একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ১১+১২

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-১১
রোকসানা আক্তার

রুমকির ছোটমামা রুমকি এবং অশ্রুকে দরজার সামনে দেখে মৃদু হেসে বলেন,
“ওইযে ওরা চলে এসছে!”
কথাটা বলতে যতটা-না দেরী হলো,ততটাই বেওয়ারিশ। পোদ্দার ফ্যামিলির সবাই হকচকিতে দৃষ্টিতে তাকায় দুজনের দিকে।ভুট্টো পোদ্দার এবং ইমতিয়াজ উদগ্রীব মনে তাকালেও আরেকজন ব্যক্তির চোখের কার্নিশ থেকে ভেসে আসছে একরাশ রাগের অবয়ব।তীক্ষ্ণ দু’খানা চোখ থেকে যেন এখুনি ধোঁয়া উড়া অবস্থা।অশ্রু সেদিকে আর বেশিক্ষণ মনোনিবেশ করতে পারিনি।টপকে তার চোখের দৃষ্টি নিচে চলে আসে।
ছোটমামা আবার সায় ছেড়ে বলেন,
“তোরা বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে আস।”
রুমকি এবং অশ্রুর টনক নড়ে উঠে।তারপর বুকের হার্টবির্টের গতিবেগ সামলে অগত্যা দুজন ভেতরে ঢুকে।বলা যায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই।সবার দৃষ্টির গোচরে পালিয়ে যাওয়াটাও বেমানান।দুজন মাথা নুইয়েই রুমের ভেতর এসেই অশ্রু দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দেয়। বুকে হাত রেখে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“উহু রুমকিরে এতক্ষণ বোধহয় শূন্যে ছিলাম।মাথাটা ঘুরচ্ছে!”
রুমকি মুখে বিরক্তি চেপে বিছানার উপর বসে।আর বজ্রকন্ঠে বলে,
“এই ব্যাটাতো দেখছি ভিজেবিড়াল।মৃত্যুর আগ পর্যন্তও পিছু ছাড়বে না।ব্যাটাকে এতটা ব্রেনওয়াশ করলাম তারপরও পিছু ছাড়ছে না!ব্যাটা আসলে চায় টা কি!”
“তুই আছিস এ চিন্তায়!ওই অরুনটার কথা ভেবেছিস?ব্যাঁটা আমাদের দিকে যেভাবে তাঁকিয়েছিল আমিতো সেখানেই হার্টঅ্যাটাক করি!”
“সেটাই অশ্রু!এখন আমাদের কি হবে?আমরা তো বেড়াজালে ফেঁসে যাচ্ছি।ওদের দু’ভাইয়ের আবার কোনো প্লান নয়তো!?”
“জানি নারে!ক্যান যে ওদিন ওই ইমতিয়াজ ব্যাটার সাথে দেখা হতে গেল!উফস!!”

“রুমকি?রুমকি?দরজা খোল!” দরজার ওপাশ থেকে রুমকির মা ডেকে উঠে।
রুমকি চিনচিন বুকে দরজা খুলে দেয়।রুমকির মা ভেতরে প্রবেশ করে বলেন,
“রুমকি তুই এখনো রেডি হস নি?”
“এ-এই তো মা হচ্ছি!”
“আর এই অশ্রু তুই এমন বেদম প্রহরের মতো দাড়িয়ে আছিস কেন বান্ধবীকে ত একটু সাজিয়ে দিতে পারিস।”
“আ-আ-চ্ছা,আন্টি! ”
“আমি গেলাম।কিছুক্ষণ পর আবার আসবো।সেজেগুজে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”বলেই রুমকির চলে যান।রুমকি অম্লান ছোট একটা শ্বাস টেনে চোখদুটো গুড়িসুড়ি করে আনে।এতটা দিন অরুনের ভয়ে সবকিছু ধুলিসাৎ করেও পার পেল না। যার ভয়ে বিয়েতে অসম্মতি হওয়া, যার কারণে ইমতিয়াজকে এতবড় মিথ্যে বলা আজ সেই ভয়ের মানবটিই তাদের পেছনে ছায়ার মতো আঁকড়েই রইল।আর লাভটা হলো কী?শেষেতে হাঁড়িপাতিল একই।আজ কে কাকে স্বান্তনা দেবে সেরকম পরিস্থিতি কারোই নেইই। না অশ্রু রুমকিকে কিছু বলে সান্ত্বনা দেবে, না রুমকি!

