একমুঠো_সোনালি_রোদ পর্ব ৫

গল্প : #একমুঠো_সোনালি_রোদ (পর্ব : পাঁচ)

অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পা অবশের মতো হয়ে এল। এবার একটু বিশ্রাম দরকার। সামির শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াল। ভেবেছিল লাইটারটা বালিশের কাছে রেখে দুম করে শুয়ে পড়বে। কিন্তু শোবার ঘরে এসে কেন জানি তার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। কী যেন একটা নেই। কিন্তু কী নেই?

এই যা! সুমেহরাই তো নেই? সে কোথায়?
ঘড়িতে একটা বেজে উনত্রিশ মিনিট। এত রাতে…

পরক্ষণেই মনে হলো, সে সুমেহরাকে চলে যেতে বলেছিল। সত্যি সত্যি চলে যায়নি তো! দ্রুত ওয়াশরুমে চোখ রাখল। এঘর-ওঘর দেখল। মা’র ঘরে একবার উঁকি দিলো। কোথাও নেই। সামির একবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে লম্বা নিশ্বাস নিল। তারপর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

উপরে উঠেই সে যেন প্রাণ ফিরে পেল। মুচকি হেসে প্রশান্তির নিশ্বাস নিল। কিন্তু এই প্রশান্তি অশান্তিতে পরিণত হলো, যখন খেয়াল করল সুমেহরা ছাদের একদম শেষ অংশে দাঁড়িয়ে আছে। একটু এদিক সেদিক হলেই নিচে পড়ে যাবে। সামির চুপ করে দাঁড়িয়ে একবার ভেবে নিল। তারপর আস্তে করে বলল, ‘সুমেহরা!’

সুমেহরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। সামিরের গলা শুনে চট করে ফিরে তাকাল। কথার জবাব না দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকল। তখনও ছাদের একদম শেষ অংশে। একটু এদিক সেদিক হলেই শেষ!

সামির ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল। এক পা। দু’ পা। একসময় সুমেহরার খুব কাছাকাছি গিয়ে আলতো করে তার কাঁধে দু’হাত রেখে কিছুটা পেছনে টেনে আনল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী করছিলে?’

সুমেহরা ধীর গলায় বলল, ‘কিছু না।’

‘মন খারাপ?’

‘উঁহু।’

‘তাহলে এত রাতে একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তা-ও আবার একদম শেষ অংশে! অতদূর গিয়ে দাঁড়াবার সাহস কী করে হলো তোমার? একটুর জন্যেই তো ছিঁটকে পড়তে।’

‘পড়ে গেলে আপনি খুশি হতেন?’ সুমেহরা ঠোঁট উল্টে বলল।

‘খুশি হতাম? হাত-পা ভাঙার পর আমাকেই তো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হত। ওষুধ পত্র সব আমার টাকায়। আদর যত্নও আমাকেই করতে হত। সব কষ্ট আমার। আর তুমি বলছো খুশি হতাম?’

‘আপনি ভেবেছেন হাত-পা ভেঙে পঙ্গু অবস্থায় আপনার কাঁধের বোঝা বেঁচে থাকতাম? না না। কখনোই না। এখান থেকে পড়ে সোজা পরকালে চলে যেতাম। আমি মরে গেলে আপনি খুশি হতেন, তাই না?’

‘ধুর! মানুষ মরলে কেউ খুশি হয় নাকি!’

‘আপনি চাইলে বলুন, এক্ষুণি এখান থেকে লাফ দেই। একবার শুধু বলে দেখুন।’

‘বুঝেছি, রাতে খাওয়া হয়নি তো, তাই এমন আবুল তাবুল বকছো। চলে খাবে।’ বলে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। সুমেহরার সম্মতি নেবার প্রয়োজনবোধও করল না। খপ করে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। টেবিলে বসিয়ে হাত ধুতে চলে গেল। ফিরে এসে প্লেটে খাবার নিল। সুমেহরা একটু অবাক হলো। তাকে খাওয়াতে এনে একা একা খেতে বসে গেল!

কিন্তু সামির যখন হাত বাড়িয়ে বলল, ‘হাঁ করো।’ সুমেহরা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে খাইয়ে দেবে!

‘কী হলো, হাঁ করো!’

সুমেহরা হাঁ করল। সামির খাইয়ে দিতে লাগল। সে খাবে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। সেওতো না খাওয়া। কিন্তু সুমেহরা কিছু বলল না। চুপচাপ খেল শুধু। হাত ধুয়ে দ্রুত ফিরে এসে অবাক হয়ে সামির বলল, ‘এ্যাই, বাইরে তো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে!’

‘আচ্ছা।’

‘কী আচ্ছা! চলো আমার সাথে।’

‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার! ছাদে। জলদি এসো।’ বলে দ্রুত পা চালাল। সুমেহরা ধীর পায়ে তাকে অনুসরণ করল৷

ছাদে দাঁড়াতেই সামির বলল, ‘কী হলো, যাও!’

‘কোথায় যাব?’

