#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৩১
#Saji_Afroz
ঘুম ভাঙতেই বালিশের পাশে হাত রাখে সাজির। খুঁজতে থাকে তার মোবাইল ফোনটি। না পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। সারারুম খুঁজেও নিজের ফোন পায় না। তার যতটুক মনে পড়ছে, বালিশের পাশেই রেখেছিল সেটি। তবে কী কেউ নিলো? অবশ্য সানজিদা মাঝেমধ্যে এমনটা করে থাকে। নিজের ফোনে টাকা না থাকলে ভাই এর টা নেয় সে।
সানজিদার কাছে যাওয়ার জন্যে দরজার দিকে এগিয়ে আসে সাজির। কিন্তু দরজা বন্ধ দেখে অবাক হয় সে। বাইরে থেকে কেউ বেঁধে রেখেছে দরজা। নাবীহার কাছে না যাওয়ার জন্যে তার মা নিশ্চয় ইচ্ছেকৃতভাবে এমনটা করলো।
প্রচন্ড বিরক্ত হয় সাজির। চ্যাঁচিয়ে সানজিদাকে ডাকতে থাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে রাগে দরজায় কয়েকটা লাথি মারে সে।
এদিকে ভাই এর এমন কাণ্ড দেখেও দরজার ওপারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সানজিদা। ভাবনায় পড়ে যায় সে। এমনভাবে দরজায় মারলে দরজাটায় না ভেঙে যায় আবার! সাজির যদি বের হয়ে চলে যায় সাজেদা বেগম তার উপরেই সব রাগ ঝাড়বেন বলে চিন্তিত সানজিদা। তাই ভাই এর জন্য মায়া হলেও কোনো সাহায্য করতে পারছে না সে।
খানিকবাদে সাজিরের রুমের দরজা খোলা হয়। সাজেদা বেগমকে দেখে এগিয়ে আসলো সাজির। সে বলল, এসবের কোনো মানে হয় মা? ক’দিন আমাকে এভাবে আঁটকে রাখবে তোমরা?
– আঁটকে রাখার মানুষ নিয়ে এসেছি। সেই আঁটকে রাখবে তোকে।
-মানে?
-তাসফিয়া ও তার পরিবার এসেছে। সাথে এসেছে কাজি সাহেব। আজ তোদের বিয়ে।
কথাটি শুনে তার ভাঙায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সাজির বলল, কীসব বলছ?
-হু।
দাঁতে দাঁত চেপে সাজির বলল, তুমি ভাবলে কীভাবে আমি এই বিয়েটা করব? কাল চলে এসেছি মানে এই নয় যে নাবীহাকে বিয়ে করতে চাইনা আমি।
-আমি জানি। আর তাই এমন পদক্ষেপ নিচ্ছি।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সাজির বলল, তুমি বললেই আমি মেনে নেব?
-মানতে তো তোকে হবেই।
-কেনো!
নিজের হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি ছুরি বের করে সাজেদা বেগম বললেন, নাহলে আমি আমার প্রাণ দিয়ে দেব।
এইবার ঘাবড়ে যায় সাজির। কারণ সাজেদা বেগমের জেদ সম্পর্কে অবগত সে। প্রচন্ড রাগ হলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না তিনি।
অনেক বছর আগে স্বামীর সাথে রাগ করে অনেক গুলো ঘুমের মেডিসিন খেয়ে নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলেন তিনি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। আজও যদি এমন কিছু ঘটান!
শান্তস্বরে সাজির বলল, মা আমাকে একটু সময় দাও। এভাবে হুটহাট জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
-হুটহাট মা কে হারাতে না চাইলে হুট করেই যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সাজির!
-অন্যায় করছ তুমি।
-যেটা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে, একদিন বুঝবি ঠিকই।
এদিকে বিরক্ত মাখা মুখ নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে তাসফিয়া। হুট করেই তার বাবা বলল, আজ তাদের বিয়ে। মা এর একটি লাল কাতান শাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। অথচ বাবা সবসময় বলতো, তাদের পছন্দে বিয়ে হলে আয়োজনে থাকবে না কোনো কমতি। সেসব কোথায়!
