#গল্প
#একজন_সঙ্গে_ছিলো
#লেখাঃনিপা
পর্ব-৩
৫.
এবার সুস্থ হতে রিশিতার একটু কম সময় লাগল। যে কয়েকদিন রিশিতা অসুস্থ ছিলো সে কয়েকদিন তাহমিদ এক মুহুর্তের জন্যেও ঘরের বাইরে যায় নি। ডঃ কামাল হোসেনের জোড়াজুড়িতে শেষমেশ রিশিতাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর জন্যে রাজি হলো তাহমিদ। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম ফারজানা মাহবুব, সে ইন্ডিয়া থাকে। একমাসের জন্যে বাংলাদেশে এসেছে তাই এই সময়ে রিশিতার ব্যাপারটা দেখার জন্যে ডঃ কামাল রিকুয়েস্ট করেছেন।
তাহমিদ রিশিতাকে ফারজানা মাহবুবের কথা একবার বলার পরই রাজি হয়ে গেলো। ও ভেবেছিল রিশিতা হয়তো রাজি হবে না, কিন্তু রিশিতা অনায়াসে রাজি হয়ে গেলো। একবুক আশা নিয়ে ফারজানা মাহবুবের কাছে যাচ্ছে, ওর বিশ্বাস এবার রিশিতা সত্যি সুস্থ হয়ে যাবে।
ফারজানা মাহবুবের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে রিশিতা আর তাহমিদ। রিশিতা রুমটাকে ভালো করে দেখছে। পুরো রুম বিভিন্নরকম পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। রিশিতার মনে হলো এই মহিলা অনেক সংসারী।
-আপনাদের কি অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম?
তাহমিদ ফারজানা মাহবুবের কথায় মুখে হাসি হাসি ভাব এনে বলল,
-না না ঠিক আছে। আমরা এসেছি বেশিক্ষণ হয়নি।
রিশিতা ভালো করে ফারজানা মাহবুবের আপদামস্তক দেখতে লাগল। মহিলা খুব একটা রুপবতী নয়, তবে চেহারায় একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে যে কারনে দেখতে ভালো লাগছে। তবে মহিলা অনেক পরিপাটি সাধারণ অরেঞ্জ কালারের সিল্কের শাড়ি, চুলগুলো হাতখোপা করে করে বাধা আর চোখে একটু কাজল, এইটুকুতেই বেশ অপূর্ব লাগছে।
-যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি কি যেতে পারি? আমার একটু ইমারজেন্সি কাজ ছিলো।
ফারজানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখলো, পরক্ষনেই আবার হেসে বলল, হ্যাঁ শিওর! আমরা দুজন মহিলা গল্প করবো তার মধ্যে আপনি থেকে কি করবেন!
-ধন্যবাদ। আসলে অনেকদিন অফিসে যাওয়া হয়না তো, ওদিকটাও তো সামলানো দরকার।
-হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো বটেই। আপনি যেতে পারেন মিঃ তাহমিদ।
তাহমিদ চলে যাওয়ার পর ফারজানা রিশিতার মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করলো,
-আমাকে কেমন দেখলেন মিসেস রিশিতা?
হঠাৎ ফারজানার করা এমন প্রশ্নে রিশিতা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ফারজানা সেটা বুঝতে পেরে বলল,
-আপনি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্যে কিন্তু বলিনি।
রিশিতা হেসে বলল, আপনাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে তাই দেখতে ভালো লাগছে।
-ধন্যবাদ। তবে আপনি যদি আমাকে স্নিগ্ধ লাগছে না বলে সুন্দর লাগছে বলতেন সেটা আমি বিশ্বাস করতাম না।
-কেনো??
-কারণ আমি দেখতে আহামরি কিছুই না। তাই কেউ যখন বলে তোমাকে সুন্দর লাগছে তার মানে হচ্ছে সে স্পষ্ট আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি কুৎসিত।
-বাহ! আপনি তো অনেক সুন্দর করে কথা বলেন। সব সাইকিয়াট্রিস্টরাই কি এরকম ভাবে কথা বলে?
