একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ৫৬+৫৭+৫৮

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৬
রোকসানা আক্তার

“অশ্রুকে বিয়ে করতে চাও ভালো কথা,তা চারিত্রিক অর্জনের সার্টিফিকেট আনলে তো?!
আলাউদ্দিনের এহেন কথায় মুহূর্তে অরুন উনার দিকে পাথর চোখে তাকায়।উনার চোখ-মুখে তেমন কাঠিন্যভাব স্পষ্ট হলো না।মুখটা স্বাভাবিক।এমন ভঙ্গিমায় আছেন যেন কিছুই হয়নি,ভারী রাশ কথাই বললেন!অরুন চোখবুঁজে সবটা সয়ে নেয়।বাসা থেকে আসার সময় মোটামুটি নিশ্চিত হয় এমন কথাই আজ তাকে শুনতে হবে।তা শুনতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই এখানে আসা।নাহলে নিজের দাম্ভিকতার তোড়ে চিরকালের জন্যে নিজের প্রিয় মানুষটিকেই হারাতে হবে।কথা আছে-বিপদের সময় সকল অপমান গায়ে মাখতে নেই।অন্তগোপনে নিজেকে যথেষ্ট সংবরণ করে স্বাভাবিক এবং ধীরকন্ঠে বলল,
“দোষ-ত্রুটি সবার থাকে।তবে ক্ষমা করার ক্ষমতা লাগে।”
“দোষ-ত্রুটি ভালো।মাত্রাতিরিক্ত দোষ-ভুল কারো কাছেই ক্ষমার যোগ্য নয়!”
অরুন মাথা নিচু করে চুপ হয়ে থাকে।আলাউদ্দিন গলা খোঁকারি টেনে আবার বলেন,
“মেয়ে আমার এমন কাউকে লাইফ পার্টনার হিসেবে চুজ করবে আমি তা স্বপ্নেও ভাবি নি অথচ এখন তার সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ করছি!”
বলেই মুখখানায় পাংসুটে করে অন্যদিক ফিরে।অরুন বলল,
“মানুষের উপরের দিক থেকে বিবেচনা করে আপনি তাকে মন্দ ভাবতে পারবেন না।হয়তো তার উপরের সত্তার ভেতরের সত্তাটা পূর্ণাঙ্গ এবং সবথেকে আলাদা।ভুল করা মানুষগুলো যখন একসময় নিজের ভুলগুলোয় অনুশোচনা বোধ করে তখন ক্ষমা হয়ে উঠে তার জন্যে আর্শিবাদ।তাছাড়া,পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরতম গুণ হলো মানুষকে ক্ষমা করা!”
“শেখাতো এসছো নাকি বুঝাতে এসছো!”
এমন শক্ত কথায় অরুন আলাউদ্দিনের চোখে চোখ রাখে।আলাউদ্দিন অরুনকে এড়িয়ে আবার বলেন,
“দ্যাখো,কথা বাড়িয়ে আর কোনো লাভ নেই।আমি একজন বাবা হয়ে মেয়েকে ওমন ছেলের হাতে কখনোই তুলে দিতে পারবো না।আর যদি বলো,মেয়ে তোমাকে ভালোবাসো, তা বলবো তার যদি ইচ্ছে হয় চলে যেতে, যাক।আমি এতে বাঁধা দিবনা।তবে একবার চলে গেলো আমার বাড়ির চৌকাঠে আর পা রাখতে পারবে না!”
“আঙ্কেল অশ্রু ওরকম মেয়ে নয় পিতা-মাতার অসম্মতিতে কিছু করবে।আর আপনি আমায় হয়তো খারাপ ভাবছেন এবং আমার বাবাকে।হু,বলতে পারেন আমি খারাপ এবং খুবই ম্যানারলেস।তবে,আমার বাবা নয়!”
“আমি এখানে কাউকে তো প্রত্যক্ষ করে কিছু বলিনি!?”
কথার পিঠে কথার জবাব আলাউদ্দিনের।অরুন এবার হাত-পা ছেড় দিয়ে বলল,
“তারমানে আপনি আমাকে অশ্রুর হাতে তুলে দিবেন না!?”
“বললাম ইতো।আবার রিপিট করে মুখ খরচ করা লাগবে?”
অরুন ঢোকর গিলে।বিপুলের বাবা পাশেই ছিলেন এবং পারুল বেগমও।অরুনকে এমন হেনস্তা করতে দেখে বিপুলের বাবা আলাউদ্দিনকে থামাতে চেষ্টা করেন,
“আহা,ভাইজান এভাবে কথা বলছেন কেন! আপনি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেই তো হয়!”
“কিসের বোঝাবুঝি!?যা বুঝার আমার আগেই হয়ে গেছে।অরুন এবার তুমি আসতে পারো।তোমার সাথে আমার আর কিছু বলার নেই!প্লিজ?”
“কিন্তু আঙ্কেল…?”
বলেই অরুন অসহায়ত্ব চোখে তাকায়।পারুল বেগম কাতর জড়ানো কন্ঠে মেয়ের হয়ে বলেন,
“পূর্বের কথা ভেবে মেয়ের ইচ্ছাকে বঞ্চিত করো না।”
আলাউদ্দিন রাগান্বিত চোখে পারুল বেগমের দিকে তাকান।পারুল বেগম স্বামীর অগ্নি চক্ষু দেখে মুহূর্তে মুখটা কালো করে ফেলে ।অরুন তারপরও নিজের চেষ্টা থেকে সরে আসেনি।নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তা বজায় রাখার চেষ্টা করে,
“প্লিজ আঙ্কেল,ওমন কথা বলবেন না।আমি অশ্রুকে অনেক বেশিই ভালোবসি, যা বলে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।আমি বাবাকে,ভাইয়াকে অধোমুখ করে এখানে নিয়ে এসছি ।উনাদের সামনে আমার বড় আশাকে নস্যাৎ করবেন না।অনেক বড় আশা করে এসেছি!”
