#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
রাত প্রায় দুটোর মতো বাজে। রিশাদ ঘুমিয়ে গেছে আরো আগেই। রিশাদের চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল মনের ভেতর। মানুষটা ভীষণ রকম ভালো। আল্লাহ্ তার মনের সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিক। মাকে সুস্থ করে দিক। মা না থাকার কষ্টটা কখনো যেন কেউ অনুভব না করে। সবার মাকে আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখুক হাজার বছর।
প্রিয়ুর চোখে ঘুম নেই। খিদেয় পেটের ভেতর চো চো করছে। পেটে খিদে থাকলে ঘুমও আসতে চায় না। তাই প্রিয়ু ফ্রিজ খুলে দেখে খাবার কী কী আছে। এখন ঠান্ডা খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না আবার গরমও করতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া রিশাদ নিজেই যেখানে না খেয়ে আছে সেখানে প্রিয়ু কখনোই রিশাদকে ছাড়া খেতে পারবে না। কোকের বোতল দেখতে পেয়ে একটা বোতল হাতে নেয়। গন্ধ শুকে দেখে মদ মেশানো আছে নাকি। না নেই! কোক নিয়ে আবারও ফ্লোরে বসে পড়ে। কোক খেতে গিয়ে আমিনের কথা মনে পড়ে। প্রিয়ুর জানামতে আমিনের এত ভালোবাসা কখনো দেখেছে বলে তো মনে হয় না। প্রিয়ু তো দূরের কথা, আশাকেও কখনো কিছু কিনে দেয়নি। তাহলে আজ কেন? তাও আবার অর্ধেক খাওয়া কোক। এসে দিয়েই চলে গেল। এতে কি কোনো মারপ্যাঁচ আছে? প্রিয়ু একটু নড়েচড়ে বসে। মনের ভেতর কেমন যেন কু গাইছে। অস্থির অস্থির লাগছে। বাড়িতে আবার কেউ নেই। আশা এখন একা আছে। প্রিয়ু কিছুক্ষণ পায়চারী করতে থাকে রুমের ভেতর। এরপর সিদ্ধান্ত নেয় এখনই বাড়িতে যাবে। টেবিলের ওপর থেকে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে, ‘আমার অস্থির লাগছে খুব রিশাদ। আমার বাড়িতে যেতে হবে। তুমি ঘুমিয়ে আছো তাই আর তোমায় ডাকিনি।’ চিরকুটটা রিশাদের বালিশের নিচে রেখে প্রিয়ু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মেইন গেটে গিয়ে সালাম চাচাকে বলে,
“আঙ্কেল আমি বাড়িতে যাচ্ছি। রিশাদ চিরকুটটা দেখবে নাকি আমি শিওর নই। রিশাদ অফিসে যাওয়ার সময় বলে দিয়েন আমি বাড়িতে গেছি।”
সালাম চাচার উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রিয়ু চলে যায়।
পথে প্রিয়ুর সঙ্গে সিয়ামের দেখা হয়ে যায়। প্রিয়ু সিয়ামকে খেয়াল করেনি। সিয়ামই প্রিয়ুকে দেখতে পেয়ে ডাক দেয়।
“আরে প্রিয়ু না?”
প্রিয়ু পিছনে ফিরে তাকায়। সিয়ামকে দেখে বলে,
“আপনি এখানে?”
“আমার এক পরিচিত ফ্রেন্ডের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বন্ধুর বাবাকেই দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাড়িতে যাচ্ছি।”
“ছিলেন কোথায়?”
“ছিলাম এক জায়গায়।”
“চলুন বাড়িতে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“না, লাগবে না। আমি একাই যেতে পারব।”
“তবুও আমি এগিয়ে দিতে চাই।”
প্রিয়ু কী ভেবে যেন বলল,
“ঠিকাছে।”
দুজন কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে।
.
