উমা পর্ব -৪৬+৪৭+৪৮+৪৯

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৬তম_পর্ব

শাশ্বতের মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহমুদ সরদার। তার ভারী মুখখানা শুকিয়ে রয়েছে। সে যাতাকলে পিসছে তা বুঝতে বাকি রইলো না শাশ্বতের। শাশ্বত তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন লিখেছে। যা তুমুল ঝড় তুলেছে। শাশ্বতের সাথে সাথে অন্যান্য সাংবাদিকরাও প্রতিবেদন লিখেছে। শাশ্বত চাপের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“আমাকে ডেকেছেন অথচ চুপ করে বসে আছেন, সরদার বাবু আমার তো সময়ের দাম আছে নাকি”
“আমার খবরটা ধামা চাপা দেবার কি উপায় নেই?”
“উপায় বলেছিলাম আপনি রাজী হন নি, বলি তো নিজেই হচ্ছেন”
“উত্তম বাবুকে আমি খুন করি নি”
“জানি, কিন্তু তার খুনের পেছনে কে ছিলো সেটাও তো বলছেন না।”
“বললে আমাকে জ্যান্ত রাখবে না।”

ভয়ার্ত কন্ঠে কথাটা বলে মাহমুদ সরদার। সরদারের ভয় দেখে শাশ্বত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কে? কে জ্যান্ত রাখবে না?”

সরদার আশেপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আপনার মামা অভিনব সিংহ রায়, সব কিছুর কলকাঠি সেই নাড়ে। তার লোকেরা আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে। যদি আমি মুখ খুলি আমাকেও মেরে ফেলবে।”

মাহমুদ সরদারের ভয়ার্ত স্বীকারোক্তি শুনে অবিশ্বাসের কালো বাদল জড়ো হয় শাশ্বতের মনে। মস্তিষ্ক রীতিমতো ফাঁকা হয়ে যায়। দৃষ্টি সংকুচিত হয় দ্বিধার মায়াজালে। মাহমুদ সরদারের কথাগুলো যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার মামা ক্ষমতালোভী, কালোকারবারিতে পটু; কিন্তু খুনী হতে পারে না। শাশ্বত মুখশ্রী খিচিয়ে বললো,
“কাউকে বাঁচানোর জন্য অন্যের উপর দোষ দেওয়াটা বুঝি অভ্যেসে পরিণত হয়েছে?”
“আমি জানতাম বিশ্বাস বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এটাই সত্যি, আপনার মামাই সবকিছুর মূলে। সেই খুন করেছে আপনার বাবাকে, কারণ আপনার মামার সকল বেআইনি কাজের প্রমাণ ছিলো আপনার বাবার কাছে। সে ফাঁস করে দিতো তার সকল রহস্য”

সালটি ১৯৭৮,
স্বাধীনতার সাত বছর পার হয়েছে। সাতক্ষীরার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় অন্যায়ের বীজ বুনেছে গভীরভাবে। নানা অস্ত্র, মাদকদ্রব্য বেআইনি পথে মায়ানমার এবং ভারত থেকে পাচার করা হচ্ছে। বিশেষ করে বেনাপোলের বর্ডার এবং মংলা থেকে, কাস্টমস ও নিজের পকেট পুরে মুখ বন্ধ রাখছে। কালীগঞ্জ থানায় তখন নতুন অসি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত উত্তম চ্যাটার্জির আন্ডারে নতুন একটি কেস আসলো। মাদকদ্রব্যের ব্যাবহার বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। অপরদিকে দশ পনেরো বছরের ছেলেদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে বেআইনি অস্ত্র, যার কোনো লাইসেন্স নেই। উত্তম চ্যাটার্জির ধারণা একটা র‍্যাকেট এই কাজ করছে। যদি এই র‍্যাকেটটাকে ধরতে পারা যেতো তাহলে তাদের মূল হর্তাকর্তারাও চলে আসতো হাতের ভেতর। সে সূক্ষ্ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিলো। ধীরে ধীরে তার পরিকল্পনা সফল ও হচ্ছিলো। গোপনীয় মিশনে খুব চতুরতার সাথে সে মাহমুদ সরদারকে ধরে ফেলেন, মাহমুদ সরদারের দায়িত্ব ছিলো এসব পাচার কৃত দ্রব্য কাস্টমস থেকে ছোটানো। যা পরবর্তীতে রুদ্র করতো। মাহমুদ সরদারকে পুলিশ কাস্টেডিতে রাখা হয় সাত দিন, রিমান্ডে তার উপর প্রচুর মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার করা হয়। অবশেষে সে তার র‍্যাকেটের সব কিছু বলে উত্তম বাবুকে। তারা ভারত থেকে আসা পেয়াজ, ফল, চালের বস্তায় নানাধরণের মাদকদ্রব্য যেমন ফেন্সিডিল, গাজা, মদ, এবং হেরোইন পাচার করতো। সাথে কিছু বেআইনি অস্ত্র ও। অভিনব সিংহের কাজ ছিলো তার লোক দিয়ে জিনিসগুলো পাচার করে দিতো রাজধানীতে। একগ্রাম গাঁজার দাম ছিলো ১০ টাকা। ফলে তাদের লাভ হতো প্রচুর। অভিনব সিংহের ব্যাবসা বাহিরে থেকে চাল ডালের বড় দোকান। কিন্তু তার চালের আরোদে ভেতর এই গুলো লুকিয়ে রাখতো এই পাচারকৃত দ্রব্য। চালের বস্তা যখন দেশের নানা অঞ্চলে যেতো এই মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও পাঁচার হতো। উত্তম চ্যাটার্জির প্রথমে বিশ্বাস হয় নি তার শ্যালক এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে। কিন্তু প্রমান হাতে আসার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজ হাতে অভিনব সিংহকে গ্রেফতার করবেন। এদিকে মাহমুদ ধরা পড়ার পর সতর্ক হয়ে যায় অভিনব সিংহ। সে নিজ থেকে যোগাযোগ করে উত্তম বাবুর সাথে। উত্তম বাবুকে দমানোর জন্য বলে,
“দেখো উত্তম, আত্নীয়ের মাঝে এমন ভুলবোঝাবুঝি রাখতে নেই। আরে লুটে খায় তো সবাই, আমি না হয় একটু বেশি লুটছি। এতে এতো অবাক হবার কিছু নেই। আর আমি কিন্তু একা খাই না, অনেক বড় বড় নেতা গোতারাও এই অংশ পায়। তাই ভালোর জন্য বলছি চেপে যাও। প্রতিমাসে ভাগ চলে যাবে। শাশ্বত ছোট, এই পুলিশের চাকরি তে ক টাকা পাও দেখে?”
“উঠুন, উঠে দাঁড়ান”