“বললাম তো অশ্রু যদি আমাদের সবাইকে ছেড়ে স্বইচ্ছায় যায়,তাহলে এখানে আমার কিছুই বলার নেই।আর হ্যাঁ,তোমার প্রস্তাব মোতাবেক আমার সিদ্ধান্তে আমি অশ্রুকে তোমার হাতে তুলে দিতে অবাধ্য!তাই সান,আমার সাথে এ ব্যাপারে ক্যাঁচর ক্যাঁচর করে কোনো লাভ নেই!”
অরুন মনটা বেজার হয়ে যায়।ইনার কথার ধরন খুবই শক্ত।নিজ সিদ্ধান্তেই যেন অটল থাকবেন।মরে গেলে,কেঁটে গেলে তারপরও বোধহয় রাজি হবার পাত্র নন।মানুষ এতটাই নিজ,পাষাণ হতে পারে!?
অশ্রু দরজার ওপাশ থেকে সবটা শুনতে পায়।দাড়িয়ে দাড়িয়ে কত ক্লেশ যে কান্না করা শেষ তা তার হিসেব দেওয়া ভার!কিন্তু নিজে এভাবে চেপে চেপে কান্না করবে আর কতক্ষণ? অরুনের সঙ্গ নিয়ে নিজেও তো পারে বাবার কাছে বলতে!মনটা এখনই যেন কল্পনায় টপটপ মুখে বাবার মুখের উপর সবটা বলে দিয়ে আসে।অথচ সরাসরি সাহস হয়নি দাড়িয়ে বাবার সামনে সবটা বলতে।
এই ভয়,দুর্বলতার কাছে হার মেনে ভালোবাসার পরাস্ত হবে?
ভেবেই আবারো ঢুকরে ঢুকরে কান্না করে দেয় অশ্রু!এবার অশ্রুর কান্নার এক ক্লেশ আওয়াজ বাইরে ছিটে পড়ে।কান্নার ধ্বনি খুবই জোরে ছিল।তাই সবার কানের তীক্ষ্ণ সুড়ং দিয়ে সেই ধ্বনি পৌঁছায়।আলাউদ্দিন কান্নাটাকে একপ্রকারে এভয়েড করে অরুনকে বলল,
“অরুন খুব রাত হয়ে যাচ্ছে।যাও বাবা বাসায় যাও।খামোখা নিজের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেন নষ্ট করছো!”
অরুন কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“আঙ্কেল,আমি এই শেষবার জানতে চাই কেন অশ্রুকে আমার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন না?দয়া করে কারণ গুলো বলবেন আমি নতমুখে তা মেনে নিব!”
আলাউদ্দিন আড়চোখে অরুনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।তারপর স্বাভাবিক গলায় বলেন,
“আকাশ-পাতালের ব্যবধান বুঝো?যদি বেশ বুঝো আশা করি আমার আর বিবরণ দিতে হবে না!”
অরুন কপালের ভাজগুলো এক করে কিঞ্চিৎ চোখে বলল,
“আমি বুঝি না এবং বুঝতেও চাই না!”
“আমি উঠছি,অরুন।”
“আপনার সাথে আমার আরো কিছু কথা আছে আঙ্কেল..!”
আলাউদ্দিন তা আর শোনে নি।চলে যায় নিজের রুমে।পারুল বেগম থমথমে মুখ করে তাকিয়ে।।অশ্রু এবার দরজার চৌকাঠের সামনে এসে দাড়ায়।অরুন পাশ ফিরে অশ্রুর দিকে একপলক তাকায়।মেয়েটার মুখটা কেমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে।খুব যে কেঁদেছে মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।চোখের পানি শুকিয়ে তার আঁশ লেগে আছে!কী করবে অরুন?এই মায়বাতীকে খুব সহজেই কি হারিয়ে ফেলবে?নাহ,তা সে পারবে না।কিছুতেই না!
তারপর অরুন পারুল বেগম সালাম করে কোনোমতে বেরিয়ে আসে। অশ্রু বেলকনিতে দৌড়ে যায়।কিন্তু অরুনকে বাইরে দাড়াতে দেখতে পায়নি।ভাবছিলো স্বপ্নের মতো অরুন বেলকনি বরাবর দাড়িয়ে তার প্রিয়সীর সাথে দেখা করে যাবে।অথচ তা করে নি!অনেকটা কষ্ট পেয়েছি নাকি সে?হয়তো পেয়েছে!

ব্যর্থ মনে ঘনঘটা আকাশের ওই মিটিমিটি তারার দিকে চোখ তাকায়।আকাশটা স্বচ্ছ পরিষ্কার। ওই স্বচ্ছ আকাশে অগণিত তারার চলাফেরা।তারা কত সুন্দর করে চিকচিক জ্বলছে।দেখতে বেশ লাগছে।মানুষের জীবনটা যদি এরকম চিকচকে হতো।তাহলে পৃথিবীর ভুবনে মানুষ কতোই না সুন্দর করে বাঁচতে পারতো!
অনেকক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকে অশ্রু অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে উঠে!এহেন অবস্থায় বিপুল এসে পাশ ঘেঁষে দাড়ায়।গলায় স্বর নরম করে বলল,
“অশ্রু,মন খারাপ?”
