এক কুয়াশার সকাল পর্ব -০৬

#এক_কুয়াশার_সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
আমি দু চোখ বন্ধ করে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে বললাম।
আমি দেখতে যাবো কণার ভাইকে।
চল আমার সাথে।

তারপর আমি আর আমার ফ্রেন্ড হেডমাস্টারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কণা আর কণার কাকীর সাথে কণার ভাইকে হসপিটালে দেখতে গেলাম।

হসপিটালে গিয়ে দেখি কল্লোল বেডে শোয়া।
তার অবস্থা খুবই খারাপ।
এই প্রথম আমি তার পুরো মুখ টা দেখলাম।
চেহারায় অসম্ভব মায়া ছেলেটার।
ডাক্তার এসে আমার সামনেই বলতে লাগলেন,আপনারা দ্রুত পেশেন্টকে শহরে নিয়ে যান।
শহরের হসপিটালে গিয়ে এডমিট করুন।
আমরা এখানে কিছু করতে পারবোনা।

কল্লোল আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সবাই কাঁদছে।
আমি না কাঁদছি,না কিছু ভেবে পাচ্ছি।
শুধু একটা প্রশ্নই কল্লোলকে করলাম।
_আমীর আংকেল?যে আপনার শার্টের কলার ধরেছিলো?

কল্লোল মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো হুম।

দ্রুত এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা হলো।

ধরাধরি করে কল্লোলকে এম্বুলেন্সে উঠাতে যাচ্ছে সবাই,আর সেই মুহূর্তে কল্লোল কিভাবে যেন আমার ক্রস বেলের উপরে থাকা এক্সট্রা ওড়নাটার এক কোণা ধরে ফেল্লো,

আমি তাকাতেই,
ও বল্লো,
_ভালবাসি।

তারপর আমার ওড়নাটা ওর হাত থেকে ছুটে গেলো।

ওকে এম্বুলেন্সে শুইয়ে দেয়া হলো।
ওর সাথে ওর কাকী,মা এবং কণা গেলো।

চলে গেলো এম্বুলেন্স।
আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

আমার বান্ধবী আমাকে বল্লো,চল এবার যাই।

আমি তখনো ঘোরের মধ্যে আছি।
কি থেকে কি হয়ে গেলো।

আমি স্কুলে না গিয়ে আর বাসায় চলে গেলাম।

তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাওয়ায় আম্মু জিজ্ঞেস করলো,

আজ এত তাড়াতাড়ি ছুটি?

আমি কোন কথা না বলে দৌড়ে আমার রুমে চলে গেলাম।

আম্মুও পিছু পিছু আমার কাছে আসলো।

_কি হয়েছে?বল আমাকে।
_আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,আম্মু কল্লোল।
ওই এক কুয়াশার সকালের ওই ছেলেটা।
ওর অবস্থা না খুবই খারাপ।
ওকে না আমীর খুব মেরেছে।

ও বাঁচবে তো আম্মু?
ওর কিছু হয়ে গেলে আমি তো নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারবোনা।

আম্মু আমাকে শান্তনা দিচ্ছে।
কিচ্ছু হবেনা ওর।
তুই চিন্তা করিস না।

আম্মুকে বললাম,আম্মু ফোন টা দাও তো।

_কেন কি করবি?
_আরে দাও না।

আমি ফোন টা নিয়ে সোজা আমার প্রাইভেট স্যারের কাছে ফোন দিলাম।

আমীরের বড় ভাইয়ের কাছে।

স্যার রিসিভ করতেই স্যারকে কাঁদতে কাঁদতে এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলতে লাগলাম।

স্যার আমাকে কান্না থামাতে বললেন,
আর বললেন,আজই আমি বাসায় আসতেছি।
যা করার আমি করবো।
আপাতত তুমি কাউকে কিছু বলোনা প্লিজ।

আমিতো জানি,যে কেউ ই নিজের ভাইয়ের সম্মান বাঁচাতে চাইবে।
আর তার ভাইয়ের সম্মান মানে তার নিজেরও সম্মান।

স্যারের সাথে কথা শেষ করে আব্বুকে কল দিলাম।
আব্বু লাইন কেটে দিয়ে নিজে কল ব্যাক করলেন।

