একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৩
রোকসানা আক্তার
“মা-বাবার এমনিতে এখন মন খারাপ তোমাকে ফিরে আসতে দেখলে প্রাণ ফিরে পাবেন উনারা।বিলিভ মি অশ্রু!”
অরুনের সবগুলো কথা অশ্রু মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করে।চোখে-মুখে স্বস্তির বদৌলতে একরাশ আতঙ্ক রয়েই গেল।বলল,
“আমি আপনার সবগুলো কথা বুঝতে পেরেছি।তবে,আমার বাবা আপনার এবং আমার সম্পর্ক মেনে নিবে বলে হয়না।কেননা,কারো সাথে সম্পর্ক আছে ভেবেই বাবা বিপুলের হাতে আমায় তুলে দিতে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আর সেখানে,আপনার কথা বলতে গেলে বিষয়টি আরো কেমিস্ট্রি হবে।গোলমাল বাঁধবে।বাবা নিজের জেদের কাছে অন্য সবকিছুকে তুচ্ছ মনে করেন। সারাটা দিন ফুঁপিয়ে কাদলেও নিজের কথা থেকে এক পাও নড়বেন না।”
“অশ্রু,আমরা চেষ্টাতো করে দেখতে পারি! এখন উনাদের বিষয়টি না জানিয়ে হয়তো পরে আফসোস করবো। এমন দিন আসবে তোমার পরিবার এবং আমার পরিবার খুবই কাতর স্বরে বলবেন কেন আমরা উনাদের না জানিয়ে বিয়েটা করলাম।উনারা কি আমাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছা দিকগুলো খুঁতিয়ে দেখতেন না!তাদের সন্তান হয়ে অবিশ্বাস নামক এই জঘন্য শব্দটায় কিভাবে নিজেরা হার মানলাম!খুব মন খারাপ করবে।কষ্ট পাবে।যে কষ্টের দাগ কখনোই শুকাবে না।আর এই কষ্টের দাগগুলোর অধিকাংশই প্রাপ্যতা পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয় মহলের কুৎসিত ভরা সেই নোংরা কথাগুলো।
তখন পারবে নিজেকে সামলাতে? পারবে আগের ভুলগুলো চুকাতে?পারবে না!”
অশ্রু চোখবুঁজে একটা দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ে।কিছুক্ষণ চুপ তারপর থেকে বলল,
“আমি ওসব বুঝি,অরুন!তবে আমার কেনজানি খুব ভয় হয়।মন বলে,বাসায় ফিরে যদি আপনাকে হারিয়ে ফেলি,তখন?!আমি আপনাকে কিছুতেই হারাতে পারবো না অরুন।কিছুতেই না।আমি সত্যি মরে যাবো।”বলেই অশ্রু টপটপ চোখের পানি ফেলতে থাকে।
অশ্রুর অনবরত চোখের পানি অরুনের বুকের পাঁজরটা চিনচিন ব্যথা করে উঠে।ভালোবাসা শব্দটি
শুধুই মায়া,আবেগ,অনুভূতি নয় যার ভেতরের সত্ত্বায় লুকিয়ে থাকে এক অনন্য তেজস্ক্রিয়তা শক্তি। যেখানে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর কথা ভাবতেই পুরো শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয় হয়ে নিজের ভালোবাসার যু্দ্ধে নামে।পেতে চায় নিজের প্রিয় মানুষটিকে । অরুন অশ্রুর দু’নয়নে তাকিয়ে তা ভীষণভাবে ফিল করে।দৃঢ় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে অশ্রুর আরো কাছে গিয়ে বসে।তার দু’হাতে আলতোভাবে ধরে বলল,
” এই মেয়ে,এত কাঁদলে হবে? আমাদের ভালোবাসা ধ্রুব সত্য!সত্যিকারের ভালোবাসার কখনো পরাজয় হয়না।শুধু নিজের উপর বিশ্বাস রাখবে।আমাকে হারানোর ভয় কখনো ফিল করবে না।মনে রাখবে আমি আছি তোমার মনের ভুবনে আর তা সবসময়ই। আমাদের প্রিয় ভালোবাসাকে জয় করে!”
“অরুন?আমার বাবা যদি আপনার কথা শোনামাত্র ধরেই আমাকে বিপুলের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেয়,তখন?”
“আচ্ছা,তোমাকে আমার কথা বলতে হবে না!”
“তাহলে কি বলবো?”
“তোমার কিছুই বলতে হবে না।যা বলার আমিই বলবো তোমার বাবাকে।শুধু আজকের রাতটা শেষ হোক।কাল সকালেই তোমাদের বাসায় হাজির হবো।”
“আর আমি বাসায় গিয়ে কি বলবো?”
“ওই যে বললাম না বান্ধবীর বাসায় গিয়েছো তাই বলবে।”
“ক-কিন্তু…!”
“এত হেজিট্যান্ট ফিল করো না অশ্রু।নিজের উপর বিশ্বাস রাখো!আমরা একটা পবিত্র ভালোবাসার বিয়ে চাই,তাই না?তাহলে আমাদের এটাই করতে হবে।”
অশ্রু ধীরভাবে “হ্যা-সূচক” মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।অরুন খুশি হয়ে কুটিল হাসে।বলল,
“প্রথমে ওরকম করলে কেন?”
“ভয় পেয়েছি।ভাবলাম যেভাবে এসছি সেভাবে ফিরে যেতে বলেছেন!”
“এতটাই অবিশ্বাস এই অরুনের উপর?”