অশ্রুর টনক নড়ে উঠে।কন্ঠ শুনেই বুঝে ফেলে বিপুল।মাথা আগের মতো স্থির রেখেই মাথা নাড়ে ‘না-বোধক’উত্তর করে।
“ওহ।”
“চল ডিনার করবি।ফুপি ডাকছেন।”
“ইচ্ছে নেই।”
বিপুল ক্ষণকাল মৌন থেকে বলল,
“এভাবে মন খারাপ করে থাকলেতো শরীর খারাপ হবে অশ্রু।”
“ভালো আছি।মন খারাপ নেই।”
“মিথ্যে বলছিস।”
অশ্রু কিছু আর না বলে পাশ কেটে চলে আসে।বিছানায় শব্দহীনভাবে বসে।বিপুল অশ্রুর সামনে এসে দাড়ায়।দু’হাত ভাঁজ করে।বলল,
“কাউকে এতটা ভালোবাসিস আগে কখনো তোর মুখ দেখে বুঝতে পারিনি।অথচ আজ বুঝতে সমস্যা হয়নি।”
তাও অশ্রু জবাব দেয়নি।অশ্রুর চুপ থাকা দেখে বিপুল আবার বলল,
“টেনশন নিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।খেতে আয়।”
বলেই পা বাড়ায়।কি মনে করে আবার পেছন ফিরে তাকায়।ধীর গলায় বলল,
“আমি ফুপার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো অশ্রু।চেষ্টা করবো তোর ভালাবাসকে তোর কাছে ফিরিয়ে দিতে।”
দাড়িয়ে থাকে নি।দ্রুতপদে বাইরে চলে যায়।অশ্রু মুখ দিয়ে ভালো লাগার এক অনুভূতি না কাজ করলেও বিপুলের এ কথাতে মনে মনে খুব খুশি হয়।আর একটা থ্যাংকসও দিয়ে ফেলে।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৭
রোকসানা আক্তার

পারুল বেগম অশ্রুর রুমের দরজায় খানিকক্ষণ খটখট করেও যখন লাভ হয়নি তখন একপ্রকারে হাল ছেড়ে দিয়ে ডাইনিং-এ এসে একটি চেয়ার টেনে সেখানটায় ধপাস করে বসে পড়েন।আলাউদ্দিন আঙ্গুলে ঢগা দিয়ে প্লেটের ভাত ঢলছেন আর চশমার উপর দিয়ে স্ত্রীকে দেখছেন।রাগে তার দু’গাল লাল হয়ে আছে। রাগ হওয়ার উৎসটি উনি নাকি অশ্রু তা জানতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে উনার।তাই খুব সজাগ কন্ঠে বলেন,
“অশ্রু খাবে না?”
নিচের দিকে দৃষ্টি বজায় রেখে অস্ফুট গলায় পারুল বেগম উত্তর করেন,
“নাহ।”
আলাউদ্দিন এক লোকমা ভাত মুখে ফুঁড়ে বলেন,
“কেন খাবে না?”
স্বামীর এমন লাগোয়া কথায় পারুল বেগম উনার দিকে দৃষ্টি এঁটেন।রাগে গালের সাথে দু’চোখ লালও হয়ে আসে। জানেই তো মেয়ে কেন খাবে না,তারউপর আবার জিজ্ঞেসও করছে!কথা আছে না- কাঁটা গাঁয়ে আসছে লবণের ছিটে দিতে।যাইহোক, ডাইনিং এ এখন সবাই এই রাগে এখানে ঝাড়লে চলবে না।একা পেয়ে আচ্ছামত তার ষোলকলা উদ্ধার করে নিবে।তাই নিজেকে যথেষ্ট আগলে গম্ভীর মুখ করে বলল,
“খাবে না মানে খাবে না!”
বিপুলের ফটকা মুখে বাণ আনতে পারেনি।ছুঁড়ে দেয় উনার গৎবাঁধা বুলি।বলেন,
“সবার সামনে খেতে আসবেই আা কোন মুখে?সেই মুখ কি আর রাখলো?ওই ছেলের সাথে রাত যাপন করে দিনে পাঠাইছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে!”
পারুল বেগম আলাউদ্দিনের থেকেও দ্বিগুণ রাগ ফুঁসতে থাকেন এবার কোহিনুর বেগমের উপর। বলেন,
“প্লিজ ভাবী,এটা আমাদের ফ্যামিলির ব্যাপার।আপনি এখানে নাঁক গলাচ্ছেন কেন?!”
“আমিতো আপনার সাথো বলিনি আপা।আমিতো ভাইজানকে বলছি!”
“ভাইজানকে ভাইজানের কথা বলবেন।আমার মেয়ের কথা নয়!”
বিপুল মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
“মা,সবাই খেতে বসছে।খাবারের মাঝে কেন আবার কথা উঠালে?”
“আমি উঠাইছি?”
“তুমিও তো ফ্যাসাদ বুলি আগে টানলে!আর ফুপা-ফুপি কথা বলছে।উনাদের মাঝখানে দরকার কি আমাদের কথা বলার!”
“তুই আমার ছেলে উনাদের হয়ে কথা বলছিস?আমাকে ছোট্ট করছিস?বাহ!ভালোই তো!খাবো না আমি আর ভাত।থাকবো না আর বাসায়।আজ রাতই চলে যাবো।এই উঠো,উঠো আমরা চলে যাবো!”
বিপুলের বাবা কোহিনূরের উপর বিরক্তি হয়ে বলেন,
“তুমি না কোহিনুর?কি দরকার কথা বাড়ানোর!?”
“তোমার ছেলের মতো তুমিও বলছো আমিই কথা বাড়াইছি?”