রোষানলে কাঁপছে উত্তমবাবুর শরীর৷ সে হিনহিনে স্বরে বলে,
“আমার চোখের সামনে থেকে বেড়িয়ে যাবেন। আপনার ওয়ারেন্ট বের হবার পর আমি নিজ হাতে আপনাকে হাতকড়া পড়াবো। ততদিন মন্ত্র যপুন, যম এলো বলে দোয়ারে”

অভিনব সিংহ অবিচল, ভয়ের এক চিলতে রেখাও দেখা গেলো না তার মুখে। সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“ভালো করলে না উত্তম।”
“সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না”

সেই রাতেই বাড়ি ফেবার সময় এক দল মানুষ উঠিয়ে নিয়ে যায় উত্তম বাবুকে। গলা কেটে ফেলে আসে রেলস্টেশনে। উত্তম বাবুর মৃত্যু তদন্ত করে নতুন অসি। সে মোটা টাকা খায় অভিনব সিংহের কাছে। টাকার লোভে তার চোখ চকচক করে উঠে। তাই সে মুখ বন্ধ করে নেয়। এদিকে, বিধবা বোনকে নিজ ঘরে ঠায় দেয় অভিনব সিংহ। মালিনী জানতো তার দাদার চরিত্র। কিন্তু শাশ্বতের জন্য নিজের মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয় লেগেছে তার। নিজের ছেলের প্রাণ বাঁচাতে দাদা যেভাবে বলেছে সেটাই মেনে নেয় সে।

মাহমুদ সরদার সামনে থাকা জল ঢক ঢক করে পান করে। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। শাশ্বত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে এতো সময় পর অনুভব করলো তার গাল ভিজে এসেছে। চোখ ঝা ঝা করছে। মামার এমন কালো সত্যি মানতে বুক চিরে আসছে। এই লোকটিকে পিতৃতুল্য ভেবেছিলো সে। সম্মান করেছে মন দিয়ে। কিন্তু আজ তাকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে সব জেনেও কিছু করতে পারবে না। ত্রিশ বছর পূর্বের সত্যিটা সে চাইলেও প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু অভিনব সিংহকে ছেড়ে দিবে না সে। কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিবে সে। শাশ্বত উঠে দাঁড়ালো। মাহমুদ সরদার তার হাত আকড়ে আকুল আবেদন করলো,
“আমাকে বাঁচান, শাশ্বত বাবু। প্লিজ আমাকে বাঁচান।”

শাশ্বত এক রাশ ঘৃণা নিয়ে রুঢ় হাসি হাসে। স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে,
“দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করুন, আপনার আযরাইল আর আমার যম আসলো বলে”

শাশ্বত কথা শুনে কলিজা শুকিয়ে আসে সরদারের। কপালে ভয়ের দরুন ঘাম জমতে লাগে। শাশ্বত এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না। বেড়িয়ে যায় সরদারের অফিস থেকে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চোখে আগুনের ফুলকি জ্বল জ্বল করছে। পারলে এখনি অসুর বধ করতো সে। কিন্তু আইনের কাছে বাঁধা। আইনি খেলা আইনের মাধ্যমেই রফা দফা করবে সে। এতোকাল মামাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে শুধু। কিন্তু আর নয় এবার মামা চিরতরে শেষ করার পালা। সে ক্ষমতার লোভে তার পিতাকে সে হত্যা করেছে। সেই ক্ষমতা কেড়ে নিবে সে, জেলের কালকুঠুরির ভেতর পঁচে মারবে অভিনব সিংহ কে, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শাশ্বত___________

উমার ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। উঠে বসতে গা গুলিয়ে এলো। ছুটলো স্নানঘরে। স্নানঘরে যাবার শব্দে রুদ্রের ও ঘুম ভেঙ্গে গেলো, তার দৃষ্টি গেলো ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাটা পাঁচটার ঘরে এসে ঠেকেছে। রুদ্র শালটা নিয়ে স্নানঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। উমা মুখটা ধুয়ে বের হয়ে রুদ্র গামছাটা এগিয়ে দিলো। তারপর উমাকে শাল দিয়ে ঘিরে দিলো। উমা লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম কি?”
“তুমি কষ্ট করবে আর আমি বেঘুরে ঘুমাবো তা কি হয়!”

বলে ধরে ধরে বসায় উমাকে। রুদ্র হাটু গেড়ে নিয়ে বসে। মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি দেয় তার ছোট বউটির দিকে।তার ষোড়শী এখন আর ষোড়শী নেই। একজন পূর্ণ নারী। কিছুদিন বাদে একজন সন্তানের মা হবে সে। সন্তান জন্ম দেওয়া কতোটা কঠিন তা উমার চেহারা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বমি করার দরুন চোখগুলো বসে গেছে উমার। খুব ক্লান্ত লাগছে তাকে। ঘুমটাও গত ল্রাতে ভালো হয় নি। উমার কোমড় জড়িয়ে ধীর স্বরে বলে,
“আমার উপর কখনো রাগ হয় না তোমার?”
“কেনো বলুন তো?”
“এই যে! আমি তোমাকে সময় নিতে পারি না, ব্যাস্ত থাকি নিজেকে নিয়ে। তোমার যত্ন নেই না।”

উমা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি যা দিয়েছেন আমার জন্য যথেষ্ট। ভালোই তো আছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”

রুদ্র জড়িয়ে ধরে উমাকে। গরম নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো উমার ভেতরটা। তখন রুদ্র ধীর স্বরে বলে,
“তোমার এই উষ্ণ হৃদয়টা কখনো শীতল হবে না তো?”

রুদ্রের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় উমা। কিছু বলা আগেই………#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৭তম_পর্ব

রুদ্র হাটু গেড়ে নিয়ে বসে। মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি দেয় তার ছোট বউটির দিকে।তার ষোড়শী এখন আর ষোড়শী নেই। একজন পূর্ণ নারী। কিছুদিন বাদে একজন সন্তানের মা হবে সে। সন্তান জন্ম দেওয়া কতোটা কঠিন তা উমার চেহারা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বমি করার দরুন চোখগুলো বসে গেছে উমার। খুব ক্লান্ত লাগছে তাকে। ঘুমটাও গত ল্রাতে ভালো হয় নি। উমার কোমড় জড়িয়ে ধীর স্বরে বলে,
“আমার উপর কখনো রাগ হয় না তোমার?”
“কেনো বলুন তো?”
“এই যে! আমি তোমাকে সময় নিতে পারি না, ব্যাস্ত থাকি নিজেকে নিয়ে। তোমার যত্ন নেই না।”

উমা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি যা দিয়েছেন আমার জন্য যথেষ্ট। ভালোই তো আছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”

রুদ্র জড়িয়ে ধরে উমাকে। গরম নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো উমার ভেতরটা। তখন রুদ্র ধীর স্বরে বলে,
“তোমার এই উষ্ণ হৃদয়টা কখনো শীতল হবে না তো?”

