একটি বৃষ্টির রাত – ২
____________________
নিঃশব্দতার মাঝে শুধু বৃষ্টি। ডানে , বামে সবখানে। নেই কোলাহল নেই যানজট। আছে শুধু বৃষ্টি এবং ল্যাম্পপোস্টর হলদেটে আলো। একেকটি বৃষ্টির স্পর্শ বয়ে আনছে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা অনুভূতি আর ল্যাম্পপোস্টর আলোয় ভালোলাগা ছেয়ে আসছে মনের কোণায়। খুশবু সবসময় আশা করেছে এমন একটি দিন আসবে যখন সে , মধ্যরাত্রে জীবনসঙ্গীর সাথে বৃষ্টির মাঝে ভিজবে ল্যাম্পপোস্টর আলোর রেখায়। এবং তা আজ খুব অনায়াসে পূরণ হয়ে গেলো এক অজানা ভদ্রলোকের সাথে। এই নিয়ে সে শতবার আঁড়চোখে বিভোরের দিক তাকিয়েছে। সাদা শার্ট ভিজে বিভোরের সুঠোম দেহ স্পষ্ট দৃশ্যমান তার চোখের সামনে। লম্বাচওড়া দেহের এই ভদ্রলোককে সুদর্শন না বললে যেমন চলছেই না।
‘জুতো জোড়া খুলে ফেলুন। হাঁটতে সুবিধে হবে।’
বিভোর হঠাৎ বলে উঠলো কথাটি। খুশবু এবার লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়লো। বিভোর এভাবেই প্রচন্ড লম্বা। উঁচু জুতো পরেও তাকে খাটো দেখাচ্ছে এর সামনে। জুতো জোড়া খুললে তো তাকে দেখাই যাবেনা। হাঁটতে অস্বস্তি হচ্ছে মাথায় রেখে জুতো জোড়া শেষপর্যায়ে খুলে হাতে নিলো । এবার খেয়াল করলো সে বিভোরের কনুই পর্যন্ত পৌঁছেছে। উনিশ বছরের জীবনে সে কখনো হাইট নিয়ে আফসোস করেনি।কারণ সদাশয় তার হাইট পারফেক্ট মনে হয়েছে। কিন্তু আজ,
‘বাড়ি কোথায় ?’
‘ধানমন্ডি তেত্রিশ।’
বিভোরের প্রশ্নে খুব দ্রুত জবাব দিয়ে জিব কাঁটল খুশবু। খুব বেশি বলে ফেলেছে কী ?বাড়ির সম্পর্কে অচেনা কাউকে বলাটা কী ঠিক হলো ?
‘আমারো। সেকশন ?’
এবার চুপ হয়ে রইলো খুশবু। বিভোর শব্দ করে হাসলো,
‘এতটাই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে আমাকে ? আপনাকে বাড়িতে যেতে সাহায্য করবো বিদায় প্রস্নটা করা।’
খুশবুর খারাপ লাগলো। সেতো সাধারণ একটি মেয়ে। এভাবে একা একজন পুরুষের সাথে এই প্রথম চলাচল করছে।সন্দেহ , ভয় তো থাকবেই। তারওপর যেই পরিস্থিতিতে পড়েছিল। অন্যকোনো মেয়ে হলে কেঁদেকেটে মাটিতে পড়ে থাকতো। মনের কোণায় ভয় , ভালোলাগা , সন্দেহ নিয়ে সে দোটনায় ডুবে আছে। বিভোর কী খারাপ অনুভব করছে ? বলবে কী খুলে ? কিন্তু কি বলবে ? ভেতরে খানিকটা ভয় এখনো রয়েছে এই নির্জনতা দেখে। হঠাৎ সামনে কিছু টেক্সি দেখে খুশি হয়ে উঠলো তার মন। দ্রুত এগোতেই দেখল বিভোর সেখানে যাচ্ছেনা। বরং সামনে হাঁটছে।খুশবু সন্দেহ দৃষ্টিতে বলল,
‘এইযে সামনে টেক্সি।’
‘এখান থেকে নেওয়াটা বেশ রিস্কি। মেইনরোড থেকে নিবো। চলুন।’
জড়তা কাজ করছে খুশবুর মধ্যে। মনেমনে বিশালাকৃতি জনক ভয়াবহ কিছু ঘটনা ভাবতে বসলো। এদিকে বিভোর তার চোখমুখের অবস্থা দেখে থেমে গেলো। কন্ঠে একটু ক্রোধ নিয়ে বলল ,
‘আমি বুঝতে পারছি আপনার ভয়ের কারণ। কিন্তু আপনার ভয়ের পাত্র আমি , সেটা হজম করতে পারছি না ঠিক। একঘন্টা আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম বিকজ অব ইউ। চাইলেই ভিজে চলে আসতে পারতাম, কিন্তু আপনাকে ওই বাজে লোকদের সামনে রেখে আসতে বিবেক পাচ্ছিলাম না। এখন আমি যেকোনো টেক্সি নিয়ে চলে যেতে পারি , কিন্তু আপনার কথা ভেবে ঠাঁই হয়ে আছি। একজন সুন্দরী রমনীকে রাত বারোটায় পেলে , এধরণের পুরুষদের মাথা ঠিক থাকেনা। কী থেকে কী ঝামেলায় পড়বো বলা যায়না। একটু কষ্ট করে সচেতন পথ নেওয়াটা ভালো না ?’
