এক কুয়াশার সকাল পর্ব -০২

#এক_কুয়াশার_সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#২য়_পর্ব
সে পেছন পেছন আমাকে ডাকতে থাকে,
এই নিধি এই নিধি তুমি জানো,তোমাকে কাজল পড়লে মারাত্মক লাগে।

আর তুমি যদি এখন না দাঁড়াও।
তাহলে আমি কিন্তু তোমার সাথে তোমার বাসায় চলে আসবো।

আমি এ কথা শুনে আরো জোরে দৌড়।

সেদিনের মত বাসায় চলে আসি আমি।
আমি এই শীতে ঘেমে একাকার হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় ঢুকি বলে আম্মু তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?

আম্মুকে রাগী কন্ঠে বললাম,
তোমাকে বলেছিলাম আমি আজ যাবোনা আমি।
তুমি শুনলেনা।

_তো কি হয়েছে এখন?

আমি আম্মুকে সব খুলে বললাম।

আম্মু বল্লো সমস্যা নেই।এত ভয় পেতে হবেনা।এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা।
আমি দেখি কি করা যায়।

আমি ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম।

আমি সারাক্ষণ শুধু এই কথাই ভাবছি,
কে করতেছে এমন আমাদের সাথে।
আর কেনই বা করতেছে।
ছেলে টা কে,
আর কিভাবে জানলো এই সময়ে আমি প্রাইভেট পড়তে যাই।
আর সেই বা কেন দাঁড়িয়ে ছিলো আমার জন্য।

এর আগেও কয়েক টা ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে।যেই ঘটনা গুলো অনেক দিন পর্যন্ত আমাকে ভালো থাকতে দেয়নি।
আমি ভয়ে ঘুমাতে পারতাম না।
চিন্তায় ভুগতাম সব সময়।
মাঝে কিছু দিন ভালোই ছিলাম,
কিন্তু আবার নতুন অশান্তি শুরু।
একটা সময় মনে হলো,আমার গায়ের রঙ কালো হলেই বোধয় ভালো ছিলো।
অন্তত শান্তিতে বাঁচতে পারতাম।

ক্লাস ফাইভে থাকা কালীন সময় আমি প্রথম বারের মত কোন ছেলের কাছে প্রেমের প্রপোজাল পাই।আর তখন থেকেই শুরু প্রেমের প্রপোজাল পাওয়া।
যদিও তখন এই প্রেম ভালবাসা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিলোনা।
ছেলেটা প্রচন্ড রকম বিরক্ত করতো,যার কারণে আমি স্কুলই বন্ধ করে দিয়েছিলাম প্রায়।

ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়ে আমি।
বুঝলামই না কোন দিন,কিভাবে এই টুকু মেয়েকে কোন ছেলে ভালবাসতে পারে বা প্রপোজ করতে পারে।

এরপর আরো কয়েক জন উপরের ক্লাসে উঠার সাথে সাথে ঘুরঘুর করা শুরু করে।
কিন্তু তার মধ্যে কয়েক জন মাত্রা ছাড়া বিরক্ত করতো।
যার ফলে মানুষ ডেকে আম্মুকে তাদের বাসায় নালিশও পাঠাতে হয়েছে।

আমি ভাবতে লাগলাম,ওই ছেলে গুলোর মধ্য থেকেই কি কেউ এমন কাজ গুলো করছে?

কিন্তু কে হবে তাহলে?

নাকি এই ছেলে এমন করছে,
যে আজ দাঁড়িয়ে ছিলো।
কিন্তু এই ছেলেকে তো আমি চিনিনা।
আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়েনা।
চোখ দেখে যত টুকু বুঝলাম।

সারাদিন এসব ভাবনায়ই দিন কাটলো।

আম্মু ইতিমধ্যে আমাদের আশেপাশের কয়েকজনকে বলেছে আমাদের বাসায় খেয়াল রাখতে।
আর আমাদের বাসার ফোন নাম্বার টাও দিয়ে রেখেছে।
তাদের ফোন নাম্বারও নিয়ে রেখেছে।
যাতে কোন সমস্যা হলে তাদের ফোন দিতে পারে।
আর তারাও আমাদের নাম্বার দেখে চিনতে পারে,আর আমাদের সাহায্য করতে পারে।

