয় না।পরের সংসার করে সে। যদি রোমান জেনে যায়? রোমানকে সে কষ্ট দিতে চায় না। স্বামীরুপে সে খুব ভালো একজন মানুষ। চায়না তার জন্য ওয়াসিফকেও ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যেতে দিতে। আচ্ছা এটা কি একধরনের পরকিয়া? হলে হোক। এই পরকিয়ায় যদি কেউ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে,পূর্বের সুন্দর জীবন ফিরে পায়,তাকে বাঁচানো যায় তবে সমস্যা কি? চলুক না সেটা সে পুরোপুরিভাবে সুস্থ হওয়ার আগ অব্দি! রান্না করতে করতে মিহি ভাবছিল। তারপর টুকটাক কাজগুলো শেষ করে ফ্রি সময়ে আবার কল দিয়ে জেনে নেয় ওয়াসিফ দুপুরে খেয়েছে কিনা। সাথে এটাও বলে দেয় রাতে যেন নিজ দায়িত্বে খেয়ে নেয়।রাতে সে কল করতে পারবে না। এভাবে দুইতিন চলে যায়। যেদিন শুক্রবার ও শনিবার আসে মিহি সেদিন কল দেয়না। ওয়াসিফ আগের থেকে কিছুটা সুস্থ। সে চায়না তার জন্য মিহির কোনো ক্ষতি হোক। তবে আশায় ও অপেক্ষায় থাকে তার ইচ্ছেমতি কখন কল করবে।

মিহি এখন হোয়াট’স এ্যাপে ওয়াসিফের সাথে মাঝেমধ্যে ভিডিও কলেও কথা বলে। রবিবার যখন কল করল ছেলেটা যেন মোবাইল হাতে নিয়ে আগেই অপেক্ষা করছিল। দুজনে সালাম বিনিময় করে কথা বলা শুরু করে।
–“খেয়েছেন? “(মিহি)
–“হু। তুমি? “(ওয়াসিফ)
–” খাইছি। আপনি তো এখন সুস্থ আমি আর কল করবো না। সবকিছু নিজের মতো গুছিয়ে নিবেন,ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করবেন,নিজের যত্ন নিবেন। ঠিক আছে?”
–“কল না দিলে মরে যাবো কিন্তু। ফিরে এসো তুমি। তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন মিহি।

নাম ধরে ডাকাতে মিহি একগালে হাসলো। বললো

–” আগে তো এই নামে খুব কম ডাকতেন। আর এখন… (একটু থেমে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ফিচেল হেসে বলে)
অনেকদিন পর,অনেককিছু বদলায়। যেমন-ডাকনাম,পরিচয়, সম্পর্ক, অধিকার। তাই না?”
–” If you put your head on my shoulder,promise i’m not gonna move mihi. please cameback…
–“সেটা সম্ভব নয় ওয়াসিফ। আমি রোমানকে ছাড়তে পারবো না। রোমান খুব ভালো।
–“তুমি আমাকে ভালোবাসোনি এটা মন মানতে চায় না ইচ্ছেমতি ”
–“যাকে অন্যের পাশে দেখতে কষ্ট হয় তাকে নিজের পাশে আগলে রাখতে জানতে হয়।”
–” হু,তোমাকে ভালোবাসার মতো ভয়ংকর দুঃসাহস করেছি এটুকু শাস্তি তো আমার প্রাপ্যই ছিল বলো!”

