একমুঠো_সোনালি_রোদ পর্ব ৪

গল্প : #একমুঠো_সোনালি_রোদ (পর্ব : চার)

গালে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে সুমেহরার ঘুম ভেঙে গেল। না না, গালে নয়। গলায় আর কপালে। সে দ্রুত উঠে বসল। সামির তার সামনে দাঁড়িয়ে। সুমেহরা হুট করে জেগে উঠবে তা বোধহয় সে ভাবেনি। সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

‘তোমার গায়ে তো ভীষণ জ্বর। জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছিলে। জ্বরের ব্যাপারটা আমাকে একবার জানালে না কেন?’ সামির বলল।

জানাবে কি, সে তো নিজেই জানত না তার গায়ে জ্বর। সামির চার বছর পর আসছে। সেকথা ভাবতে ভাবতে জ্বরের কথা মনেই হয়নি। কিন্তু এখন ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে। অস্বস্তি লাগছে। সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘ওষুধ লাগবে না। অল্প একটু জ্বর। সকাল হতে হতে সেরে যাবে।’

‘অল্প একটু! গা পুড়ে যাচ্ছে। তুমি নিজেই একবার কপালে হাত দাও।’

সুমেহরা বিস্মিত হয়ে কপালে হাত দিলো। জ্বর অনেকটাই। তবুও সে বলল, ‘সামান্য জ্বর। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না।’

‘কী বলো সামান্য! জ্বর কখনো সামান্য হয়? তুমি শুয়ে পড়ো। আমি জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি।’

সুমেহরা স্তব্ধ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। কী বলে সে! জলপট্টি দিয়ে দেবে! মানুষটা এত যত্নশীল! স্বপ্ন দেখছে না তো! স্বপ্নে তো গা ছোঁয়া যায় না। সে ছুঁতে পেরেছে। তার মানে স্বপ্ন নয়। কিন্তু…

কিছু বলার আগে সামির সত্যি সত্যি জলপট্টি নিয়ে হাজির হলো। বলল, ‘এখনও বসে আছো কেন! শুয়ে পড়ো। আমি জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছি।’

রাতের তিনটা। এই সময় মানুষটা জেগে জেগে জলপট্টি দিয়ে দেবে! তাই কি হয়? না করতে গিয়েও পারল না। বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ শুয়ে পড়ল। সামির তার কপালে জলপট্টি দিতে দিতে বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো! চোখ বন্ধ করো। ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করো।’

সুমেহরা চোখ বন্ধ করতেই গাল বেয়ে জলের শ্রোত বয়ে এল। এ-অশ্রুজল কীসের? বিষাদের না কি আনন্দের? এতদিন পর একদিনে এত সুখ! তার কপালে এত সুখ সইবে?

সুমেহরার চোখে জল দেখে সামির তাকে সান্তনা দিলো। বলল, কিচ্ছু হবে না। সকাল হবার আগেই জ্বর কমে যাবে। সুমেহরা বলল তার মায়ের কথা। মা’কে খুব মনে পড়ছে তাই চোখে জল। কিন্তু সামির জানে না এই অশ্রুজলের আসল রহস্য।

একসময় সামির ধীর গলায় ডাকল, ‘সুমেহরা, ঘুমিয়ে পড়েছো কি?’

ঘুমায়নি। ঘুমের ভান করে চুপ করে থেকেছে। সামির উঠে দাঁড়িয়ে পাতলা কম্বল দিয়ে সুমেহরার গা ঢেকে দিলো। সুমেহরা ভাবল, এবার বুঝি মানুষটা ঘুমাবে। কিন্তু না। সে ঘুমাল না। বসে রইল তার মাথার কাছে। জলপট্টি দিলো সারা রাত। একসময় সুমেহরা গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল। তখনও সামির তার মাথার কাছে বসে আছে। ঘুমঘুম চোখে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে।

যখন ঘুম ভাঙল, চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে। ঘড়িতে নয়টা বেজে একুশ মিনিট। সামির তখনও পাশে বসে আছে। সুমেহরাকে জেগে উঠতে দেখে বলল, ‘গুড মর্নিং! এখন কেমন লাগছে?’