বিপুলের বাবা আর কথা না তুলে খাবারে মন দেন।কোহিনূর খাবার রেখে রাগে-ক্ষোভে নাক টেনে টেনে রুমের দিকে চলে যায়।পারুল বেগমও গলা ভর্তি রাগ নিয়ে সোফার দিলে চলে আসে।
পারুল বেগম চলো যাওয়ায় আলাউদ্দিন বলেন,
“বিপুল, ভাইজান, নুজিফা তোমরা খাও।খাবারের উপর কখনো রাগ করতে নেই।ওরা মহিলা মানুষ,বেজাইল্লা তাই খাবারের উপর রাগ করে চলে গেছে।”
তারপর আর কি পারুল এবং কোহিনুর ছাড়া সবাই ই খাবার শেষ করে।খাবার শেষে আলাউদ্দিন সোফায় গিয়ে বসেন।আর টিভি ছেড়ে দেন।পারুল বেগম স্বামীকে দেখে আরেকটু দূরে গিয়ে বসে।বিপুল কিছু বলবে ভেবে বেসিন থেকে তড়িঘড়ি হাত ধুঁয়ে আলাউদ্দিন কাছে আসে ।আলাউদ্দিন বিপুলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“বসো এখানে।খেলা চলছে। খেলা দেখো।”
বিপুল অনিচ্ছুক সত্ত্বেও বসে যায়।কয়েক মিনিট কাঁটার পর বিপুলের ভেতর উসখুস শুরু হয়।পারুল বেগম দূরে রাগ মনে বসে থেকেও বিপুলের অবস্থা বুঝতে ঢের দেরী হয়নি।তাই তিনি নিজেই বলে উঠলেন,
“বিপুল,কিছু কি বলতে চাও?”
বিপুল পারুল বেগমের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।এই হাসির মাধ্যমে বুঝাতে চায় সে আসলেই কিছু বলবে।পারুল বেগম বলেন,
“বলো,কী বলবে?”
“য়ু ফুপার সাথে বলতাম আর কি!”
আলাউদ্দিন টিভির দিকে চোখ রেখে এদিকের সবগুলো কথোপকথন মাথায় এঁটেছেন।তড়বড় বলেন,
“বল।তবে, আস্তে।তোর ফুপী যেন এতে ভাগ না নিতে পারে!”
পারুল বেগম স্বামীর থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিক আবার মুখ করে নেন।বিপুল গলায় একটা খাঁকারি টেনপ খুব স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগলো,
“ফুপা,আমি আসলে অশ্রুর ব্যাপারে কথা বলতে এসছি।”
“তো বলো,এত হ্যাজিটেন্ট কেন?ওকে বিয়ে করবে এটাই তো?”
“আজ্ঞে না।”
আলাউদ্দিন টিভি থেকে চোখ সরিয়ে বিপুলের দিকে দৃষ্টি এঁটেন।বলেন,
“তাহলে?”
“ফুপা,পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের ভালোলাগা -মন্দলাগা আছে।তারা তাের পছন্দ মতো চলতে বাঁচতে ভালোবাসে।যদি এতে বাঁধা পোড়ন আসে তখন সেই মানুষটি আর স্বাভাবিক থাকে না।তাই অশ্রুরও তার ব্যতিক্রম নয়।সে যেমন চায়,যেভাবে বাঁচতে চায় তাকে প্লিজ বাঁধা দিবেন না।ওর হয়ে ওর মনের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করুন।ও খুব মন খারাপ করে আছে।”
“তুমিও তো ওর মতো আবেগ প্রবণ হয়ে আছো দেখি!”
“আবেগ নয় ফুপা।প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনা একমাত্র আমি ছাড়া এর উপলব্ধি কেউ বুঝবে না!”
বলেই বিপুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আলাউদ্দিন বলল,
“তুই যে অশ্রুকে পর করে দিবি,সে কষ্ট হজম করতে পারবি?”
বিপুল খানিক টুকু হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আমি কষ্ট আর কি!কিন্তু আমার থেকেও অশ্রুর কষ্ট হচ্ছে বেশি!আমি একটা ছেলে আমার সহনশীল ক্ষমতা অনেক।কিন্তু ও একটা মেয়ে হয়তো সহনশীলতার কাছে হার মেনে নিজের খারাপ কিছু করে বসবে ফুপা!”
পারুল বেগম এতক্ষণ সবটা শুনেছেন।বিপুলের সাথে একমত হয়ে বলেন,
“বিপুল,একটু বোঝা বাপ!আমি একে একথা গুলোই বুঝাতে পারছি না।মেয়ের পছন্দ-অপছন্দ দেখার দায়িত্ব পিতা-মাতার ।তা জেনেও তার থেকে সরে আসছে!”
আলাউদ্দিন কঠিন গলায় বলেন,
“তারথেকেও বেশি বড় দায়িত্ব ওর ভবিষ্যতের সুখ-দুঃখ দেখা।”
“অরুনকে বিয়ে করলে ওর সুখই হবে।কারণ,দুজন -দুজনকে জানে,বুঝে,ভালোবাসে!তাছাড়া,অরুনকে ছেলে হিসেবে আমার ওতো খারাপ মনে হয়নি,যতটা খারাপ রিপোর্ট ওই মেয়েগুলো দিয়েছে!”
