একদিন_বৃষ্টিতে_বিকেলে পর্ব ৫

#কিছু_অধ্যায়(পর্ব_৫)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

রিক্সায় ওঠার পরে চুপচাপ আছি। সে অন্যদিক ফিরে আছে। কিছুক্ষণ পরে শুধালো,
” কখনও প্রেম করেছেন?”
” তেমন কিছু আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি ।” আমি সাবলীল ভাবে বললাম। তবে সে চমকায় না। বরং ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি রেখে বলে,
” কখনও প্রেমে পড়েছেন?”
” মোবাইল, টিভি আর উপন্যাস ছাড়া বোধহয় অন্যকিছু তে পড়িনি।”
” কেন?”
” হয়তো তেমন কিছু ভালোই লাগেনি।”
” যদি কখনও ভালো লাগে?”
” ভালো লাগা আর প্রেমে পড়া তো এক নয়।”
” যেমন?”
” প্রেমে পড়লে বিপরীতে থাকা মানুষটির সবকিছুই ভালো লাগবে।”
” যদি কখনও প্রেমে পড়েন?”
” হবে কিছু একটা।”

সে ম্লান হাসে। সাথে আমিও।
কথা বলার একপর্যায়ে বলে ফেললাম,” বিয়ে কবে করছেন?”
সে বলে,” হয়তো খুব শীঘ্রই।”
“ওহ।” ছোটো করে বললাম। কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। কেন যেন আমার খুব কষ্ট হল। এহেন কষ্ট কখনও হয়েছে বলে মনে পরে না। আচ্ছা, তাহলে এই কষ্টের নাম কী? আমি উত্তর খুঁজে পাই না। সে নির্বিকার ভাবে বলে,
” কী হল?”
” কিছু না তো।”
” এই যে, কিছু একটা ভাবছেন। তা কী ভাবছেন, শুনি?”
” কই, কিছুই না।”
” অবুঝ নই।”
” তা বুঝে নিন না!”
আমার কথায় সে হেসে দেয়। আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাই।
কিছুক্ষণ পরে সে বলল,
” লেখাপড়া কতদূর এগোলো? না-কি সারাক্ষণ দুষ্টু বুদ্ধি নিয়ে থাকেন।”
” চলছে। শুধু একটু পিছিয়ে আছি।”
” একটু পিছিয়ে থাকা কিন্তু চলবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তো!”
” কে বলল, আমি দাঁড়াতে পারি না? আমি তো খুব দৌড়াতেও পারি।”
” ফাজলামো শুরু করলেন আবার! আমি এ দাঁড়ানো, সে দাঁড়ানো কে বুঝাচ্ছি না। যোগ্যতা বুঝাচ্ছি।” হেসে বলল আদ্রিয়ান।

আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,
” এত যোগ্যতা দিয়ে কী হবে? সে-ই তো জামাইর গলায় ঝুলতে হবে।”
” নিজের একটা সাইট ঠিক করা উচিত। তারপরে অন্যসব।”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে ম্লান হাসলাম। কী দারুণ চিন্তাভাবনা তার। আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। বলে,
” নিশ্চয়ই মনে মনে রেগে আছেন? আর আমাকে বকে যাচ্ছেন?”
” ছিহঃ এমন কেন করবো? ”
” আমার সাথে জোরপূর্বক আসলেন। তারপরে আবার জ্ঞানও দিচ্ছি। এরজন্যই হয়তো মনে হল।”
” এমন কেন মনে হয়?”
” মন যে স্বাধীন। যা ইচ্ছে তা-ই করে। তাকে কী বেঁধে রাখা যায়?”
” হু। ”
” কী হু? মন কি এলোমেলো হয়েছিল কখনও?”
” বোধহয়।” আনমনে বলে ফেললাম।
সে অবাক হয় না৷ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
” সে লগন চাঁদ কে? যার জন্য এত দুষ্ট বুদ্ধিতে ঘেরা মনটা এলোমেলো হয়ে গেল!”
আমি হাসফাস করতে লাগলাম। কিন্তু তার ঠোঁটের কোণের হাসি প্রশস্ত হচ্ছে। খানিকটা সময় নিয়ে বলল,
” স্পেশাল কেউ! এজন্য লজ্জা পাচ্ছেন।” কথাটি বলে হোহো করে হাসলেন। আমিও হাসলাম। ভেতরকার মন সম্পর্কে কি বলা যায়! তার কথাগুলো শুনে যে আমার ভারাক্রান্ত মনে দুঃখ দুঃখ অনুভব হল। তার খবর হয়তো কখনও জানতেই পারবে না। আমায় চুপ থাকতে দেখে আদ্রিয়ান বলল,
” থাক বলতে হবে না। ”
” দুঃখ পেলেন না-কি?”
” কেন? কারণ আছে? ”
” হয়তো মনে হল।”
” এত অবুঝ মন?”
” কিশোরী মন।”
” মনের এত প্রকারভেদ হলে সহজে কি মনের খবর পাওয়া যায়?”
” মনের খবর জেনে কী করবেন শুনি?”
” সব কি বলা যায়?”
” থাক বলতে হবে না।”
” এখন আপনি দুঃখ পেয়েছেন!”
আমি আদ্রিয়ানের কথা শুনে হেসে ফেলি। আদ্রিয়ান হেসে বলল,
” কষ্টের মধ্যে কীভাবে হাসতে হয়, মেয়েদের থেকে বোধহয় আর কেউ পারে না।”
” মাতৃত্ব আছে যে।”
” একজন ভালো বোন, প্রেমিকা, মেয়ে, স্ত্রী এবং সবশেষে মা। ইশ! একই অস্তিত্বে যে কতগুণ!”
” আপনার মত তো সবাই বুঝে না। সে-ই তো প্রয়োজন শেষ হলে ছুড়ে ফেলে দেয়।”
” সেজন্যই তো আমার আমিটাকে নিয়ে কষ্টে আছি।”
“সে-কী? এজন্য আপনার কষ্ট হল কেন?”
” না হওয়ার কারণ আছে? আমার আমিটা যে একজনকে খুব ভালোবাসে। সেই একজনের মনেও যদি এমন চিন্তাভাবনা থাকে? তখন সবকিছুই বৃথা মনে হবে না?”
কথাটি বলে আদ্রিয়ান ম্লান হেসে তাকায়।
আমি খানিকক্ষণ চুপ থাকি। তারপর বলি,
” এত দুঃখ পাবেন না তো!”
” কেন পাব না?”
” কার এমন সাহস আছে আপনার সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা নিয়ে থাকবে। পজেটিভ ছাড়া তো কখনওই নেগেটিভ হবে না।”
“সত্যি বলছেন? তাহলে দুঃখ পেলাম না।”
” জি, গ্যারান্টি দিচ্ছি। তবে ছেলেমানুষ হয়ে এত দুঃখ পেলে চলে?”
” কেন চলবে না? আমাদের কি মন নেই?”
” সে তো আছেই। নির্ভেজাল মনটাই যে তাদের থাকে। তবে সবার মন নয়।”
” তা অবশ্য ঠিক৷ সব মানুষ কখনওই সমান হয় না।”
” জি।”

আজকের দিনটা কেমন যেন সুন্দর লাগছে। সূর্যের কিরণ ঢলে পড়ছে চারিদিকে। শীতের দিন তো! এজন্য সূর্যের কিরণের প্রতি এত ভালোবাসা। ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত জনজীবন নিয়ে ঘিরে থাকে চারিপাশ। মধ্যকারে কিছু প্রেম, কিছু ভালোবাসা, কিছু আবেগ আর কিছু ব্যাকুলতা নিয়ে তৈরি হয় কিছু অধ্যায়। তখন মনে হয় এগুলো সাথে যদি কখনও দেখা না হত তখন বোধহয় বড়ো কোনো ভুল হয়ে যেত। এমন স্মৃতি নিয়েই তো কয়েক জীবন পাড় করা যায়। কেউ-বা সুখে, কেউ-বা দুঃখে।
তার সাথে আজ অনেকটা সময় পাড় করলাম। আর একটা কিছু আবিষ্কারও করলাম। যেকোনো কথা বলার সময়েই তার ওই গম্ভীর মুখে উপচে পরে কিছু হাসি। সূর্যের কিরণের মত তার জোত্যি। আমি মনে মনে বলি,” ইশ! সময়টা যদি থমকে থাকতো তবে এর হাসির কিরণে নিজেকে বারবার আবিষ্কার করতাম।”
তবে সময় তো আর স্থির থাকে না। সে তার নিজস্ব গতিতে প্রবাহমান।
বাসায় যখন ফেরলাম তখন রিক্সা অবধি সে ঠিক করে দিল। যতক্ষণ না রিক্সা তার চোখের আড়ালে হয়েছে ততক্ষণই তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর আমিও আঁড়চোখে বারবার উঁকিঝুঁকি দিয়েছিলাম। যদি সে দেখে ফেলে? তখন কী হবে? তবে কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে তা-ই হল। চোখাচোখি হয়ে গেল। তখন দুজনেই অপ্রতিভ হয়ে চোখ সরিয়ে ফেললাম। তারপরে তো রিক্সাটা দূরেই চলে গেল।