আমি ডিরেক্ট আব্বুকে বললাম,তিন দিনের মধ্যে আপনি দেশে আসবেন।
কিভাবে আসবেন আমি জানিনা।
তবে আসবেনই।

আব্বু বললেন,কি হয়েছে মামণি?
তোমার আম্মুকে দাও।
আমি বললাম,আমি যা বলেছি তাই যেন হয়।

নইলে আমি এই বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো।
কারো সাথে যাবোনা।
একাই যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাবো।

ছোট মানুষ আমি।
আর এই বয়সের সময় টা বড্ড মারাত্মক সময়।
এই বয়সে কে কখন কি করে বসে বলা যায়না।জেদ টাও এই সময় বেশি থাকে।
তখন পরিবারের মান সম্মানের কথাও মাথায় থাকেনা।
এ সময় নিজের জেদ টাই সব থেকে বড় মনে হয়।
নিজেকেই সঠিক মনে হয়।

তাই আব্বুও বুঝে সব কিছু দ্রুত ওকে করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

রাতেই স্যার তার বাসায় আসলেন।
এসে আমীরকে ইচ্ছেমত পিটালেন।
এতে করে কিছু মানুষ জানাজানি হলো বড় ভাই ছোট ভাইকে মেরেছে।
কিন্তু কি কারণে মেরেছে তা আর কেউ সঠিক জানতে পারেনি।

বড় ভাই মেরেছে তাই আমীর আর ভাইয়ের উপর হাত তুলতে পারেনি।

পরের দিন সকালে স্যার আমাদের বাসায় আসলেন।
এসে বললেন আমরা যেন কোন রকম চিন্তা না করি।আর যা কিছু হয়েছে সব কিছুর জন্য সে নিজে মাফ চাইলেন তার ভাইয়ের তরফ থেকে।
এরপর যা করার সব কিছু যেন তার উপর ছেড়ে দেই এই কথাও বললেন তিনি।

আর জিজ্ঞেস করলেন,কল্লোলের কি অবস্থা এখন?

আমি উত্তর দিলাম জানিনা।
কোন ফোন নাম্বার বা কিছুই নেই জানার মত।

স্যার বললেন,আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি।

স্যার চলে গেলেন।

কিছু ক্ষণ পর এক প্রতিবেশী আমাদের বাসায় এসে আম্মুকে ডেকে বলতেছে,

নিধির মা শুনো।

_হুম বলেন ভাবী।
_শুনলাম নিধির জন্য নাকি মাস্টারের ভাই আমীর এক পোলারে মাইরা ফেলছে।

এত ক্ষণে এলাকা জুড়ে খবর হয়ে গেছে আমার জন্য আমীর এক ছেলেকে মেরে ফেলেছে।

আমার নিজের আপন কাকীরা ঢোল পিটাচ্ছে এলাকা জুড়ে আরো।
হাসাহাসি করছে।
চাচ্চুরা বিদেশ।

নিজের মানুষরাই যদি শত্রু হয়,সেখানে পরকে আর কি বলবো।

আমার এবং আমার পরিবারের ভেতর দিয়ে তখন কি যাচ্ছিলো তা শুধু আল্লাহ জানেন।

আমি মনে মনে শুধু দোয়া করছিলাম,আল্লাহ মানুষ যা বলে বলুক।

কিন্তু কল্লোলের কিছু যেন না হয়।
নইলে আজীবন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।

আম্মুও দোয়া করতেছে ছেলেটার যেন কিছু না হয় আল্লাহ।

এরপর স্যারকে আম্মু কল দেয়।
আর জিজ্ঞেস করে,

এলাকার সবাই বলাবলি করছে,তোমার ভাই যাকে মেরেছে ওই ছেলেটা নাকি মারা গেছে?
কথা কি সত্যি?

_না ভাবী,ছেলেটার গত কাল খুব খারাপ অবস্থা ছিলো।
তবে এখন নাকি একটু ভালো আছে।
আমি ওর বাসার লোকের কাছ থেকেই খবর নিয়েছি।চিন্তা করবেন না।
আর নিধিকেও চিন্তা করতে না করেন।