রুদ্রের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় উমা। কিছু বলার আগেই রুদ্র স্নিগ্ধ কন্ঠে আওড়ালো,
“আজ
ফাগুনের সকাল বেলায় আলোর
রঙটা ভিন্ন রকম
চাইছে সে রং রঙের দোলায়
আজ ফাগুনে তোমায় প্রথম

আজ ফাগুনের হাওয়ায় দখিন
ভালোবাসা আলোর ভেলায় দুলছে কুসুম
ভোরের
থেকে বাড়িয়ে দিচ্ছে মিষ্টি একটা কি পিপাসা তোমার
ঘ্রাণে আমার আমি যাচ্ছি মেখে

আজ ফাগুনে কিছু খোপায় ফাগুনের ঘর
তারই থেকে একটুকু দেয়
বাসন্তি প্রেম তার জন্য আমার
আমি ফাগুন বিভোর ফাগুন ছন্দ দুহাত
ভরে দিয়ে দিলেম”

ভোরের স্নিগ্ধ কিরণে গভীর নয়নে চাইলো উমা। রুদ্রের চোখের অজানা মায়ার সাগরে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারছে। উমা আলতো হাতে রুদ্রের মুখখানা তুলে ধরলো, নিবিড় চুম্বন আকলো রুদ্রের ললাটে। রুদ্র নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো উমাকে। সময়টা যেনো থমকে গেছে। শীতল আবহাওয়ায় উষ্ণ আবেশে মত্ত রুদ্রের বিচলিত হৃদয়ে প্রসন্নতার ছোয়া বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেনো উমার হৃদয়ের কর্ণিশে নিকষকৃষ্ণ ভয় উঁকি দিচ্ছে। ভয় হচ্ছে এই ভালোবাসার কোমল আবেশটি নীল বিষাক্ত যন্ত্রণায় পরিণত না হয়ে যায়। নামহীন ভয়ের কারণটি জানা নেই। তবে ভয়ের চিত্রটি খুব বিশ্রী দেখতে। বিশ্রী তার হাতপা। উমা আলিঙ্গন দৃঢ় করলো। এই মানুষটিকে হারাতে নারাজ সে। আপন বলতে তো এই কটা মানুষ ই রয়েছে।

রাজশ্বী চটের ব্যাগখানা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। আজ শুক্রবার, সুমনের সাথে শিবপুরের ওখানে যেতে হবে। বেশ কটা গ্রাম রাতারাতি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। দখলে চলে আসছে অন্য মানুষ। অথচ ব্যাপারখানা সম্পূর্ণ ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে সূক্ষ্ণ নিপুনভাবে। দিদিকে মিথ্যে বলতে ভালো লাগে না রাজশ্বীর, কিন্তু সত্যটাও বলতে পারছে না। তাই সত্য লুকাতে হচ্ছে। মহাভারতেও যুধিষ্ঠির সত্য লুকিয়েছিলেন। রাজশ্বী তো পাপ কার্য করছে না, সে ন্যায়ের জন্য পথ বেছে নিয়েছে। পথখানা দূর্ঘম বিধায় দিদির হয়তো আপত্তি হবে৷ সেকারণেই সত্য লুকানো। রাজশ্বী ঘর থেকে বের হতেই মুখোমুখী হলো রুদ্রের। রাজশ্বীকে তৈরি দেখে সে সরু দৃষ্টিতে চাইলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
“যতদূর জানি আজ তোমার কলেজ নেই, কোথায় যাচ্ছো?”
“আজ ছাত্রের পরীক্ষা নিবো তো তাই”

বলেই তাকে পাশ কাটিয়ে হাটা ধরলে রুদ্র বলে উঠে,
“ছাত্রের বাসাটা কি ” সময়ের খবর” অফিস? শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করবো, কি লুকাচ্ছো?

শান্ত কন্ঠের কথাটা হিম ধরিয়ে দিলো রাজশ্বীর শিরদাঁড়ায়। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকালো সে। রুদ্র তখন বললো,
“আমি মানুষটা ভয়ংকর হলেও এতোটা খারাপ নই যে আমাকে মিথ্যে বলা লাগবে, যদি সত্যিটা বলো এমন ও হতে পারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।”

রাজশ্বী কিছুসময় চুপ থেকে বলে,
“আমি ওখানে ইন্টার্ণ হিসেবে কাজ করছি। বেশ কিছু মাস শাশ্বত দায়ের অফিসে কাজ করছি। দিদিকে জানাবেন না জামাইবাবু, দিদি রাগ করবে”
“যখন তোমার দিদি জানতে পারবে তখন? তখন কি বলবে”
“জানা নেই, তবে এখন জানাতে চাচ্ছি না।”
“সাংবাদিকতা ভয়ংকর পেশা। জীবনের ঝুকিও রয়েছে।”
“জানি, জীবনের ঝুকি তো সর্বত্র ই। আপনি রাজনীতিতে আসেন, ওখানে কি ঝুঁকি নেই? আছে। তাহলে শুধু ভয় পেয়ে লাভ আছে?”

রুদ্র রাজশ্বীর যুক্তিতে চুপ করে গেলো। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“আমার নাম্বারটা রাখো, যদি কখনো কোনো ঝুঁকি অনুভব হয় আমাকে ফোন করবে, মনে থাকবে”

রাজশ্বী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। এর পর সে বেড়িয়ে গেলো। রুদ্র সরু দৃষ্টিতে রাজশ্বীর যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। তারপর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার।

২৪.
উষ্ণ রোদে আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন অভিনব সিংহ। তার হাতের পাশে কাঠের টেবিলটিতে উষ্ণ গরম চা এবং আজকের খবরের কাগজটি রাখা৷ বার্ধক্য চোখে সোনালী বর্ডারের চশমাটা পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে পরিষ্কার করলো সে। তারপর খবরের কাগজটা হাতে নিলো সে। কাগজটি খুলতেই কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসলো তার। তখন ই দীপঙ্কর কড়া নাড়লো দরজায়। অভিনব চোখ ঘুরায়। দীপঙ্গকর ভীত চাহনীতে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। অভিনব সিংহ অভয় দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে দীপঙ্কর?”
“পুলিশ এসেছে জ্যেঠু……..
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৮তম_পর্ব