রুমকির বিলম্বিত দেখে মা আবার রুমে আসেন।রুমকি এখনো আগের মতো বিছানার উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে।পিনপিনে রাগটা সামাল দিতে কষ্টই হচ্ছে রুমকির মায়ের।মাথাচাড়া দিয়ে এবার রুমকিকে ঝংকার আওয়াজে বলেন,
” রুমকি তোর সমস্যা কি বলতো?একেতো শপিং থেকে দেরী করে এসেছিস এখন আবার রেডি হতেও দেরী করছিস?এসব কোনধরনের একগুঁয়ে!? ”
রুমকি কেঁপে উঠে।তারপর মায়ের কাছে পরাজিত হয়ে বাধ্যমনে রেডি হয়ে নেয় ।রুমকি নীল বেনারসি পড়ে পোদ্দার ফ্যামিলির সামনে এসে দাড়ায়।রুমকির সাথে অশ্রুও আসে।রুমকি অনেক বেশি অপ্রস্তুত পড়ায় অশ্রুকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসে।অশ্রু সাথে থাকলে সে মনে একটু বল পাবে।সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে পারবে সে ভেবে।অশ্রুও রুমকির মুখের দিকে তাকিয়ে আর না বলতে পারিনি।
রুমকি ঘোমটা মুখে সবাইকে সালাম করে উঠে।ভুট্টো পোদ্দার রুমকিকে দেখে স্মিত মুখে সালামের জবাব নেন। বসতে বলেন।রুমকি আলতোভাবে সোফার বাম কোণায় বসে।ভুট্টো পোদ্দার হেসে উঠে বলেন,
“তো তোমার নাম কি?”
“জ্বী,আমার নাম রুমকি বিনতে আফিয়া।”
“সুন্দর নাম।স্টাডি?”
“অনার্সে অধ্যয়নরত।”
“কোথায়?”
“জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি।”
“কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়তেছ?”
“ফিন্যান্স।”
“গ্রেট সাবজেক্ট!
এবার তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো উওর করবে।উওরটা আমি দ্বিধাহীনভাবেই শুনতে চাইই।।ওকে?”
ভুট্টো পোদ্দারের এমন শক্ত কথায় রুমকি খানিক টুকু কেঁপে উঠে। আল্লাহই জানে কী এমন প্রশ্ন করবে যে এভাবে ডিরেক্ট উওর দিতে হবে। নাকি অরুনের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে! যদি তুলে ফেলে তাহলে কি উওর করবো।মানলাম করেই ফেললো তাহলে আমার এবং অশ্রুর কি দশা হবে!হে খোদা খোদা রহম করো, রহম করো।ইয়া মাবুদ!
পেছন থেকে অশ্রুও শক্ত করে রুমকির কাঁধ চেপে ধরে। রুমকি থরথরে কাঁপুনির বাঁধ সামলে নিজেকে সংযত করে ধীরভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান করে।
“নোও নোও,এরকম ইঙ্গিত উওর নয়। জাস্ট স্মার্ট উওর করবে।”
“জ্বী,বলুন!”
“জ্বী বলুন ” শব্দ দুটো উচ্চারণ করতে রুমকির জান বেরিয়ে যাওয়া যাওয়া অবস্থা।
“আমার ছেলে তোমার যতগুলো বর্ণনা দিল সবগুলোর সাথে তুমি পারফেক্ট ম্যাচিং।অবশ্য আমার ছেলের গুণের প্রশংসা না করে পারছি না।আমার ছেলের চোজও বেস্ট।তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।আমার ছেলের এ বিয়েতে কোনো আপওি নেই। তোমার এ বিয়েতে কোনো আপওি আছে?”
রুমকি ক্ষীণভাবে দম ছাড়ে। চোরাচোখে অরুনের দিকে তাঁকায়। আবার ইমতিয়াজের দিকে।ইমতিয়াজের মিষ্টি হাসির মুখখানা ঝলমলে প্রদীপ উওরের অপেক্ষায়।অশ্রু ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দমাতে পারছে না।এই মানুষটিকে সত্যিই বারণ করবে।আর বারণ করলেও অশান্ত মনটাকে শান্ত রাখতে পারবে!