মিহি নিশ্চুপ। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সে। ওয়াসিফ ফের বলে__
–” আমার বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিলাম জীবন নাকি তখনই সুন্দর হয় যখন ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পায়। ও তবে ভালোবেসে সার্থক। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়েছে সে। আর আমাকে দেখো,আমিও একসময় খুব গুছানো ছিলাম। আর এখন আদিম, বন্য। অবশিষ্ট বলতে আর কিছুই নেই।নিজেকে পুড়িয়ে শেষ করে ফেলেছি তোমার জন্য। অথচ কপাল, তোমাকে নিজের করে পেলাম না। আমি ব্যর্থ ইচ্ছেমতি। আমি সত্যিই ব্যর্থ। আমি তোমাকে এখনও বুঝাতে পারিনি আমার আর্তনাদ,আবেগ ভালোবাসা। আমি কখনও তোমাকে বুঝাতে পারিনি যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি,কতটা নিজের করে চাই।”
–” তবে থেমে আছেন কেন? আমার মতো মানুষগুলো নিয়ে অবান্তর ভেবে সময় নষ্ট করে কষ্ট পাবার মানে আছে? আপনি এখন অনেকটা সুস্থ, কাল থেকে অফিসে যাবেন। এখন রাখি?”
–” রেখো না। একটা গান শুনাও।”
–“পারিনা।”
–“মিথ্যে বলছো কেন? গাও।”
–“না। আপনি পরে আবার খুঁচাবেন। ”
–” নাহ,বলো।”
–“আপনি গান। তারপর আমি গাইবো। অনেকদিন হল আপনার সুরে গান শুনি না। ”
বলা মাত্রই ওয়াসিফ গায়ক ইমরানের ‘‘ফিরে আসো না,আর তো পারিনা, চল বাঁচি না আবার একসাথে..’’ গানটা গেয়ে মিহিকে বললো-“এবার বলো।”
–” একটু গাই। চলবে?”
–” আচ্ছা এক লাইন হলেও গাও।”
ওয়াসিফ গিটার বাজাচ্ছে, মিহি সুর তুলে__

“প্রেমে পড়া বারন, কারনে অকারণ
আঙ্গুলে আঙ্গুল হাত ছোঁয়ালেও হাত ধরা বারন।”

–” কিন্তু তুমি নিজে থেকেই তো আমার হাত ধরে ছিলে ইচ্ছেমতি।”
গানের মধ্যেই ওয়াসিফের কথা শুনে থেমে যায় মিহি।চোখ,ভ্রুযোগল কুঁচকে উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে–” কবে?”
–” ভুলে গেলে সব?”
–” ফালতু কথা কম বলবেন আমি কখনও আপনার হাত ধরিনি বরং আপনিই সবসময় আমার হাত ধরেছেন। ”
–” তোমার মনে নেই মৃদুল ভাই বিয়ের পর যখন তোমাদের বাড়িতে প্রথম যাবে তার আগেরদিন সন্ধ্যায় ছাদে তুমি আমার হাত ধরেছিলে?”
মিহির মনে পড়েছে। শব্দ করে হেসে বলে–” ওটা তো আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ধরেছিলাম। ”

মৃদুল মিলির বিয়ের ছয়দিন। আগামীকালই মিহি বাড়ি ফিরে যাবে। সবার মন খারাপ ছিল সেদিন। এই দিনগুলোর মিস করবে বলে বিকেলে ছাদে আড্ডা বসেছিল। মাগরিবের আযানের একটু পরেই ঘটনাটা ঘটে। আযান দিয়েছে বলে যার যার মতো করে নিচে নেমে এসেছিল। মৃদুল মিলিকে নিয়ে নিজের রুমে,ফরিনা ও ফরিদা দুই বোন একসাথে, ইলমা তার মেয়ে ঐশিকে নিয়ে। পিছনে ছিল ঈশা,মিহি,ওয়াসিফ। ওয়াসিফ তখন মিহির কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো — বলো ভালোবাসো?
–“না। বাসি না।”
–“বলো ভালোবাসো?”
মিহি ফের না বলে দেয়। ওয়াসিফ আরেকবার বলেও যখন মিহি না বললো ওয়াসিফ তখন মিহির হাত ধরে ঈশাকে শুধালো — ” তুই নিচে যা ঢুবলি,আমরা একটু পরে আসছি। কেউ কিছু বললে মেনেছ করে নিস।”
ঈশাও বাচ্চাদের মতো হেসে নিচে চলে এল। পিছনে মিহির এত ডাক কানে নিল না সে।

ঈশা চলে যাওয়ার পর ওয়াসিফ ফের বলে–” বলবেনা?”
মিহি আহ্লাদী কন্ঠে বলে –“না”
–“একদম ছাদ থেকে ফেলে দিব।”
বলে ওয়াসিফ মিহিকে ধাক্কা দিতে গেলেই মিহি ওয়াসিফের হাতটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। মুখে শুধায় — প্লিজ নায়ায়ায়ায়া।”
ওয়াসিফ ঠোঁট কামড়ে হাসে।

