একদিন_বৃষ্টিতে_বিকেলে পর্ব ৪

#কিছু_অধ্যায়(পর্ব_৪)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

রেস্টুরেন্টে গিয়ে আবারও থমকে যাই। মাসুদ আংকেল এখানে আছেন। রেস্টুরেন্টে পা ফেলা মাত্রই তার তীক্ষ্ণ চোখের নজর আমার দিকে পরলো। আজ নির্ঘাত কিছু হবে আমার। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি! সে নিশ্চয়ই ধমক দিবে, না হয় আব্বুকে বলে দিবে।
মাসুদ আংকেল আব্বুর প্রাণপ্রিয় বন্ধু। গলায় গলায় ভাব তাদের। সে সুবাদে এক জনের ছেলেমেয়ের কোনো ত্রুটি পেলে হয়তো শাসাবে , নয়তো চুপি চুপি বন্ধুর কানে ঢালবে। এরজন্য ভয় হল। আমি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারলাম না। সে আমার নাম ধরে ডাক দিল। তখন আর কী করা! সালাম বিনিময়ের পরে চুপচাপ দাঁড়ালাম।
সে ধীরভাবে বলল,
” এখানে কী করছো?”
” বান্ধবীদের সাথে আসছি।”
” আচ্ছা। কী খাবে?”
” কিছু না।”
” রেস্টুরেন্টে কিছু না খেতে আসে?”
” বার্থডে ট্রিটের জন্য।” নিম্নস্বরে বললাম। সে খানিক হাসে। বলে,
” আচ্ছা, যাও তবে।”
” সময় করে আমাদের বাসায় আসবেন কিন্তু।”
” জি, মা। সময় করে যাব।”

আমি কোনোভাবে সেখান থেকে আসলাম। বান্ধবীরা হাসছিল আমার অবস্থা দেখে। তবে আমার মতোই তাসবিহার মুখমণ্ডলও পরিবর্তন। তবে কারণ জানি না।

.

বাসায় ফেরার পরে ভয়ে ভয়ে থাকতে হল। এই বুঝি মা উত্তমমধ্যম শুরু করবে। মাসুদ আংকেল কি সত্যিই বলেছে কিছু? না-কি এসব ছোটোখাটো ব্যপার বলার কোনো দরকার হয় না। বললে বলবে আমার কী? আমিও আটঘাট বেঁধে নামবো। তার ছেলের সম্পর্কে দোষ বানিয়ে তাকে বলবো।
দুই প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মধ্যে এক বন্ধুর একমাত্র মেয়ের দোষ থাকলে, অন্য বন্ধুর একমাত্র ছেলের দোষ কেন থাকবে না? থাকতেই হবে। কিন্তু দোষ যোগাড় করব কীভাবে? তার ঝগড়ুটে ছেলের সাথে তো সেই কবেই শেষ দেখা হল। শুনেছি বিদেশেই আটঘাট বেঁধে নেমেছে। লেখাপড়া সেখানে, থাকে সেখানে। তার দেখা তো আর হবে না! তাহলে দোষের ভাগিদার বোধহয় আমার একারই হতে হবে। একটুখানি ঘুরেছিই তো! এত ভয় কেন পাচ্ছি।
আম্মুর কাছে গিয়ে ভাব করার চেষ্টা চালালাম। সে রান্নায় ব্যস্ত। আমি যাওয়া মাত্রই ইলিশ মাছের ভাজা ডিম মুখে দিয়ে দিল।
মিষ্টি হেসে বলল,” গোসল করে আসো আম্মু। সকালে কিছু খেয়ে যাওনি। এখন খেতে হবে।”

মায়ের আদুরে কথাটি পছন্দ হল না। এই তো কিছুক্ষণ আগে চিকেন বার্গার শেষ করলাম। আমার একটুখানি পেট। তাতে কী আর কিছু রাখা যায়? কিন্তু মা যখন বলেছে তখন আমাকে তার ইচ্ছেমতোই খাওয়াবে। একটু স্বাস্থ্য যে কেন হয় না! তাহলে যদি একটু হলেও শাস্তিটা কমে।
আমি নির্বিকার হয়ে গোসলে গেলাম। খাবারের কষ্ট মানা গেল। কিন্তু কোনো আলোচনা, সমালোচনা তো হয়নি! এটা কম কীসের!