পারবো আমি?উফস এই মানুষটার রূপ চুম্বকের মতো আকর্ষিত কেন যেটি আমায় বারংবার তার দিকে টানছে।প্লিজজ রুমকি নিজেকে শান্ত কর কর। য়ু হু পারবো না।একদমই পারবো না।মরে যাবো!তাহলে ফিরিয়ে দিস না।ললাটের উপর সবটা ছেড়ে দে।আল্লাহর উপর আশ্বাস রেখে।এসব ভাবতে ভাবতে রুমকি কখন যে ভুট্টো পোদ্দারকে বলল,”না এই বিয়তে আমার কোনো আপওি নেই।”তা তার মাথায়ই ছিলনা।
যথাযথ উওর পাওয়ায় ভুট্টো পোদ্দার খুশির লগনে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন।বাদবাকি সবাইও ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে রাখতে পারেননি। মুহূর্তেই সবার হৃদয়ঙ্গনে আনন্দের উল্লাস বয়ে গেল।অশ্রু অনেকটা অস্বাভাবিক হয়ে মনের অজান্তে তার অরুনের দিকে চোখ পড়ে।অরুন এই মুহূর্তে অশ্রুকে একপ্রকারে ইগনর করছে।অশ্রুর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।এমন ভঙ্গিমায় সবার সাথে হাসছে,প্রাণ খুলে কথা বলছে যেন তাকে সে দু’শতাব্দীতেও দেখেনি। একদম অচেনা,অজানা।
তারপর ভুট্রো পোদ্দার হাই তুলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে আবার বলেন,
“আমার ছেলেদুটো ছোটবেলায় তাদের মাকে হারায়।মায়ের আদর কি তারা জানে না।আমি তাদের মায়ের অভাব পূরণ করতে কখনোই কোনোকিছুর কমতি রাখিনি।তারা যা চেয়েছে তাদের সবগুলো আবদারই পূরণ করেছি।ইভেন তাদের লাইফ পার্টনার চোজও তাদের উপর ছেড়ে দিয়েছি এই ভেবে যে ছেলেগুলোর মুখে আমি কখনো একরাশ দুঃখের ছায়া দেখতে পারবো না।তাদের সুখেই আমার সুখ।তারা যেভাবে চায় সেভাবেই আমি।তাইতো ইমতিয়াজ তার পছন্দের সাথীর কথা বলামাএই একমুহূর্তও দেরী করিনি।পাগল বেশে থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ ব্যাক করি।”
কথাগুলো বলেই একটা দৃঢ় শ্বাস ছাড়েন।লোকটির মনে বোধহয় অনেক কষ্ট।এই মানুষগুলোকে টিভির পর্দা যতটা না কঠোর হৃদয়ের দেখায় ঠিক রিয়েলিটি লাইফে তার উল্টো।এদের পর্দায় দেখলে মনে হয়—ইস,এই মানুষগুলো কত হ্যাপী।এদের মনে কোনো দুঃখ নেই।এদের মতে আমরাও যদি সুখী মানুষ হতে পারতাম।
তবে দিনশেষে সবারই একটা-না একটা আক্ষেপ, দুঃখ থেকেই যায়।এই পৃথিবীতে আমরা কেউই সর্বসুখী নই।
“যাইহোক অনেক কথাই বলে ফেললাম।এই খুশির বহরে আগে সবাই মুখ মিষ্টি মুখ করে নিই।
বলেই নিজে একগাল মিষ্টি মুখে ফুরান।আর রুমকির দিকে একটা মিষ্টি এগিয়ে দেন।একে একে সবাইকে ভুট্টো পোদ্দার মিষ্টি মুখ করান।মিষ্টির আদান-প্রদান শেষে ইমতিয়াজ নিজ হাতে রুমকিকে মুক্তোর সেই দুলদুটো কানে পড়িয়ে দেয়।সবাই হাতের তালি বাঁজিয়ে আনন্দটাকে আরো উত্তলিত করে তোলে।তবে সবার এই আনন্দ মুহূর্তটা অশ্রুর কেনজানি হজম হচ্ছে না।কোথাও যেন একটা ফাঁকফোকর রয়ে যাচ্ছে।রুমকি কি কোন ভুলপথে এগুলো নাতো?তাছাড়া,এই অরুনের হিংস্র রূপটা এখন এত স্মিত কেন!কতটা ভদ্র ভদ্র লাগছে বোঝাই যাচ্ছে না কপটতার হৃদয়!