আব্বুকেও আম্মু ফোন করে জানায় সব।যেহেতু আব্বু প্রবাসী।তাই
আব্বুও তার আশেপাশের বন্ধু বান্ধবদের ফোন করে জানায় যেন আমাদের একটু খেয়াল রাখেন তারা।
সবাই আশ্বাস দিলেন তারা খেয়াল রাখবেন আমাদের।

রাতে আজ আম্মুকে বললাম,তুমিও আমাদের সাথে ঘুমাও।

ভয় লাগছে আমার।

আম্মুও আজ আমার আর ছোটর সাথে ঘুমালো।

ঘুমিয়ে পড়েছি আমরা সবাই।
আর যেহেতু গ্রাম,গ্রামে সবাই খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে।

হঠাৎ রাত সাড়ে ১২ টা বা ১ টার দিকে কেউ আমাদের টিনের চালে ঢিল মারতে শুরু করে।

আর ভয়ে আমি চিৎকার দিয়ে উঠি।
আমি ছোট বেলা থেকেই অনেক ভীতু।
আমার ছোট বোনের চেয়েও সাহস কম আমার।
এমন কি এখনো আমি একটা মুরগীর বাচ্চা কিংবা জ্যান্ত মাছ নিজের হাতে ধরতে পারিনা।

আমি জানিনা আল্লাহ কেন আমাকে এত কম সাহস দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।

আমি ঘুম থেকে উঠেই কাঁদতে শুরু করি।
আম্মু বলে চুপ কর,আমি সবাইকে ফোন দিচ্ছি।
আম্মু ফোন দিতে দিতে কয়েক জন চলে আসে আমাদের বাসায় যদিও।
কিন্তু যে ঢিল ছুড়েছে কি আর বসে আছে নাকি।
সে ঠিকই চলে গেছে।

যারা এসেছিলেন তারা কয়েক টা বড় বড় ইটের খন্ড দেখতে পেলেন।
কোন অসভ্য এগুলোই ছুড়েছে এত ক্ষণ।

সবাই বললেন,এবার দরজা আটকে শুয়ে পড়ো তোমরা।
যে এই কাজ করেছে সে চলে গেছে।
চিন্তা করোনা।
কাল একটা ব্যবস্থা করা যাবে।

সেদিনের মত রাত টা কাটলো কোন রকম।

আব্বুকে সকাল হতেই ফোন দিয়ে জানানো হলো।
আমি কাঁদতে কাঁদতে আব্বুকে বললাম,
আব্বু আপনি চলে আসেন।
আপনার আর বিদেশে থাকা লাগবেনা।
আমার খুব ভয় লাগে।
আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন।

আব্বু আমাকে শান্ত করলেন।
বললেন,সে সব কিছু ওকে করে খুব দ্রুত চলে আসবেন।

আব্বু আবার আমাদের প্রতিবেশীদের ফোন দিয়ে বললেন,
তারা যেন কেউ আমাদের বাসায় রাতে পাহারা দেন।

দুই এক দিন পাহারা দিলেই ধরা পরে যাবে যে এমন করছে।

এতে তারাও মত পোষণ করেন।
দুজনকে ঠিক করা হলো আমাদের বাসায় পাহারা দেয়ার জন্য রাতে।
তারা দুজন বললেন,রাত ১২ টার সময় আমাদের বাসার রাস্তায় থাকবেন তারা।
তাহলেই বুঝতে পারবে কারা এই কাজ করে।
কারণ রাস্তা দিয়েই তো বাসায় প্রবেশ করবে সেই অসভ্য।

যেই কথা সেই কাজ।
তারা ঠিক রাত ১২ টায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো।
আমরাও সেদিন জেগে আছি।

রাত প্রায় দুটো।
আজ কোন সাড়া নেই কারো।

তাই পাহারারত দুজন বাইরে থেকে আম্মুকে ডেকে বললেন,
আমরা তাহলে চলে যাই কাকী।
কেউ তো আসলোনা।
আপনারা ঘুমিয়ে পড়েন।আর যেই আসুক রাতে,দরজা খুলতে বললে খুলবেন না।

