ইস্ক সাহেবান পর্ব -১৬

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব -১৬||


—ভাইসাব ইশরা আপা তো ঘরে নাই। উপর থেকে চিৎকার করে কথাটি বলে মারিয়াম। তার কথা শুনে ইশাল চটজলদি খাবার টেবিল এর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাত থেকে চামচ প্লেটে পড়ে গিয়ে মৃদু আওয়াজ তুলল।

—-নেই মানে? ওয়াশরুমে আছে হয়তো! ইবাদের কথা শুনে ইশাল একটু স্বস্তি পেল। কিন্তু পরক্ষণেই মারিয়ামের বলা কথা শুনে ইশালের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।

—-না ভাইসাব! আপামণি তো কোথাও নেই। এই চিঠি টা রেনুরে দিয়ে গেসিলো। চিঠির কথা শুনে ইশাল আর এক মুহুর্ত ও দাঁড়ালো না। দ্রুত গিয়ে চিঠি টা হাত থেকে নিয়ে পড়তে শুরু করে,

“মি.ফায়াজ”,

‘গুড মর্নিং। আপনি যখন এই চিঠি পাবেন তখন হয়তো আমি থাকবো না, আপনার থেকে অনেক দূরে আমার অবস্থান হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কখনো এটা চাইনি যে আমি আপনার থেকে দূরে থাকবো। আমি চেয়েছিলাম আজীবন আপনার ছায়ার মত পাশে থাকতে। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম অন্ধকারে ছায়ার অস্তিত্ব হয় না। আপনি আমায় আলোয় রেখে নিজেই অন্ধকারে চলে গেলেন। যার ফলস্বরুপ আমি না চাইতেও দূরে সরে গেলাম। চাইনি বিশ্বাস করুন, এতোটা দূরে থাকতে আমি চাইনি। কিন্তু আপনি দিলেনই না। থাকতে দিলেন না আমায়। আমি সেই তারার মত হতে চেয়েছিলাম যেই, তারা চাঁদের সাথে ভেসে ওঠে আর চাঁদ মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই মিলিয়ে যায়। কিন্তু আপনি আমায় বাকি সাধারণ তারাদের কাতারে ফেলে দিলেন। আমি যখন ভাবছিলাম আমি আপনার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবো তখনই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কেন জানি না, নিজের উপর অনেক রাগ হচ্ছে আমার। আমি কখনো কারো যোগ্য হয়ে উঠতে পারি নি। ছোটবেলায় ইফতির সাথে প্রচুর ঝগড়া করতাম বলে বাবা মা দুজন কে দু’প্রান্তে রেখেছে। দূরে গিয়ে আমি ওর অভাব হারে হারে টের পেয়েছি। কাছে থাকতে যদি বুঝতাম এত কষ্ট আমি কখনোই পেতাম না। এখন দেখুন? বদমেজাজী, উশৃংখল স্বভাব সব এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। আপনি হয়তো এসব কারণের জন্যই আমায় গ্রহণ করেন নি। আজ আপনার কাছ থেকে দূরে এসে আমি নিজেকে একবার দেখেই অবাক হয়েছি। এমন কেন হয় ডাক্তারবাবু? কেন আমার প্রিয় জিনিসের সাথে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার পরই আমি নিজেকে শুধরে নিই? কেন বুঝতে পারি নিজের ভুল? আপনি আমায় দূরে সরিয়ে দিলেন তো, আমিও কখনো আপনার সামনে যাবো না। আপনি বলেছেন, আমার জীবনে কেউ আসবে। কেউ আসবে না ডাক্তার! কারণ আমি যাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম সে আসেনি। রাজার সিংহাসন চেনেন? ওই সিংহাসন রাজা না আসলে খালি পড়ে থাকে। কেউ বসে না। বসা মানেই অন্যায়। আপনি আমার মনের সিংহাসনের রাজা। আপনার জন্য বানানো সিংহাসনে কেউ বসবে না। আমি কাউকে বসতেই দেব না। ভালো থাকবেন ডাক্তার। এই বদমেজাজী মেয়েটি কখনো আপনার সামনে আসবে না। আমি আপনার থেকে নিজেকে ততটা দূরে সরিয়ে রাখবো যতটা দূরে রাখলে আপনি আমার আভাস ও পাবেন না’।

চিঠি শেষ হতেই ইশালের বুক কেঁপে উঠলো। চিঠি ভাজ করে পকেটে রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।

—–কি আছে চিঠিতে? ইবাদের কথা শুনে চমকে পেছনে ফিরে ইশাল।

—-কি কিছু না।

—-মিথ্যে বলছিস? রিজেক্ট করেছিলি তাই না? কথাটি শুনে ত্রস্তনয়নে ইবাদের দিকে তাকালো ইশাল।

—–তুই জানতি?

—–সাহায্য করেছিলাম। তোর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা দেখে সাহায্য করেছিলাম। ভেবেছিলাম তুই মেনে নিবি কিন্তু, তুই তো?

—-তুই আমাকে বলিস নি কেন?

—-বললে কী করতি? মেনে নিতি? ইবাদের কথায় ইশাল অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।

★বাড়ি ফিরেছে ইশরা সকালেই। সারাদিন বাহিরে ছিল। সন্ধ্যায় ফিরেছে। দিদার মাহসান দুপুরেই চলে গেছে।

—-তুই ইফতি কে রেখে চলে এলি যে? ইশরার পাশে বসে জিজ্ঞেস করেন নাহিদা বেগম।

–এমনি, আমার ফিরে যেতে হবে। ইতালি তে একটা কোম্পানি তে আমি এপ্লাই করেছিলাম। ওখান থেকে ফোন এসেছে। কালকেই ফিরতে হবে। আমার চাকরী হতে গেছে মা।

—চাকরীর কোনো দরকার ছিল না ইশরা। এতদিন পর এসে আবারও চলে কেন যাবি?