অশ্রু হাসার চেষ্টা করে আবার মাথা নাড়ে।অরুন হাঁক ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা অশ্রু শুনো?তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে তোমার।আর আমারও?বাবা বোধহয় টেনশন করছেন খুব!আর সি.এন.জি করে যাবা নাকি গাড়িতে?”
“গাড়ি করে গেলে আশপাশের লোক চোখ তুলে তাকাবে।সিম্পল আগে যেভাবে যাতায়াত করতাম ওভাবেই যাবো।রিক্সাতেই হয়ে যাবে।”
“তোমার যেটা সুবিধা।আর চলো আগে ডিনারটা করে নিই।”
“আমার ডিনার করতে এখন একদম মুড নেই!প্লিজজ?”
“ডিনার না করো জলখাবার খাও?”
“তাও না।বিকেলে চা খেয়েছি ওটা জমে গ্যাস হয়ে গেছে।”
“সেদিনও এরকম করলে।আর আজও!আজ আমি একদম মানবো না।হালকা খাবার হলেও খেতে হবে।ওকে?”
“প্লিজ অরুন?চাপ দিবেন না।”
“কোনো চাপ দিচ্ছি না।আসো আমার সাথে?”
অশ্রু অনিচ্ছা ভাবে দাড়িয়ে থাকে।অরুন এহেন দেখে মুখটা বেজার করে ফেলে।বলল,
“আমি কিন্তু তোমার সাথে রাগ করবো!আর রাগে তোমার সম্মতি নাও ফেলে একদম কেদে দিব!”
অশ্রু খিলখিল হেসে দেয়।অরুন অশ্রুর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।মুগ্ধতা কন্ঠে বলল,
“তোমার হাসি খুব সুন্দর, অশ্রু!”
মুহূর্তে অশ্রু হাসি থামিয়ে ফেলে।লজ্জা পাওয়ার ভণিতা করে বলল,
“আচ্ছা,আগে খাবার খাবো চলুন।”
“চলো।”
তারপর তিনজন পিজা,লাচ্ছি,কোকোলা দিয়ে মোটামুটি জলখাবার শেষ করে।হোটেল থেকে বেরিয়ে আবরার রিক্সার খোঁজে একটু সামনে এগোয়।আর পেছন পেছন অশ্রু এবং অরুন।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে।অশ্রু অরুনের দিকে আনমনে একনজর তাকায়।তার উসকোখুসকো চুলগুলো বাতাসের গতির বেগে দোলছে। উদাসীন মুখটা সোডিয়াম বাতির আলোয় স্বচ্ছ সোনালী দেখাচ্ছে আর অপ্রতিম চোখদুটো চিকচিক করে উঠছে।সুন্দর মুখ,সুন্দর তার সব।অশ্রুর চোখদুটো নিরক্ষণ যন্ত্রের মতো যেন অরুনের রূপের তরী গুনছে!
ইচ্ছে হয় অরুনের চুলগুলো আলতো একবার ছোঁয়া এঁকে দিতে কিন্তু এখন তা চাইলেও অসম্ভব।ভেবেই অশ্রু একটা আক্ষেপ নিঃশ্বাস ছাড়ে।অশ্রুর ঘোর ভুবনের মাঝে অরুন বলে উঠলো,
“অশ্রু,তোমার রিক্সা! ”
অশ্রু চমকে সামনে তাকায়।সত্যিইতো তার বিদেয় হবার লগ্ন চলে এসছে।সময় হবে না আর একদন্ড দাড়ানোর।পাশে আবরারের ফোন বেজে উঠে।নূরী কল করেছে হয়তো।গাড়ির তীব্র আওয়াজে কথা ভালোভাবে শুনতে না পেয়ে আবরার খানিক টুকু দূরে চলে যায়।অরুন অশ্রুর হাত ছেড়ে বলল,
“অশ্রু রিক্সায় উঠো।”
অশ্রু ছোটস্বর টেনে “হ্যা” বলে রিক্সার দিকে পা বাড়ায়।রিক্সার সামনে যেয়ে পায়ায় পা রাখবে এমতাবস্থায় পেছনে ফিরে।চোখদুটো টলমলা করে বলল,
“বায়!”
অরুন ছলছল চোখে তাকিয়ে হেসে দেয়।বলল,
“টেক কেয়ার।সাবধানে যাবে।”
অশ্রু রিক্সায় উঠে বসে।রিক্সা ছেড়ে দেয়।অরুন এবার গলা উঁচিয়ে আবার বলল,
“অশ্রহ,বাসায় গিয়ে পৌঁছালে আমায় কল করে জানিও।”
মুহূর্তে অশ্রু অনেকটা দূরে চলে যায়।তারপর অরুন মনটা বেজার করে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
শুনশান পরিবেশের আতঙ্কগ্রস্ত মানুষগুলার সামনে হুটহাট অশ্রুর বাসায় এমন আগমনে উপস্থিত সবার চোখ কপালে!অশ্রুর মামীতো একদম তরতাজা চোখে বাঁজে স্বপ্ন দেখছেন।এ কী করে সম্ভব!অশ্রু বাসায় ফিরে আসবে!অশ্রুর মা খুশি হয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছেন।অশ্রুর দিকে এগিয়ে গদগদ কন্ঠে বলেন,
“অশ্রু,তুই! এসেছিস মা?কোথায় ছিলি কাল সারারাত?