মেয়ের মলীন মুখের দিকে তাকিয়ে তার অবস্থা বুঝতে পারলেন বাবা। তিনি তাসফিয়ার পাশে এসে বললেন, সবই হবে আবার। অনুষ্ঠান হবে বড় করে।
-কিন্তু আজই কেন এভাবে বিয়েটা হচ্ছে?
-সেসব জানার তোর প্রয়োজন নেই।
-আমার লাইফ নিয়ে ঘটনা ঘটছে আর আমিই জানব না?
-তুই যখন পালিয়েছিলি তখন আমাদের জানিয়েছিলি? ভুলে যাস না, সবকিছুর পরেও আমরা তোকে ক্ষমা করে নিজেদের কাছে রেখেছি। তাই এখন আমরা যা বলব সেটাই তোর মানতে হবে। বাইরে গিয়ে তো বুঝেছিস, দুনিয়ায় টিকা এত সহজ না!
তাসফিয়া আর কিছু বলল না। তার বাবা উঠে পায়চারি করতে লাগলেন।
সকালে তার কাছে এসেছিলেন সাজেদা বেগম। নাবীহা ও সাজিরের সম্পর্কে তাকে জানান। এরপর বলেন, তিনি তাসফিয়াকেই পুত্রবধূ বানাতে চান। একবার বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তিনিও বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যান। সাজিরের মতো ছেলে তিনি হারাতে চান না। সবটা জেনেও সাজিরের মা তাসফিয়াকে মেনে নিচ্ছে। সাজিরও একদিন ঠিক মেনে নেবে।
.
.
.
ঘুম ভাঙতেই নিজের পাশে আজরাকে না দেখে উঠে পড়লো নাবীহা। আজরা কী চলে গেছে? হয়তোবা!
ভীষণ পিপাসা পায় তার। ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যায় পানি পান করার জন্যে। এসে দেখলো মা ও ভাই এর সাথে বসে নাস্তা করছে আজরা। নাবীহাকে দেখে নায়লা খাতুন বললেন, উঠে গেলি?
আজরাও তাকে দেখে বলল, ঘুম ছিলিস বলে ডাকিনি। আয়। নাস্তা করে নে।
নাবীহা এগিয়ে আসে। পানি পান করে বলল, আমি ফ্রেশ হইনি। হয়ে এসে খাব।
-একদিন ব্রাশ না করলে কিছু হয় না। বেসিং এ মুখটা ধুয়ে আয় তো।
নাবীহা তাই করলো। সবার সাথে বসে নাস্তা সেরে নিলো সে।
নায়লা খাতুন বললেন, সকালের নাস্তাটা আজরা বানিয়েছে। মেয়েটা এত কষ্ট করলো!
-কী যে বলেন না আন্টি। কীসের কষ্ট!
জহির বলল, এত বড়ো ঘরের বউ হয়েও তুমি রান্না জানো?
আজরা হেসে বলল, বউ তো পরে হয়েছি। আগে মেয়ে ছিলাম না?
নায়লা খাতুন বললেন, হ্যাঁ আজরা মা? ওখানে রান্না করতে হয়?
-হয় না। তবে শখের বশে আমি করে থাকি।
নাবীহার দিকে তাকিয়ে নায়লা খাতুন বললেন, তুই ঠিক আছিস?
সে হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে। তিনি আরও বললেন, এসব নিয়ে ভাবিস না। তুই আমারই মেয়ে।
নাবীহা মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল, তুমিও ভেবো না কিছু।
-আমি ভাবছি অন্য কথা। সাজেদার কী হলো! সে বিয়ের বিপক্ষে ছিল বলেই সাজির গোপনে বিয়েটা সারতে চেয়েছে।
আজরা বলল, হ্যাঁ ঠিক। কিন্তু সাজির ভাই এর মায়ের কী হলো এটা আমারও প্রশ্ন।
নায়লা খাতুন বললেন, হ্যাঁ রে নাবীহা? কথা হয়েছে সাজিরের সাথে?
-নাহ।
-সে কী! ফোন দেয়নি সে?