বিকেলে টিভি দেখছিলাম। মা পাশে এসে বসলো। বলল,
” আংকেলের সাথে দেখা হয়েছিল?”
” জি। ফোন করেছে বুঝি?”
” হ্যাঁ, করেছিল। তা কোথায় গিয়েছিলে?”
” বান্ধবীর জন্মদিন ছিল তাই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। সেখানেই দেখা হল।”
” আচ্ছা।”

মা কিছু বলল না। বোধহয় তেমন দোষের কিছু হয়নি। আহ, বাঁচা গেল। আমি খুশি হয়ে কিছু বলতে যাব তখনই মা গাম্ভীর্য কণ্ঠে বললেন,
” এভাবে ঘুরাঘুরি করবে না। আর গেলেও বলে যাবে। মনে থাকবে?”
“হুঁহ।”

বিকেল পাড় হয়ে গেল। সন্ধ্যার পরে বই নিয়ে বসলাম৷ তখন মন কি আর সেখানে থাকে? বই ধরলেই তো সমস্ত চিন্তাভাবনা এসে মাথায় পাড়ি জমায়। আমার বেলায়ও তাই হল।
আমি আদ্রিয়ানের কথা ভাবতে লাগলাম। মানুষটা অনেক আলাদা। রাগ মিশ্রিত আছে কি-না আমি জানি না। তবে বেশ অমায়িক। এমন মানুষের প্রতি ভালোলাগা তো হতেই পারে। সে ঠিকই বলেছিল,” মানুষের মন বিচিত্র ধরণের। কখন কী হয়, বুঝা বড়ো দায়।”
সত্যই। এই বিচিত্র মনে যে কোনো সময়ে, যে কাউকে ভালো লাগতে পারে। শুধুমাত্র কোনো কারণ ছাড়াই। তখন যদি বিপরীতের মানুষটিকে আরও দারুণ ভাবে উপস্থাপন হতে দেখি তখন তো কথাই নেই!
অকারণেই হেসে ফেলি। সে তো বেশ আছে নিজ জায়গায়। খামোখা আমি এত ভাবছি কেন? কতবার নিজেকে ঠিক রাখতে চাইলাম তবুও হল না। বারবার ঘুরেফিরে ভাবনাটা একই হয়ে যায়।
আমি হতাশ হয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে মা আসে। বলে,
” তোর বাবা আসবে এই মাসের শেষের দিকেই।”
” সত্যি! তাহলে বেশ ভালো তো। কতগুলো দিন কেটে গেল বাবাকে দেখলাম না। সে কি আমাকে দেখলে চিনতে পারবে, মা?”
” কেন পারবে না?”
” সাত বছর কেটে গেল যে! এখন কী আমার ফেস মনে থাকবে?”
” আট-দশ বছর পরে যদি কেউ মনে রাখতে পারে, তাহলে তোর বাবা কেন পারবে না?”
” ও মা! কে রাখলো মনে? আমার জানামতে তো কেউ নেই।”
” সারাক্ষণ নিজের মতো থাকলে বাহিরের কথা মনে থাকে?”
” কেন থাকবে না! আমার এত ভুলো মন না-কি? ”
” কম কীসে?”
” একবার বলেই দেখো না। সব মুখস্থ বলে দেব।”
” তোর মাসুদ আংকেলের সাথে দেখা হল তো আজ। সে কীভাবে মনে রাখলো তোকে?”
” বাবার মত চেহারা আমার। না চেনার উপায় আছে! আর আমিও তো তার গোলগাল চেহারা দেখে চিনে ফেললাম। সে বেলায় কিছু না?”
” তাহলে নিজের চেহারার মত আরেকজন দেখে তোর বাবা কেন চিনতে পারবে না?”
” হয়েছে। বুঝিছি। সরাসরি না বুঝিয়ে ভেঙেচুরে বুঝিয়ে দিলে?”
” সরাসরি বোঝার মেয়ে তো তুই নয়। তাই একটু খাটুনি করতে হল।”