মানসিক অশান্তির মধ্যে দুই দিন চলে যায়।

আমার আব্বুও দেশে চলে আসেন।

কল্লোলের অবস্থার উন্নতি হয়।

এদিকে আব্বুর কাছে আবিরদের বাসার লোক জন আমার জন্য প্রস্তাব পাঠান।
আবির ডিরেক্ট বলেছে নিধিকে আমার কাছে বিয়ে না দিলে আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবো।
স্যারের ভাইয়ের জন্য স্যারও প্রস্তাব দেন।
আম্মুর আবির ভাইয়াকে অনেক পছন্দ।
কিন্তু আব্বু এত তাড়াতাড়ি আমাকে বিয়ে দিবেন না।

আর তাছাড়া একই এলাকায় আমীর আর আবির ভাইয়া দুজন।
আবার কল্লোল ও।
এদের এক জনের কাছে বিয়ে দিলে পরবর্তীতে বাকি দুজন যে আমার কোন ক্ষতি করবেনা এর নিশ্চয়তা কি।
এই বলে আব্বু সবাইকে না করে দিলেন।

আমি আম্মুকে বললাম,আমাকে খালামণির বাসায় পাঠিয়ে দাও কয়েক দিনের জন্য।
আমার এখানে একটুও ভালো লাগছেনা।

আব্বুকে বললাম,আপনি আমার জন্য আপনার অন্য যেই জায়গা আছে।
ওখানে বাসা করেন।

আমি এই এলাকায় আর থাকবোনা।
এখানে থাকলে আমি একদিন মারাই যাবো।

আব্বু আম্মুকে বললেন,তুমি কি চাও?

আম্মু বললেন,আমিও চাই তুমি অন্য জায়গায়ই আমাদের বাড়ী করে দাও।

ওদের যখন বিয়ে দিয়ে দিবো।তখন না হয় শেষ বয়সে ইচ্ছে হলে আবার এখানে আসবোনে।

আব্বু আমাকে বললেন,আমার সাথে কিছু দিন থাকবেনা মামণি?
কিছু দিন থাকো আব্বুর সাথে,তারপর যেও খালামণির বাসায়।
আব্বু আছেনা এখন,কোন সমস্যা হবেনা।

আমি আচ্ছা বললাম।
পরের দিন আব্বু ইট,রড সিমেন্টের দোকানে চলে গেলেন।
সব কিনেও ফেল্লেন।

শুরু করে দিলেন আমাদের নতুন বাসা তৈরী করা।

কল্লোল এখন পুরোপুরি সুস্থ।

এর মাঝে আমার টেস্ট এক্সাম শুরু হয়।
আব্বু আমাকে প্রতি এক্সামের দিন সাথে করে এক্সাম দিতে নিয়ে যান।আবার নিয়ে আসেন।

আব্বু যত দিন আছেন আমাদের সাথে,কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হইনি আমরা।

আমাদের নতুন বাসার
অল্প কিছু কাজ বাকি আছে।
আব্বু চলে যাবেন কিছু দিনের মধ্যে।

আব্বু বলেছেন,এ বাসার ফার্নিচার সব যেন এ বাসায়ই থাকে।নেয়ার কোন দরকার নেই।তাহলেই লোকজন জানবে কোথায় নতুন বাসা আমাদের।
আর আব্বু আরো বলেন আমরা যেন ওই বাসায় একদিন হুট করে চলে যাই।
আর ওই বাসার ঠিকানা যেন কাউকে না দেই।

আব্বু আবার চলে যান বিদেশ।
আর আমাদের বলে যান,বাসার সব কাজ কমপ্লিট হলেই যেন আমরা নতুন বাসায় উঠে যাই।

আমার ছোট মামা বাকি কাজ গুলো দেখবেন।

আমরা এখন অপেক্ষায় আছি নতুন বাসায় কবে উঠবো।
আর কবে মুক্তি পাবো এই এলাকা থেকে।

আব্বু চলে যাবার কয়েক দিন পর আমার এক বান্ধবী আমাদের বাসায় আসে।

আমাকে বলে,চল একটু হাঁটতে বের হই।
কত দিন হয় হাঁটতে বের হইনা।

আম্মু বল্লো,
যা ঘুরে আয় একটু।
ভালো লাগবে।

দুজন বের হলাম।
হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর যেতেই দেখি আবির ভাইয়া ব্রিজে দাঁড়ানো।