-দিয়েছিল। রিসিভ করিনি।
-সাজিরের উপরেও কম ধকল যায়নি! বিয়ে করতে এসে মা এর জন্য চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওর সাথে কথা বলা উচিত তোর। ছেলেটার কী দোষ বল?
আজরা বলল, আন্টি ঠিক বলেছে।
নাবীহা চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের রুমে যায়। এসেই ফোন হাতে নেয়। সাজিরকে ফোন দেয় সে। কিন্তু সাজির রিসিভ করে না। এইবার নাবীহা লাগাতার তাকে ফোন দিতে থাকলো।
.
.
.
-বিয়েতে রাজি থাকলে বলুন কবুল?
কাজির প্রশ্নে পাথরের মতো বসে রয়েছে সাজির।
আজ মা এর জেদের কাছে তাকে হার মানতে হচ্ছে। অসহায় লাগছে নিজেকে।
এদিকে সাজেদা বেগমের হাতে রয়েছে সাজিরের ফোন। নাবীহার এতবার কল দেখে তিনি তার নাম্বারটা ব্লক করে দেন। এরপর সাজিরের উদ্দেশ্যে বললেন, কবুল বল বাবা?
নিরূপায় সাজির মেঝের দিকে তাকিয়ে ছলছলে নয়নে বলল, কবুল!
.
.
.
-আজ কী মানতাশার বর তাকে নিতে আসবে?
মানতাশার ফুফু দিলুয়ারা জামানের প্রশ্নে মনোয়ারা বেগম বললেন, আসবে তো৷ কাল জামাই এর কাজ ছিল অফিসে তাই পারেনি আসতে।
-নিজেদের অফিস তাদের। কয়েকদিনের জন্য কাজ গুলো অন্য কেউ সামলাতে পারলো না?
জবাবে কিছু বলতে পারলেন না মনোয়ারা বেগম। দিলুয়ারা জামান বললেন, কাল কত আয়োজন করেছিলে জামাই আসবে বলে৷ মেহমান সবাই ওয়েট করছিল। কিন্তু মেয়ে এলো একা। তাও তোমাদের গিয়ে আনতে হলো।
তাদের কথার মাঝে মানতাশা এসে বলল, আমাকে বেরুতে হবে মা। আরশানের ফোন এসেছিল। চলে যেতে বলল আমাকে।
দিলুয়ারা জামান বললেন, সে কী! আজও জামাই আসবে না?
-নাহ।
-কেন?
-অফিসের কাজ আছে।
এই বলে মানতাশা নিজের রুমের দিকে চলে যায়। দিলুয়ারা জামান বললেন-
এই জন্যই নিজেদের থেকেও উঁচু বংশে মেয়ে বিয়ে দিতে নেই। কেমন ব্যবহার দেখেছ ওদের! আর মেয়ে এসেছে ক’টা দিন থাকবে না এখানে! জামাই এসে তাকে দেখে যাবে তা না! উল্টো তাকে চলে যেতে বলছে, তাও একা।
সে কথার কোনো প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে মনোয়ারা বেগম মানতাশার রুমে এলো। তাকে তৈরী হতে দেখে বলল, আরশান একটু বেশিই করছে না?
কিছু বলল না মানতাশা। চিরুনি নিয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। মনোয়ারা বেগম বললেন, যা বুঝলাম ওর কাছে ওর ভাবীই সব। মালিহার সাথে মিলেমিশে চলার চেষ্টা করিস। তবে আরশানের মন জিততে পারবি।
-ওর মন জেতার আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার প্রয়োজন মেটালেই হলো।
চিরুনি রেখে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো শুরু করে মানতাশা। মনোয়ারা বেগম বললেন, স্বামীর সাথে সম্পর্ক কী শুধু প্রয়োজনের? একদিন তাকে প্রিয় করতেও ইচ্ছে হবে।
-হবে হবে সব হবে। এত ভয় পেও না তো তুমি।
আপনমনে মনোয়ারা বেগম বললেন, ভয় তো হয়! এজাজকে ঠকানোর শাস্তি এই দুনিয়াতেই পেয়ে যাবি বলে ভয় হয়।
.#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৩২
#Saji_Afroz
-সাজির ফোন রিসিভ করছে না?