পাশ থেকে অশ্রুর মামী বলে উঠেন,
” কারণ,জিজ্ঞেস করবেন না আপা।ফূর্তি-আয়েশের কথা সবার সামনে তো আর মুখ ফসকে বলতে পারবে না।তা অশ্রু ছেলেটা ছেড়ে দিল বুঝি?পছন্দ হয়নি তোকে?”
অশ্রুর মামা গরম নয়নে অশ্রুর মামীর দিকে তাকান।তেড়ে গিয়ে বলেন,
“এসব বলতে মাথায় আগে বিবেক বাঁধো।কার সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় সে ম্যানার্স টুকু বোধ হয় জানো না!”
“কথা বলো নাতো তুমি!এই মেয়ে দুশ্চরিত্রা! স্বইচ্ছে মা-বাবার চোখমুখে চুনকালি দিয়ে এখন আবার পতিতালয় মেয়ে হয়ে ফিরে এসছে তাকে কি তাহলে আদর করবো?”
একথা শুনে পারুল বেগম নিজেকে মোটেও শান্ত রাখতে পারেননি।এমন খোলা কথা সবার সামনে বলাতে পারুল বেগমের মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।চড়ে উঠেন কোহিনুরের উপর।ক্ষ্যাপা গলায় বলেন,
“বাহ ভাবী,বেশ বললেন।কথা আছে মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি।আমার মেয়ে কি করছে না করছে সেটা আমি দেখবো এবং আমি বলবো!আপনাকে এতকিছু বলতে বলিনি।মেয়ে আমার যেখান থেকেই আসুক সেইফলি তো আমার কোলে ফিরে এসেছে তাতেই আমি খুশি!এখন অনুরোধ কেউ কিছু বলবেন না!”
পাশে আলাউদ্দিনও ছিলেন।তিনি কর্ণার সোফায় বসে আছেন নিথর মুখে।মেয়েকে একপলক দেখেছেন বৈকি।তবে মেয়েকে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন কি হোন নি তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
অশ্রু কান্না মুখ করে বলে উঠলো,
“মামী, আমি বাঁজে কোথাও যাইনি।আমার বান্ধবী রাইসাদের বাসায় ছিলাম।”
“কেন গিয়েছিলি ওখানে ?”
“কারণ তো চিঠিতেই জানলে, মা।”
“আমরা কি তোর আপন না?আমাদের একবারও মুখ ফগগটে বলতে পারলি না?তোর ভালোমন্দ দেখার কি আমাদের অধিকার নেই?”
অশ্রু কথা বলেনি।টপটপ চোখের পানি ফেলে।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৪
রোকসানা আক্তার
আলাউদ্দিন ফ্লোরে নিবদ্ধকৃত চোখদুটো এবার অশ্রুর দিকে আওড়ায়।অনবরত তার ঠোঁট কাঁপছে সাথে টানা নাকের হাঁপানি।শ্লেষা মুখের বাণী যে মিথ্যে ছিল আলাউদ্দিন তা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করেন।মনের অন্দরে গূঢ় ক্রোধের চিহ্নটা উনার মুহূর্তে ধপ করে জ্বলে উঠে। চোখ-মুখ শক্ত করে একপর্যায়ে সোফা ছেড়ে দাড়িয়ে যান। অশ্রুর দিকে বজ্রকন্ঠ ছুঁড়ে দেন,
“বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিস না অন্য কোথাও গিয়েছিস তা তোর চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে!তা যেখানেই গেছিস এখানে আবার ফিরে এসেছিস কেন!”
বাবার ওমন কথায় আঁতকে উঠে।অতি সংগোপনে তেতো একটা ঢোক গিলে মাথা নিচের দিকে নুইয়ে নেয়।এই সুবাদে কোহিনুর বেগমও একটু সুযোগ পান।আলাউদ্দিনের সাথে এক সুরেলা মিলিয়ে বলেন,
” ভাইজান,ঠিক বলছেন।এই আপনার মেয়েটা বুঝে না এখনকার ছেলেরা যে ফুলের মধু খেয়ে ঘুরে বেড়ায়!কিছু বললেই আপা আমার দিকে আড়নয়নে তাকায়।কথা আছে না হককথা বললেই খারাপ!”
পারুল বেগম কাঠিন্য চোখে তাকিয়ে বলেন,
“আমিতো আপনাকে খারাপ বলিনি!আর আমার মেয়ে কোনো দোষ না করলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে আমিই বা চুপ থাকবো কেন!”
“তাহলে আপনি সিউর কিভাবে আপনার মেয়ে নির্দোষ!?”
“মায়েদের প্রমাণ লাগে না।মেয়েদের মনের কথা মারা এমনিতেই জানে!”
“আচ্ছা তাই যদি হয় তাহলে তুমি তোমার মেয়েকে নিজমুখে আবার জিজ্ঞেস করো ও কালরাত কোথায় ছিলে?যদি ও তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে তাহলে সত্যিটা বলবে।আর যদি না রাখে তাহলে বলবো তুমি মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারোনি!”
কথাটা অশ্রুর আঁতে এসে আঘাত করে।মাথা উঁচিয়ে সবার দিকে টগবগে চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়তে থাকে আর গাল বেয়ে টপটপ পানি পড়ে।কোহিনুর আবারো কিছু বলবে বিপুল তার আগেই কথার ফোঁড়ন কাঁটে।বলল,
“বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?কেন এখন তোমরা এরকমটা করছো সবাই,বলো?”