আমি হেসে ফেলি মায়ের কাণ্ডে। মা বলল,
” এবারে আর কোনো দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় রাখিস না। তোর বাবা আসলে কিন্তু মেয়ের বিয়ে দিয়েই যাবে।”
” আমাকে এত খারাপ মনে হয় কেন?”
” তুই যা মেয়েরে বাবা! যে কাউকে কথার ফাঁদে ফেলে কাৎ করে দিবি। আমি ‘মা’ হয়েই পারি না! ”

মায়ের কথাগুলো শুনে হেসে দেই। পরক্ষণেই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলি,
” বিয়ে দিলেই তোমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। এরজন্য এর তাড়া করছো?”

মা নিশ্চুপ হয়ে যায়। বলে,
” ধুর পাগলি! এমনটা কেন মনে হবে? সন্তানের উপরে দায়িত্ব তো সারাজীবনই থাকে। কিন্তু সবদিক তো ঠিক রাখতে হবে।”
” কোন দিক এলোমেলো আছে?”
” ভালো ছেলে কি হাত ছাড়া করা ঠিক?”
” ভাগ্যে যা থাকবে তা-ই তো হবে।”
” মাসুদ ভাইয়ের ছেলের কথা মনে আছে তোর?”
” কেন থাকবে না? তার মতোই গোলগাল, সার্ফেক্সেলের গুণে ধবধবে সাদা, সে না?”
” ফাজিল মেয়ে! এখনও এই কথাগুলো মনে আছে তোর?”
” কেন মনে থাকবে না? তার জন্য একটু টিভি দেখতে পারছি? সারাক্ষণ খেলা নিয়ে বসে থাকতো। একবার তো রিমোট নিয়ে ঝগড়া করে হাতে সবগুলো দাঁত বসিয়ে দিলাম। তবুও ওই সার্ফেক্সেলটা ভালো হল না। আচ্ছা বাদ দাও তো, এখন বলো সে আগেরমতোই মোটু আছে? তাহলে এই জীবনে আর মাসুদ আংকেলের ছেলেবউ দেখা হবে না।”

” কেন দেখা হবে না? তোকেই তো ছেলেবউ করে নিয়ে যাবে।”
” আমিই কেন? আমি বিয়ে করবো না। দরকার হলে চিরকুমারী থাকবো। তবুও তাকে না। কেমন ঝগড়ুটে ছেলে।”
” মারবো এক চড়! বড়ো হলেও কি সেরকমই থাকে! পরিবর্তন হয় তো।”
” একদমই না।”
” দেখেছিস কখনও?”
” আমি কীভাবে দেখবো?”
” তাহলে ছেলেটিকে নিয়ে খামোখা এত কথা বললি কেন! একটা রাজপুত্র সে।”
” মেয়ে বিয়ে দিবে তো! সেজন্য এমন মনে হল।”
” মনে তো হবেই।”
” যা ইচ্ছে করো। কেউ যে আমার কথা শোনার নয় তা তো জানিই।”
” তুই কথা শুনেছিস আমাদের?”
” আমার মতো ভদ্র আছে এ দুনিয়ায়? তাহলে কেন শুনবো না!”
” মাইর খাবি।”
” বাহ রে! বিয়ে দিবে আর এখনও মারতে চাইছো?”
” বই পড়। অযথা কথা না বলে।”
” আরেকটা কথা বলো তো!”
” কী কথা?”
” বড়ো হলে তোর মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে নেব। এমন বাংলা ছবির কথোপকথন গুলো মনে আছে? ”
” ফাজলামো শুরু করছিস আবারও?”
” আহঃ বলো না! বাবা বলেছিল? না-কি মাসুদ আংকেল বলেছিল?”
” কেউ কিছুই বলেনি।”
” তাহলে?”
” আমরা খেলার সাথীও তো ছিলাম না। আমার সাথে তো মিলতোই না। তাহলে এমন তো কিছু হওয়ারও নেই যে, বড়ো হলেও একসাথে থাকব।”

