#একমুঠো_সুপ্ত_বসনা
#সুপ্তি_আনাম
|| পর্বঃ ০২ ||
🌺🌺🌺
ব্যালকোনিতে দ্রুতগতিতে পায়চারি করছে ইয়ানা। চুলগুলো এলোমেলো করা। মাথায় এখন রাজ্যের টেনশান ভর করেছে। হাতের মধ্যে থাকা স্মার্ট ফোন দিয়ে বারবার তার বয়ফ্রেন্ড নিলয়কে ফোন করছে। এই নিয়ে সতেরো বার হবে তাও ফোন রিসিভ করার কোনো নামগন্ধ নেই! একে একে তেইশ বার ফোন করার পর ইয়ানার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোন রিসিভ করে নিলয়। সাথে সাথে নিলয়ের কানে কারো বাজখাঁই কন্ঠ বাড়ি খায়!
—‘আমার চুটকি বাজিয়ে এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিস? আকাইম্মা বয়ফ্রেড কোথাকার। উঠ ঘুম থেকে উঠ’
ইয়ানার ঝাঁঝালো কথা কিছুই বুঝতে পারে না নিলয়। তাও সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
—‘কি__ কি হয়েছে?’
—‘কি হয়েছে জানিস না? তুই সেদিন আমায় একটা ধান্দাবাজ ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলি না? সেই ধান্দাবাজ লোকটার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে’
—‘হোয়াট দ্যা হেল? তুমি তো মাত্রই মাস্টার্স কম্পিলিট করলা, এতো জলদি বিয়ে? আর ওই ডাক্তার জানে না, যে আ’ম ইয়োর বিএফ?’ (নিলয়)
—‘চুপ থাক তুই, সব দোষ তোর। না তুই আমাকে ওই ধান্দাবাজটার কাছে নিয়ে যেতি আর না ও আমাদের বাসায় পাত্রপক্ষ সেজে আসতো।’ (ইয়ানা)
নিলয় থতমত খেয়ে বলে,
—‘আচ্ছা তুমি রাগ কেনো হচ্ছো? আমি দেখছি ব্যাপারটা’
—‘এখন জলদি পালানোর ব্যবস্থা কর, নাহলে অগত্যা ওই ধান্দাবাজটাকে বিয়ে করতে হবে’
কথাগুলো বলে ফোন টা বেডে ছুড়ে দেয় সে।
রাগে ক্রোধে ফেটে পড়ছে সে।
————————
—‘কি আপু? তোর মুড অফ কেনো রে? এতো ভালো ডাক্তার জামাই পাচ্ছিস, আর কি চাই? আমি হলে তো খুশিতে গড়াগড়ি খেতাম।’
তার বোন সুহানার কথা শুনে তার দিকে দৃষ্টি দেয় সে।
—‘ওই ধান্দাবাজটা আমার জামাই হতে পারে না কিছুতেই। আর ডাক্তার মাই ফুট।’
রাগে গজগজ করে বলে সে। ইয়ানার কথায় তার রুম থেকে চলে যেতে বাধ্য হয় সুহানা। রাগ লাগলে ইয়ানা সব সময় একা থাকতে পছন্দ করে। আজও তাই করছে।
—————————
বিকেল ঢেলে সন্ধ্যে নেমেছে। চারিদিকে অন্ধকার বিরাজমান। সাথে বাহিরে চারিদিকে বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ। ঠান্ডা আবহাওয়া এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। এতোক্ষণ ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে আনমনচিত্তে গান করছিল ইয়ানা। ব্যালকোনির রেলিঙের উপরদিক থেকে আসা বৃষ্টিকণাগুলো বারবার তার গায়ে এসে বাড়ি খাচ্ছে। সিক্তরূপে দুটো পাখির পানে চেয়ে আছে সে। পাখিগুলো খুব সুন্দর করে বৃষ্টিবিলাস করছে। কি চমৎকার সে দৃশ্য। বারবার পাখির আনন্দের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে ইয়ানার। এখন পাখিগুলোই হয়তো সবচেয়ে সুখী জীব!
কিছুক্ষণ পরেই তার ফোনের রিংটোনটা বেজে ওঠে। ফোনের কাছে ছুটে যায় সে। মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠেছে। যেয়ে ফোনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। আননোন নম্বর ফোন দিয়েছে। ফোনটা তুলে বলে,
—‘কে ভাই আপনি? ফোন দিয়ে অহেতুক ডিস্টার্ব করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আপনাদের?’
ওপাশ থেকে কাশির শব্দ পাওয়া যায়।
—‘ এখন আবার কথা না বলে, কাশির ভান করছেন? কি জন্য ফোন দিয়েছেন না বললে এক্ষুণি কেটে দিচ্ছি’
বলে ইয়ানা ফোন কেটে দিতে উদ্যত হলেই, ওপাশ থেকে একজন বলে,
—‘আরে তুৃমি কথা বলার সুযোগ দিলে তো বলবো? সে তখন থেকে একাই বলে যাচ্ছ…!’