হানিফের সাথে তর্কাতর্কি হচ্ছে আমিনের। যেই টাকাটা আমিনকে দেওয়ার কথা ছিল সেই টাকা হানিফ দিতে নারাজ এখন। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুরো টাকাই দেয় হানিফ। একটা কাজে আটকে যাওয়ার কারণে যেসময়ে যাওয়ার কথা ছিল সেই সময়ে যেতে পারেনি। হানিফ আমিনের বাসায় যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন ছেলেরা এসে আমিনকে মারধোর করে টাকা সব নিয়ে যায়। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় আমিন ওদের কাউকেই চিনতে পারেনি। রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে।
দূর থেকে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে প্রিয়ু আর আমিন এগিয়ে আসে। আমিনকে দেখে দুজনই বেশ চমকে যায়। তারচেয়েও বেশি চমকে যায় আমিন নিজে। নেশাগ্রস্থ থাকলেও প্রিয়ুকে চিনতে ওর কখনোই ভুল হবে না। প্রিয়ু আমিনকে ধরে বলে,
“তোমার এই অবস্থা কেন? কে মেরেছে তোমায়?”
আমিন প্রিয়ুর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বলে,
“তুই এখানে কেন? তুই কোথায় ছিলি? তুই প্রিয়ু?”
সিয়াম আর প্রিয়ু দুজনই দুজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। প্রিয়ু বলে,
“হ্যাঁ, আমিই প্রিয়ু। তুমি এমন করছ কেন? আশা আপুকে রেখে তুমি এখানেই বা কী করছ?”
সবচেয়ে বড় ধাক্কা বোধ হয় এখন আমিন খায়। অবাক হয়ে বলে,
“আশা বাড়িতে?”
“হ্যাঁ।”
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না আমিন। দৌঁড়াতে শুরু করে। একটু পরপর হোঁচট খাচ্ছে তবুও থামছে না। ওর পেছনে সিয়াম আর প্রিয়ুও দৌঁড়াতে থাকে।
.
.
এলোমেলো হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আশা। হানিফ ফোনের লাইট অন করে প্রিয়ুর বদলে আশাকে দেখতে পায়। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় হানিফের। টাকা নিয়ে এত ঝামেলা করল আর শেষমেশ কী না প্রিয়ুর বদলে আশা! সে যাই হোক, টাকা তো উসুল করতে হবে। ঘুমন্ত আশার দিকে এগিয়ে যায় হানিফ। গা থেকে ওড়না সরাতেই দরজায় করাঘাত করতে থাকে আমিন। ক্রমশ করাঘাতের শব্দ বাড়তে থাকে। আমিন জোরে জোরে করাঘাত করতে করতে ডাকতে থাকে হানিফকে।
“দরজা খোল! হানিফ দরজা খোল।”
হানিফ দরজা খোলে না। আশেপাশের বাড়ির মানুষজনও ঘুম থেকে উঠে যায়। দেখতে আসে কী হয়েছে। আমিন কিছু বলছে না। ওর পায়ের নিচের মাটিকে হালকা মনে হচ্ছে ভীষণ। বিরক্ত হয়ে হানিফ দরজা খুলে। ততক্ষণে হানিফের সাথে দেখতে পায় এলাকার আরো মানুষজনকে। দেখতে পায় প্রিয়ু আর সিয়ামকেও। থতমত খেয়ে যায় হানিফ। হানিফকে দেখে সবাই খুব অবাক হয়। আমিন হানিফের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
“দরজা খুলতে এত দেরি করলি কেন? কী করছিস তুই আমার বোনের সাথে?”
আমিন থতমত খেয়ে বলে,
“কী যা তা বলছিস?”