২৪.
উষ্ণ রোদে আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন অভিনব সিংহ। তার হাতের পাশে কাঠের টেবিলটিতে উষ্ণ গরম চা এবং আজকের খবরের কাগজটি রাখা৷ বার্ধক্য চোখের সোনালী বর্ডারের চশমাটা পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে পরিষ্কার করলো সে। তারপর খবরের কাগজটা হাতে নিলো সে। কাগজটি খুলতেই কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসলো তার। তখন ই দীপঙ্কর কড়া নাড়লো দরজায়। অভিনব চোখ ঘুরায়। দীপঙ্গকর ভীত চাহনীতে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। অভিনব সিংহ অভয় দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে দীপঙ্কর?”
“পুলিশ এসেছে জ্যেঠু, আপনাকে খুজছে। তাদের কাছে এরেস্ট ওয়ারেন্ট ও আছে।”

অভিনব সিংহ অবিচলিত দৃষ্টিতে চাইলো দীপঙ্করের দিকে। অভিনবের চাহনীতে নিজের বিচলিত হৃদয় শান্ত হয়ে গেলো দীপঙ্করের। মাঝে মাঝে জ্যেঠুকে খুব রহস্য জালের মতো ঠেকে তার কাছে। লোকটির বয়স ষাট ছুই ছুই কিন্তু তাকে কোনো কঠিন কথায় বিচলিত কিংবা ঘাবড়াতে দেখে নি। সকাল বেলা সূর্য উঠার সাথে সাথে পুলিশের আগমণ মোটেই শুভ কিছু না। তবুও লোকটি শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অভিনব পেপারখানা ভাজ করে উঠে দাঁড়ালো। সোনালী বর্ডারের চশমা চোখে পড়ে নিলো। তারপর এগিয়ে দীপঙ্গকরের সামনে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় বললো,
“সকালের খবর পড়েছো?”
“না জ্যেঠু, কেনো?”
“আমি নিচে যাচ্ছি পড়ে নিও”

কথাটা বলে ঘর ছাড়লেন অভিনব সিংহ। দীপঙ্গকর ছোট টেবিল থেকে পত্রিকাটি হাতে নিলো। চোখ বিস্ফোরিত হলো তার। সম্মুখ পেজেই বড় করে লেখা,
“রক্তিম নদী ভাসিয়ে ক্ষমতার চূড়ায় অভিনব সিংহ”

হেডলাইন পড়েই দীপঙ্গকরের বুঝতে বাকি নেই কি লেখা বাকি প্রতিবেদনে। সে টেবিলে ছুড়ে মারলো পেপারটি। তারপর ছুটলো অভিনব সিংহের পেছনে।

লক্ষী দেবী পুজোর ঘরে ব্যস্ত, ফুলির মা থাকতে সব কিছু আগ থেকেই গুছিয়ে দিতো। ফলে তার কখনো কষ্ট করতে হয় নি। কিন্তু ফুলির মার যাবার পর থেকেই সব কাজ একা করতে হয়। আঁচল খানা মাথায় তুলে হাত জড়ো করে পুজো করছিলেন তিনি। তখন মৌমিতা ছুটে এলো, কম্পিত স্বরে বললো,
“জ্যেঠীমা, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। বাইরে পুলিশ এসেছে।”

মৌমিতার কথা শুনেও সে নড়লো না। তার গোপালের পুজোর সময় তিনি অনড় থাকেন। পুজো শেষ করা অবধি তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলো না মৌমিতা। ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গছে। প্রচন্ড উত্তেজনায় তার কপালে ঘাম জমছে। লক্ষী দেবী তার পুজোটা শেষ করলেন, তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
“হয়েছে কি? পুজোর সময় বিরক্ত করছিলে কেনো?”
“জ্যেঠী মা, বাইরে পুলিশ এসেছে। তারা জ্যেঠুকে ধরে নিয়ে যাবে, চলুন”

মৌমিতার কথায় নির্বিকার লক্ষী দেবী। যেনো এটা তার স্বামীর এমন পরিণতিটি তার পূর্বথেকেই জানা ছিলো। শান্ত কন্ঠে বলে,
“আমি যেয়ে কি হবে শুনি?”
“আপনার চিন্তা হচ্ছে না? জ্যেঠুর উপর না জানি কি সব দোষারোপ করছে”
“চিন্তা, একটা কথা কি জানো একটা সময় পর আর চিন্তা হয় না; তখন অভ্যেসে পরিণত হয়। এতো নতুন নয়। তুমি চিন্তাটি না করে বরং এক খানা কাজ করো, রুদ্রকে খবর দেবার ব্যাবস্থা করো।”

লক্ষী দেবীর এমন শান্ত কন্ঠে বিস্ময়ের সর্বোচ্চ আসমানে মৌমিতা। যতই হোক, স্বামীকে জেলে নিয়ে যাবে কথাটা যে কোনো স্ত্রীর মেনে নেওয়া কঠিন। মৌমিতা সময় নষ্ট করলো না। সে নিচে চলে গেলো। লক্ষী পেছনে ফিরে নিজের গোপালের প্রতিমূর্তির পানে চাইলো। তার চোখ ভিজে এলো অশ্রুতে। অশ্রুর কারণটা কেবল ই সেই জানে, মাঝে মাঝে তারোও তালা বাধা সরল মনের ইচ্ছে হয় একজন স্বাভাবিক স্ত্রীর ন্যায় সংসার করতে। যেখানে একটা স্বাভাবিক ভালোবাসার সুতোয় বাঁধা পরিবার থাকবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন ই থেকে যায়।

পুলিশ স্টেশনে আরো একবার ইন্টারোগেশন রুমে অভিনব সিংহ। ইতিমধ্যে তার রিমান্ডের ওয়ারেন্ট বেড়িয়ে গেছে। কিন্তু বয়সের মূল্য করে তার সাথে এখনো কোনো দূর্ব্যাবহার করা হয় নি। জামিনের জন্য ছুটছে দীপঙ্গকর। অভিনব সিংহ আয়েশ করে বসে রয়েছেন। সামনে শ্রাবণ বসে রয়েছে। তার মুখে এক রাশ বিরক্তি। সকাল সকাল ফোন এলো উপর মহল থেকে গ্রেফতার করতে হবে অভিনব সিংহ কে। সরকার বদলের পূর্বে দল দেখা হয় না, পত্রিকায় কলম খোঁচালেই তাকে জেলে নিতে হবে। মেজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে রেট দিয়েছেন। বড় বাজারের গুদামে চালের বস্তায় প্রায় দশ লক্ষ টাকার মাদকদ্রব্য পাওয়া গিয়েছে। সাথে পনেরো লক্ষের মতো টাকা এবং অস্ত্র। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। শ্রাবণ ধীর স্বরে বললো,
“সময় নষ্ট করলে নষ্ট হবে। গত বারগুলো বেঁচে গেলেও এবার বাঁচবেন না। এবারের চোটে সব কিছু শেষ অভিনব বাবু। যতবার রেট দেওয়া হয়েছিলো কিছু পাওয়া যায় নি। কিন্তু এবারের ব্যাপারখানা সম্পূর্ণ আলাদা৷ এবার আপনার আমলারা জানার আগেই কর্মশেষ। লোকে বলে ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না— ভুল সব। আপনি তো ভাত ছড়িয়েছিলেন। লাভ কি! আরেকটা খবর জানেন? এসিস্ট্যান্ট আইজি সাসপেন্ড হয়েছেন। এবার মুখ খুলবেন?”