“তুমি ওদের হয়ে কথা বলছো,তুমিও আবার ঘুষটুষ দখলে নিলে নাকি?”তাচ্ছিল্য করে বলেন।
পারুল বেগম এবার আরো রেগে যান।সোঁজা দাড়িয়ে যেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলেন,
” তুমি অরুনকে বারোভাতারী আরো কত রাজ্যের কথা না আজ বললে?একটা কথা কি জানো?দোষটা অরুনের একার নয়,ওই বিপরীত মুখী মেয়েগুলারও আছে।আর অশ্রু তাদের নামেও রিপোর্ট দিয়েছে।যেই স্মৃতি আসছিল না আমাদের বাসায় সে প্রতিদিন থানায় গিয়ে গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসে!যেখানে আইন মেনে নিলো অরুনের একার দোষ নয়,সেখানে তুমি কেনো অরুনকে একাই দোষী ভাবছো!পৃথিবীতে কোন মানুষই একেবারে শুদ্ধতার শিরোমণি নয়।কালি কমবেশি সবার মাঝেই আছে।তুমি হয়তো কাউকে খুব ভালো জানো, কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে মদ খায়, জোয়া খেলে নাহয় শিশু পাঁচার করে।মানুষের কাছে তার এসব কর্মকান্ড প্রকাশ হয়নি।সে সমাজে সাধুবেশে সবার সাথে ধার্মিকভাবে চলছে দয়া দেখাচ্ছে,দান করছে।নিতান্ত তুমি ওই মানুষটাকে কখনোই খারাপ ভাববে না।
অথচ,যে মানুষগুলোর ব্যাপারে মিডিয়া প্রকাশ হয়ে যায় আমরা একেবারে তাদের নিচে নামিয়ে দিই।ওটা ফাঁস হয়েছে বিধায়তো জানতে পেরেছো,আর হাজারো হাজারো ছদ্মবেশী মানুষ ভেতরে যে তাজা প্রাণওল খতম করে তাদের যে বলতে পারো না তারা খারাপ!কেন মানসিকতা মাথায় একপাক্ষিক ঝুঁলে রেখেছো বলো ত?উভয় দিক ভাবো আশা করি বাস্তববাদী চিন্তা জাগ্রত হবে!”
আলাউদ্দিন কিছুক্ষণ মৌন থাকে।আর বিপুল পারুলের সব কথা শুনলেও কানে ধরে আঁটকে রাখে স্মৃতি শব্দটা।মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ নিয়ে বলল,
“কোন স্মৃতির কথা বললেন, ফুপী?”
“ওই যে ওদিন যে একটা মেয়ে অশ্রুর সাথে দেখা করতে এলো ও।”
“ওহ আচ্ছা!”
বলেই বিপুল মনে মনে খুব বেজার হয়ে যায়।তাছাড়া,স্মৃতি যে খুব উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে এসব তার দ্বারা অসম্ভবের কিছু নয়!পারুল বেগম আলাউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে আবার বলেন,
“তোমার চাকরি, অশ্রুর থ্রেট এসেও আল্লাহ রহমতে কোনো একশান আসে নি একবারতো ভালোভাবে জানলেই না এসব কিছুর পেছনে কার অবদান রয়েছে!”
বিপুল বলল,
“কে ফুপি?”
“অরুন!আর অরুন জনসম্মুখে নিজের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে নিল শুধুমাত্র অশ্রুর জন্যে!”
আলাউদ্দিন এবার নড়েচড়ে বসলো।খুবই শান্ত গলায় বললো,
“এসব যদি অশ্রুকে লোক দেখানো ভালোবাসা হয়ে থাকে পারু,তখন?অবশেষে আমার মেয়ের মনও পেয়ে গেল ও!এখন ওর অপমানের প্রতিশোধ নিতে ইজ ভেরী সিম্পল।আর তা অশ্রুকে বিয়ে করেই চুকাবে!
তুমি একটা জিনিস ভাবো যে ছেলের জামাকাপড়ের মতো দিনেক দিন মেয়ে চ্যান্জ করে সে ছেলে একটা সাধারণ ঘরের মেয়ের প্রতি কেন এতটা আক্রোশ বাড়বে তাওনহুটহাট! বুঝতে পারছো কিছু?”
“ভালোবাসা কখনো ভেবেচিন্তে হয়না।তুমিও তো একসময় আমায় প্রপোজ করে বসলে যেটা আমি আগে কখনো ভাবিওনি। তো?আমাদের বিয়েটাও ভেবেচিন্তে হয়েছিল?”
“তখনকার দিন আর এখনকার দিন অনেক পার্থক্য,পারু।ওরা খুব ধনী ঘরের ছেলে।এরা প্রথমে সেম্পিথি নিয়ে এলেও পরে দেখা যাবে এদের আসল রূপ!এরকম শত শত পরিবার আছে এবং নিজ চোখে দেখেছি অনেক।তাই চাই আমাদের পরিবারের স্ট্যাজনুযায়ী মেয়েকে বিয়ে দিব।সেটা বিপুল হলেও মন্দ না!”
বিপুল কিছু আর বলে নি।মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাঁকিয়ে আছে।পারুল বললেন,
“তুমি পৃথিবীর সবাইকে কেন একই রকম ভাবো।পৃথিবীর সবাই এক নয়!এখন নিজেরা নিজেরা এসব ভেবে মেয়ের ইচ্ছেকে অপ্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না?আমি বলি কি একবার মেয়ের সাথে কথা বলো,তার মনের ভাষা বুঝো।তারপর নাহয় কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিও!,”
বিপুলও পারুল বেগমের সাথে সায় দিল।আলাউদ্দিন খানিকক্ষণ চুপ থেকে টান গলায় বললো,
“আচ্ছা,দেখি।”
পারুল বেগম মনে মনে বেশ খুশি হোন!

অশ্রু ঘুমানোর চেষ্টা করছে দু’চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারছে না।অরুনকে কিছুক্ষণ আগে দু’তিনবার কল দিলো, রিসিভ করেনি।তাই নিয়ে মনে আরো বেশি উৎকন্ঠা। এভাবে হাইতাই কিছু সময় চলতে চলতে যেই অশ্রুর চোখে ঘুম ঘুম পায়,ঠিক তখন কল বেজে উঠে।বালিশের কিণার হাতরিয়ে ফোন হাতে নেয়।অরুন কল করেছে।এবার মনে একটু স্বস্তি ফিরে আসে।রিসিভ করে বললো,
“হ্যালো?”
“অশ্রু কেমন আছো?”অরুনের মুখের ধ্বনি খুব গম্ভীর।অশ্রু মনে মনে তা উপলব্ধি করে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“ভালো।কখন বাসায় ফিরেছেন?”
“এইতো ঘন্টাখানেক আগে।”
“ওহ।তো ডিনার করেছেন?”