আলাউদ্দিন বলেন,
“ও নিজ খুশিতে যাবে,আবার নিজ খুশিতে ফিরে আসবে।মাঝখানে সমাজের কাছে আমাদের ছোট করবে!জীবনটাকে সে কি পেয়েছে পুতুল খেলা?”
“আঙ্কেল,এটা সিউর কীভাবে ও অন্য ছেলের হাত ধরে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে!”
“ওকেই জিজ্ঞেস করো।সত্যিটা বেরিয়ে আসবে!”
বিপুল পাশ ফিরে কিঞ্চিৎ অশ্রুর দিকে তাকায়।অশ্রু নিচের দিকে তাকিয়ে নিমজ্জল ঘামছে সাথে পায়ের কাঁপন।আলাউদ্দিন আক্ষেপ কন্ঠ টেনে আবার বলেন,
“ওকে বলো ও যেখান থেকেই এসেছে সেখানে আবার ফিরে যেতে এ বাড়ি ওর জায়গা নেই!”
বলেই আলাউদ্দিন একমুহূর্ত দাড়িয়ে থাকেন নি।হর্ণপায়ে রুমে চলে যান।অভাগা অশ্রু মাথা তুলে বাবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।পরপর মামীও চলে যায়।
আর বসার রুমে দাড়িয়ে থাকে বিপুল,তার মামা,নুজিফা এবং পারুল বেগম!
পারুল বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে পিঠে হাত বুলান।নরম মিশ্রিত কন্ঠে বলেন,
“অশ্রু,রুমে চল!”
অশ্রুর মামাও পাশ থেকে তাই সম্মতি দেন।অশ্রু মায়ের সাথে রুমের চলে আসে।পারুল বেগম মেয়েকে খাটের উপর বসিয়ে মাথা হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,
“কাদিস না।জানিস তো তোর বাবা এরকমই এই রাগ,এই ভালো।”
অশ্রু মাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।নাঁক টেনে টেনে বলল,
“মা,তোমরা বিপুল ভাইয়ার সাথে আমায় বিয়ে দিবা নাতো?”
“দিব না।”
“সত্যি বলছো তো দিবা না?”
“হুম,সত্যি বলছি দিবো না।এবার তুই কান্না থামা।”
“বিপুল ভাইকে আমার পছন্দ না।”
“আহা,জানিতো।কান্না থামাবি?”
বলেই মেয়েকে ছাড়িয়ে মুখখানা হাতের মুঠোয় তুলে ধরেন।আবার বলেন,
“চোখের পানি মুছ।”
অশ্রু চোখের পানি মুছে।পারুল বেগম মুখে হাসি চেপে মুখের এলোমেলো চুলগুলো পেছনে গুঁজে দেন।তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলেন,
“অশ্রু একটা সত্য কথা বলবি আমাকে?”
“কি।”
“তোর কি কারো পছন্দ আছে?”
অশ্রু নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে।অশ্রুর চুপ থাকা দেখে পারুল বেগম হাই তুলতে তুলতে বলেন,
“আচ্ছা,তুই খুব ক্লান্ত।ফ্রেশ হয়ে নে।আমি তোরজন্যে খাবার নিয়ে আসতেছি।”
বলেই পারুল দরজার দিকে পা বাড়ান।অশ্রু মন জগতে ভাবতে থাকে,মাকে কি সত্যিটা বলে দিবে যে সে অরুন নামের কাউকে খুব ভালোবাসে?তখনতো সবাই মাকে কতই না কটাক্ষ করলো কারো সাথে সম্পর্ক আছে ভেবে।আর কাল যদি অরুনের দমকা উপস্থিতি সবার মুখে মাকে আরো তাচ্ছিল্য কথা শুনতে হয়?
অশ্রু দরজার দিকে তাকিয়ে প্রকাশিত কন্ঠে বলল,
“মা শুনো?”
পারুল বেগম হাটার মাঝেই থেমে যান।পেছন ফিরে,
“কী?”
অশ্রু থেমে যায়। বলতে যেয়েও মনটা নিষিদ্ধ নগরী হয়ে যায়।সাহস কুলোয় না। হাসি ভাব এনে প্রসঙ্গ পাল্টায়,
“নাহ,মা কিছুনা।তবে এই শাড়িটা খুব সুন্দর!”
পারুল বেগম মেয়ের এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খান।কিছু না বুঝে উঠতে পেরে চোদুটো রাঙ্গিয়ে বলেন,
“পাগল মেয়ে।”
তারপর রুম ত্যাগ করেন।
রাতে শোয়ার সময় অশ্রু এক বিভোর চিন্তা মাথায় নিয়ে খাটে পিঠ লাগায়।একদিকে অরুনের ফ্যামিলি মানবে কি মানবে না তাই নিয়ে ভয়।অন্যদিকে তার নিজের ফ্যামিলি!কেমন হবে অনিশ্চিত এই ভবিষ্যৎ !তাদের ভালোবাসা কি আদৌ জয় হবে?নাকি বৃথা স্বপ্ন নিয়ে দুঃখগুলোকে সংবরন করতে হবে!
ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা ছোট হয়ে আসে।
একটা মুহূর্তে তংতং কল বেজে উঠে মোবাইলে।অশ্রু ফোন হাতে নেয়।তাকিয়ে অরুন।ব্যাকুল হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে।গদগদ হাতে কল রিসিভ করেই বলল,
“হ্যালো,অরুন?”
“কোথায় তুমি? রুমে?”
“হ্যাঁ।কোনো জরুরী তলব আছে নাকি?”
“আছে,বৈ-কি।কোথাও যেও না।আমি আসছি!”