ফারজানা হেসে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি খাবেন চা না কফি?
-শুধু ঠান্ডা পানি।
ফারজানা ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
-রিশিতা আজ ডক্টর হিসেবে নয়, আমরা দুজন নারী হিসেবে গল্প করবো। দুজন দুজনের জীবনের গল্পগুলো বলবো ও শুনবো।
রিশিতা হেসে বলল, আপনি কি আপনার সব পেশেন্টদের ঠিক এই কথা বলেন??
-না। ডঃ রিশিতা নামটা শোনার পর আপনার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিয়েছিলাম, সেখান থেকেই জানতে পারলাম যে সাধারণ রিশিতা থেকে ডঃ রিশিতা হয়ে ওঠার একটা লম্বা গল্প আছে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো গল্পটা আপনার মুখ থেকে শুনতে।
-শুধু কি সেকারনে? নাকি ট্রিটমেন্টের জন্যেও?
কোনো ভনিতা না করে ফারজানা বলল, হ্যাঁ সেজন্যও দরকার। একদম শুরু থেকে এই পর্যন্ত সবকিছু জানতে চাই, তাহলে চিকিৎসা করতে সুবিধা হবে।
রিশিতা বলল, আমি সব বলবো কিন্তু একটা শর্তে, আপনাকেও আপনার গল্পটা বলতে হবে, কারণ আপনাকে প্রথম দেখেই আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
ফারজানা হেসে সম্মতি জানালো।
৬.
আমার বাবার বাড়ি ফরিদপুর, আর মায়ের বাড়ি কলকাতার বর্ধমানে। আমার মা ছিলো আমার নানার একমাত্র মেয়ে। নানা মারা যাওয়ার পর মা কিছুতেই আর এদেশে এসে থাকতে রাজি হলোনা, তাই বাধ্য হয়ে বাবাকেও সেখানে থাকতে হলো। নানার ব্যবসার হাল ধরলো বাবা।
ও আমার বাবার নামটাই তো বলা হলো না! আমার বাবার নাম মাহবুব ইসলাম। তার দুই মেয়ে, বড় মেয়ে ফারহানা মাহবুব আর ছোট মেয়ে ফারজানা মাহবুব। আমার বড় বোন আমার থেকে চার বছরের বড়। আমরা দুজনই বাবার খুব আদরের, ঠিক কতোটা আদরের সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। সব রকম স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছেন, আর আমরা সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছি। একবার আমার আপা এসে বাবাকে বলল, সে একটা ছেলেকে ভালোবাসে, তখন আপা সেভেনে পড়ত আর ছেলেটা নাইনে। মা শুনে প্রথমে রাগারাগি করলেও বাবা ছিলো একদম শান্ত। সে সবটা মেনে নিলো, আর আপাকে শর্ত দিলো প্রেম করো আর যাই করো পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করতে হবে। এমনকি আপার ঘুরতে যাওয়ার টাকাও বাবা দিতো।
মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যে আপা একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেলো। যে ছেলেটার সাথে পালিয়ে গেলো সেই ছেলেটা পেশায় ছিলো কাঠমিস্ত্রী। আমাদের বাড়ির বাথরুমের দরজা লাগানোর কাজে এসেছিলো বাবা ব্যাকুল হয়ে গেলেন আপার পরীক্ষার জন্যে। তাই ওই ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা মায়ের হাতে পায়ে ধরেছিল আপাকে পরীক্ষা দেয়ানোর জন্যে। তারা রাজি তো হলোই না উল্টো বাবার নামে থানায় কেস করলো। বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল।
এইটুকু বলে থেমে গেলো ফারজানা। রিশিতা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো, এক চুমুক পানি খেয়ে ফারজানা আবারও বলা শুরু করলো,
বাবাকে পুলিশ নিয়ে গেলে মা আমাকে নিয়ে সেখানে যায়। আপাও এসেছিলো, আপাকে দেখে মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আপা এসে বলল , এই লোকটাকে ছাড়বেন না, এই লোকটা জানোয়ার, ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। দেখুন আমাকে মেরে কি করেছে!