“তুমি করেছো?”
“ডিনার করতে আজ ইচ্ছে হয়নি।তাই করিনি।”
“রাতের খাবার না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বা।এরকমটা করবা না।এখন গিয়ে খেয়ে নাও।যাও!”
“কিন্তু এখনতো খাওয়ার সময় নয়!”
“মাত্র এগোরটা বাজে।”
“মাত্র!”
“কথা না পেঁচিয়ে খেতে যাও।”
“আমার ইচ্ছে হয় না।”
“আচ্ছা,আমি কল রাখলাম।”
“আরেহ নাহ নাহ শুনুন?খাবো খাবো।আর একটা কথা?”
“হু,বলো?”
“আপনি করেছেন?”
অরুন একথা ইগনোর করে অন্য কথা টানে,
“খাবারের আগে আধা গ্লাস পানি খাবা। কেননা পানুিতে গলা ভিঁজে এতে খাদ্যের কণা দলা বেঁধে গলায় আঁটকায় না।”
“বুঝলাম।আমার উত্তর?”
“আমার কথা বাদ দাও।যাওতো তাড়াতাড়ি। দেরী হয়ে যাচ্ছে!”
“আপনার গলা দিয়ে ভাতের নালা ঢুকে নি,তা আমার গলা দিয়ে ফরফর করে ঢুকবে বুঝি?”
অরুন চুপ থাকে।তবে,দৃঢ় শ্বাস ছাড়ার শব্দ কানে আসে।অশ্রুও চুপ থাকে।কিছুক্ষণ এভাবে কেঁটে যাওয়ার পর অরুন বলল,
“আঙ্কেল কী বললেন?”
“জানি না।আমি রুম থেকেই আজ বের হইনি।বাবা আসে নি আমার রুমে।”
“ওহ!”
“এখন কি করবেন ভেবেছেন?”
“আমি তোমার বাবার সাথে আবার কথা বলবো।”
“দরকার নেই।বাবার কথা শুনতে আসার দরকার নেই।”
“আমি না তোমাকে ভালোবাসি অশ্রু?”
“ভালোবাসলে নিজের মানও দিতে হবে?”
“তাহলে তোমাকে যে আমার হারাতে হবে!”
অশ্রু এবার নিঃশব্দে ছোট একটা ঢোক গিলে।অরুন বললো,
“কাল বিকেল বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাবো।আমার বাবা তোমার বাবার সাথে কথা বলবে!”
“আপনার যেটা ভালো হয়!”
“অশ্রু ভীষণ মিস করছি তোমায়।এক মুহূর্তে তোমায় ছাড়া আমার সকল অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।ইদানীং কেনজানি তোমাকে বড্ড বেশি মনে পড়ে!”
অশ্রুর চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়ে।নাক টেনে টেনপ বললো,
“আমিও খুব,অরুন।আপনি ছাড়া আমি দ্বিতীয় কাউকে ভাবতে পারিনা।”
“অশ্রু একটু রাখছি।বাবা বোধহয় দরজায় নক করছে।তুমি খেয়ে নিও,হ্যাঁ?আমি আবার কল দিব।’
” আচ্ছা। ”
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৮
রোকসানা আক্তার

সকাল বেলায় অশ্রু ওয়ারড্রবের জামাকাপড় গুলো গোছানোর সময় আলাউদ্দিন ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করেন।অশ্রু বাবাকে দেখে কিছুটা বিচলিত বোধ করে।তারপর হাতে রাখা জামাটা নিচে রেখে একটু হেসে উঠে।মেয়ের স্ফুট হাসি দেখে আলাউদ্দিন গলায় খাঁকারি টেনে বলেন,
“কাল থেকে আমায় তো অভিশাপ দিয়ে এসছিস।এখন হাসি দিয়ে বাবাকে কি বুঝাতে চাইছিস?”
অশ্রু হাসি থামায়।মাথাটা নুইয়ে এনে বাবাকে বলল,
“কিছু বলবে,বাবা?”
“অপ্রয়োজনে কখনো তোর রুমে এসেছি?”
অশ্রু ছোট্ট একটা ঢোক গিলে।তারপর পাশে রাখা চেয়ারটি বাবার দিকে দিয়ে বলল,
“বসো,বাবা।”
আলাউদ্দিন চেয়ারে বসেন।মেয়েকে বলেন,
“তুই দাড়িয়ে কেন!বস।কথা আছে আমার।”
অশ্রু মাথা নেড়ে হ্যা সম্মতি দিয়ে বিছানায় বসল।আলাউদ্দিন মেয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ থমথমে মুখে তাকিয়ে থাকেন।মেয়ের চোখ ফুলে গেছে।গাল চিমসে হয়ে আছে।চুলগুলো কেমন এলোমেলো ।মন খারাপ করে নিজের যত্ন নিতে যে ভুলে গেছে তা আলাউদ্দিন বেশ বুঝতে পারলেন।তাছাড়া,মন খারাপ হবে এটা অস্বাভাবিকের কিছু নয়। ভেবেই আলাউদ্দিন মস্তিষ্কে গুঁজে রাখা কথাগুলোর প্রসঙ্গ টানে।বলেন,
“অরুনকে তুই ক’দিন হলো চিনিস?”
বাবার এহেন কথায় অশ্রু টগবগিয়ে উঠে।খুব চাপা গলায় জবাব দেয়,
“বেশিদিন নয়,বাবা।”
“তাহলে কী বুঝে ভালোবাসলি?”