অভিনব সিংহ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় শ্রাবণের দিকে। এবার সত্যি সব তার নাকের নিচে ঘটেছে। প্রতিবার শাশ্বত তার হাটু ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনোবার ই সফল হতে পারে নি। কারণ অভিনব সিংহের লোকেরা আগ থেকে তাকে সতর্ক করে ফেলতো। যার দরুন খুব চতুরতার সাথে প্রমাণ গায়েব করে ফেলতেন অভিনব সিংহ। কিন্তু এবার তেমন কিছু হয় নি, উপরন্তু তার গোপন ব্যাবসাগুলোও ধরা পড়ে গিয়েছে। এতোকাল সরকারি বহু টাকা সে আত্নসাৎ করেছিলেন। হিসেব ও নেই। পথের কাঁটাগুলোকে উপড়ে তুলে ফেলেছেন। শুধু শাশ্বতের বেলাতেই তিনি দূর্বলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু শাশ্বতের পক্ষে এতো কিছু খুঁচিয়ে বের করা অসম্ভব। তবে তার জন্য এতো বড় গর্তটি কে খুড়বে? রুদ্র? অভিনব সিংহকে চুপ থাকতে দেখে সজোরে টেবিলে আঘাত করে শ্রাবণ। কর্কশ কন্ঠে শাসিয়ে বলে,
“দিবাস্বপ্ন দেখার সময় শেষ অভিনব সিংহ বাবু। মোট সাতখানা খুনের চার্জ ও হবে। তৈরি থাকুন। এবার মনোনয়ন পত্র তো দূরে থাক! জেল থেকেই বের হওয়া দুষ্কর হবে।”
“আমি তোমার মতো অসিদের পালি। আমার উকিল ব্যাতীত আমি কোনো উত্তর দিবো না। এগুলো বিরোধী পক্ষের চাল, সম্পূর্ণ সাজানো নীলনকশা”

শ্রাবণ টিটকারীর হাসি হাসে। তারপর বলে,
“বেশ আসুক আপনার উকিল”

তারপর সে উঠে দাঁড়ায়। কন্সটেবলকে বলে,
“উনাকে জেলে ভরুন, দেখবে যেনো ভালো খাতির দারি হয়”

বলেই বেড়িয়ে যায়। অভিনব সিংহ বসে থাকে পাথরের ন্যায়। তার কানে যেনো ধ্বনি আসছে। পরাজিত যুদ্ধের শঙ্গনাদ। তবে কি হেরেই গেছে সে!!!!

শিবপুর ইউনিয়নের দক্ষিণের গ্রামগুলো একের পর এক ফাঁকা হচ্ছে। মানুষগুলো রাতের আধারেই ঘর ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। সুমন এবং রাজশ্বী এসে পৌসেছে পালপাড়ায়৷ এখানে দু ঘর পর পর যদি কাউকে পাওয়া যায়। খালি ঘরগুলো ভাঙ্গার ব্যাবস্থা হচ্ছে। মানুষেরা ঘর ছেড়ে কেনো চলে যাচ্ছে কারোর ই জানা নেই। একটা চালের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে সুমন। একজন বৃদ্ধ দরজা খোলে। বৃদ্ধকে সালাম দেয় সুমন। বৃদ্ধের মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে তিনি অপ্রসন্ন। তার চোখ মুখ খিঁচে এসেছে। সুমন কথা শুরু করার চেষ্টা করে,
“চাচা, ভালো আছেন?”
“তা দিয়ে আপনের কি কাম?”
“না আসলে আপনি কেমন আছেন তাই জানতে চেয়েছিলাম?”
“আপনের কি মাথায় সিট আছে? তক্ত কইরেন না।”

বলেই দরজা আটকাতে গেলে রাজশ্বী এগিয়ে এসে বলে,
“চাচা, রাগ করবেন না। আমরা খবরের কাগজের লোক। আসলে এই গ্রাম নিয়ে একটা খবর ছাপাইতাম। তাই আপনার সাথে কটা কথা কইতে আইছি।”
“কি কথা?”
“আচ্ছা, গ্রামের মানুষ দিন দিন কমছে কেনো? তারা নাকি জমি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে? কারণ কি?”

লোকটির মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। ভয়ে রক্তশূন্য মুখখানি রাজশ্বীর দৃষ্টি এড়ালো না। লোকটি আমতা আমতা করে বললো,
“তারা গেছে তাদের ইচ্ছা। আপনারা তো লোক ভালা না, এতে খবর বানানোর কি আছে?”
“আপনি বুঝছেন না চাচা, আপনাদের জমি বাড়ি যদি কেউ অন্যায় ভাবে দখল করে থাকে আমাদের জানাতে পারেন। সরকার থেকে সাহায্য পাবেন আপনারা।”

লোকটি আক্ষেপের স্বরে বললো,
“আর সরকার, সরকারের লোক ই মানুষের সাথে জড়িত। যান যান ভাগেন, ত্যাক্ত কইরেন না।”

বলেই মুখের উপর দরজা আটকে দেয় বৃদ্ধ। রাজশ্বী এবং সুমনের কথা বলার সুযোগটিও দিলো না। হতাশ সুমন বললো,
“এখন কি করবে?”
“একজন দরজা দিয়েছে, সবাই তো দেই নি। দেখি, কেউ না কেউ তো কথা বলবেই”

রাজশ্বী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মন বলছে, এরা ইচ্ছে করে গ্রামছাড়া হচ্ছে না। কেউ তাদের গ্রামছাড়া করছে। কিন্তু এই ভূমিদস্যুরা কারা‌!

নিজের কাজের ঘরে বসে রয়েছে রুদ্র। বেশ কিছু কাজ জমে গিয়েছে। ক দিন উমার সাথেই থেকেছে সে। সামনে মননোয়ন পত্র পূরণ করবে সে। তখন উমাকে সময় দেওয়া হবে না। তাই এই কদিন ঘুষ হিসেবে কাজ করেছে সে। অবশ্য উমার সাথে থাকার সময় বাহিরের জগতের কিছুই মনে থাকে না তার। তখন সে মিশে থাকে উমার মাঝে। তার ষোড়শীটি তার সর্বত্র জুড়ে থাকে। মন মস্তিষ্ক তখন মগ্ন থাকে তার উষ্ণতায়। তার চুলের সুবাসে লিপ্ত থাকতে ইচ্ছে হয় রুদ্রের। তার পদ্মের ন্যায় চোখের কাজলে মিশে থাকতে ইচ্ছে হয়। সময়টা কখন কেটে যায় হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। উমার দেখে দূরে থাকতে হবে ভেবেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা উৎপন্ন হয়। এ যেনো অধৈর্য্য যন্ত্রণা। এর মাঝেই টেলিফোনটা বেজে উঠে রুদ্রের। রুদ্রের কল্পনার জগতে বিঘ্ন ঘটে। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরে সে। খিটখিটে গলায় বলে,
“কে?”
“রুদ্র দা আমি দীপঙ্গকর”
“হ্যা বলো”
“দুঃসংবাদ আছে একটা”
“কি?”