“আরেকটা কথা আমি আমার ছেলের বিয়ে দিতে আর দেরী করতে চাইই না।শুভ কাজটা তাড়াতাড়িই সেরে ফেলতে চাই।কারণ আমার ছেলেটারও আমেরিকা ফেরার খুবই তাড়া।”
“তাহলে একটা ফিক্সড সময় ঠিক করুন বেয়াই সাহেব।(মামা)”
“হুম।”
রুমকির বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যায়।আগামী সপ্তাহের উনত্রিশ তারিখে রুমকি এবং ইমতিয়াজের বিয়ে।উফস কোনো একটা তাড়াহুড়োর মধ্যেই বিয়ের তারিখটা পড়ে যায়।

“আমি ভাবতেও পারিনি এত তাড়াতাড়ি আমি বিয়ের পিড়িতে বসবো।”
“তুমি কি আমার সাথে বিয়ে করতে রাজি নও রুমকি?আমি কি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর চাপাচ্ছি?”
একথায় রুমকি ইমতিয়াজের দিকে ভারমুখে তাকায়।কিছুক্ষণ আগে ইমতিয়াজ রুমকির সাথে একা একটু কথা বলবে বলে তার বাবার থেকে সম্মতি নেয়।এখন দুজন পার্সোনাল রুমে অবস্থান করছে একে-অপরের মনের কথা জানার আকুলতায়।
“ন-না সেরকমটি নয়।কেন এমনটি মনে হলো?”
“এইযে কাল বারণ করে দিলে!আসলে জানো কি রুমকি মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সবটা মানুষটির চাইনা।তুমি বাচ্চা গর্ভধারণে অক্ষম তাতে আমার সমস্যা নেই।আমি যে তোমাকে পাবো এটাই আমার অনেক।তোমার ওই কথায় সত্যিই আমি একটুও আকুতি হইনি।শুধু বার বার মাথায় এটাই আসছে তোমাকে আমি হারাতে পারবো না।কোনোভাবেই না।”

ইমতিয়াজের এমন হৃদয় নিঙড়ানো কথা রুমকিকে বিচলিত করে।ইমতিয়াজতো সত্যিই তাকে অনেক ভালোবাসে।ছেলেটা ও কথা শুনার পরও তাকে ছাড়তে রাজি নয়।এরকম ছেলে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।এ ভেবে খুশিতে রুমকির চোখমুখ ছলছল করে উঠে।নাহহ সত্যিই ইমতিয়াজ ছেলে হিসেবে খারাপ নয়।সে ভুল মানুষকে নির্বাচন করেনি।যোগ্যবান একজন ছেলেকেই লাইফ পার্টনার হিসেবেই বেছে নিয়েছে!
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-১২
রোকসানা আক্তার

পোদ্দার ফ্যামিলি চলে যাবার পর বাসায় ছোটখাটো একটা ঝগড়া বেঁধে যায়!রুমকির মা ফুঁসে চৌচির তার দু’ভাইয়ের উপর।এইতো সামনের মাসেই তার ছোটবোনটা অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশ ব্যাক করছে।রুমকির বিয়ের তারিখ এই মাসেই ফিক্সড করার কী এমন প্রয়োজন ছিল?আর দু-তিন দিন দেরী হলেতো মহাভারত লুপে যেত না!বোনটা তার কত আশাবাদী ছিল রুমকির বিয়ের এভরিথিং সে নিজহাতে করবে।আর দু’ভাই হাঁসফাঁস না ভেবেই মাঝখান দিয়ে পোদ্দারের ডেটে সম্মতি হয়েছে।
“উফস বুবু,তুমি খামোখা এত চিন্তা করছ। তোমারতো ইমতিয়াজের কথাও ভাবা উচিত।পোদ্দার নিজেইতো বললেন তার ছেলেটার আমেরিকা যাওয়ার খুব তাড়া।এখন রাবেয়ার জন্যে অপেক্ষা করলে বিয়েটাও আর হবে না।আর পরে যদি পোদ্দার ফ্যামিলি বিয়েটা ক্যান্সেল করে!জানোইতো বড়লোকদের সাতপাঁচ থাকে মনে।এদের মন বোঝা দায়।”
ভাইদের কথায় রুমকির মা আওয়াজাস্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।তখন রুমকি এবং অশ্রু সোফার কার্ণিশ ঘেঁষে দাড়িয়ে।রুমকি তার মাকে কিছু একটা বলতে যাবে ভাবতেই রিং বেজে উঠে।বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সবুজ বাটনে টাচ করে রুমকি কানের কাছে মোবাইল গুঁজে নেয়।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম? “
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কে রুমকি?”