খুশবু এবার স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিশ্চুপ চোখজোড়ায় জ্বালা করতে শুরু করল। বিভোর কী বলতে চাচ্ছে সে বোঝা ? হ্যাঁ বোঝাইতো। উটকো ঝামেলা সে। ভাবতেই তার চোখের কোণে জল জমতে শুরু করেছে। অভিমানে বুক ফুলে উঠেছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় এবং ল্যাম্পপোষ্টের হলদে আলোয় তাকে একটি সতেজ নীল ফুল দেখাচ্ছে বিভোরের চোখে , খানিকটা মায়াবী তো খানিকটা সহজসরল ও। ছোট নিঃশ্বাস ফেলে সে খুশবুর হাত থেকে জুতো জোড়া নিজের হাতে নিয়ে হাঁটা ধরল। হতম্ভব খুশবু দ্রুত চেঁচাল,
‘আরে কী করছেন ?আমার কাছে দিন।’
‘শাড়ী ধরবেন নাকি জুতো না ব্যাগ?’
‘আমি পারবো সব একত্রে ধরতে।’
বিভোর হাসলো।এবং পরপর ব্যাগটিও খুশবুর হাত থেকে নিয়ে নিলো।
‘ কী করছেন ?’
খুশবু চেঁচাতেই বিভোর বলল,
‘আবার ভাববেন না যে , আপনার ব্যাগ চুরি করার মতলব এঁকেছি। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ৷ আপাতত জেন্টলম্যান সাজার চেষ্টায় মেতেছি। চলুন।’
‘ আরে না দিন না, প্লিজ।’
‘ আরে থাক না, প্লিজ।’
খুশবু কিংকর্তব্যবিমুঢ়৷ এই না রাগ দেখালো? এতদ্রুত রাগ শেষ? আঁড়চোখে বিভোরের দিক পুনরায় তাকাল যিনি মন খুলে হাসছে। খেয়াল করল বিভোর হাসলে তার দু-গালে টোল পড়ে। অদ্ভুত সুন্দর।
জুতো হাতে বিভোর খুশবুর পাশে হেঁটে চলেছে। সামনে ফ্লাইওভার দেখা যাচ্ছে। এবং মাত্র একটি টেক্সি এসে থেমেছে। বিভোর সজোরে ডাকল ,
‘ওই মামা। যাবানি ?’
টেক্সিতে একজন মধ্যবয়সী ড্রাইভার।
‘কই যাইবেন ?’
‘ধানমন্ডি তেত্রিশ।’
‘মেলা দূর। এতো রাইতে যামুনা।’
‘চলেন না মামা। সাথে আছে নারী উইদাউট গাড়ি। ভিষণ বিপদে পড়েছি। আপনি ছাড়া আমাদের গতি নেই।’
কী অমায়িক সুন্দর ব্যবহার। খুশবুর বেশ ভালো লাগলো শুনতে। সে টেরাচোখে বেশ কয়েকবার বিভোরকে দেখে নিল৷ বিভোর তখন ড্রাইভার মামাকে মানাতে ব্যস্ত। ড্রাইভার মামা তখন পেছনে দাঁড়ানো খুশবুকে দেখে চিন্তায় পড়লো।
‘এতদূর যাইবার তেল নাই। মিরপুর পর্যন্ত যাওয়া যাইব।’
বিভোর একটু ভাবতে বসলো। মিরপুর দুই’য়ে থামলে বাস পাওয়া যেতে পারে৷
‘ আচ্ছা , ঠিকাছে। ‘
‘ চারশো হইলে যামু।’
‘ সমস্যা নেই৷ আপনি শুধু চলুন।’
গাড়িতে বসতেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল খুশবু। ভিজে থাকা চুলগুলো ঝাড়তে লাগলো। খেয়ালই করল না বিভোরের চোখজোড়া , যেই চোখজোড়া তার পানে তাকিয়ে দ্রুত অন্যদিক ফিরে গেল।
‘খারাপ লাগছে খুশবু ?’