অশ্রু চুপ থাকে।মেয়ের চুপ থাকা দেখে আলাউদ্দিন আবার বলেন,
“এক দুইদিনের পরিচয়ে মানুষ মানুষকে ভালোভাবে চেনে উঠতে পারে না অশ্রু!রঙ্গিন হাওয়ার দোলায় সবকিছুই চাকচিক্য ভাবছিস অথচ যখন একই থালায় সংসার পাততে যাবি তখন দেখবি সেই ভালো মানুষটার অচেনা রূপ!কতটা ভয়াবহ আর কতটা বিমর্ষ!মানুষ মানুষের সাথে যুগ যুগ ধরে চলাফেরা করলেও মানুষের আসল রূপ ধরা যায় না।আর দু একদিনের পরিচয়ে কীভাবে রে মা!”
অশ্রু দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ে।বাবার মুখখানে খুব স্বাভাবিকতায় তাকায়। বলল,
“মানুষকে চিনতে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লাগে না বাবা। দৃঢ় বিশ্বাস, আর মনের মিলই যথেষ্ট।এখন এখানে প্রধান হলো আমাদের মন!মনকে আমরা যেমন ভাবনা তুরে নিয়ে যাবো মন ঠিক সেদিকে যাবে!যুগ যুগ মনকে অবিশ্বাসের খাঁচায় বন্দি রাখলে মন সেই দ্বিধাই ছুটে চলবে,কখনোই মুছবে না।কৈশোর পেরুবে,যৌবন পেরুবে,প্রৌঢ় পেরুবে,বৃদ্ধ পেরুবে!তাহলে মানুষ চেনার উপযুক্ত সময় কোনটা বাবা!”
“বেশ ত! তাহলে তোর যা ইচ্ছে কর।আমার বাণী যদি তোর হৃদয়ে না পৌঁছে তাহলে মুখের শক্তি ব্যয় করে তোকে হাজারো নিষেধ,উপদেশ,আদেশ দিয়ে লাভ নেই।”
খানিকক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“আদেশ,নিষেধ,উপদেশ সবকিছুতে তোমার অধিকার আছে বাবা!”
“অধিকার যদি থাকতোই মেয়ে আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করতো।বড়ই আফসোস,কেউই আমার কথা বুঝলো না।”
অশ্রু ফকফকে চোখে বাবার দিকে তাকায়।ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার যদি একটুও মন না টানে,তাহলে আমি চেষ্টা করবো অরুন নামের শব্দটিকে ভুলে যেতে।তবে,দুঃখ এটাই পালিয়ে বিয়ে করিনি তোমাদের কথা ভেবে।তোমাদের সম্মতি হবে।পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই বিয়েতে আসবে।তোমাদের খুশির আবেশে ওরাও বেশ স্বস্তি পেত। তবে নিয়তি বলে যে একটা শব্দ আছে তা বোধহয় বিধাতা আমাকে দেয়নি।তোমরা অভিভাবক।তোমাদের বুঝ-অবুঝ অবশ্যই আছে।ছোটবেলায় তোমাদের ইচ্ছার গন্ডিতে রক্ষিত ছিল আমাদের জীবন। আমরা হাসলে তোমরা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে,আমরা কাদলে তোমরা ব্যথিত হতে।সেই বিবেকের নীড় ছেড়ে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্যতা দিয়ে অভিভাবককে কষ্ট দেওয়া এই জগতে খুব কমই মানুষ সুখী হয়েছে।তাই ছোটবেলার জীবন তোমাদের মতে চলেছিল,বড় বেলার জীবনও নাহয় চলুক!নিজের কথা ভেবে অন্যের মুখের হাসি কেড়ে নেওয়ার মানে হয় না বাবা!”
বলেই অশ্রু বিছানা থেকে উঠে বেলকনির দ্রুতপদে চলে আসে।কথা গুলো বলেছিল ঠিকই কিন্তু বুকের ভেতর হাঁপানীর উৎপাত প্রচন্ড।বুক ঢুকরে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে অশ্রুর!সত্যিই কী পারবে অরুনকে ভুলতে?তার সকল মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে দিয়ে অন্যের সাথে সংসার পাততে!
বলা কথাগুলো খুবই অভিমান,কষ্টের,রাগের ছিল তা তার বাবা বুঝতে পেরেছি কিনা অশ্রু জানে না।

আলাউদ্দিন বসা থেকে মেয়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন।মেয়ে বাইরের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে।চোখে থেকে হয়তো অজস্র পানির স্রোত বেয়ে পড়ছে। প্রচন্ড কষ্ট বুকে এই কথা গুলো বললো তা আলাউদ্দিনের বুঝে উঠতে বেগ পেতে হয়নি। তবে কী করবেন তিনি?মেয়ের ওতো একটা পছন্দ আছে।শুধু নিজের ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে মেয়েকে কষ্ট দিবেন?আচ্ছা,মেয়ে যদি তার অন্য সংসারে গিয়ে নিজের প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে খুব কষ্টাভূত হয়!দুঃভরা মন নিয়ে বাবাকে অভিশাপ দিতে থাকে!?জীবনটা ওর।জীবনটাতো তার নয়।তাহলে কেন এমন হেয়,স্বার্থপর কাজ মেয়ের উপর চাপিয়ে দিবেন?
ভেবে কূল পাননা আলাউদ্দিন। কূল হারা নৌকার মতো নদীর মাঝখানে যেন ভাসছেন আলাউদ্দিন।
বিলম্ব না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ান।গলা ছেড়ে মেয়েকে বলেন,
“আমি যাচ্ছি অশ্রু।”
বলেই চলে রুম থেকে বেরিয়ে যান।অশ্রু বুঝতে পারলো তার বাবা রুমে নেই।তাই এখনই সুযোগ কান্না করার। ভালো মতো চাপা কান্নার দলা গুলোকে গলা থেকে বের করে বুকটা হালকা হবে!