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আছে রুদ্রের। দীপঙ্গকর কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“জ্যেঠুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আজ তো শুক্রবার তাই বেইল ও হচ্ছে না।”

দীপঙ্গকরের কথায় চরম অবাক হয় রুদ্র। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে বলে,
“কি বলছো”
“সত্যি বলছি রুদ্র দা, আমার মাথা কাজ করছে না। জ্যেঠী মা কেমন পাথরের ন্যায় বসে আসে। আপনি আসলে ভালো হতো।”
“আমি আসছি, মাকে চিন্তা না করতে বলো, রাখছি”

বলেই ফোন রেখে দেয় রুদ্র। তখন ঘরে প্রবেশ ঘরে উমার। রুদ্রের চিন্তিত মুখশ্রীতে সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে? এতো ব্যস্ত দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?”
“বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে৷ শুক্রবার বলে বেল হচ্ছে না।”
“এখন?”
“আমি ও বাড়ি যাচ্ছি। মা তো একা”
“আমিও যাই?”
“পাগল নাকি? ওখানে তোমার কাজ নেই। তুমি এখানে থাকো। নিজের খেয়াল রাখো। তোমার শরীর তো ভালো নেই। এই অবস্থায়।ও বাড়ি আমি নিবো না।”
“কিন্তু, মাকে সামলাবেন কিভাবে?”
“চিন্তা করো না, মৌমিতা আছে। তুমি নিজের খেয়াল রেখো৷ পারলে তাকে এখানে নিজে আসবো”

উমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। রুদ্র বেড়িয়ে পড়ে৷ উমা হাত জড়ো করে বলে উঠে,
“দূর্গা, দূর্গা। দেখো মা, অযথা যেনো কেউ কষ্ট না পায়”

উমা পেছন ফিরে রুদ্রের কাজের টেবিলটি দেখে। লোকটি সব এলোমেলো করে গিয়েছে। উমা কাগজগুলো গুছিয়ে রাখতে থাকে। কাগজ গুছাতে গুছাতে একটা সাদা ফাইল হাতে পড়ে উমার। ফাইলটি খোল ছিলো বিধায় অসর্তকতায় বেশ কিছু দলিল বেড়িয়ে আসে। দলিল গুলো গুছাতে গুছাতে উমার চোখে পড়ে, দলিল গুলো নতুন। মাস খানেক পূর্বে বানানো হয়েছে। এক রাশ কৌতুহল হয় উমার। এই জমি গুলো কবে কিনেছে রুদ্র! সে তাকে এই বিষয়ে কিছুই জানায় নি। যদিও সে মংলায় জমি কেনার কথা বলেছিলো। খুতিয়ে দেখলে খেয়াল করে জমিগুলো শিবপুরের মৌজায় পড়েছে………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪৯তম_পর্ব

উমা কাগজগুলো গুছিয়ে রাখতে থাকে। কাগজ গুছাতে গুছাতে একটা সাদা ফাইল হাতে পড়ে উমার। ফাইলটি খোল ছিলো বিধায় অসর্তকতায় বেশ কিছু দলিল বেড়িয়ে আসে। দলিল গুলো গুছাতে গুছাতে উমার চোখে পড়ে, দলিল গুলো নতুন। মাস খানেক পূর্বে বানানো হয়েছে। এক রাশ কৌতুহল হয় উমার। এই জমি গুলো কবে কিনেছে রুদ্র! সে তাকে এই বিষয়ে কিছুই জানায় নি। যদিও সে মংলায় জমি কেনার কথা বলেছিলো। খুতিয়ে দেখলে খেয়াল করে জমিগুলো শিবপুরের মৌজায় পড়েছে। শিবপুর নামটি বেশ কিছুদিন পূর্বেই খবরের কাগজের কলামে পড়েছিলো উমা। রুদ্রের ব্যাবসা কিংবা কাজের ব্যাপারে কখনোই খুব মনোযোগী হয় নি উমা। রুদ্র নিজ থেকেই অনেককিছু তাকে বলতো, মাঝে মাঝে দু একটা বুদ্ধিও নিতো। সেকারণে তার কিছু কিছু ব্যাপার তার জানার আয়ত্তে রয়েছে। বাকি অনেকটাই একটা গোলকধাঁধা। মনে সন্দেহ না জাগার কারণে সেই ব্যাপারগুলোকে ঘাটে নি উমা। তবে আজ মনের অদূর আকাশে সন্দেহের ধূসর মেঘের আনাগোনা হচ্ছে। না চাইতেও বহু প্রশ্নেরা হুমড়ি খাচ্ছে মনে। যেখানে রুদ্রের কোনো ব্যাবসায়িক কাজ ই নেই সেই অন্ধলে বিঘার পর বিঘা জমি কেনো কিনেছে রুদ্র। মোট সাতখানা দলিল। উমা হিসেব করে দেখলো তাতে মোট ২০ বিঘার ন্যায় জমি রয়েছে। এতো জমি রুদ্র কেনো কিনেছে কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না উমার। উমা ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। খবরের কাগজের কলামটির একটি লাইন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে,
“শিবপুরে ভূমিদস্যুর তান্ডব, ঘরহীন মানুষ গায়েব হচ্ছে রাতারাতি”