“জ্বী! আপনাকে চেনতে পারলাম না।”
“আমি অশ্রুর বাবা।অশ্রু তোমার কাছে আছে?”
“জ্বী আঙ্কেল।”
“ওর কাছে একটু কলটা দাও।”

রুমকি অশ্রুর হাতে মোবাইলটা তুলে দেয়।অশ্রু জিজ্ঞাসূচক ভাবে তাকাতেই রুমকি বলে উঠে,
“আঙ্কেল কল করেছেন।তোর সাথে কথা বলবেন।”
“বাবা?”
“হু।”
অশ্রুর বুকের মাঝখানটা চ্যাৎ করে উঠে।বাবাকে একদিন থাকার নাম করে তিন তিনটে দিন আছে তারপরও একবারো কল করেনি বাসায়।হয়তো এখন সেই ফয়সালার ঝাঁড়ি খেতে হবে অশ্রুকে।অশ্রু মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু দূরে সরে আসে। কাঁপা হাতে হ্যালো বলতেই আলাউদ্দিনের রাজ্যের ঠেঁটামি শুরু হয়ে যায়।
“একদিন থাকবি বলে বাবাকে কথা দিয়েছিস।কিন্তু তিন দিন পেরিয়ে চারেকে আসছে তারপরও তোর বাসায় আসার নামগন্ধ নাই!কি করিস এতদিন ও বাসায়!তোর মা তোকে নিয়ে কতটা চিন্তায় আছে জানিস?আর তোর ফোন সুইচড অফ কেন?”
ফোনের কথা শুনতেই অশ্রু থরোলো কেঁপে উঠে।সেদিন অরুনের বাসায় গিয়েই তো মোবাইল রেখে আসছে।আর এখন যদি বাবাকে তাই বলে দেয় একে-তো খাবে ধরা তারউপর মিথ্যা।নাহ নাহ বাবাকে এটা কিছু একটা বলে বুঝাতে হবে।তারচেয়ে অজুহাতের সাহায্যই শ্রেয়।তা ভেবে অশ্রু ইতস্ততা মনে বলে,
“বাবাকে আসলে তোমার নাম্বারটা রুমকির কাছে নেই। তাই বলা হয়নি আমার ফোনটা যে নষ্ট হয়ে গেছে! “
“কি বলছিস?দু’মাস আগেইতো ফোনটা কিনে দিয়েছিলাম।আর “অপো ফোন”এত তাড়াতাড়ি ভেস্তে যাবে তা তো বিশ্বাস হচ্ছে না।আচ্ছা মানলাম তোর ফোন নষ্ট। তবে সিমতো আর হাওয়া হয়নি,না?”
“হু!” ক্ষীণস্বরে।
“তোর সিমটা রুমকির ফোনে ঢুকিয়েও তো আমায় একবার জানাতে পারতিস।”
“বাবা আমার সিমের গার্ড এবং রুমকির সিমের গার্ড এক নয়।”
“বুঝলাম।তুই যা বলছিস সবই বিশ্বাস করলাম।তা বাসায় কবে আসবি!?”
“কালই চলে যাবো বাবা!”