দুপুরের খাবার না খেয়েই অশ্রু ঘুমিয়ে যায়। একটা ফোন কলে ঘোর ঘুম ভাঙ্গে।যখন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে চারদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসছে।ঘুমের সময়টা এত দীর্ঘ হবে ভাবতে পারেনি ।দু’দিন ঠিকমতো মুখে অন্ন যায়নি।এতে শরীর একদম দুর্বল, নিস্তেজ হয়ে যায়।যদিও অশ্রু নিজেকে তা বুঝতে দেয় নি।হাজারো কষ্ট,চিন্তার ভর মাথায় নিয়ে নিজের কেয়ার করাটা কোনো দুস্পাপ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় ।তাই কাহিল চোখে একগাদা ঘুম চেপে বসাটা স্বাভাবিক।
ঘুমা ঘুমা চোখে ফোন রিসিভ করে।রিসিভ হতেই অরুনের ভয়েস।অরুন বলল,
“এতবার কল দিলাম।কল রিসিভ করো নি কেন!”
“ঘুমে ছিলাম।”
“ভালো করেছো।তোমাদের বাসায় যেয়েও ঘুরে আসলাম তখনো দেখলাম ঘুমে!”
“কি আপনি আমাদের বাসায় এসেছেন?”
“ভুলে গেলে?”
অশ্রু চমকে যায়।মনে পড়ছে আজ বিকেলেই তো সে এবং তার বাবা বাসায় আসার কথা।এখন বিকেল কেটে সন্ধে!অশ্রু তাড়াতাড়ি চোখবুঁজে জিব কাঁটে। বলল,
“স্যরি,স্যরি আসলে আমি ঘুমে ছিলাম।এতটাই বেঘোরে ঘুমালাম খেয়াল ছিল না!”
অরুন হেসে বললো,
“ইট’স ওকে।এত উত্তেজিত হবার কিছু নেই। আমি জানি তুমি ঘুমে ছিলে।আঙ্কেল তোমায় উঠাতে চেয়েছিলেন আমার বারণ করি।তাই পরে আর তোমায় তুলতে যায়নি।”
“আপনার বাবা এসেছে!কিন্তু আমি এভাবে ঘুমালাম..! “ইতস্ততা মনে বললে।
“আহা,আবার!আরেহ বাবা এতে সিরিয়াসের কিছু নেই এখানে ।সাক্ষাৎ তোমার বাবার সাথে ছিলো।তোমার সাথে নয়।”
অশ্রু মুখ চেপে হাসে।অরুন বলল,
“আচ্ছা,অশ্রু?আজ বিকেলে কেন তোমাদের বাসায় গেলাম,মনে আছে তো?নাকি ওটাও ভুললে?” শেষের কথাটা চোখ টিপে বলল।
“খুব করে মনে আছে!তবে,শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না!”
“কেন?”
অশ্রু জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে।কিছুক্ষণ মৌন থেকে তারপর বলল,
“ভয়।বাবা যেই অনড় “রাজি” শব্দটা আমার জন্যে দুর্লভ বস্তু। তাই শুনার আগ্রহ নেই।”
অরুন হেসে বলল,
“এতটাই অনাগ্রহ? ”
“শুনে কী লাভ!?কষ্টের ভারটা দ্বিগুণ করার ইচ্ছে নেই!”
“যদি বলি রাজি হয়েছেন?”
“এমন লোভাতুর স্বপ্ন?প্লিজ আর শুনছি না।”
অরুন হাসি চাপাতে পারছে না। হাসতে হাসতে যেন
হাঁপিয়ে যাবে!অতঃপর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল,
“অশ্রু,আঙ্কেল রাজি হয়েছেন!”
“কী,সত্যি!?”
“বিশ্বাস হয় না?”
“আমি স্বপ্নে শুনছি না তো?”
“নাহ,অশ্রু। সত্যি!”
অশ্রু মোবাইলটা এক পাশে টপকে ফেলে চটং ফটং একটা লাফ মেরে উঠে!আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে!এত্ত খুশি,এত্ত খুশি। খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে যাবে অশ্রু।হাতের মুঠ শক্ত করে ইয়েস ইয়েস বলে আরেকবার হন্তদন্ত লাফ মারে!তার লাফের সাথে বিছানাটাও ঘটঘট খুশিতে লাফাতে থাকে।অশ্রুর পাগলামো না দেখলেও অরুন শুনতে পায়।সে মাথা উঁচিয়ে পরমনান্দে হাসির সমুদ্রে হারিয়ে যেতে যেতে বললো,পাগলী আমার।তারপর হাসি থামিয়ে বলল,
“অশ্রু শুনো?”
কল লাউড করা ছিল।অশ্রু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে তা হাতে নেয়।বলল,
“হু।”
“খুশি শেষ হয়েছে?”
“এখনো না।অরুন আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না বাবা যে রাজি হয়ে যাবেন।আল্লাহ!”
“বললাম না ভালোবাসা আমরা জয় করেই ছাড়বো!”
“তুমি এত্ত ভালো কেন,অরুন?”
“এত খুশিতে তুমি বলা লাগবে না।বাসরে বললে বেশি খুশি হবো।”
অশ্রু লজ্জা পেয়ে থতমত খায়।থেমে থেমে বললো,
“ঢং যত!”
অরুন হেসে দেয়।বলল,
“আচ্ছা,এবার শুনো।এখন গিয়ে আন্টি,আঙ্কেল সবাইকে বড় বড় ধন্যবাদ দিয়ে আসবা।ব্যাসিকেলি সবথেকে বেশি আন্টিকে। আন্টি আমাদের ভালোবাসাটার খুঁটি ছিলেন।পরম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আন্টির প্রতি।”
“এই আন্টি নয়।শ্বাশুড়ি মা বলবা!”
“আচ্ছা।আগে যাও।”
“যাচ্ছি।”

চলবে….
(আহা,অতঃপর একটা বিয়ের দাওয়াত পাবো 😁)
চলবে….
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here