প্রিয়ু তাড়াতাড়ি রুমে ঢোকে। সাথে যায় আরো কয়েকজন মহিলা।
—————————–
ভোরের আলোর সাথে নিভে যাচ্ছে আশার নিজের জীবনের আলো। এক পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কাঁদছে। অন্যদিকে এলাকার মানুষরা সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। আলেয়া বেগম, মনসুর আলী খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। আমিন ক্ষেপে আছে হানিফের ওপর। এত মানুষের এত কথা শুনতে না পেরে আমিন আবারও হানিফকে মারতে যায়। হানিফও এবার রেগে গিয়ে বলে ফেলে,
“টাকা নেওয়ার সময় মনে ছিল না? আজকে যদি আশার জায়গা প্রিয়ু থাকত তখন তো তুই মারতে আসতি না। তাছাড়া তোর সাথে তো আমার ডিল হইছিল প্রিয়ুকে নিয়ে।”
আমিন এবার থেমে যায়। পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায় সবার কাছে। হানিফ সবকিছু খুলে বলে সবাইকে। একটা মানুষ এতটাও নিচে নামতে পারে! আশা এতক্ষণ কাঁদলেও এবার তেড়ে যায় আমিনের দিকে। সিয়াম আটকে রাখে আশাকে। প্রিয়ু আমিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“টাকার জন্য এত নিচেও নেমে গেছ তুমি? শুধু মাত্র তোমার আপন বোন নই বলে? আজকে যদি আপুর জায়গায় আমি থাকতাম। আমার সাথে…”
প্রিয়ু পুরো কথা বলতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসায় আমিনের গালে। ইচ্ছেমতো থাপ্রাতে থাকে আর বলে,
“তুই তো মানুষ না। জানোয়ার তুই! অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে যে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয় সেটা দেখলি তুই? আজ যদি আমরা না আসতাম? তাহলে আপুর কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত বুঝতে পারছিস তুই? অবশ্য তুই তো চেয়েছিলি আমার ক্ষতি।”
আলেয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়ুর দিকে তেড়ে আসে। হাত চেপে ধরে বলে,
“এইসব কিছুর পেছনে তোর হাত আছে। তোর জন্যই এসব হইছে।”
প্রিয়ু হাত ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে বলে,
“এতকিছুর পরও! এতকিছুর পরও অন্ধ হয়ে তুমি আমার দোষ দেখছ?”
“ওরে ছাড়ো।” বলেন মনসুর আলী।
এলাকার গুণীজনরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে হানিফের সঙ্গেই আশার বিয়ে দেবে। এর ঘোর প্রতিবাদ জানায় প্রিয়ু। এরকম চরিত্রহীন ছেলের সাথে বোনের বিয়ে দেবে না প্রিয়ু। এই প্রথম প্রিয়ুকে সাপোর্ট করে আমিনও। আমিন সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“ওর সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে দিমু না আমি।”
আলেয়া বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন,
“তুই কোনো কথাই বলবি না আর। এই মাইয়ারে এখন কেডায় বিয়া করব? সমাজে মুখ দেখাইতে পারমু আমরা কেউ?”
সিয়ামের উদ্দেশ্যে কঠিন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রিয়ু। জিজ্ঞেস করে,
“আমার আপুকে বিয়ে করবেন ডাক্তারবাবু?”
উত্তর দিতে সময় নেয় না সিয়াম। আশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি আশাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম। আমি জানি, এখানে আশার কোনো দোষ নেই। আশার যদি কোনো ক্ষতিও হয়ে যেত তবুও আমি আশাকে বিয়ে করতাম। আমি আশাকে বিয়ে করতে রাজি। আমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা দিচ্ছি, আবার পরিবারকে নিয়ে আমি আজই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসব। আর আজই আমাদের বিয়ে হবে।”
যেখানে সিয়াম নিজেই বিয়ে করতে রাজি হয় সেখানে আশার পরিবার বা এলাকার অন্য কেউই দ্বিমত করে না। সিয়ামের উত্তরে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় প্রিয়ু। আশার জীবনে নতুন আশার আলো হয়ে আসছে সিয়াম। ডাক্তারবাবু!
মানুষজনের ভীড় কমেছে। সিয়াম বাড়িতে গিয়েছে ওর পরিবারকে সাথে করে নিয়ে আসতে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ স্তব্ধ হয়ে আছে।
রিশাদ লাঞ্চ টাইমে প্রিয়ুদের বাড়িতে আসে। হঠাৎ করে ওমন চিরকুট ও সালাম চাচার মুখে প্রিয়ুর অস্থিরতা শুনে রিশাদ নিজেও কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। তাই আর কিছু না ভেবেই প্রিয়ুদের বাসায় চলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই রিশাদের সাথে দেখা হয় আলেয়া বেগমের। সালাম দিয়ে রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
“প্রিয়ু বাড়িতে আছে?”
আলেয়া বেগম জিজ্ঞেস করেন,
“তুমি কে?”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]
ছবি আর্ট- Mehjabin Oyshe Umi