“চট্রগ্রাম থেকে তোর মামিরা আসছেন।তোকে বাসায় না দেখতে পেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে।এখনো সন্ধে হয়নি।এখনই চলে আস।আর যদি আসতে প্রবলেম হয় তাহলে বিপুলকে এড্রেস দিই। বিপুল তোকে এসে নিয়ে যাবে।”
“বিপুল” শব্দটি অশ্রুর কানে আসতেই চোখেমুখে বিরক্তির আভা ভেসে আসে।এই বিপুলটাই তার জীবনের কাঁটা।এখনো এ’কাঁটা পথ আঁটকে আছে।কিছুতেই সরছে না।এই কাঁটার জন্যে আজও রুমকির কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেনি।ভার্সিটির কোনো ছেলে প্রপোজ করে বসলেই সবার আগে চোখ-কান খাঁড়া হয় বিপুলের।তালগোল পাকানোর জন্যে ভার্সিটিতে মেহেরাজ নামের একটা লম্পট আছে যার এখানের কথা সেখানে বয়ে বেড়ানো কাজ।সে-ই দিনরাত অশ্রুর পেছনে আটার মতো লেগে থেকে বিপুলকে বার্তা প্রদান করে।মেহেরাজ বিপুলের বেস্ট ফ্রেন্ড।দুজনে একই কলেজে পড়াশুনা করেছে।তবে আকাশচুম্বী স্বপ্নে সেও যে জগন্নাথে চান্স পেয়ে যাবে তা কল্পনার বাহিরে।বাকি রইল বিপুল।বিপুলের ইচ্ছে ছিল ঢাকার যেকোনো একটা ভার্সিটিতে হয়ে গেল দিব্যি দিন কাটবে।ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অশ্রুকে নিয়ে যখন-তখন ঘুরতে যাবে,রাস্তার অলিগলিতে ফুচকা,ঝালমুড়ি খাবে।সময়ে-অসময়ে রেস্টুরেন্টের নাম দিয়ে অশ্রুকে নিয়ে প্রেমের আলাপ করবে।তার দিনের বেশিরভাগ সময়ই অশ্রুর সাথে কাঁটাবে।স্থানুর ললাটে বিঁধে তার কপাল চট্রগ্রাম ভার্সিটিই রয়ে গেল।সে সেখানে চান্স পেয়ে যায়।মা-বাবাকে আকুতি মিনতি করে ঢাকার যেকোনো প্রাউভেটে ভর্তি হতে।কিন্তু উনাদের কথা পাবলিক রেখে প্রাইভেট কেন!তাছাড়া আমাদের বাড়িই যেহেতু চট্রগ্রাম তাহলে দু’জায়গায় পুতুপুতু টাকা খরচা করার কোনো দরকার নেই।অতঃপর বিপুল তার বাবার জবাবের কাছে জমে গিয়ে বরফ রূপান্তরিত হয়।মনে জেদটা চেপে এখনো বাবার সাথে অভিমান করে আছে!অশ্রু যখন শুনেছিল বিপুলের ঢাকা আর আসা হবে না সেদিন অশ্রুর খুশি কে চায়!খুশির লগনের তীরে আরেকটা ধনুক বুকে ছুঁড়ে তা হলো মেহেরাজ।কপালের দুঃখ সইলেও আরশের দুঃখ রয়ে গেল।ওই জন্জালই সব ফাঁস করে।অশ্রু উল্টো রিয়াকশন নিতে গেলেই বিপুল আলাউদ্দিনের ভয় দেখায়–”এই অশ্রু বেশি পার পেতে যাস না তাহলে তোর কপালে কিন্তু সুনীল আছে।ফুপাকে এমন মশলা দিব যেখানে কথা বলতেও একশোবার ভাববি।”তখন শুকনো পাতার মতো অশ্রুর মুখটাও চিমসে আসে।আলাউদ্দিনও বিপুলের সব কথা চোখকান খোলা রেখে বিশ্বাস করে ফেলেন।তারমতে,বিপুল একজন সত্যবাদী,আন্তরিক,ভদ্র ছেলে।মানেই যে সে মজা নেয় তবে তার মজাতে আদার জালটা খুবই কম।ছ্যাতে গিয়েও তেজে না।আর সেই অধমটাই কাল বাসায় এসে ফুরফুরে হাজির।অশ্রু টাল সামলে আলাউদ্দিনকে বলে,
“ব-বাবা আমি নিজেই যেতে পারবো।বিপুল ভাইয়ার আসা লাগবে না।”দুজন ক্লাসের হলেও এইজে বিপুল অশ্রুর দেড়েক বছরের বড়।তাই সে বিপুলকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করে।
“নিজে থেকে আসতে পারলে ত ভালোই।আচ্ছা তাহলে তাড়াতাড়ি চলে আস।দেরী করিস না।”
“আচ্ছা বাবা।”
মুখটা বিমূঢ করে রুমকির হাতে ফোন দেয়। গ্যাঁজ গ্যাঁজ গলায় বলে,
“রুমকি আমার বাসায় যেতে হবে!”
“হঠাৎ বাসায়?”
“বাসায় মামিরা আসছেন।”
“তাই বলে আজই!আমার এমন একটা মুহূর্তে…… “শেষ না করেই ভার মুখে থেমে যায় রুমকি।
“তা ভাবিস না।আমি ওটা ম্যানেজ করতে পারবো!তবে…!”অশ্রু মাথাটা নুইয়ে ফেলে।রুমকি তা বুঝতে পেরে অশ্রুর মুখের কথা টেনে নিজে বলে,
“অরুনের বিষয়টা ভাবছিস?ও বিয়েতে থাকলে তোর আসাটা প্রবলেম হবে,তাই না?”