আম্মু আচ্ছা বলে তাদের বিদায় জানালো।

রাত প্রায় তিন টা।
আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি।

হঠাৎ আমার পাশেই টিনের মধ্যে বারির আওয়াজ।
কে যেন লাঠি দিয়ে নয়তো হাত দিয়ে আমাদের ঘরের টিনের মধ্যে বারি দিচ্ছে।
আমি আবার চিৎকার দিয়ে উঠি।

এবার কাঁদতে কাঁদতে বলি,
দেখেন,যেই হোন আপনি।
দয়া করে এমন কইরেন না আর।
আপনি কি চান আমাদের বলেন।
এমন করে বিরক্ত করবেন না দোহায় লাগে।
আমি খুব ভয় পাই।

আম্মুও বলে,কে তুমি।
কি চাও।

এবার সে উত্তর দেয়,

_আপনার মেয়ে কে চাই।
দিবেন?

ভয়েজ টা এমন ভাবে চিকন করে বলেছে।
বোঝার সাধ্য নেই কে সে।

আম্মু বলে,

_মেয়েকে চাও মানে?

সে বলে,
আপনার বড় মেয়েকে বিয়ে করতে চাই বিয়ে দিবেন?
আর আপনার মেয়েকে বলেন,রাজি হতে।
তাহলে আর আমি এমন করবোনা।

আমি বললাম,আপনি কে আমি না জেনে কিভাবে রাজি হবো?
বলুন তাহলে কে আপনি?

সে একটা অসভ্যের মত হাসি দিয়ে বলে,
বললে তো সবাইকে জানিয়ে দিবা তুমি জান।

আম্মু বলে,না বাবা কাউকে কিছু বলবোনা।
তা ছাড়া ওকে তো এখন বিয়ে দিবোনা।
সামনে ওর পরীক্ষা।
আগে কলেজে উঠুক।কলেজ শেষ করুক।তারপর ওকে বিয়ে দিবো।

তুমি কাল আমার সাথে দেখা কইরো।আমি কথা দিলাম,কারো কাছে তোমার নাম বলবোনা।
আর বাবা রাত বিরাতে এমন কইরোনা।
বুঝোই তো মেয়েরা মেয়েরা থাকি আমরা।

ছেলেটা বলে,সত্যি ওরে বিয়ে দিবেন না এখন?

আম্মু বল্লো সত্যি বাবা।

তারপর ছেলেটা বলে,ঠিক আছে।
তাহলে আগে কলেজে উঠুক।
আমি আর বিরক্ত করবোনা।
যাই তাহলে আমি।
আর আপনার মেয়েরে বইলেন,ও যেন ঘোমটা দিয়ে বের হয়।
ওরে কোন পোলা যেন না দেখে।

আম্মু বলে আচ্ছা ঠিক আছে।

তারপর বেয়াদব টা চলে যায়।

কিন্তু কথা গুলো এমন ভাবে কন্ঠ চেকন করে বলে,কারোই বুঝার ক্ষমতা নেই যে কে এই ছেলে।

সে চলে যাবার পর আম্মুকে বললাম,তুমি এত বাবা বাবা করলা কেন এই বেয়াদব টাকে?

আম্মু বলে,আমি যদি ভালো ভাবে কথা না বলতাম তাহলে কি ও যেতো?
এখন তো বল্লো আর বিরক্ত করবেনা।

এখন ঘুমা।
সকালে কথা বলবোনে।

সকাল হলো,

আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
এই কয়দিনের মধ্যে কেউ তোকে বিরক্ত করেছে?
বা কিছু বলেছে?

আমি বললাম,নাতো।
তেমন কেউ তো কিছু…
তারপর মনে পড়ে আমার কুয়াশার সকাল টার কথা।

আম্মুকে বললাম,ওই যে বললাম কুয়াশার সকালে ছেলেটা দাঁড়িয়েছিলো মুখ ঢেকে।

আম্মু বল্লো,ছেলেটার কন্ঠ কি এই ছেলের মত?