কটকট কল কেটে যায়।অশ্রু চোখ কপালে তুলে গুড়োবালি খায়!এই ছেলে বলল কী!এতরাতে আসবে কোথায়!এমন গূঢ় কথার অশ্রু অর্থ বুঝলো না।যাইহোক মজা করেছে বৈ-কি। ভেবেই অশ্রু মাথা ঝাঁকায়।
পেছন ফিরে তাকাতেই বেলকনির দরজার দিকে চোখ যায় তারসাথে চমকে উঠে। দরজার চৌকাঠ ধরে এক সুদর্শন যুবক দাড়িয়ে।তার চুলগুলো সীমাহীন উড়ছে ফাগুনের মৃদু বাতাসে।
দৃষ্টি এদিকে। চোখমুখে বিষাদ ক্লান্তি ভরা।
অশ্রু সবিস্ময় চোখে বলল,,
“আপনি এত রাতে?!”
অরুন হাত দিয়ে ইশারা করে,
“আস্তে কথা বলো,আস্তে!কেউ শুনে ফেলবে তো!?”
“কিন্তু এখানে কিভাবে আসলেন ?”
“বলব।।সব বলবো।আগে একটু শান্ত হও প্লিজজ?”
অশ্রু বারংবার ঢোকর গিলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।মিনিট একের মাঝে ক্ষিপ্রতা কিছুটা কমে এসলে। অরুন হাসি দিয়ে এদিকে এগুতে এগুতে বলল,
“এতরাতে কেউ বেলকনির দরজা খোলা রাখে?যদি চোর এসে আমার প্রিয়সীকে নিয়ে যেত,তখন?”
“কী!বেলকনির দরজা খোলা ছিল?!”
“জ্বী,ম্যাডাম!”
“কিন্তু আপনি এত উপরে কিভাবে উঠলেন?”
“টেকনিক আছে!”
“কিভাবে?”
অরুন হাসে।
“প্লিজ বলুন না কীভাবে উঠলেন?”
“বলছি..তার আগে তোমায়…
বলেই অরুন অশ্রুর দু’হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নেয়।তার দু’ঠোঁটে দু’হাত রেখে আলতোভাবে স্লাইড করতে থাকে!অশ্রুর ঘনহারে নিঃশ্বাস নিতে থাকে।অশ্রুর গরম নিঃশ্বাসের আভা অরুনের মুখ চেয়ে যায়।অরুন স্লাইড ক্ষণকালে বন্ধ করে আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলল,
” কিস করবো?”
অশ্রু মুহূর্তে লজ্জায় লাল হয়ে যায়।মাথা নিচু করে আনে।
“করি?”
“ন-নাহ!”
“য়ু-হু করবো!”
“এই নাহ।”
“তোমার বারণ শুনবো না!”
বলেই অরুন অশ্রুকে নিজের সাথে মিশিয়ে তার ঠোঁট দু’টো নিজের ঠোঁটের আয়ত্তে চলে যায়।বিদুৎ চমকানোর মতো অশ্রুর ভেতরটা এক শিহরণ জেগে উঠে!
ঘুমে ভেঙ্গে যায় অশ্রুর।তরহর শোয়া থেকে উঠে বসে। বেলকনির দরজার দিকে তাকায়।বেলকনির দরজা আঁটসাঁট ভাবে বন্ধ!জানলার পর্দা ভেদ করে সকালের মৃদু সূর্যের আলোয় পুরো রুমটা আলোকিত ।এটা যে একটা স্বপ্ন ছিল অশ্রু এবার সম্পূর্ণ পরিষ্কার।
মনের মাঝে একটা আক্ষেপতার দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল,
“ইস এটা যদি বাস্তব হতো!”
বলেই আবারো লজ্জায় মুখটা আরক্তিম হয়ে এবার লাল টকটকে দু’গাল!
এই লাল টকটকের বেশিক্ষণ বিরাজ থাকেনি।এরইমধ্যে মোবাইল বেজে উঠে।অরুন কল করেছে।অশ্রুর দু’ঠোঁটে ভুবন ভুলানো হাসি ফুটে ওঠে।পুলকিত গলায় বলল,
“হ্যালো?”
“হ্যালো,অশ্রু?আমি,বাবা,আবরার এবং ইমতিয়াজ ভাইয়া কিছুক্ষণ পরই তোমাদের বাসায় আসছি!বাবা বিয়েতে মত দিয়েছেন।বললাম না?বাবা এই বিয়েতে মত হবে!”
একথা শুনে অশ্রুর মনে এতটাই খুশি ধরে যায় যা বলার ভাষা তার এই মুহূর্তে নেই।থেমে থেমে বলল,
“সত্যি?”
“হুম,সত্যি।আমি অনেক খুশি অশ্রু!”
“আমিও!তা আসতে কতক্ষণ লাগবে?”
“এইতো এক/দেড় ঘন্টার মতো লাগবে।আর শুনো?”
“হু।”
“তুমি আজ পাতা কালার একটা শাড়ি পড়বে।পাতা কালার আমার এবং বাবার ফেভারিট কালার।আর চোখের নিচে গাঢ় কাজলতো অবশ্যই।ব্যাস এটুকু সাজলেই এনাফ।”
“শুধু এটুকুই?”
“ইয়েস,ম্যাম।অতি সুন্দরীদের বেশি সাজতে নেই।তাদের অল্পতেই মানায়!”