আবির ভাইয়াকে দেখে আমি আমার বান্ধবীকে বললাম,চল অন্য রাস্তায় যাই।

ও বল্লো,আরে চল আবির ভাইয়াই তো।
কিছু হবেনা।
সে ভালো আছে।

আমি না করা সত্ত্বেও ও আমাকে টেনে ব্রিজেই নিয়ে গেলো।
আমিও গেলাম।

ব্রিজ দিয়ে হাঁটছি,
হঠাৎ আবির ভাইয়া আমার বান্ধবীকে বলে থ্যাংক ইউ।

আমি অবাক হই।
ওকে কেন আবির ভাইয়া থ্যাংক ইউ বলে।
পরে বুঝতে পারি,আবির ভাইয়া ওকে পাঠিয়েছে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।

আমার এই বান্ধবীটা আমার এলাকার বান্ধবী।সেহেতু ওর সাথে আবির ভাইয়ারও ভালো সম্পর্ক।
যেহেতু আমরা একই এলাকার সবাই।

আমি চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি মাত্র,আর আবির ভাইয়া আমাকে বলে উঠেন,

কিছু দিনের মধ্যে আমি বাইরে চলে যাবো।
আর আমি চাই তোমাকে বিয়ে করে রেখে বাইরে যেতে।
এখন তোমার মতামত কি সেটা আমাকে জানাও।

কাকী আমাকে পছন্দ করেন এটা আমি জানি।
আর কাকার টা আমি দেখবো।

তুমি তোমার মতামত জানাও।

আমি ডিরেক্ট তাকে বলে দিলাম,

_আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা।
আর তাছাড়া এখন আমি বিয়েও করবোনা।
আমার বিয়ে করতে দেরি আছে।

আমি আব্বু আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করে তারপর যা করার করবো।
আপনি ভালো ভাবে বিদেশ যান।
এসে ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করেন দোয়া রইলো।

আমি কথা শেষ করতে না করতেই আবির ভাইয়া ব্রিজের রেলিং এর উপর দাঁড়িয়ে গেলো।

_এবার বল,
বিয়ে করবি আমায়?
নইলে আমি সত্যি সত্যি এখান থেকে লাফ দিবো নিধি।
তুই যখন ক্লাস ফাইভে পড়িস আমি সেই তখন থেকে তোকে মনে মনে ভালবাসি।
তোকে না পেলে আমার জীবন টাই এলোমেলো হয়ে যাবে।
আমার তিল তিল করে তোকে নিয়ে গড়া স্বপ্ন গুলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে।

প্লিজ আমাকে বিয়ে করে নে।
আমি তোকে দুনিয়ার সব সুখ এনে দিবো।
কথা দিলাম।

এদিকে আমার বান্ধবীও বলছে,
রাজি হয়ে যা নিধি।
আবির ভাইয়া অনেক ভালো।
আর ভাইয়া আপনি নামেন প্লিজ ওখান থেকে।

_আপনি কি নামবেন?
লোক জন দেখলে কি বলবে?

এর মধ্যে এক মুরুব্বি এসে হাজির।
_কি হইছে এইখানে?

_আপনার জানা লাগবে?
আপনি যান এখান থেকে।

আবির ভাইয়া পুরা উল্টা পালটা বিহেভ করছে।

আমি লোক টাকে বললাম,দাদাভাই আমাকে নিয়ে যান এখান থেকে।

_দেখ নিধি,তুই এক পা আর বাড়ালেই আমি এখান থেকে লাফ দিবো।
তুই আমায় বিয়ে করবি কি না?

_একবার তুই একবার তুমি।আপনার মাথার তার ছিঁড়ে গেছে ভাইয়া।
আপনি প্লিজ বাসায় যান।

দাদা ভাই টা আবির ভাইয়াকে নামতে বলছে।
পাগলামি করতে না করছে।

কিন্তু তার একই কথা,

_তুই আমাকে বিয়ে না করলে আমি এখান থেকে লাফ দিয়ে আমার ভালবাসার প্রমাণ দিয়ে যাবো।

আর খুব জেদ উঠে যায় আবির ভাইয়ার বাড়াবাড়িতে,
আমি চিল্লায় বলি,যা ইচ্ছা তাই করেন আপনি।
আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা।

এ কথা বলে আমি দাদাভাই এর হাত ধরে মাত্রই দু কদম বাড়াই।
আর আমার বান্ধবী আয়ায়া বলে চিৎকার দিয়ে উঠে,

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি আবির ভাইয়া রেলিং এ নেই।
সে সত্যি সত্যি ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেছে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here