কারো পুরুষালি কন্ঠ শুনতেই থমকে যায় সে। খানিক বাদেই বুঝতে পারে এটা ডা. আনাজ।
—‘ইউ বিচ, আমার নম্বর কিভাবে পেলেন? আর সাহস কি করে হয়, আমাকে ফোন দেওয়ার? ‘
রাগে চিল্লিয়ে বলে সে।
—‘মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ মিস. ইয়ানা। আ’ম ইয়োর ফিউচার হাসবেন্ড, গট ইট? আর নিজের ফিউচার হাসবেন্ডের সাথে এভাবে কথা বলবে?’
—‘ইউ আর নাথিং মোর দ্যান অ্যা ধান্দাবাজ। আর আপনার নম্বর এখনি ব্লক লিস্টে ফেলে দিচ্ছি’
ফোনটা কেটে দিয়ে সাথে সাথে আনাজের নম্বর ব্লক করে দেয় সে। এখন মুড বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে তার। প্রথমত তার বিয়ে নিয়ে টেনশান আর দ্বিতীয়ত আানাজকে দেখে টেনশান হচ্ছে।
ধান্দাবাজ লোকটা তার হাত ধুয়ে পেছনে পড়ে আছে,
#একমুঠো_সুপ্ত_বাসনা
#সুপ্তি_আনাম
|| পর্বঃ ০৩ ||
🌸🌸🌸
জৈষ্ঠ্যমাসের দিন। রৌদ্রস্নাত প্রকৃতি। সে সকাল থেকে সূর্য আপন তেজে তার শক্তির বাহার দেখাতে ব্যস্ত। ইয়ানার বাড়ি ‘সোহান ম্যানশন’এ আজ কিছু কর্মচারীদের যাবতীয় কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আগামীকাল ইয়ানার গায়ে হলুদ। সবাই মুখের এক চিলেতে হাসি ফুটিয়ে রেখে সানন্দে কর্মসম্পাদনে ব্যস্ত। ইয়ানার মা খুশিতে ছুটে বেড়াচ্ছে। অবশেষে তার মেয়ে তার জিবনে পূর্ণতা দিতে চলেছে। ইয়ানার বাবা মি. সোহান সবাইকে বলে দিয়েছেন, তার মেয়ের অনুষ্ঠান যেন জাঁকজমকপূর্ণভাবে হয়, কোনো ক্রমেই যেনো কমতি না থাকে। পুরো এলাকাবাসী যেন বলতে পারে ‘একটা বিয়ে খেয়েছে’। বড় মেয়ে বলে কথা!
.
.
ড্রেসিং টেবলের আয়নার সামনে দাড়িয়ে ম্লান মুখশ্রীতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে আছে ইয়ানা। তার দৃষ্টি অপলক। সে কিছুতেই চায় না ডা. আনাজ তাকে বিয়ে করুক। তার প্রতিবিম্বে হাত দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুর তুলে প্রশ্ন করে সে,
—‘তোর সাথেই কেনো এমন হলো ইয়ানা? কেনো নিয়তি এতটাই খারাপ হলো যে, তোকে আর তোর ভালোবাসাটাকে একত্রে দিতে পারছে না? কেনো? ‘
নিমিষেই তার নয়নজোড়া থেকে দু’ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। আজ তাকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে।
ঠুক ঠুক ঠুক ~ কারো গেটে কড়া নাড়ার আওয়াজ পেতেই অশ্রুসিক্ত নয়নজোড়া ওড়না দিয়ে। মুছে নেয় সে। কোনোভাবে ‘আসছি’ বলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকে সে।
আবার কড়া নাড়তেই দৌড়ে যেয়ে গেট খুলে দেয় সে। তার মা এসেছে, হাতে অনেক গুলো প্যাকেট।
—‘কি আম্মু? কিছু বলবে? ‘
—‘কি হয়েছে তোর? ঠিকঠাক আছিস তো?’
