এক জোড়া নুপুর পর্ব -০৬

#এক_জোড়া_নুপুর (৬)

বিগত কয়েক মাস যাবত নির্বা নিজেকে তৈরি করেছে। সবটা দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছে সে। ফলস্বরূপ টেস্ট পরীক্ষাটা ভীষণ ভালো হলো। এরপর আরো পড়াশোনা চালিয়ে গেল। পাশাপাশি মিউজিকটাও ধরে রাখল যতটা সম্ভব। সিদ্ধান্ত’র দেশে ফেরার কথা। সে বাবার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। এই সময়টায় নির্বা যাকে সব থেকে বেশি মনে করল সে হলো শাহান। ছেলেটার কালচে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে ওর কেবল হাসি পায়। না জানি কত দিন ধরে কত শত নিকটিনের স্পর্শে গোলাপি ঠোঁট জোড়া কালচে হয়েছে। সে জানে মানুষ দুঃখে সিগারেট খায়। কিন্তু শাহান কেন খায়? তার মনেও কি দুঃখ আছে? এইসব চিন্তা করেও বিশেষ লাভ হয়নি। খুঁজে পায় নি কোনো কারণ। হেরার রেজাল্ট তুলনামূলক খারাপ এসেছে। তাই সে পড়াশোনায় বেশ সিরিয়াস হলো। বাসায় তিনটে টিচার রাখা হয়েছে। স্কুলে এসেও মেয়েটা দম ফেলার সময় পায় না। ওর ব্যস্ততার জন্য নির্বা কিছু বলেও না। কিন্তু মনে মনে শাহানের জন্য ওর বুক পুড়ে। কষ্টে চৌচির হয়ে যায় ভেতরটা। এত অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল যে নির্বা প্রশ্ন করেই ফেলল।
“তোর ভাই কি সারা বছর শহরেই থাকেন?”

“সারা বছর না। তবে বেশিরভাগ সময়ই শহরেই থাকে।”

“ওহ। সেখানে পড়াশোনা করে?”

“হুম। সাথে রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে। আমি অতো খোঁজ নেই না।”

“কেন,তোর ভাই হয় না?”

বই থেকে মুখ তুলল হেরা। নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে নির্বা। সে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে সবাই তো তার ভাইয়ের খোঁজ রাখে।”

“হুম। বলেছিলাম না ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক অতোটা মসৃণ নয়। এক বাড়িতে থাকি। দু একটা কথা হয় এই তো।”

“ওও।”

“হুম। বাট আমায় ভালোবাসে।”

চমৎকার করে হাসল হেরা। নির্বা অন্যমনস্ক হলো। ছেলেটা শহরে এত কি করে? মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরলেও তো পারে। আর ফিরে যখন তখন তার সাথে দেখা করে না কেন? কি সব অযৌক্তিক কথাবার্তা! নির্বা বড়ো অসহায় বোধ করছে। তার সাথে মানুষটার কোনো সম্পর্ক কি আছে? এই যে মন কাঁদে এর কি কোনো মানে আছে? সে জানে না। নানান রঙে রাঙা এই অনুভূতির সঠিক নাম সত্যিই তার জানা নেই।

সিদ্ধান্ত ফিরে নির্বাকে দুটো কাজ দিল। কাজ দুটোর একটি ছিল ঢাকায়। একটা পোগ্রামে গান গাইতে হবে। তাও সিঙ্গার হিসেবে। নবীন সিঙ্গারদের নিয়েই এই পোগ্রামটা। নির্বার কি যে ভালো লাগল। সিদ্ধান্ত তার জীবনে অনেকটা মেঘ না চাইতেই জলের মতো। সে তো কখনো গায়িকা হওয়ার স্বপ্নই দেখে নি। অথচ মানুষটা তাকে নিজ হাতে স্বপ্ন দেখাল। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় নির্বার চোখ মুখ খুশিতে মেতে উঠল। এত সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচয় করানোর জন্যে সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই একটা ধন্যবাদ পায়। সে খুব কম কথা বলে থাকে। দরকার ছাড়া কোনো প্রশ্নই করে না। সিদ্ধান্ত ও এতে কিছু মনে করে নি। বরাবরের মতোই কাজ প্রেমি সে কাজে ধ্যান দিয়েছে। আজ নির্বা যখন সুযোগ পেল তখন সিদ্ধান্ত ফোনে মগ্ন। অনেকটা ভয় নিয়েই সে বলল, “একটা কথা বলব?”