.

বাবা এসেছে। তার জন্য মাসুদ আংকেলের পরিবার যেহেতু বাংলাদেশে আছে তাই তারাও এসেছেন সাক্ষাৎকারের জন্য। আর এত এত মেহমান, আত্নীয়স্বজনের ভিড়ে আমার ক্ষুদ্র মনটা নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। আমি ব্যাকুল হয়ে ব্যালকনিতে এসে বসে আছি। চারিপাশে বাবার আনা চকলেটে ভিড়। তবে তার সাথে বন্ধুত্ব হল না আমার। আমি সেই কোনো এক কারণে দুঃখ পেয়ে বসে আছি। ইশ! এত দুঃখ বুঝি এই ক্ষুদ্র মন সইতে পারে!
আমার ভারাক্রান্ত মন দেখে বাকি সবারও মন খারাপ হল। তবে আমি কেন জানি মনের মেঘগুলো কাটাতে পারলাম না। কেউ একজনের জন্য। এখন বোধহয় সবকিছুর সমাপ্তি ঘটবে বলে। কেন সমাপ্তি হবে? সূচনা হলে কী দোষ? আমার মনের মেঘ কাটাতে বোধহয় কাউকে দরকার। তবে সে কীভাবে জানবে? আর কেনই-বা মনের মেঘগুলো কাটাবে? এর উত্তর মিললো না আমার কাছে। আমি শুধু বাহির দেখতে ব্যস্ত।
হয়তো খুব শীঘ্রই তার এই কিছু অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে। যতটুকু ছিল আমার কাছে ঠিক ততটুকুই। বিয়ের পীড়িতে বসে কি অন্যকারো কথা ভাবা যায়? কেনই-বা ভাববো? সে কি আদৌও কেউ হয়? আমি এর জবাবও খুঁজে পেলাম না।
আজ মনের মেঘগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পরেছে। যা হওয়ারই থাকবে না তাহলে সেগুলোই সামনে আসে কেন? কেনই-বা স্মৃতি গুলো মনের গভীরে স্থাপিত হয়? কোনো কিছুরই জবাব নেই আমার কাছে।
সেদিন তো উল্টাপাল্টা বলেছিলাম, যে দেখতে আসবে সরাসরি ছেলেকেই বলে দেব এই বিয়ে মানি না। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। কিন্তু পরিশেষে হল কী? সে নিজেই এই কথাগুলো শুনিয়ে দিল। তখন আমার খুব দুঃখ হয়েছিল। সরাসরি নাকচ করেছে বলে। আস্তে আস্তে সেই মুখকেই কল্পনায় আনতে হল। হয়তো যে অপছন্দ করে সে-ই কল্পনায় বসবাস করে। কী এমন অপূর্ণতা আছে যার জন্য এই অপছন্দ হওয়া, তা নিয়েই সে-ই কল্পনার শুরু হয়। তারপরে যদি বিপরীতের মানুষটির এত গুণ, এত সহমর্মিতা দেখি তাহলে ভালো না লেগে পারে? আমার বেলায়ও হয়তো তাই হল।

#চলবে

পরের পর্বে শেষ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here