আজরার করা প্রশ্নে নাবীহা জবাব দিলো, করেনি। এখন সংযোগ যাচ্ছে না।
-কালই তার সাথে কথা বলা উচিত ছিল। ভাইয়াও নিরুপায়।
-আমি কথা বলার অবস্থাতে ছিলাম না। সবকিছু এলোমেলো লাগছিল তখন।
-বুঝেছি।
আজরার ফোন বেজে উঠে। ইনতিসারের কল এসেছে। সে রিসিভ করতেই ইনতিসার তার হালচাল জিজ্ঞাসা করে নাবীহার খবর নেয়। আজরা বলল, অফিস থেকে ফেরার পথে আমাকে নিতে আসবেন।
-তুমি চাইলে আজও থাকতে পারো।
-বলছেন?
-হু।
-ঠিক আছে। তবে থাকি।
ফোন রাখার পর নাবীহা তার হাত ধরে বলল, ধন্যবাদ রে।
-কেন?
-আমাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। তুই না থাকলে নিজেকে আরও অসহায় মনে হত।
নাবীহাকে জড়িয়ে ধরে আজরা বলল, আমি থাকতে এমনটা তোকে মনে হতে দেব নাকি?
.
.
.
মানতাশাকে দেখে মালিহা বলল, এসেছ তবে। আমি ভেবেছি তুমি আসবেই না আজকে।
-কেন?
-লজ্জায়!
-নিজের বাড়িতে আসতে লজ্জা কীসের?
-স্বামী আনতে যায়নি বলে।
-ওসব আনা নেওয়া আমি এমনিতেও পছন্দ করি না। নিজের মতো চলতে পছন্দ করি আমি। আসা যাওয়া নিজেই করতে পারি। কাউকে প্রয়োজন নেই।
এই বলে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে আসে মানতাশা। আরশান নেই। নিশ্চয় অফিসেই হবে।
মানতাশা ফোন হাতে নিয়ে আজরাকে কল দেয় নাবীহার খবর নেওয়ার জন্যে। আজরা ওখানেই আছে শুনে মনটা খারাপ হয় তার। নাবীহার এমন দিনে তারও ওখানে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সে পারেনি।
মালিহা ও আরশানের উপরে মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে সামলে নেয় সে। ভাবতে থাকে কীভাবে আরশানকে কাবু করা যায়। মুহুর্তেই মানতাশার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। যেটা সে আজই কাজে লাগাবে। এখন শুধু রাত হওয়ার অপেক্ষা।
.
.
.
বিয়ের পর তাসফিয়া নিজের বাড়ি চলে যায় তার পরিবারের সঙ্গে। দুই পরিবার ঠিক করলো, কিছুদিন পর তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। তখনি তাসফিয়া এই বাড়িতে আসবে।
সেই কবে থেকে সাজির নিজেকে রুম বন্দী করে রেখেছে। নিজের ফোনটাও নেয়নি মা এর কাছ থেকে। নিয়েই বা কী করবে! নাবীহাকে কী জবাব দেবে সে? অন্যদের মতো সেও যে ঠকালো নাবীহাকে। মেয়েটা এতবড়ো সত্যিটা মেনে নিতে পারবে তো?
.
.
.
ড্রয়িংরুমে এসে ইনতিসারকে দেখে আজরা বলল, আপনি এখানে?
একটা বড়ো প্যাকেট আজরার দিকে এগিয়ে দিয়ে ইনতিসার বলল, তোমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলাম। রান্না করার মুড কারো নিশ্চয় নেই এখানে। সকালেই আনা দরকার ছিল। কিন্তু ওতকিছু মাথায় আসেনি তখন।
প্যাকেটটি হাতে নিয়ে টেবিলের উপরে রাখে আজরা। এরপর বলল, ঠিকই বলেছেন। যদিও সকালে রান্না করতে হয়নি। কিন্তু রাতের জন্য করতে হত৷ আর এখানে কারো মনমানসিকতা ভালো নেই। তাইতো থেকে গেলাম আমি। কারণ ওদের উপরে কী যাচ্ছে তা অন্যান্য আত্মীয়রা জানে না। কেবল আমি আর মানতাশা ছাড়া।
-মানতাশা কোথায়?