সেটা বলেই আপা পিঠের কাপড় সরিয়ে দেখালো।
আমার মা তখন হতবিস্ময়ে কান্না ভুলে আপার দিকে তাকালো। আর আমি বাবার দিকে তাকালাম, আমার চোখে চোখ পরতেই বাবা চোখ নামিয়ে নিলো লজ্জায়।
কিছুসময় চুপ করে থেকে ফারজানা আবারো বলতে শুরু করলো,
বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর আমাদের জীবনটা যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। সবাই বলতে লাগল, লোকটাকে ভেজা বিড়াল মনে হয় কিন্তু ভিতরে এতো বড় শয়তান! ভাগ্যিস বড়টা পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছিল!
আমি ছিলাম শক্ত ধাতুতে তৈরি তাই খুব একটা কাঁদতে পারতাম না, কিন্তু আমার ভীষণ কষ্ট হতো।
একদিন রাতে বাবা এসে আমাকে বলল, ছোটন আমরা যদি দিল্লি গিয়ে থাকি তবে কি তোর সমস্যা হবে?
আমি বলেছিলাম, না বাবা আমিও এখান থেকে চলে যেতে চাই। সেদিন প্রথম বাবার চোখে হেরে যাওয়া দেখেছিলাম আমি।
আমরা সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে দিল্লি গিয়ে আবারও নতুন করে শুরু করলাম। সেখানে বাবা সবাইকে বলেছিল আমি তার একমাত্র মেয়ে। দিল্লি গিয়ে আমরা আপাকে একদম ভুলে গেলাম। কখনও আপার কোনো খবর নেইনি।
এরপর কেটেছে অনেক বছর আমি তখন সাইকোলজিতে চুটিয়ে পড়াশোনা করছি। একদিন বন্ধুদের সাথে কলকাতা ঘুরতে গেলাম। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে আমার এক দুসম্পর্কের মামাতো বোন পড়তো সেখানে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আমি যখন সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম তখন একটা বাচ্চা ছেলে আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে পালালো। হোটেলে ফিরে যাওয়ার মতো টাকা ছিলো না বলে আমি হেটেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে আমার সামনে থামলো, গাড়ি থেকে একজন সুদর্শন পুরুষ নেমে আমাকে স্পষ্ট বাংলায় জিজ্ঞেস করলো
-ইয়ং লেডি আমি কি তোমাকে পৌছে দিতে পারি? আমি দেখেছি যে তুমি তোমার ব্যাগ হারিয়েছো।
আমার কি হলো জানিনা, আমি গাড়িতে উঠলাম।
গাড়িতে বসে দুজন টুকিটাকি আলাপ করলাম নিজেদেরকে নিয়ে। ভদ্রলোকের নাম ছিলো ফয়সাল আরেফিন, স্কটল্যান্ড থাকে। ইন্ডিয়া ঘুরতে এসেছে।
আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় নিজের ফোন নাম্বার আমাকে দিয়ে বলল, তুমি যদি আমাকে ফোন করো তবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবো! হঠাৎ করেই লোকটা সানগ্লাস খুলে ফেলল, তখন আমি দেখতে পেলাম যে লোকটার চোখ দুটো নীল।
পর পর তিনরাত আমি লোকটার সাথে কথা বললাম। তারপরই আমি গিয়ে বাবাকে বিয়ের কথা বললাম। বাবা মা দুজনেই সম্মতি দিলো। বাবা শুধু একবার বলেছিলেন, আরো একটু সময় নিলে কি ভালো হতো না! আমি সেদিন বাবাকে ভরসা দিয়ে বলেছিলাম তোমার মেয়ে সাইকোলজির স্টুডেন্ট, সে কখনও মানুষ চিনতে ভুল করতে পারেনা!