“হু।”
“কিছুক্ষণ আগে সবটা যেরকম নর্মাল ছিল বিয়েতেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না।আই’ম সিউর!”
“তুই একশো পার্সেন্ট কনফিডেন্স? “
“ইয়াপ।খামোখা ওই বিদঘুটের কথা ভেবে নিজের হ্যাপীনেস মুহূর্তটাকে কেন জলাঞ্জলি দিবি।আমি সেকারণেই সাতপাঁচ না ভেবে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিয়ে ফেলি।কারণ,সংসারটা আমি ইমতিয়াজের করবো,ওর সাথে নয়।আর ও যেসব করেছে এতে ওর লজ্জা পাওয়াটা দ্বিগুণ ছিল।তা পায়নি!”
“ওরা একরমই।লজ্জা পেলে আর এরকম কুকর্মে লিপ্ত থাকতো না।বায় দ্য ওয়ে,একটা নিউজ আছে।”বলেই অশ্রু ফোপাঁতে থাকে
“আরেহ ফোঁপাচ্ছিস যে?কি নিউজ বল!”
“বিপুল গতকাল আমাদের বাসায় এসছে!”
রুমকি বিপুলের কথা শুনামাএই মুখে হাত রাখে।ভ্রু বেঁকে বলে,
“উহরে অশু!ওই কাঁটাটা তো তোকে একদম খেয়েই ফেলবে।তবে যা-ই বলিস ওই কাঁটাটাকে আমার সেই লাগে!”
“পৃথিবীতে আর কাউকে ভালো লাগলো না এই অধমটাকে তোর ভালো লাগলো বুঝি?”
“হ্যাঁ!”
“তাহলে ইমতিয়াজ ভাইয়াকে রেখে ওকেই তো বিয়েটা করতে পারতিস!”
রুমকি খিলখিল হেসে উঠে।বলে,
“স্রষ্টা ওটা তোরজন্যে গড়েছিল আমার জন্যে নয়।”
“তাই?এতোটা সিউর কিভাবে তুই?”
“মন বলছে।”
“মন বললে তো সব সত্য হয়না।”
“দেখা যাক।”
“আমিও দেখবো!”
“বাহারে বিপুলের হয়ে কথা বললাম বলে তুইতো বেশ রেগে গেছিস!”
“রাখ আদিখ্যেতার জম।যাচ্ছি আমি।বেলা ফুরচ্ছে।”
“আচ্ছা সাবধানে যাস।আর কল করলে চলে আসিস।”
তারপর অশ্রু রুমকির বাসার সবার থেকে বিদেয় নিয়ে বাসায় রওনা করে।বাসায় পৌঁছার পর মামীকে এবং ইরাকে দেখে আহ্লাদে আটখান।জড়িয়ে গিয়ে গননা বিহীন চুমু বসায়।মামী অশ্রুকে অনেক দিন পর কাছে পেয়ে ছাড়তেই চাচ্ছেন না।
“কেমন আছিস অশ্রু?”
“আমিতো সেই ভালো।তা মামা আসেনি কেন?”
“তোর মামারতো সেই এক প্যারা।বেচারী সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া কর্মবসান পায়না।”
“ওহ।”
মামীর সাথে কথা শেষ করে ইরাকে আই ভুড়ে বলে,
“তুই কেমন ইরা?”
“ভালো আপু।তুমি?”
“ভালো।পড়ালেখা ঠিকঠাক চলেতো?”
“হু।”
“এবার যেন কোন ক্লাসে তুই?”
“এইটে”
“জি.এস.সি ক্যান্ডিডেট।গোল্ডেনের জন্যে ফাঁকফোকর যেন না থাকে।”
“ইনসাল্লাহ আপু।”
সবার সাথে মোটামোটি দেখা শেষ করে মনে মনে আহ্লাদে পুলকিত হয়।যাক এখনো ওই অধমটার সাথে দেখা হয়নি নাহলে ভেড়া বানিয়ে ছাড়তো।ভাবতে ভাবতে অশ্রু নিজরুমে প্রবেশ করে।চোখদুটো রুমের চারদিকে স্থির রাখতেই চেঁচিয়ে উঠে!

চলবে..
(বিপুলের ব্যাপারে আপনাদের কিরকম ধারণা😌)


চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here