—এত লেখাপড়া কেন করিয়েছ তাহলে? কিছুদিন করি।

—-সামনেই ইফতির বিয়ে, তোর নানা আজ সে ব্যাপারেই কথা বলেছে। তুই এখন গেলে কবে আসবি।

—ও মা তুমি চিন্তা করো না তো। আমি ওর বিয়ের জন্য ঠিকই ছুটি নিয়ে আসবো। তুমি আর মুখ ভার করে থেকো না মা। কথাটা বলেই নাহিদা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে ইশরা।

জানলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইশরা। জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাতের নিকষকালো আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের মাকে এই প্রথম মিথ্যে বলেছে ইশরা। কি বলতো? এখানে থাকলেই ইশরার সব এলোমেলো হয়ে যাবে। পারবে না নিজেকে সামলাতে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টিকে আজ সারাদিন দেখেনি ইশরা। ভালোবাসায় হেরে গেছে। ভালোবাসা তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।

—-আমি কাল চলে যাচ্ছি। আপনি আমায় আর দেখবেন না ডাক্তার। ভালো থাকবেন। আপনার দেওয়া প্রত্যাখ্যান কে সযত্নে আগলে আমি অনেক দূরে চলে যাবো।

★ছাদ থেকে নেমে আসার সময় অন্ধকারে কারো সাথে ধাক্কা লাগে ইশালের।

—-আপনি ঠিক আছেন ইশরা, আম’সরি আমি খেয়াল করিনি। ত্রস্তব্যস্ত হয়ে বলে ইশাল।

—–ভাইয়া আমি মারিয়াম। ইশরা আপা তো সকালেই চলে গেছে। মারিয়ামের কথা শুনে নিজেই বোকা বনে গেল। সব সময় ইশরা কে কেন কল্পনা করছে সে। ইশরা এখানে নেই। কেন না চাইতেও ইশরাকে কল্পনা করছে?

—-ওহ্! আচ্ছা। ইশাল দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে। নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। ইজি চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে দিলো।

—‘কী ডাক্তারবাবুর মাথা ব্যাথা করছে’?
ইশাল ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো। নাহ্! আশেপাশে কেউ নেই। ইশালের মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগের কথা। রুমে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে বসে ছিল। ইশরা রুমে এসেই ইশালকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে উপরোক্ত কথাটি বলে উঠল। বাড়িতে না থেকেও মেয়েটি পুরো বাড়িতে নিজের অস্তিত্ব রেখে গেছে। সারাটা দিন ইশাল শুধু ইশরার কথাই ভেবেছে। মেয়েটা কোথায় আছে? কী করছে? কি খেয়েছে? ইশালের মাথা থেকে যাচ্ছেই না। ইশাল কী একবার ফোন করবে? কিন্তু নাম্বার তো নেই। কী বলবে ফোন করে? বারান্দায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো ইশাল।


sun te hein jub peyar ho to diye jal uthte hein
Tanme manme aur nayanme diye jal uthte hein..

Ajaa priya ajaa…aja priya ajaa hoo ooo aja priya
Aja tere hi tere hi liyee jalte diyee..

Bitani tere sayeme sayeme
jindegani bitani tere sayeme sayeme……

মধ্যরাতে কারো সুরেলা কন্ঠ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় ইবাদের।
শোয়া থেকে উঠে বসে দুহাতে মুখ মালিশ করর বালিশের পাশ থেকে চশমা টা তুলে নিল। বিছানা ছেড়ে নেমে বের হয়ে ইফতির রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল ইবাদ।

Kabhi kabhi ese diyo se lag bhi jati agh bhi
Dhule dhule se anchalo pe lag hein jate rag bhi…

Hein virano mein badalte
Dekhe man ke baag bhi…

Sapno mein shringar ho to
Diye jal uthte hein…

Khawashiyo ke aur sharam ke
Diye jal uthte hein…

Aaja piya, aaja tere hi
Tere hi liye jalte diyee…

Bitani tere sayeme sayemee
Jindegani bitani tere sayeme sayeme…

ইফতি কে যে রুমে রাখা হয়েছিল ইফতি সেখানে নেই। যেখানে ইফতি থাকতো আগে ইফতি সেই রুমেই বসে গান গাইছে। আজ ৬মাস পর ইফতিকে এভাবে গান গাইতে দেখে ইবাদ অবাক হয়ে গেল। এখনো পুরোপুরি সুস্থ ইফতি হয় নি। কালকেই ইফতিকে লাস্ট ডোজ দেওয়া হবে। ইফতির সুস্থতা যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। ইবাদ হাত বাড়ালেই যেন ইফতির সুস্থতা স্পর্শ করতে পারবে। এই ৬মাসে কম ঝড়-ঝাপটা সহ্য করতে হয় নি। ইফতির নিজ হাতে কাটা চুলগুলো ঘাড় ছাড়িয়ে একটু বড় হয়েছে। চোখমুখের যে বেহাল দশা ছিল তাও আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছে। গৌরবর্ণ মুখটির চকচকে ভাবটা ভেসে উঠেছে। এক হাতে পর্দা ধরে মাথা কাত করে পুরো দৃশ্য দেখে যাচ্ছে ইবাদ। হঠাৎই ইফতি গান থামিয়ে দিল। এক হাতে মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। অস্ফুটস্বরে ‘ডাক্তার’ শব্দটি উচ্চারণ করেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ইফতি।

চলবে…?

|| অসুস্থ অবস্থায় কী লিখছি আল্লাহ মালুম। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সবাই ভুল ক্রুটি মার্জনা করবেন।||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here