—‘হা_হ্যা আম্মু আমি ঠিক আছি। জাস্ট একটু হেডডেক হচ্ছিলো তো, তাই রেস্ট করছিলাম’
মুখে জোরপূর্বক একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে কথা গুলো বলে।
—‘ওহ, আচ্ছা ভেতরে চল, এই দেখ তোর বিয়ের জন্য’
ভেতরে যেয়ে বেডে বসে ইয়ানাকে দেখান তিনি। ইয়ানার এসব দেখে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও মুখ ভার করে বসে আছে সে। তার মনে এখন শুধু এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে, আনাজ তাকে চড় মারার শাস্তি হিসেবে বিয়ে কেনো করতে চাইছে? তাহলে বিয়ের পর তার কি অবস্থা হবে, ভেবে গায়ে শীতকাটা দিয়ে উঠছে তার। এদিকে তার মা হাস্যমুখে তার বিয়ের গয়নাগাটি, শাড়ি এসবে হাত বুলিয়ে দেখছেন।
টকটকে লাল রঙের শাড়ির পাড়ে হাত বুলিয়ে বলেন,
—‘দেখ মা, পাড়ে কি সুন্দর গর্জিয়াস কাজ করা।তোকে খুব মানাবে রে। আর এই দেখ তো এই জুয়েলারি গুলো কেমন? ‘
বলতে বলতে ইয়ানার দিকে তাকাতেই চুপ হয়ে যান তিনি। ইয়ানা অন্যপানে মুখ ভার করে বসে আছে।
তার মা অবাক সাগরে নিমজ্জিত হয়ে বলেন,
—‘কি এমন মুখ ফুলিয়ে কুমড়ো পটাশ হয়ে আছিস কেন? ‘
—‘ওওও আম্মু, তোমার কাছে একটা রিকোয়েস্ট আছে। তুমিতো আমার পেয়ারি মা, তাই না? আমার বিয়ে নিলয়ের সাথে দাও না মা প্লিজজজ?’
নিলয়ের কথা শুনতেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন,
—‘তোর মতো ঘ্যাড়তাড়া আর দুটো নেই। ওই টিউশান করা জবলেস ছেলেটার সাথে আমি তোর বিয়ে হতে দেবো? নেভার-এভার। আর আমাকে খবরদার তেল মাখাতে আসবি না। এগুলো ঠিক করে রাখবি।’
বলে বেড থেকে উঠে রাগে গজগজ করতে করতে চলে যান তিনি। সারাদিনের আনন্দটা যেন নিমিষেই মাটি চাপা পড়ে গেলো।
—‘এট এ্যানি চান্স, ওই ধান্দাবাজটার সাথে যদি আমার বিয়ে হয় তাহলে কিন্তু আমার বিয়েতে মোটেও কাঁদব না বলে দিলাম।’
তার মায়ের যাওয়ার সময় চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে সে। তার কথার কর্ণপাত না করেই চলে যান তিনি।
ইয়ানার চিল্লানির শব্দ শুনে দৌড়ে ছুটে আসে তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট যমজ ভাই-বোন।
—‘সে কি আপু, আমি দিন-রাত গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে রূপচর্চা করছি, তোর জন্য নাচ শিখছি আর তুই বিয়ে আটকানোর চিন্তায় আছিস?
ইয়ানার ছোটবোন সুহানা বলে। সেই সাথে তার ভাইটাও সুর মিলিয়ে বলে,
—‘হ্যা সেটাই তো, আমি ভাবছি গেট ধরে যে টাকা পাব তা কাউকে না দিয়ে আইফোন কিনবো…
তার কথায় আপত্তি জানায় সুহানা,
—‘হোয়াট রাবিশ? তুই সব টাকা একাই খরচ করে ফেলবি, আর আমরা বোলতিহীন দর্শক হয়ে থাকবো না? বাবাজির শখ দেখেছি স আপু?
এক পর্যায়ে তাদের তর্ক ঝগড়ায় রূপ নেয়। এদিকে বাকরুদ্ধভাবে তাকিয়ে আছে ইয়ানা।সে মনে মনে ভাবছে, সে এতোটাই আনলাকি যে তার সিবলিংস কত বুদ্ধিহীন!
ইয়ানা আর চুপ থাকতে না পেরে তাদের প্রচন্ড ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়, রাম ধমক যাকে বলে।
—‘তোরা বুদ্ধিহীনতার চরম পর্যায়ে পৌছে গেছিস। তোরা নোবেল ডিজার্ভ করিস’
ইয়ানার অস্বাভাবিক চিল্লানিতে দুজনেই জমে পাথর হয়ে যায়। আসলে তখন তাদের নিজেদের খেয়ালই ছিলো না যে তারা কি করছে।
দুজনেই ধমকানি খেয়ে থমকে যায়। ইয়ানার আদেশে তাকে একা করে দিয়ে রুম থেকে চলে যায়।
ইয়ানা তার শাড়ি- জুয়েলারি -মেকআপবাক্স এসবের দিকে পরখ করে নিলো। তার ফোনটা ভাইব্রেশান ছিলো বিধায় ভো ভো করে শব্দ হয়ে বেজে উঠলেই, ফোন হাতে নেয় সে। নিলয় ফোন করেছে। হার্টবিট ফাস্ট হয়ে যায় তার। না-জানি নিলয় কি নিউজ দিবে।
—‘হ্যালো’ বলতেই অপরপাশ থেকে নিলয়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর পাওয়া যায়। যার ফলস্বরূপ থমকে উঠে সে….
চলবে,
চলবে,
(