“হয়েছে এত মিষ্টি কথা।তাড়াতাড়ি আসবেন।আমি রাখলাম।”
“বায়।টেক কেয়ার।”
“টেক কেয়ার।”
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-৫৫
রোকসানা আক্তার
পাতা কালার শাড়িটি শরীরের সাথে আঁটসাঁটভাবে বিঁধে আছে।মাথায় হাতখোপার উপর গাজরা লাগানো।কানে দুল।গলায় সীতা চেইন। এছাড়া,চোখের নিচের গাঢ় কাজলটা মুখে আরো কড়াভাব এনে দিয়েছে।দৃষ্টি এঁটলেই মনে হয় যেন দেবী কদম্বিরী সবার সম্মুখে আড়ি পায়ে বসে আছেন।
অরুন সেই অপ্রতিম রূপের ডালির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি।শ্লেষা তার হাত-পায়ে কাঁপন ধরে। নিমিষে মাথা নুইয়ে আনে।পাশে আবরার বসা ছিল।সেও অশ্রুর সৌন্দর্যে পঞ্চমুখ।তাই প্রসংশা না করে মুখে কুলুপ লাগাতে পারেনি।তার মুখটা অরুনের কানের দিকে ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,
“এ কী দেখলাম মাম্মা।আমিতো পুরাই ক্রাশ!ভাবি সুন্দর তবে অতিমাত্রায় যে সুন্দর তা আজ দেখলাম।তাইতো ভাবি অরুন এতশত মেয়ে রেখে এই সাধারণ মেয়ের পেছনে এত ঘুরঘুর করছে ক্যান।ঘুরঘুর করে যে মন্দ করেনি তা আজ বেশ বুঝলাম।আসলেই মাম্মা এই মেয়ের ভেতর চুম্বকীয় আকর্ষণ আছে যা আমাকেও ভেতরে ভেতরে টানছে!”
লাস্ট কথায় অরুনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।কঠিন চোখে আবরারের দিকে তাকাতেই আবরার ঢোকর গিলে মাথা নিচু করে আনে।তারপর মশা তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে বললো,
“ভাবীকে নিয়ে একটু কৌতুক করা যায় না,বুঝি?”
“অরুন দাঁতে দাঁত চেপে তার মাথাটা আবরার দিকে গুঁজে বলল,
” কৌতুক ভালো।তবে অতিমাত্রার কৌতুক ভালো নয়!”
আবরার আবারো একটা ঢোকর গিলে।তারপর খানিকটুকু হাসার চেষ্টা করে সামনে তাকায়।এখানে মোটামুটি সবাই উপস্থিত শুধু অশ্রুর বাবা ছাড়া।জরুরী তলবে সকাল দশটায়ই আর্জেন্ট অফিসে চলে যান।অশ্রু এমনটা জানতো না।সে ঘুম থেকে উঠার পর আর বাইরে যায় নি।নিজেকে সাজাতেই উঠে পড়ে লেগে যায়। সকালের নাস্তাটা পারুল বেগম নিজে এসেই রুমে দিয়ে যান।যদি ডাইনিং এ যেয়ে নাস্তাটা সারতো তাহলে অরুনের বাবাকে এমন কর্পূরভাবে এনে নিজেকে ছোট্ট মনে হতো না।এখন অশ্রুর নিজের কাছে নিজেরই খারাপ লাগছে।উনি আশা নিয়ে এসেও নিরাশ মনে বাড়ি ফিরবেন।
অশ্রুর মামা কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে ভুট্টো পোদ্দারকে বলেন,
“আমি বুঝলাম আপনার কথা,মিস্টার ভুট্টো পোদ্দার।অরুন অশ্রুকে ভালোবাসে এবং অশ্রুও অরুনকে ভালোবাসে এতে আমার সন্দেহ নেই।তবে আসল কথা হলো–এহেন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণটাই আমার ভাইজানের উপর।উনি রাজি থাকলে কারোই অসম্মতি হবে বলে মনে হয়না!”
“জ্বী।তবে,এমন সময় উনি যে বাসায় থাকবেন না তা জানি না।এসে বড়ই আফসোস হলো।”
“এখানে আফসোসের কিছু নেই ভুট্টো পোদ্দার।ভাইজান আসলে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ কথাটা উনার কানে পাড়বো।দেখি উনি কি মতামত দেন।”
ভুট্টো পোদ্দার একটু নড়েচড়ে বসেন।অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,
“দেখেন,আমার ছেলেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার কখনো অজুহাত ছিলনা এবং এখনো নেই।তারা যা চায়,যেভাবে থাকতে পছন্দ করে,যেভাবে বাঁচতে ভালোবাসে তাতে তাদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আমি দিয়েছি।কাল রাত ও যখন আমায় অশ্রুর কথা বলে প্রথমে আমি অনেকতা কাঠিন্য হই,তারপর ছেলের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর আগলে রাখতে পারিনি।নিজের সকল জেদ,ক্ষোভ, ঘাত-প্রতিঘাত জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলের কথায় রাজি হয়ে যাই।ছেলে আমার সম্মতি পেয়ে যখন ঠোঁঠ ছড়িয়ে হেসে দিল সত্যিই আমি তখন বড়ই তৃপ্ত হয়েছি।এই বুঝি মনে শান্তি এলো।নাহলে সারাটা জীবন ছেলের কাছে একটা অপরাধ বোধ থেকে যেত!”