আমি বললাম,আমি তো কন্ঠই বুঝিনি এই ছেলের।
আম্মু উত্তর দেয় আমিও তো বুঝলাম না।

তারপর আম্মু বলে এই কয়েক মাসে আর কেউ কিছু বলেছে মনে করে দেখ।

আমি মনে করতে হঠাৎ মনে হলো,
তিন চার মাস আগে আবির ভাইয়া আমাকে প্রোপোজ করেছিলো।

সে আমাদের প্রতিবেশী।
কিন্তু সে তো এমন করার মত ছেলে না।
সে খুব ভালো।
আর খুব ভালো সম্পর্ক আমাদের সাথে তার পরিবারের।

আম্মুকে বললাম,আম্মু আবির ভাইয়া প্রোপজ করেছিলো আমায়।
বলেছিলো প্রেম করবি আমার সাথে?
আমি না করেছিলাম।
আর বলেছিলাম,ধুর ভাইয়া।
আপনি আর আমি ভাই বোন তো।
আপনি এসব কি বলেন?

আম্মু বলে,নাহ ও এমন করবেনা কোন দিন।
আচ্ছা আবার একটু ভাবিস,কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস নাকি।

আর এই ছেলের কথায় তো বুঝা গেলো,এই ছেলে হয়তো তোকে কিছু বলেছে আর তুই রাজি হোস নি।
বল্লোনা,আপনার মেয়েকে রাজি হতে বলেন?

আচ্ছা ভাববোনে।
বাদ দাও এখন।
ভালো লাগছেনা কিছু আমার এখন।

আম্মু উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানাতে চলে যায়।

বুঝতেছিনা,আজ কি যাবো পড়তে।
যাবো নাকি স্কুলে।
কি করবো।

ভাবলাম,থাক যাই পড়তে।
প্রথম টা বাদ দেই।
২য় টা পড়তে যাই।
তত ক্ষণে অনেক টা বেলা হয়ে যাবে।

আমি রেডি হয়ে পড়তে যাচ্ছি,
হঠাৎ মাঝ পথে গিয়ে দেখি,

আবারো মাফলার পড়ে মুখ ঢেকে ওই ছেলে দাঁড়িয়ে আছি।

আমি তাকে দেখে দূর থেকে বললাম,
আপনি আজকেও দাঁড়িয়ে আছেন?
এই শীতের মধ্যে কেন দাঁড়িয়ে থাকেন?
নাম কি আপনার?

সে দূর থেকে জোরে উত্তর দিলো,
হুম দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য।
তোমাকে দেখতে।
আর আমার নাম,কল্লোল।
তুমি আমাকে চিনবেনা।
আমি তোমাকে প্রতিদিনই দেখি।তবে দূর থেকে।তুমিই আমাকে দেখোনা।তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগেনা।

আমি জোরে বললাম,আপনি যদি আজ না চলে যান।
আর যদি কাল থেকে আমার সামনে আসা বন্ধ না করেন।
তাহলে কিন্তু আমি আর পড়তে আসবোনা।

সে বলে,
না না না।
তুমি কিন্তু আসা বন্ধ করোনা।
আমিই আসবোনা তোমার সামনে।
দূর থেকে দেখবো ওকে?
তুমি কিন্তু পড়া বন্ধ করোনা।

আমি বললাম আচ্ছা।
তারপর কল্লোল সত্যি সত্যি চলে যায়।

আমি দেখতে পাই এলাকার এক আংকেল আসতেছে।
আমি তার সাথে সাথে স্যারের কাছে পড়তে চলে যাই।

স্যারের কাছে পৌছানোর পর দেখি,কয়েক জন মিলে জড় হয়ে কি যেন দেখছে।

আমি সামনে গিয়ে দেখি তিথী মোবাইল নিয়ে এসেছে।আর সবাইকে ওর পরিবারের ছবি দেখাচ্ছে।

আমি তাকাতেই দেখি ওদের পরিবারের সবার এক সাথে জয়েন একটা ফটো।
আর সেখানে তিথীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,এই ছেলেটা তোর কি হয়?
ও উত্তর দেয়,কেন?এটা আমার বড় ভাই দুর্জয়।তুই চিনিস নাকি আমার ভাইয়াকে?
আমি বললাম,সত্যি তোর ভাইয়া এই ছেলে?
ও বলে হুম।কেন কি হয়েছে?

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তিথীকে বললাম,
তোর ভাইয়ার গায়ে দেয়া টিশার্ট টা আমার ব্যাগের ভেতর সেদিন কিভাবে আসলো?আর এদিকে আমার সারা শরীর কাঁপছে।আমার মনে হচ্ছে আমি বোধয় এখনই সেন্সলেস হয়ে যাবো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here