“হুম বলো।”

“আপনাকে অনেক বেশি ধন্যবাদ।”

হঠাৎ এমন কথা শুনে কিছুটা বিব্রত হলো সিদ্ধান্ত। চটপট নিজেকে সামলে নিল স‍ে।
“হঠাৎ?”

“কারণ অনেক দিন ধরেই বলার ছিল কিন্তু বলা হয় নি।”

“আচ্ছা।”

“হুম। আপনি না এলে কখনো স্বপ্নই দেখতাম না।”

“স্বপ্ন দেখার জন্যেও কখনো কখনো মাধ্যম লাগে। ধরে নাও তোমার স্বপ্নের মাধ্যম হয়ে এসেছিলাম আমি।”

মুচকি হাসল নির্বা। কথাটা ভীষণ মনে ধরল তার। সিদ্ধান্ত নিজ পকেট থেকে একটা চকলেট এগিয়ে দিল।
“এটা তোমার জন্যে।”

“না না আমার লাগবে না।”

“স্নেহ করে দিচ্ছি। তাছাড়া তোমার বয়সী মেয়েরা চকলেট খুব পছন্দ করে থাকে। ঠিক বলছি?”

“জী।”

“তাহলে নাও। তুমি নিশ্চয়ই ডায়েট করছো না।”

কথা শেষে হো হো করে হাসল সিদ্ধান্ত। নির্বা লজ্জা পেল। সে একটু বেশিই চিকন। তাই বলে এমন করে বলতে হবে?

গান গাওয়ার পূর্বে আরেকবার প্র্যাকটিস করল সবাই। তারপর গেল মেকাপ রুমে। সেখান থেকে সবাইকে মেকাপ করিয়ে দেওয়া হলো। ভারী মেকাপ করাতে নির্বা বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। অথচ সবাই বলছিল তাকে খুব সুন্দর লাগছে। সে নিজেও আয়নায় দেখেছে। তবু অস্বস্তি যাচ্ছে না। কিছু সময় পর নির্বাকে ডাকা হলো। মেয়েটি ইষৎ কেঁপে উঠল। এত দর্শকের সামনে কখনো গান গাওয়া হয়নি যে। ওর এই ছটফট দেখতে পেল সিদ্ধান্ত। সে হেসে মঞ্চে প্রবেশ করল। নির্বা যেন একটু ভরসা পেল। কিন্তু তার হাত ঘামছে। টিসু এগিয়ে দেয় সিদ্ধান্ত। সেটা চেপে ধরতেই সিদ্ধান্ত বলল, “ব্রেভ গার্ল। আমি আছি তো।”

কি সুন্দর করে বলল কথাটা। নির্বার শরীরে যেন বল এসে গেল। সে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল। সবাই তীব্র অপেক্ষায় বসে আছে। চারপাশের লাইট কমে এল। ধীরে ধীরে সুর তুলল। নির্বার গান ছড়িয়ে পড়ল সব খানে। মেয়েটি যেন নিজের সবটুকু দিয়ে সুর তুলেছে। যত ভালোবাসা আছে সব ঢেলে দিয়েছে। গান শেষ হতেই নির্বার দু চোখে পানিতে ভরে উঠল! সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত স্ট্রেজ থেকে নামিয়ে নিল। নির্বা হুট করেই ভীষণ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ওর এই কান্নার কারণ কি জানা না থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত’র বুকের ভেতরে বাঁশি বাজল। সে আলগা হাতে মাথায় স্পর্শ করল। যে স্পর্শে মিশে আছে এক সাগর ভরসা।

লাইভ টেলিকাস্ট হওয়া গানের অনুষ্ঠানটা দেখছিল হেরা। সে চেচিয়ে উঠল। পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিল যেন। নির্বাকে দেখতে পেয়েছে সে। শাহান বাড়ির পেছনের দিকে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সন্ধ্যার এই সময়টায় সে সিগারেটে ডুবে থাকে। হেরাকে লাফাতে দেখে বলল, “পাগলের মতো লাফাস কেন?”