‘এই দ্যাখো! ভিজবে না? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বৃষ্টির পানি তোমাকে ছুঁতে পারবে?’

‘বৃষ্টিতে ভিজব?’ সুমেহরা ভ্রু কুঁচকাল। রসিকতা করছে না তো!

‘আরে বাবা হ্যাঁ। যাও।’ বলে ধাক্কা দিয়ে সুমেহরাকে খোলা আকাশের নিচে পাঠিয়ে দিলো। বৃষ্টির পানি টুপটুপ করে সারা গায়ে পড়ছে। চারপাশ নিঃস্তব্ধ। তীব্র বিস্মিত একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

সুমেহরা একবার আকাশের দিকে তাকাল। বৃষ্টিতে ভিজবার অপরাধে কত বকাই না খেতে হয়েছে। কতবার মা’কে লুকিয়ে ভিজে অসুস্থ হয়েছে তার হিসেব নেই। বিয়ের দু’দিন আগেও বৃষ্টিতে ভিজেছিল সে। ভেবেছিল, এই বুঝি শেষবার। এরপর স্বামীর ঘরের কেউ এমন পাগলামো মেনে নেবে না। কিন্তু এখন, এখন তো উল্টো হচ্ছে!

হঠাৎ সামির এসে সুমেহরার পাশে দাঁড়াল। একদম গা ঘেঁষে। সুমেহরা বলল, ‘একি! আপনিও চলে এসেছেন!’

‘কেন, হিংসে হচ্ছে?’

‘না না।’

‘তিনটি জিনিসে আমার দূর্বলতা আছে। এক. বৃষ্টির পানি। দুই. সিগারেট। আর তিন…’

‘তিন?’

সামির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘থাক, বাদ দাও।

সেদিনের পর সুমেহরার শরীর কেমন যেন ভারী হয়ে এল। মনে হতে লাগল, তার খুব বড়ো একটা অসুখ হয়েছে। কিন্তু সে পাত্তা দিলো না। হয়তো তার মনের ভুল। ক’দিন পরে এমনিই সেরে যাবে। এই ভেবে সে কাউকে কিছু বলল না। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর এক রাতে সুমেহরার গা কাঁপতে লাগল। জ্বর নেই তবুও কাঁপছে। ব্যাপারটা সামির সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল। ঘুমঘুম চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

সুমেহরা গুনগুন করে বলল, ‘আমি মনে হয় আর বাঁচব না। ধরুন আমাকে। শক্ত করে ধরুন।’

সামির শক্ত করে ধরল। একসময় সুমেহরা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কাঁপা শরীর স্থির হয়ে গেল। তবুও সামির ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে রাখল সারা রাত।

পরদিন সামির খুব করে বলল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু সুমেহরা কিছুতেই রাজি হলো না। রাতে স্বপ্ন দেখে এমন করেছিল বলে শেষমেশ ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা আটকানো গেল।

ক’দিন পরে ঘটল আরেক ঘটনা। সামির বসে বসে টিভি দেখছিল। সুমেহরা চা বানিয়ে নিয়ে এল। চায়ের কাপটা সামিরের হাত দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে দুম করে ফ্লোরে পড়ে গেল। না, অজ্ঞান হয়নি। তবে মাথাটা ঘুরছিল বেশ। সেদিন সামির দু’হাত বাড়িয়ে তাকে তুলে নিল। শোবার ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। পাশে বসে বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

সুমেহরা কোনোমতে চোখ খুলল। ধীর গলায় বলল, ‘কিছু হয়নি।’

‘কিছু একটা তো হয়েছে। বলো আমাকে!’

সুমেহরা ভেবে পেল না কী বলবে। একসময় সামির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘বলবে না তো? ঠিক আছে। না-ই বলো। মরলে মরো গিয়ে। আমার কী? আমি তো তোমার কিছু হই না, তাই না?’

‘আপনি আমার কেউ না?’ সুমেহরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল।

সামির দৃষ্টি সরিয়ে বলল, ‘তাইতো মনে হয়। কিছু হলে তো বলতে কী হয়েছে।’

‘কিছু হয়নি তো।’

‘তাহলে সেদিন রাতে ওমন করেছিলে কেন? আর আজ, আজ হঠাৎ ফ্লোরে পড়ে গেলে কেন? কিছু না হলে কেউ হঠাৎ ফ্লোরে পড়ে যায়?’

‘যায় না বুঝি?’

‘না, কখনোই না।’ বলে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে গেল।

মা লাঠিতে ভর করে ধীর পায়ে সুমেহরার ঘরে এলেন। তখন তার চোখ লেগে গেছে। কপালে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল। চমকে উঠে বলল, ‘মা, আপনি এখানে!’

‘আরে আরে উঠতে কে কইছে! শুইয়া থাকো।’ বলে মুচকি হাসলেন তিনি। তার হাসি দেখে সুমেহরা ঠিক আন্দাজ করে নিল, তিনি কী ভাবছেন। কিন্তু তা যে হবার নয়। এমন হওয়াটা যে একেবারেই অসম্ভব!

(চলবে)
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here