সুমেহরা উঠে বসে বলল, ‘ভালো।’

‘ভালো? দেখি, দেখি।’ বলে সুমেহরার কপালে রাত রাখল। বিস্মিত গলায় বলল, ‘বাঃ, অনেকটাই সেরে গেছে দেখছি! এই নাও কফি।’ বলে কফির মগ এগিয়ে দিলো। সুমেহরা মগ হাতে নিয়ে দেখল, তাতে কফি নেই। চা।

‘আশ্চর্য হলে তো? জানতাম তোমার কফি পছন্দ না। তাই কফির মগে চা বানিয়ে রেখেছি।’

সুমেহরা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই সামির আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘চা ভালো হয়নি তো? জানি। এই খারাপ চা-ই গত চারটা বছর খেতে হয়েছে। বিদেশের মাটিতে নিজের চা নিজে বানিয়ে খেতে হয়। সেখানে তো তোমার মতো একটি বউ নেই। যে চা বানিয়ে দেবে। হা হা!’

সুমেহরা লাজুক ভঙ্গিতে হাসল, ‘চা ভালো হয়েছে।’

‘তাই! থ্যাংক য়্যু!’

সামির অনেকগুলো ওষুধ সুমেহরার হাতে ধরিয়ে দিলো।সকাল সকাল এতগুলো ওষুধ কোথা থেকে নিয়ে এল সে! সুমেহরা ড্যাবড্যাব করে তাকাল। সামির গম্ভীর ভাবে বলল, ‘এভাবে তাকালে চলবে না। টেবিলে খাবার রাখা আছে। নাস্তা শেষ করে ওষুধ খাবে। আমি একটু বেরোচ্ছি। বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করে আসি। তুমি কিন্তু মনে করে খেয়ে নিও।’

তারপর যে বেরিয়ে গেল সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো তার খবর নেই। সুমেহরা সেজেগুজে তৈরি হয়ে থাকল। যাতে সামির এসে তাকে এই অবস্থায় দেখে চমকে যায়। কিন্তু সামির এল না। বিকেল চারটা নাগাদ ডোরবেল বাজল। সুমেহরা ভাবল এই বুঝি সামির এসেছে। কিন্তু সামির আসেনি। এসেছে ওপাশের ভবনের দ্বিতীয় তলার সেই মেয়েটি। সে সুমেহরার থেকে বয়সে কমসেকম পাঁচ-ছয় বছরের বড়ো হবে। সুমেহরা ভেবেছিল মেয়েটা অভদ্র টাইপের হবে। কিন্তু তার ব্যবহার দেখে সে সত্যিই অবাক হলো। এতটাই অবাক হলো, অপরিচিত অবস্থায় ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বসল। মেয়েটাও তার কথায় চলে এল।

শ্বাশুরি মা ভিতরের ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বললেন, ‘কে এসেছে গো?’

সুমেহরা বলতে যাচ্ছিল মেয়েটার কথা। কিন্তু মেয়েটা একরকম নিষেধ করল না বলার জন্য। শেষমেশ সুমেহরা বলল, ‘কেউ না, মা।’

তারপর মেয়েটাকে শোবার ঘরে নিয়ে বসাল। মেয়েটার আচার-আচরণ যেমন সুন্দর, সে দেখতেও তেমন সুন্দর। একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। সুমেহরা আমতা আমতা করছিল। মেয়েটাই আগ বাড়িয়ে বলল, ‘কেমন চলছে আপনাদের?’

‘ভালো।’

‘ভালো!’ মেয়েটা চমকে উঠল। যেন তাদের ভালো থাকাটা অসম্ভব। বলল, ‘আপনার হাজবেন্ডের কী অবস্থা?’

‘ভালো।’

‘গতরাত আপনাদেরকে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কী যে ভালো লাগছিল! একদম পারফেক্ট জুটি। হিংসেও হচ্ছিল।’

হিংসে! হিংসে হবে কেন! সুমেহরা কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার বর বুঝি গোমড়মুখো?’

মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমার বর নেই। আ’ম ডিভোর্সড্। বাট হ্যাপি।’ বলে মৃদু হাসল। হাসি দেখে মনে হলো মেয়েটি সুখে নেই। কষ্টে আছে। তার চার দেয়ালে লেগে আছে বিষাদ বেদনার ছাপ।

সুমেহরা বলল, ‘ওঃ! আপনি কিন্তু দেখতে অনেক সুন্দর।’

মেয়েটি ধরা গলায় বলল, ‘কী হবে এই সৌন্দর্য দিয়ে? এরচে’ আমার সবটুকু সৌন্দর্য আমি আপনাকে দিয়ে দেই…’

‘এমা, সৌন্দর্য আবার দিয়ে দেওয়া যায় নাকি!’

‘যায় না বুঝি? আজ আসি। ভালো থাকবেন।’ বলে প্রস্থান করল মেয়েটা। যেতে যেতে কয়েকবার ফিরে ফিরে তাকাল। মেয়েটির চোখ ছলছল করছে। চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু সুমেহরা স্পষ্ট দেখতে পেল।

সে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সামির এল। ঘরে প্রবেশ করার আগেই বলল, ‘মুনতাহা কেন এসেছিল?’

সুমেহরা অবাক হয়ে বলল, ‘মুনতাহা কে?’

‘একটু আগে যে বেড়িয়ে গেল।’

‘এমনি এসেছিল। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করল।’

‘আর কখনো এলে তাড়িয়ে দিও।’

‘কেন, তাড়িয়ে দেব কেন?’

‘এত কেন কেন করো কেন? যা বলেছি তাই করবে।’ বলে দ্রুত ঘরে চলে গেল। এদিকে সুমেহরা সাজুগুজু করেছে তা একবার চেয়েও দেখেনি। একবার তার দিকে ফিরেও তাকায়নি।

রাতের এগারোটা। সুমেহরা খাবার টেবিলে চুপ করে বসে আছে। মা অসুস্থ শরীর নিয়ে টেবিল পর্যন্ত আসতে কষ্ট হয়। তাই প্রতিদিন শোবার ঘরেই খাবার দেওয়া হয়। আজকেও তাই করেছে। মা’র ঘরে খাবার দিয়ে এসেছে সেই দশটায়। মা বলেছেন, ‘সামির খেয়েছে?’

‘খায়নি। খাবে।’ বলে সুমেহরা চলে এসেছে। সেই থেকে এক ঘন্টা যাবৎ টেবিলে বসে আছে। সামিরের খবর নেই। ঘড়ির কাটা যখন জানান দিলো সাড়ে এগারোটা। তখন সে উঠে দাঁড়াল। শোবার ঘরে গিয়ে দেখল, সামির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সুমেহরা দূর থেকে বলল, ‘রাত অনেক হয়েছে খেতে আসুন।’

এক মিনিট কাটল। দু’মিনিট। তারপর তিন মিনিট। সামির জবাব দিলো না। আসক্তিহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। সুমেহরা ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ নিচু গলায় বলল, ‘আসুন খাবেন।’

‘খিদে নেই।’

‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন? রেগে থাকলে আমাকে শাস্তি দিন। না খেয়ে থেকে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন কেন?’ বলে সামিরের হাত ধরল।

‘বললাম তো খিদে নেই।’ বলে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিতেই সুমেহরা ছিটকে পড়ল। দেয়ালে লেগে কনুইয়ের কিছুটা অংশ কেটে গেল। সুমেহরা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। সামির এর আগে কখনো এত খারাপ আচরণ করেনি তার সাথে।

‘এ্যাই মেয়ে, কান্নাকাটি করছো কেন? যাও। যাও এখান থেকে।’

সুমেহরা চলে এল। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এল। তার হাত-পা কাঁপছে। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। পৃথিবীর সবচে’ দূর্বল মানুষ বুঝি সে? পৃথিবীর সবচে’ অসহায় মানুষ বুঝি সে?

ছাদে রেলিং নেই। সুমেহরা একদম শেষ অংশে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। এখান থেকে পড়লে মরবে না নিশ্চয়ই? কিন্তু দেয়ালের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোহার রড যদি সুমেহরার বুক বরাবর ঢুকে যায়, তখন? তখন কি সে মরে যাবে? সে মরলে সামির কাঁদবে তো? ভাববে তো একটুখানি?

(চলবে)
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here