“আরে ভাইয়া তুমি জানো আজ কি হয়েছে?”

“কি হয়েছে? যার জন্য এমন ছাগলামি করছিস!”

“আমাদের নির্বাকে টিভিতে দেখানো হচ্ছে। মেয়েটা কি যে ভালো গাইল আজ। সবাই প্রশংসা করছে। আই এম প্রাউড অফ হার। উফ স্কুলে গিয়ে ওকে জড়িয়ে না ধরা অবধি শান্তি নেই।”

শাহানের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে আপনমনে সিগারেটে জ্বালাতে লাগল বুক। হেরা চারপাশে হৈ হৈ ফেলে দিল। তার বান্ধবীকে আজ টিভিতে দেখানো হয়েছে!

বাড়ি ফিরে বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়ল নির্বা। জামাল পুরো রাস্তা জুড়ে মেয়েকে বাতাস করে এসেছেন। সিদ্ধান্ত গাড়ি পাঠাতে চাইলেও ভদ্রলোক গাড়ি নিলেন না। তার মতে গাড়ি নিয়ে যেতে হলে লেট হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো ট্রেনে করে যাবেন। তেমনটাই করেছেন তিনি। সুমিতা আর নিশু অপেক্ষা করছিল। টিভিতে মেয়ের গান শুনে ওনার চোখে জল চলে এসেছে। নিশু নিজেও বান্ধবীদের বড়ো মুখ করে বলে এসেছে। তার বুবু সেরা সিঙ্গার।
“এক গ্লাস পানি দাও মা।”

“নিশু তোর বাবা আর বুবুর জন্য ঠান্ডা পানি আন তো।”

সুমিতা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তার মেয়েটাকে বেশ শাসনে বড়ো করেছেন তিনি। তবু মেয়েটা এত দূর যাবে কল্পণাও করেন নি। জাফর পানি পান করে ফ্যানের নিচে বসলেন। কাজ শেষ করে মেয়েকে আনতে গিয়েছিলেন। তাই একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছে।
“গোসল করে এসো। আমি খাবার বেড়ে রাখব।”

“হুম। নিশু,কাপড় এনে দে তো।”

সুমিতা মেয়ের পাশে বসলেন। আলগোছে চুল গুলো গুছিয়ে দিলেন।
“কি হয়েছে?”

“জানি না মা। আমার খুব খারাপ লাগছে।”

“এত ধকল শেষ করে এসেছিস একটু খারাপ তো লাগবেই।”

“হুম।”

“খাবার খাইয়ে দেই?”

“ক্ষিদে নেই।”

“এমন করলে তো চলবে না সোনা। হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেলে ভালো লাগবে।”

“সত্যিই ক্ষিদে নেই মা। প্লিজ জোড় করো না। আমি ঘরে গিয়ে রেস্ট নেই।”

যাওয়ার সময় সিদ্ধান্ত’র দেওয়া চকলেটের কথা মনে পড়ল। নিশুকে সেটা দিয়ে স্বীয় কক্ষে এল সে। দরজা লাগিয়ে কিছু সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। ওর ভেতরটা বিক্ষিপ্ত। একটা রোষানলে শেষ হয়ে যাচ্ছে সবটা। দু চোখে ভীষণ যন্ত্রণা। আচ্ছা একই সময়ে একাধিক মানুষের প্রেমে পড়া যায়?

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**ব্যতিক্রম কিছু দেওয়া চেষ্টা করছি। দয়া করে বাজে কমেন্ট থেকে বিরত থাকুন।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here