” মাথা খারাপ করিস না তো!”
” ধুর। তুমি তো ভালোই আছ, মাথা খারাপ কেন করতে যাব!”
” যাবি তুই?”
“যাচ্ছি, যাচ্ছি।”
বলে টিভির রুমে আসলাম। টিভি দেখায় মনোযোগ দিতে চাইলেও হল না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে কেন! মায়ের সাথে সবকিছু বন্ধুর মত বলে ফেলি রাগিয়েও দেই। বাবা আসলে তো এসব ওয়ারড্রবে রাখতে হবে। তেলাপোকায় যদি আমার উদ্ভট কথাবার্তা গুলোকে কেটে দেয়? তখন কী বলবো? আমার কথার ভাণ্ডার ফুরিয়ে এলো যে!
আর বিয়ের পীড়িতে যখন বসতেই হবে তখন তার সাথেই কেন হল না? মন পরিবর্তন হয়। সময় মত কেন হল না? তার মন একদিকে আছে আর আমার মন তার দিকে গেছে। এদিকে আরেকজনের সাথে কথাবার্তা চলছে।
মাথা যাবে, সাথে আমিও যাব। এসব ভাবতে ভাবতে।

.

ক্যাম্পাস থেকে বেড় হওয়ার পরে দেখা হল তার সাথে। আদ্রিয়ান খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখা মাত্রই কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বলল,
” এতক্ষণে আসার সময় হল? সে-ই কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম।”
” কেন করেছিলেন?”
” আজ ট্রিট নেওয়ার কথা না?”
” ওহ, আচ্ছা। ভুলে গিয়েছিলাম।”
” সকালেই তো আসার পথে কথা হল। এখনই ভুলে গেলেন?”
” ভুলো মন হলে আমার দোষ কী?”
” এত ভুলো মন হলে চলে?”
” হয়ে যাই।”
” মন খারাপ?”
” কই? নাতো!”
” তাহলে ভুলে যাচ্ছেন যে?”
” এমনিই।”
“আচ্ছা। রিক্সায় যেতে পারি?”
” অচেনা কারো সাথে যাওয়া বোধহয় ঠিক নয়। ক্ষমা করবেন।”
” আমায় অচেনা মনে হল?”
” তিন দিনের পরিচয়। এতটা চেনা কেন মনে হবে?”
” হলে দোষ কী?”
” অনেককিছুই।”
” তাহলে যাবেন না আজ?”
” নাহ।”
” আচ্ছা। ভালো থাকবেন। ডিস্টার্ব করলাম বোধহয়।”
” এই, না! সেরকম কিছু নয়।”
” হুঁহ।”

দুজনেই নীরব রইলাম। কেউ সরেও যাচ্ছে না। আর কথাও বলছে না। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোনদিকে যাই এখন? না পারলাম এখন থেকে নড়তে আর না পারলাম কথা রাখতে। খানিক বাদে বললাম,
” আচ্ছা, চলেন তবে।”
” সত্যি তো?”
” মিথ্যে কেন বলবো?”
” একটু আগেই তো কথা রাখলেন না।”
” স্নিগ্ধ মন! কখনওবা বড়োদের মত আচরণ আর কখনওবা কিশোরী মনের বিচরণ।”
” ইশ! এভাবে বললে তো প্রেমে পরে যাব। ”
” নিষেধ যে।”
” কে বললো?”
” কেউ একজন বলেছিল।”
” সবকিছু যে সত্যি হবে এমন কেন মনে হয়?”
” মুখের কথা ছিল। তাহলে মিথ্যে কেন মনে হবে?”
” কারো সাজানো কথাই তো কেউ উল্টো শোনাতে পারে।”
” যেমন?”
” জানি না। এই খালি, এদিকে আসেন।”
সে রিক্সা ডাক দিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কীসের সাজানো কথা ছিল? ভাবতে লাগলাম। তবে প্রয়োজনের সময়ে তো সবকিছু মনে পরে না! আমারও তাই হল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here