এখন মনে পড়তেই দুজন শব্দ করে হাসে। যে হাসির সৌন্দর্যরূপ রয়েছে সুন্দর একটা পরিবেশ ফুটাইতে।

কয়েকটা দিন পর ওয়াসিফ একদম সুস্থ হয়ে যায়।মিহির কথামত অফিসে যাওয়া আসা করে। এরমধ্যে একদিন রোমান অসুস্থ বলে অফিসে যায় নি। রান্না করতে করতে মিহি ওয়াসিফের সাথে কথা বলতেছে।এমন সময় রোমান রান্নাঘরে আসে কোনো একটা কাজে। এসে দেখে মিহির কথা বলার ধরন অন্যরকম। পক্ষান্তরে পশ্ন করে–“কার সাথে কথা বলছো মিহি?”
মিহি যেন চমকে উঠে। ভয় পেয়ে যায় অনেকটা।তোতলিয়ে বলে–“কককই কারো সাথে না তো!
–“তাহলে আমি কি ভুল শুনলাম? আবার কানে ফোনও। এটাও ভুল দেখছি?”
–“ফফ ফরিনা আআন্টি কল করেছে।”
–“তোতলাও কেন? কিছু কি লোকাচ্ছ আমার থেকে? ফোনটা দাও আমার কাছে।”
–“না ইয়ে মানে….
বলার আগেই রোমান মিহির কাছ থেকে কেড়ে ফোনটা নিয়ে কানে তুলে সালাম দিল।
–“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো বাবা?”
–“জ্বী আন্টি ভালো। আপনি কেমন আছেন?
–” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। মিহিকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসোনা একদিন!”
–“জ্বী যাবো ইনশাআল্লাহ। মিহির সাথে কথা বলুন। ”
বলেই রোমান মিহির কাছে ফোনটা দিয়ে দিল। তবে দেওয়ার আগে মিউট করে কানে ধরে বলে “সরি”।তারপর কপালে চুমু একে এক কাপ চা নিয়ে রুমে চলে যায়। মিহি এতক্ষণ ভয়ে ছিল এই না ধরা পড়ে যায়।মনেমনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। এদিকে ওয়াসিফ পুরুষালী কন্ঠ শুনে কলির কাছে ফোনটা দিয়ে বলে-“মায়ের মতো করে কথা বল।” কলিও তাই করে।তারপর দুজনে হাসতে থাকে। ওয়াসিফ অফিস যাওয়ার পর থেকে কলির সাথে মিহির প্রায় কথা হয়। ওয়াসিফ খুশি বলে কলিও খুব খুশি। মিহি আর ওয়াসিফ যখন একসাথে হেসে হেসে কথা বলে কলি তখন ওদেরকে মনভড়ে দেখে। মনে মনে শুধায় –” যার কাছে যার শান্তি মিলে তার কাছেই তাঁর ঠাঁই হোক।”

ঘটনাক্রমে রোমান ইদানীং খুব অসুস্থ থাকে। একদিন অফিসে গেলে তিন দিন যেতে পারে না। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। বাড়িতে কারও মন ভালো নেই। সবাই নিশ্চুপে কাঁদে। মিহি ওয়াসিফকে বলেছে কয়েকদিন কথা বলতে পারবে না। সে যেন নিজের যত্ন নিতে ভুল না করে। ওয়াসিফ জানে রোমান অসুস্থ তাই সেও কল দেয়না। মিহির কয়েকটা ছবির সাথে একা একা কথা বলেই দিনরাত পার করে।

রোমানের অসুস্থ হওয়ার ঠিক সপ্তাহখানেক পরেই তার মৃত্যু হয়। খুব অল্প বয়সে মৃত্যু। প্রিয়জনদের ছেড়ে চিরজীবনের মতো নিদ্রারত হল রোমান। মাত্র আটাশ বছর বয়সে একমাত্র ছেলেটাকে হারালেন বাবা মা। মাত্র তিন- চার মাসের সংসারে মেয়েটা হল অল্প বয়সে বিধবা।

চলবে….
____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here