পালপাড়া ছাড়িয়ে সামনে মেঠোপথ দিয়ে হেটে যাচ্ছে রাজশ্বী এবং সুমন। মাথার উপর আকাশ আলো করা তেজহীন সূর্য। রাজশ্বীর পায়ের গতি মন্থর। সুমন হাপিয়ে হাপিয়ে হাটছে। একটু পর পর শুধু মুখ থেকে বিরক্তির শব্দ করছে। তাদের আজকের পুরোদিনটাই যেনো মাটি লাগছে। কেউ তাদের সাথে কথা বলতেই আগ্রহী নয়। যতটা ঘরে কড়া নাড়ছে সকলে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। সুমনের লম্বাটে মুখখানা আরোও লম্বাটে লাগছে। তার মুখে আক্ষেপের এক গাঢ় রেখা। দুপাশে সবুজ ফসলের মাঝে চিংড়ীর ঘের। বসন্তের রঙ লেগেছে। সবুজ ঘাসে ঘেরা ঘের দেখতে খুব ই চমকপ্রদ লাগছে। এর মাঝে কিছু কচি ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু চকচক করছে সূর্যের রশ্নিতে। অন্য সময় হলে হয়তো এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম প্রশান্তি দিতো রাজশ্বীকে। কিন্তু আজ দিচ্ছে না, সে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। একটি মানুষো মুখ খুলছে না। ব্যাপারটা অবাক করছে তাদের। এর মাঝে এক দম্পতিকে চোখে পড়লো রাজশ্বীর। তারা ব্যাগগুলো কাধে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ মহিলা তার পাঁচবছরের মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরেছে। আর পুরুষটি ব্যাগ বস্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে একটি টেম্পোর মতো ছোট যানবাহন। সুমন ছুটে গেলো তার কাছে। সুমনের আকস্মিক ছুটে আসা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে লোকটি। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি সমস্যা ভাই? এভাবে ছুটে আসছেন কেনো?”
“ভাই একটু দাঁড়ান, কিছু কথা ছিলো”
“আমরা কোনো কথা কইতে পারব না”

বলেই পাশ কাটালেই সুমন তাদের রাস্তা আটকায়। আকুতির স্বরে বলে,
“ভাই, দুই মিনিট। অল্প কিছু কথা”
“আরে মশাই কে আপনি, তক্ত করে যাচ্ছেন”

রাজশ্বী অবস্থার অবনতি দেখে ছুটে গেল। লোকটিকে ধীর গলায় বুঝানোর চেষ্টা করলো,
“ভাই, আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে এসেছে। সামনেই তো ভোট, কোনো বাড়িতে কতটা ভোটার আছে সেটা জানতে এসেছে। আপনারা তো এই ইউনিয়নের ভোটার তাই নয় কি?”
“জ্বে”
“আপনারা কি কোথাও যাচ্ছেন?”
“জ্বে যাচ্ছি?”
“দেখে তো মনে হচ্ছে আপনারা একেবারের জন্য কোথাও যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন?”

দম্পতির রাজশ্বীর প্রশ্নে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। রাজশ্বী অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো উত্তরের। লোকটি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমরা দুজনই ভোট দেই, কার্ড ও আছে। আমরা শহরে যাচ্ছি, আমার জমি ভিটা বেঁচে দিছি।”
“ওমা কেনো?”
“কি আর কমু, হালার পুতেরা আমগোর চাষের জমি দখল কইরা নিছে। এখন কাম ছাড়া চলাম কেমনে? তাই বেঁচে দিছি।”

রাজশ্বীর চোখ চকচক করে উঠে সে সুমনকে দৃষ্টির ইশারা করে। সুমন সেটা বুঝে অবাক হবার রঙ্গ করে বলে,
“দখল কইরে নেছে, কে দখল করছে?”
“ওই চামার গুলান। রাতের অন্ধকারে জমি ঘেরাও দিয়ে দেছে”

লোকটির পত্নী তাকে বাধা দেয়। বাহু টেনে বলে,
“আহ, কি বলছো তুমি”
“আরে কইতে দাও। এরা সরকারি লোক।”

তারপর লোকটি বলতে শুরু করে,
“আর বইলেন না ভাই, রাতের আন্ধারে এক দল লোক আমগোর জমি দখল কইরে নেছে। আমাদের ধানের জমি গুলা রাতারাতি নিজের নামে করে লাইছে। আমরা মূখ্য মানুষ, কথা কইবার জন্য গেলে ওরা কয় প্রমাণ কই? আমাদের বাপ দাদার জমি, এতো কি কাগজ বানাইছি। হালার পুতেরা নকল কাগজ বানায়ে সব দখল করে লাইছে। চেয়ারম্যানের কাছে গেছি বিচারের জন্য। চেয়ারম্যান কয় কাগজ কই? কয়েকজন তো গেছিলো ও তাদের বিপক্ষে কথা কতি। লাভ হলো না গো, ছোয়াল দুটোরে জায়গায় মাইরে লাইলো। পুলিশের কাছে গেছি, পুলিশ কয় ছোটলোকের জাত মরবি ই তো। টাকা দেচ্ছে নে না, পরে আমরা ভাবলাম টাকা দিতাছে যখন তাই নেই। দামের আধা টাকায় বেঁচে দিছি। এখন সব বেঁইচে শহরে যাই। এই টাকায় রিক্সা চালাম, আর কি করবো!”

লোকটির স্ত্রী আঁচলে মুখ গুজে কাঁদে। লোকটি কনুইয়ে জল মুছে। রাজশ্বী স্তব্দ হয়ে যায় লোকটির বক্তব্যে। সুমন লোকটিকে বলে,
“চিন্তা কইরেন না ভাই, সব ঠিক হয়ে যাবে”
“দোয়া করবেন ভাই। আজকেরা আমরা সিধা বইলে মাইনষে আমগোরে ঠকায়ে পায়ের তলে পিসতেছে। আল্লাহ এগোর উপরে ঠাডা ফেলাবো।”

লোকটির চাপা কষ্টটি চোখে ছলছল করছে। এক রাশ বিতৃষ্ণায় বুক বিষিয়ে আসে রাজশ্বীর। না দেখেও কাউকে ঘৃণা করা যায় জানা ছিলো না তার। অন্যায়ের কি কোনো মাত্রা নেই। কতোটা পাশবিক হলে এই অক্ষরজ্ঞান মানুষগুলোর সরলতার সুযোগ নেওয়া যায়। এক অদৃশ্য জিদ চেপে বসে রাজশ্বীর মাথায়। জিদ সত্যকে সামনে আনার। জিদ, ওই পশুগুলোর মুখোশ টেনে ছিড়ার। দম্পতি সামনে এগিয়ে যায়। একটা লেবুনাতে উঠে চলে গেলো। সুমন আক্ষেপের স্বরে বলে,
“মানুষের মূল্যবোধ ধ্বংসাস্তউপে পরিণত হচ্ছে, অথচ আমাদের গর্ব আমরা নাকি মানুষ। পশুরাও এদেএ পাশবিকতায় লজ্জা পাবে”
“আমরা কি এদের থামাতে পারবো না?”

রাজশ্বীর ক্ষুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞাস করা প্রশ্নে সুমন চুপ হয়ে গেলো। তার সত্যি জানা নেই এই প্রশ্নের উত্তর। সত্যি কি এদের থামানো সম্ভব?

২৫.
রুদ্র দু দিন হয়েছে ফিরে নি। দু-তিনবার কথা হয়েছে উমার সাথে। কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য। অভিনব বাবুর বেল হয় নি। আজ সকাল দশটায় তাকে কোর্টে তোলা হবে। এর পর তার বিচার হবে। উমা পুজো সেরে নিলো। ফুলির মা নাস্তা নিলো টেবিলের। আঁচলখানা টেনে উমা আসলো খাবার রুমে। ফুলির মা উমার শুকনো মুখখানা দেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“বউ ঘুম হয় নি?”