-নতুন বিয়ে হলো ওর। সে কী আর এভাবে থাকতে পারবে? তবে নিশ্চয় আসবে নাবীহাকে দেখতে আবার।
-নাবীহা ঠিক আছে?
-মন খুবই খারাপ ওর৷ এর উপরে সাজির ভাই এর সাথেও ফোনে কথা বলতে পারছে না।
-কেন?
-সংযোগ যায়না।
-ব্লক করলো না তো?
আজরা একটু থেমে বলল, এটা তো ভেবে দেখিনি। তবে উনি কাল বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলেন। তখন নাবীহা রিসিভ করেনি।
-আমার মনেহয় সাজিরের বাসার কারো সাথে কথা বলা উচিত তোমার। সাজিরও কী অবস্থায় আছে কে জানে! এই সময়ে যখন সে এখানে আসেনি নিশ্চয় কোনো কিন্তু রয়েছে।
আজরা জহিরকে ডাকলো। তার থেকে সানজিদার ফোন নাম্বার নেয়৷ এরপর তাকে কল দেয়। কল রিসিভ করতেই আজরা বলল, হ্যালো আমি আজরা বলছি। নাবীহার বান্ধবী৷ সাজির ভাই কোথায়?
সানজিদা ওয়াশরুমে ছিল বলে সাজেদা বেগম ফোনটি রিসিভ করেছেন। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সাজির এখন অন্য জনের স্বামী। তোমার বান্ধবীকে বলবে ওকে যেন আর ফোন না দেয়।
-কীসব বলছেন?
-আজ সকালেই ওর বিয়ে হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠানও হবে। দাওয়াত পাবে ও বাড়ির সকলে। জানিয়ে দিও।
এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি। নিশ্চুপ আজরাকে দেখে ইনতিসার বলল, কী হলো?
-সাজির ভাই এর নাকি আজ সকালেই বিয়ে হয়ে গেছে।
ইনতিসার কিছু বলার আগেই পেছনে দেখতে পায় নাবীহাকে। সে মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ে। আজরা ছুটে যায় তার দিকে। নাবীহাকে জড়িয়ে ধরতেই সে কেঁদে উঠে বলল, কার জন্য কী করলাম আমি! সাজিরও শেষমেশ ধোকা দিলো আমাকে! এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব রে আজরা? কী নিয়ে বাঁচব? এই দুনিয়াতে কেউই যে আমার আপন রইলো না। কেউ না!
এই বলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নাবীহা। নায়লা খাতুন এসে মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইনতিসার বলল, আমি এখুনি ডাক্তার নিয়ে আসছি।
.
.
.
বাসার একজন কর্মচারীকে দিয়ে অনেক গুলো ফুল, মোমবাতি ও বেলুন আনিয়ে নিলো মানতাশা।
ছেলেটি এসব নিয়ে উপরে উঠছে দেখে তাকে থামালেন মালিহা। এসব নিয়ে কোথায় যাচ্ছে তা জানতে চাইলে জবাবে বলল সে, নতুন ভাবী এসব আনিয়েছেন।
-কেন?
-সেটা আমি জানিনা।
-ওহ!
ছেলেটি সেসব নিয়ে মানতাশাকে দেয়। সে যেতেই দরজার পাশে মালিহাকে দেখতে পায় মানতাশা। সে বলল, এখন ফ্রি আছে এমন কাউকে পাব? মহিলা কর্মচারীর কথা বলছি।
-কেন?
-আমার রুমটা সাজাব।
-হঠাৎ?
-এটাও বুঝছেন না ভাবী! আরশানকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে।
তিনি কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি সেখানে এসে হাজির হয় আরশানের বড়ো ভাই আশফাকুল হোসাইন। তিনি মালিহাকে বললেন, তুমি এইখানে! সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমায়।
-কিন্তু কেন?