এতটুকু বলে ফারজানা থেমে গেলো। ফারজানাকে থেমে যেতে দেখে রিশিতা বলল,
-আপনার খারাপ লাগলে আর বলতে হবে না।
ফারজানা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলো,
বিয়ের পর আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবতী ভাবতে শুরু করলাম, কারন ফয়সাল আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কোনো কাজের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই, যেখানে ঘরের কাজ আমার করার কথা সেখানে সব কাজ ও করতো। আমাকে বলতো সুইটহার্ট তুমি শুধু ক্যারিয়ার নিয়ে ভাববে আর কিছু নয়।
আমিও দিনরাত এক করে পড়াশোনা, রিসার্স নিয়ে থাকতাম। ফয়সাল সপ্তাহে পাঁচদিন আমার সাথে থাকতো। বাকী দুই দিন ব্যাবসার কাজে বাইরে থাকতো। বিয়ের তিনবছর পর্যন্ত এরকমই চলছিলো, একদিন আমি ফয়সাল কে বলেছিলাম আমিও তোমার সাথে যাব। ফয়সাল কোনোভাবে রাজি তো হলোই না উল্টো আমার সাথে রাগারাগি, চেঁচামেচি করলো। আমার কেনো যেন ব্যাপারটায় খটকা লাগলো, আমি ফয়সালের পিছনে লেগে রইলাম কিন্তু সেটা ফয়সালকে বুঝতে দিলাম না।
কিন্তু ফয়সাল সম্পর্কে যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা শুনে আপনি হয়তো খুব অবাক হবেন!
রিশিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফারজানার দিকে তাকালো।
-আমি ছিলাম ফয়সালের দ্বিতীয় স্ত্রী। আমাকে বিয়ে করার সাত বছর আগে আরও একবার বিয়ে করেছিল। আর সেখানে একটা মেয়েও আছে।
-তারপর? আপনাদের সম্পর্ক কি এখনও আছে?
-হ্যাঁ। আমাদের একটা ছেলেও আছে।
-আপনি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে কেন আসলেন না?
-কিভাবে আসতাম? আমি তো বিয়ের আগে একবারও ফয়সাল সম্পর্কে জানতে চাই নি! বাবার সামনে কিভাবে আসতাম?
-আপনি আপনার স্বামীর কাছে কৈফিয়ত চাননি?
-চাইলেই বা কি হতো! সে বলতো সুইটহার্ট তুমিতো একবারও জানতে চাও নি যে আমি বিবাহিত কি না! আর আমি তো নিজে থেকে বিয়ের জন্যে যাইনি তুমিই এসেছিলে।
রিশিতা আর বলার মতো কিছু পেলোনা।
-আর একটা মজার ব্যাপার হলো আমার বিয়ের নয় বছর পর সে আবারও একটা বিয়ে করলো আর তারপর সপ্তাহে পাঁচদিনের পরিবর্তে আমার কাছেও দুদিন থাকতে শুরু করলো।
-আপনি আপনি বাবা মাকে কিছু জানান নি?
-না! তাদেরকে জানালে তারা ভাবতো তাদের করা কোনো পাপের শাস্তি পাচ্ছি। বাবা মাকে কষ্ট দেয়ার চেয়ে সুখী থাকার অভিনয় করা অনেক ভালো।
আমার মা যখন কাউকে বলে দোয়া করি আমার মেয়ের মতো কপাল যেন তোমার ও হয় তখন আমি মনে মনে চিৎকার করে বলি, তোমার মেয়ের মতো কপাল যেন আর কারো না হয়!
– আপনার স্বামী কি কখনও আপনার সাথে খারাপ আচরণ করে ?
-না! সে খুব ভালো অভিনেতা।অভিনয়ে সে খুব পারদর্শী। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হয়েও যেখানে তার মন বুঝতে পারি না, সেখানে আপনি বুঝতে পারছেন না সে কতটা নিখুঁত অভিনেতা!
রিশিতা চোখে পলক না ফেলে ফারজানার দিকে তাকিয়ে রইলো।আর ফারজানা তখন শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরেছে ।
চলবে……….……