“জ্বী,পোদ্দার আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কথা।”
পোদ্দার হাই তুলতে তুলতে বললেন,
“জানি উনার সাথে আমার চরম শত্রুতা।তাই বলে নিজেদের আত্মাসম্মানের কথা ভেবে দুটো ছেলেমেয়ের সকল আশা,স্বপ্ন,ইচ্ছা,ভাষণ ধূলিসাৎ করে দিব এহেন আমি মোটেও ডিজার্ব করিনা।”
পারুল বেগম মুঁচকি হেসে দেন।ভুট্টো পোদ্দারের কথায় উনিও যে ভারী রাশ পেয়েছেন তা উনার মুখের অবয়বে প্রতীয়মান।হাসি বজায় রেখেই বলেন,
“জ্বী,ভাই।আল্লাহ চায়তো ওরা ওদের পছন্দের মানুষকে নিজের করে নিবে।”
কোহিনুর বেগমের এবার বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুরী পেটা করছে।পারুল এতে সম্মতি দেবে তা উনার কল্পনার বাইরে ছিল।যেখানে উনার স্বামীর মান হরণ করেছিল এবং একপর্যায়ে মেয়েকে নিয়েও খারাপ কথা তুললো আর মেয়ে কিনা সেই কপট বাবার কপট ছেলেকে মন দিয়ে ফেলেছে।তাছাড়া এখন সাধীও করতে চায়! আর তার মা তাতে যোগ দিয়ে ঢোল পিটাচ্ছে এরাতো নিশ্চই হারামজাদা!নিজের ক্ষিপ্রতাকে আপনে সংবরণ করে অতিথীর সামনে সৌজন্যতা বজায় রেখে পারুল বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আপা,আমরা নিজেরা সম্মতি দিলেতো হবে না।দেখি ভাইজান কী বলেন!তাই এখন খামোখা হেসে কোনো লাভ নেই।” বলেই হাসার চেষ্টা করেন।
পারুল বেগম আর কথা বলেননি।এই মহিলার সাথে এখন কথা বাড়াতে গেলেই মানসম্মানে এখন বারোটা বাঁজবে।কাজেই চুপ থাকাই শ্রেয়।
সবার মোটামুটি হাসাহাসি, ঠাট্টা তামাশা,কৃত্রিম সৌজন্যতা একপ্রকারে চলছে।তবে সোফা থেকে খানিকদূরে ডাইনিং চেয়ারে বিপুল নিঃশব্দে বসে আছে।সে সেখানে যোগ দেয়নি।দিতে ইচ্ছেও হয়নি।তার মনে এক বিষাদ বিষন্নতা ঘিরে ধরেছে।চোখজোড়া একদিকে নিবদ্ধ রেখে বিভোর ভাবনায় আকুপাকু দিচ্ছে।অশ্রুরও একজন পছন্দের মানুষ আছে।যাকে সে খুব ভালোবাসে এবং সারাজীবন তাকে তার করে পেতে চায়।অথচ দুজন কতই কাছাকাছি ছিল সে অশ্রুর মনের কথাটি টুকে নিতে ব্যর্থ হয়।সেদিন যদি হৃদয়ঙ্গম জ্ঞাত হতো অশ্রু অন্যের, তার নয়। তাহলে স্মৃতিকে নিজের কাছে খুব যত্ন করে আগলে রেখে দিত।স্মৃতির অভ্যেসগুলোয় নিজেকে মানিয়ে তার হয়ে পথ চলতো। অশ্রু নামক এই বস্তুটির নাম সেদিনই মন থেকে মুছে ফেলতো।আর আজ?অশ্রুর আশায় নিজের প্রাক্তনকে হারাতে হয়েছে।কথা আছে–আশা মানুষকে বাঁচতে শেখায় না,অনেক সময় জীবন অন্ধকার করে দেয়!যেখানে হাত-পা রাখার ঠাই থাকে না!!
নিবৃত্তে অরুন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সোফার রুম থেকে কোহিনুর ঘটাং ঘটাং পা ফেলে ছেলের দিকে এগিয়ে এসে ঠাঁট গলায় বলেন,
“গিয়ে দ্যাখ,তোর বাবা কী মধুমাখা কথা বলছে ওদের সাথে!একবারও নিজের ছেলের কথা ভাবে না।মেয়েটাকে ওখানে বিয়ে দিয়ে দিলে নিজের ছেলেটা যে….!”
কথার মাঝেই বিপুল তার মাকে থামিয়ে দেয়।সজাগ কন্ঠে বলল,
“তুমিতো কালরাত অশ্রুকে অনেক কটাক্ষ করেছো এখন আবার আমার কথাও ভাবছো?”
“আরেহ,ওসবতো আমি এমনি বলেছি।ওমন কুৎসা কথা শুনার পরও তুই যখন আবারো ওকে বিয়ের করার কথা বলবি ও খুব সেম্পেথি হবে।ভাববে,তুই কারো কথা গাঁয়ে মাখিস নি।তুই ওকে অগাধ হৃদয় দিয়ে এখনো খুব ভালোবাসিস।তোর প্রতি ওর একটা বিশ্বাস জন্মাবে! ”
“তোমার কি বিশ্বাস ও কাল অন্য কোথাও ছিল?”
“আরেহ অন্য কোথাও থাকবে কেন?!আমি অশ্রুকে ছোট্টকাল থেকেই ভালো করে চিনি।ও খুব ভদ্র,শান্তশিষ্ট মেয়ে।ওরকম বিদঘুটে কাজ করবে বলে মনে হয়না।বান্ধবীর বাসাই ছিল!”