ফুলির মার প্রশ্নের উত্তর দিলো না উমা। বরং অন্যমনস্ত মনে হেটে হেসেলে ঢুকলো। উমার উদাসীনতা দেখে ফুলির মা তার কাছে এসে তার কাধে স্পর্শ করে। তখন উমা চমকে উঠে। এই দুদিন তার মন বড্ড উদাসীন। সারাটাক্ষণ গভীর চিন্তায় মন বিচলিত রয়েছে। তাই কোনো কিছুতেই তার মনোযোগ নেই। ফুলির মা তাকে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“বউ তোমার শরীরডা কি খারাপ? মুখটা চুপসাইয়া গেসে এক্কেরে। রুদ্র দাদা আইবো না আজকেরা? ওরে কমুনে ডাক্তার দেখাতে।”
“না গো, আমার কিছু হয় নি। শুধু দু দিন ঘুম হয় নি। তাই চোখ বসে গেছে।”
“আজ কলেজে যাওন লাগতো না তোমার। ফিট খাইয়া পইরে যাবা নে। পোয়াতি মাইয়াদের ঘরে থাকাই ভালা।”

উমা বুঝতে পারলো আজ ফুলির মা তাকে কলেজে যেতে দিবে না। কিন্তু আজ তার কলেজে যেতেই হবে। সামনে পরীক্ষা, বান্ধবীদের কাছ থেকে নোটপত্র জোগাড় করতে হবে তার। তাই ফুলির মার কথা বাধা দিয়ে বললো,
“সামনে পরীক্ষা ফুলির মা, এমনিতেও কিছুদিন পর কলেজে যাওয়া হবে না। তাই পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে চাই।”
“এতো পইড়ে কিতা হবো?”
“অনেক কিছুই হবে গো, তুমি বুঝবে না”

হেসেই কথাটা বললো উমা। ফুলির মা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“খায়ে নাও তো,বুঝি না বাপু তোমাদের রঙ্গঢং।”

উমা স্মিত হেসে খেতে বসলো। কিন্তু খাবারটা গলা দিয়ে নামলো না। মনের ভেতরে এক অস্বস্তি ডানা মেলে ঘাপতি মেরে আছে। কোনো মতে খেয়ে উঠলো উমা।

কলেজ শেষ হতে বিকেল হলো আজ। তেজহীন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। উমা ব্যাগ থেকে ফোনটি বের করে দেখলো। রুদ্রের ফোন আসে নি। গতকাল রাতের পর আর কথা হয় নি রুদ্রের সাথে। উমা ফোন দিয়েছিলো ক বার কিন্তু সে ফোন ধরে নি। উমার চিন্তা বাড়লো। এমনটা কখনোই হয় না। সে রুদ্রের নম্বরে ফোন দিলো। কিন্তু ফোনটি বন্ধ। কিছু একটা ভেবে রুদ্রের গুদামে ফোন দিলো। অনেকক্ষণ বাজার পর টেলিফোন তুললো রক্তিম।
“আদাব, কেন বলছেন?”
“আমি উমা, রক্তিম দা?”
“হ্যা বলো উমা, আজ এখানে ফোন করলে যে?”
“উনি কি গুদামে এসেছেন?”
“না রুদ্র তো গুদামে আসে নি।”

উমা বিচলিত হয়ে পড়লো। কোনো অঘটন কি ঘটলো? সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“উনি কি ফোন করেছিলো? কিছু জানেন ও বাড়ি কি হয়েছে?আমি ফোন করেছিলাম ধরেন নি, উপরন্তু তার ফোন বন্ধ।”
“চিন্তা করো না উমা, ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। দুঃসংবাদ তো একটা আছেই। জ্যেঠুর বেল হয় নি। রুদ্র কোর্ট থেকে বের হয়েই ঘেরের দিকে চলে গিয়েছে। আজ কিছু পার্টির সাথে মিটিং আছে তার।”

রক্তিমের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো উমা। তারপর বলল,
“রক্তিম দা আমি রাখছি। ভালো থাকবেন”
“আচ্ছা”

ফোন রেখে গাড়িতে উঠলো উমা। প্রদ্যুত কে বললো,
“প্রদ্যুত দা, ঘেরের বাড়ি চলুন তো”
“বাড়ি যাবেন না?”
“দাদাকে নিয়ে তারপর যাবো”

প্রদ্যুত আর কথা বাড়ালো না। মিনিট বিশেক বাদে গাড়িটি থামলো ঘেরের বাড়ি। রুদ্রের মাছের ঘের এখানে। তার মাঝে একটা একতলা বাড়ি। বাড়িটি তত্ত্ববধায়কের থাকা খাওয়ার জন্য করা। রুদ্র প্রায় এখানে আসে। তার যত মিটিং সব এখানেই করে সে। উমা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। বাড়িটিকে দেখে কেনো যেনো বুকে কামড় পড়লো উমার। শুনশান একটা বাড়ি। হাতঘড়িতে তখন বিকেল ৫.৪৫টা বাজে। অথচ ঘেরের বাড়িতে কোনো সাড়া শব্দ নেই। উমা এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। বাড়ির অন্দরেও কেউ নেই। পিনপতন নিরবতা৷ উমা এক একে সব ঘর গুলো দেখলো৷ মোট চারটি ঘর এই বাড়িতে। একটি রুদ্রের, বাকিগুলো অন্যদের। তার মধ্যে রুম ঘুরতে ঘুরতে আরেকটি দরজা দেখলো উমা। দরজাটি দেখে মনে হলো আরেকটি ঘরের। কিন্তু উমার জানা মতে এই বাড়িতে শুধু চারটি ই ঘর। সে দরজাটি ধাক্কা দিতেই একটি সিড়ি নেমে গেলো নিচের দিকে। উমার কেনো যেনো ভয় হচ্ছে৷ তবুও কৌতুহলের কাছে ভয় হার মানলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে। নামতে থাকলো অন্ধকার সিড়ি দিয়ে। মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে সাবধানতার সাথে থামতে থাকলো সে। হঠাৎ কারোর চিৎকার কানে এলো তার। বুকটা কেঁপে উঠলো। হিম ধরে গেলো শিরদাঁড়ায়। সিড়ি থেকে থেমেই একটি ঘর। যার দরজা আজানো। মশালের হলুদ রশ্নি ফাঁক থেকে চুইয়ে পড়ছে। উমা কাঁপা হাতে দরজাটা খুললো। যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাতে বুক কেঁপে উঠলো তার। চিনচিনে অসহনীয় ব্যাথায় আহত হলো হৃদয়……….

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here