-আরে আমার বন্ধু নতুন রিসোর্ট খুললো না? ওর ওখানে আজ দাওয়াত। রাতটা সেখানেই কাটাব।
-কিন্তু…
-তাড়াতাড়ি আসো তো। আগে বলতে মনে ছিল না।
স্বামীর তাড়া পেয়ে নিজের রুমের দিকে তৈরী হতে এগিয়ে যান মালিহা। এদিকে মানতাশা ধন্যবাদ দেয় আশফাকুলকে। আসলে সেই তাকে বলেছিল, আজ আরশানকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। তাই বাসাটা ফাঁকা চায় সে। আরশান তার উপরে রেগে আছে, রাগ কমাতে চায় সে।
বাকিটা বুঝে নেন আশফাকুল হোসাইন। কিন্তু এটা বুঝেন না, মূলত মালিহাকে সরাতেই এই কাজটা করছে মানতাশা। সে চায়না মালিহা আজও উল্টাপাল্টা কিছু বলে আরশানের মেজাজ খারাপ করুক।
.
.
.
-ডাক্তার কী বলেছে শুনিসনি? একদম কিছু না খেলে কীভাবে হবে?
আজরার কথা শুনে নাবীহা বলল, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না রে।
-এইভাবে তো শরীর দূর্বল করে ফেলবি!
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আজরা বলল, কে?
-আমি। আসব ভেতরে?
ইনতিসারের কণ্ঠ শুনে আজরা বলল, আসুন।
ইনতিসার এসে একটি প্যাকেট আজরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ডাক্তার বলেছিল নাবীহাকে তরল খাবার বেশি বেশি খাওয়ানোর জন্য। তাই চটজলদি চিকেন স্যুপ নিয়ে এলাম রেস্টুরেন্ট থেকে।
-খুবই ভালো করেছেন। ওর আবার এটা খুব ফেবারিট।
-তাই!
-হু। আমি একটা বাটি নিয়ে আসি।
এই বলে আজরা চলে যায়। ইনতিসার ও নাবীহার চোখাচোখি হতেই দু’জনেই আবার চোখ সরিয়ে ফেললো। হালকা কেশে ইনতিসার বলল, আমি বুঝতে পারছি তোমার উপর দিয়ে কী বয়ে যাচ্ছে।
-এটা বোঝার ক্ষমতা কারো নেই।
-আছে নাবীহা। আমিও যে পছন্দের কাউকে না পাওয়ার কষ্টটা অনুভব করেছিলাম।
কথাটি বলে থমকে যায় ইনতিসার৷ এটা কী বলে বসলো সে! মুখ ফসকে এমন একটা কথা বেরিয়ে এল, যা একেবারেই ঠিক হয়নি।
এদিকে নাবীহাও চমকাও। সে কী বলবে ভেবে পায়না। ইনতিসার বলল, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে জানাবে।
এই বলে সে বেরিয়ে যায়। নাবীহা তাকিয়ে থাকে তার পথের দিকে।
.
.
.
বাসায় ফিরে কাউকে না দেখে সোজা নিজের রুমে আসে আরশান। রুমের ভেতরে এসে রুম সাজানো দেখেও অবাক হয় না সে। মালিহা আগেই তাকে ফোন করে সব জানিয়েছে। এটাও বলেছে, এসবে যেন গলে না যায়। স্বামীকে কঠোর হতে হয় শুরুতে। নাহয় স্ত্রী হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। আরশানও এমন প্রস্তুতি নিয়েই আসে। কিন্তু মানতাশাকে দেখে সবই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। সাদা রঙের টিস্যু শাড়ি পরেছে সে। ঠোঁটে দিয়েছে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। খোলা চুলগুলো কাধের এক পাশ করে রেখেছে। তাকে দেখে পাগলপ্রায় আরশান। এই রূপ দেখেই তো মানতাশার প্রেমে পড়েছিল সে।
এদিকে আরশানের চাহনি দেখেই মানতাশা বুঝলো, আজ আর কোনো কিছুতেই আটকাবে না আরশান। কেবল আঁটকে যাবে মানতাশার সৌন্দর্য্যে। তবেই তো তাকে বশে আনা হবে সহজতর!
.
চলবে
চলবে
.