“মা,অশ্রুর যেটা ভালো লাগে সে করুক করুক।প্লিজ এবার তোমায় আবারো বলছি কারো পার্সোনাল লাইফে নাক গুলিও না! ”
“বারবার একই কথা কেন বলিস রে তুই?আমিতো তোর ভালোর জন্যেই বলছি।আর একমাত্র আমিই জানি তুই অশ্রুকে কতটা ভালোবাসিস!”
“একপাক্ষিক ভালোবাসা কখনো পূর্ণ হয়না।ভালোবাসা,বিয়ে উভয়েই পারস্পরিক সহানুভূতিতে হয়।আই থিংক ইউ ক্যান আন্ডার্সটেন্ড!”
বলেই বিপুল চেয়ার ছেড়ে অন্যত্রে চলে যায়।কোহিনুর বেগম সং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
অতিথিদের কথা বলার শেষ পর্বে অশ্রু উঠে আসে।বিছানার উপর নিথর মুখ করে বসে!মনটা ভালো নেই। অরুনের বাবা আসছে,তার বাবা বাসায় নেই।কতটা হীনমন্যতা হয়ে গেলো ব্যাপারটা।বাবা থাকলেতো সরাসরি সম্মতির একটা আঁশ পাওয়া যেত এখন সেটা বোঝাও মুশকিল।রাতে মামার থেকে একথা শুনামাত্রই না জানি কতটা ক্ষেপে উঠে এবং তার দিকে তেড়ে যায়!কিছুতেই কিছু মাথায় আসছে না অশ্রুর!
ভেবেই মাথা ঝাঁকায়।তবে আফসোস বিলাশের বেশিক্ষণ ঠাই হয়নি।তার আগেই অরুন রুমে এসে গড় হাজির।সম্মুখে দাড়িয়ে বলল,
“অশ্রু, মন খারাপ তোমার?”
অশ্রু মাথা থেকে হাত ছাড়িয়ে তাকায়।দু’পাশে মাথা নাড়ে।অরুন মুখে হাসি টেনে বলল,
“আচ্ছা বিছানা থেকে নামোতো?”
অশ্রু চোখজোড়া প্রশস্ত করে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়।অরুন বলল,
“বলছি।আগে নামো!”
অশ্রু নামে।অরুন অশ্রুর কাছে এসে শাড়ির আঁচল টেনে অশ্রুর মাথায় উপর ছড়িয়ে দেয়।একদম বউ বউ লাগছে তাকে।এইরকম একটা বউই অরুনের প্রয়োজন!অরুন হাসিটাকে এবার দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলল,
“এইযে এখন বউ সাজালাম।কাল/পরসু তুমি এই অরুনের বউ হয়েই পোদ্দার বাড়ি যাবে!কথা দিলাম।”
অশ্রু উৎকন্ঠা নিয়ে বলল,
“তবে অরুন,বাবা?বাবা যদি রাজি না হোন!”
“রাজি অবশ্যই হবে।আমি রাজি করিয়েই ছাড়বো ইট’স মাই প্রমিজ!আজ রাতেই তোমাদের বাড়ি আসছি।তোমার বাবার সাথে কথা বলতে।”
অশ্রু মলীন মুখটাকে এবার হাসি হাসি ভাব নিয়ে আসে।অরুনের এমন আশ্বস্ত কথায় নিজেকে স্থির না রাখতে পেরে অরুনকে আলতো জড়িয়ে ধরে।বলল,
“ধন্যবাদ,অরুন।অনেক ধন্যবাদ।বিশ্বাস তোমাকে ছাড়া এই জীবনে আমার আর কাউকে চাই না।শুধুই তোমাকে।”
অরুন অশ্রুর পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে সামনে দাঁড় করায়।বলল,
“আমার সুন্দরের ডালি এখন হাসছে।বাহ বেশ দেখাচ্ছে।এমন হাসি সবসময় রাখবা যাতে অফিস থেকে ক্লান্তিভরে ফিরে এসেও রূপের ডালির হাসি হাসি মুখটা দেখলে মনটা মুহূর্তে ভালো হয়ে যায়!”
অশ্রু অধোমুখ করে নেয়।অভিমানী গলায় বলল,
“বাবাকে আগে রাজি করাও।তারপর বউ করার স্বপ্ন দেখো।আগে এত আশা ভালো না!ঢং!”
অরুন হেসে দেয়।
“হাসবে না।আমার খুব ভয় হচ্ছে বাবাকে নিয়ে।”
“কোনো ভয় নেই।আমি আছি।”
“জানি।”
“তাহলে এমন উৎকন্ঠা কেন?”
“জানি না।”
অরুন আবারো হেসে দেয়।তারপর হাসি চাপিয়ে বলল,
“আচ্ছা,থাকো।আর বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গেছে।গেলাম।টেক কেয়ার।”
বলেই অরুন দরজার দিকে পা বাড়ায়।কী ভেবে পেছন ফিরে।বলল,
“অশ্রু?তোমাকে আজ এতটাই অসাধারণ লাগছে যা বলার মতো ভাষা নেই আমার।এত সুন্দর কেন তুমি?”
এক দমে বলে শেষ করেই দাড়িয়ে থাকে নি।দ্রুতপদে বাইরে চলে যায়।আর অশ্রু কিঞ্চিৎ লজ্জায় মুখ চেপে হাসে।
চলবে…
(এই প্রথম গল্প এত্ত রাবারের মতো লম্বা হলো।আমি নিজেই বিরক্ত😐 কবে শেষ হবে!!!)
চলবে…
চলবে…