খুশবু খানিক চমকে উঠলো। এমনভাবে ডাকছে যেমন তারা দুজন ছোটকাল থেকে পরিচিত ? আর এমন গভীর কন্ঠে তার নামখানাও বেশ অদ্ভুত সুন্দর শোনাচ্ছে।
‘না। ঠিকাছি।’
‘একটু চোখ বুঝে মাথা হেলে রাখেন। ইউ’ল ডেফিনেটলি ফিল ব্যাটার।’
তারপর বিভোরের ধ্যান ড্রাইভার মামার দিক।
‘তো মামা ? এতরাতে এখনো রাস্তায় যে ? বাড়িতে মামি বুঝি রাগে না ?’
ড্রাইভার মামাও যেমন মুহূর্তেই ফ্রি মাইন্ডেড হয়ে গেলো। মুখ ভোরে হেসে মন খুলে বলতে লাগলো,
‘রাগে না আবার। মুখ ফুইল্লা বইয়া রইবো। আমি ফিরলে কথাই কইবো না। কতশত কিছু কইয়া মানাইতে হয়। আপনি তো জানবেনই , আপনার ও তো আছে পাশেই।’
খুশবুর গাল দুটো গরম হয়ে উঠলো। ড্রাইভার মামা তাদের ভুল বুঝেছে। সে আশা রাখল হয়তো বিভোর ব্যাপারটা ক্লিয়ার করবে কিন্তু না বরং বিভোর ড্রাইভার মামার সাথে শব্দ করে হাসলো কিন্তু অমত করলো না। খুশবু দ্বিধায় পড়লো। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস পেলো না।
টেক্সির পর্দা সরিয়ে দিতেই বৃষ্টি খুশবুকে পুনরায় ছুঁয়ে দিতে শুরু করেছে। বাইরে বৃষ্টি তখনো দৃঢ় । বিভোর নিজের দৃষ্টি বাইরে রেখেই প্রশ্ন করল,
‘এতরাত করে কোথা থেকে ফিরা হয়েছিল ?’
‘বার্থডে পার্টি।’
‘উইদ আউট প্রটেকশন কোনো পার্টিতে না যাওয়াটাই শ্রেষ্ঠ। আর এতটা দূর হলে তো কথাই নেই। পার্টি হচ্ছে আনডিপেন্ডেন্ট ফাংশনাল একটিভিটিস। কখন এটার সমাপ্তি কেউ জানবে না। আর আপনি শেষ না করে ফিরতেও পারবেননা। তাই অবশ্যই সাথে বড় ভাই বা বাবা বা অন্যকেউ মাস্ট রাখতে হবে।’
এতো যুক্তিকর কথা বলে কী প্রমাণ করতে চায় ? খুশবু মাথামোটা ?
‘ আপনি কোথা হতে ফিরলেন?’
‘বসের সাথে আউট অব টাউন ছিলাম মিটিং নিয়ে। অবশ্য আমি সেখানেই কোনো হোটেল দেখে থেকে যেতে পারতাম৷ বাট স্টিল আই ফিল মোর এট ইজ হোয়েন আম হোম। তো , পড়াশোনা চলছে? ‘
‘ হুম। অনার্স প্রথম বর্ষে এবার।’
‘ ছোটো তাহলে। এখনো অবুঝ বয়সে আছেন। বাড়ি থেকে এতদূর একা বেরোনোর পারমিশন কীভাবে পেলেন ?’
আজ শাড়ী পরিহিত খুশবুকে দেখে বন্ধু রাফা বলেছিল তাকে আজ নারীজাতি লাগছে। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ুয়া মেয়ে তা কেউ বলবেই না। এখন বিভোরের কথায় বুঝতে পারলো বিভোর তাকে রাফার বলা ‘ নারীজাতিই ‘ মনে করেছে।
‘ না বলে বেরিয়েছিলাম। তারপর পৌঁছে ফোনে জানিয়েছি।একটু রেগেছিল বাবা কিন্তু রাফার কথায় মেনে নিয়েছে।’
‘ এমনটা আর কখনওই করবেন না। ভাবতে পারছেন আজ কী দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো?’
খুশবু কী নিজের মনের কথাগুলো বলবে, আসলেই ঠিক বলছেন। আপনি না থাকলে আমার যে কী হতো। তা কল্পনা করার সাহস পাচ্ছি না। আপনি আজ ফেরেশতার ন্যায়পথ অনুসরণ করে আমায় বাঁচাতে চলে এসেছেন।বড় কৃতজ্ঞতা। কিন্তু পরক্ষণেই অনুভব করলো মনের কোণায় এখনো লুকিয়ে থাকা ভয়ের কথা। এতদ্রুত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কী হবে ? এখনো অনেকদূরের রাস্তা। বাড়িতে সহিসালামত ফিরুক আগে।তারপর লাগলে পা ধরে থাকবে বিভোর। তিনচার লাথি দিয়েও ফেলতে পারবে না তাকে।
চলবে!
নাবিলা ইষ্ক৷