এক জোড়া নুপুর পর্ব -০৭

#এক_জোড়া_নুপুর (৭)

নিজের মনকে সামলাতেই হোক কিংবা পড়াশোনাকে মনে প্রাণে গ্রহণের তাগিদেই হোক, নির্বা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এখন গান করবে না। এস এস সি পরীক্ষাটা শেষ হোক তারপর গানে জোর দিবে। ওর এই সিদ্ধান্তের সাথে এক মত ব্যক্ত করেছেন পরিবারের সকলেই। কেউ ই চায় না গানের জন্য পড়াশোনার ক্ষতি হোক। এমন কিছু একদমই উচিত হবে না। সেই জন্যেই সিদ্ধান্ত’র দেওয়া দ্বিতীয় গানের শো টা বাতিল করল সে। বাচ্চা একটি মেয়ে মাঝে মাঝে খুব বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অথচ নিজের মন সামলাতে অপরাগ! নব্যা কিশোরী হৃদয় ক্ষণে অন্যরকম অনুভূতিতে সিক্ত হয়। এই বয়সটা আসলেই ভয়ঙ্কর। নিশু তখন বাগানে বসে গাছ লাগাচ্ছিল। বোনকে দেখে ছুটে এল।
“বুবু গাছ গুলো লাগিয়ে দাও না।”

“মাত্রই এলাম,আর শুরু করে দিলি?”

“দাও না বুবু।”

“পারব না। পরে আসবি।”

“প্লিজ বুবু।”

“আচ্ছা দিচ্ছি। এত ঢং করিস তুই। যা পানি নিয়ে আয়।”

খুশি মনে বালতি ভরাট করে পানি আনল নিশু। সেটা থেকে এক জগ পানি নিয়ে প্রথমে আলগা মাটি গুলো মেখে নিল নির্বা। তারপর কিছু মাটি খুঁড়ে সেখানে অল্প একটু পানি দিল। পানির উপর আবার মাটি দিয়ে সাথে দিল উপযোগী সার। গাছ লাগিয়ে সুন্দর করে চারপাশ ভরাট করল। একটু নিচু জায়গা রাখল নিয়মিত পানি দেওয়ার জন্য। অল্প একটু পানি দিল গাছের মূলে। নির্বার গাছ লাগানোর পদ্ধতি দেখে নিশু হা হয়ে রইল। তার বোনের হাতের গাছ বেশ ভালো হয়। এত গুণী মেয়েটা!

টেস্ট পরীক্ষার পর দুটো মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছে নির্বা। সবগুলোতেই সে প্রথম হয়েছে। শিক্ষকরা অন্যবারের থেকে এবার বেশি কিছুর আশায় আছেন। গত কয়েক বছর ধরেই স্কুলের রেজাল্ট বিশেষ ভালো হচ্ছে না। এ প্লাসের সংখ্যা শূন্য তে এসে গেছে। এবারের বাচ্চাগুলো পড়াশোনায় কিছুটা আগ্রহী। তাই বেশ ভরসা নিয়ে আছেন স্কুল পক্ষ। হেরার রেজাল্ট ও তুলনামূলক আগের থেকে ভালো এসেছে। সে খুশিতে নেচে বেড়াচ্ছে। বহু দিন পর দুই বান্ধবী আড্ডায় বসল। ওদের স্কুলের পাশে মসজিদ। তারপর কিছু ছোট ছোট দোকান। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি হয় সেখানে। তারপাশেই নদীর ধারে নতুন একটি দোকান হয়েছে। ফাস্টফুড আইটেমের দোকান। বেশ উত্তেজিত ওরা। এই এলাকায় একটি মাত্র ফাস্টফুডের দোকান। তাই বেশ ভীড়। খাবার অর্ডার দিয়ে ওরা এল নদীর কিনারে। সেখানে কিছু কচুরি পানা আর শাপলা দেখতে পেল। এই শাপলা দেখেও শাহানের কথা স্মরণ হলো। সেবার কি কান্ডটাই না ঘটল! শাপলা তুলতে গিয়ে নদীর পানিতে ভিজতে হলো। তারপর আবার শাহানের সাথে দেখা! সব কেমন চোখের পাতায় উঠে এল। ওর মিটিমিটি হাসি দেখে ধাক্কা দিল হেরা।
“কি?”

“এত মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছিস?”

“কিছু না তো।”

“মিথ্যে বলছিস! আমি স্পষ্ট দেখলাম তুই চুপিসারে মৃদু হাসছিস।”

“ও কিছু না।”

“কিসের কিছু না। মনের আকাশে রঙ উঠেছে বললেই হয়। আমি বুঝি তোর, খুব পর?”

“তা নয় রে বোকা। সত্যিই সিরিয়াস কিছু না। একটা কথা মনে করে হাসলাম।”

“আচ্ছা, বিশ্বাস করলাম।”

হেরাকে জড়িয়ে ধরল নির্বা। দু বান্ধবীর ভালোবাসায় মেতে উঠল প্রকৃতি। মাথার উপর দিয়ে চিল উড়ে যাচ্ছে। নদীর পানি কলকল করে শব্দ করছে। সুন্দর এক অনুভূতি মনে দোলা দিয়ে চলল। কিছু সময় নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে রেখে উঠে এল। ভীড় কমে এসেছে। ওরা বার্গার অর্ডার করেছিল। একদমই মিনি সাইজের বার্গার। ভেজিটেবল বার্গার পনেরো টাকা আর চিকেন বার্গার পঁচিশ টাকা। ওরা চিকেন বার্গার নিয়েছে। সাথে নিয়েছে দশ টাকা করে দুটো ভেজিটেবল রোল। নির্বা রোলে কামড় বসিয়ে বলল, “কোচিং করব ভাবছি।”

“বাসায় পড়লেই তো ভালো। কোচিং এ অতো মানুষ…”

“হু,তবে কোচিং না করলে পোষাবে না। আব্বু বলেছে এস এস সি পরীক্ষা শেষ হলে ঢাকা নিয়ে যাবে। তাই প্রিপারেশন আরো ওয়েল করতে হবে।”

“তার মানে কলেজ সেখান থেকেই করবি?”

“হুম।”

মন খারাপ করে ফেলল হেরা। বিষয়টা এত সময় পর খেয়াল করল নির্বা। আলগোছে জড়িয়ে ধরল বান্ধবীকে।
“মন খারাপ করলে চলবে?”

“তোকে দেখতে পাব না।”

“কেন পাবি না? আমি কি ম রে যাচ্ছি রে!”

“এসব বলিস না দোস্ত। আমার ভয় হয়। তবে খারাপ লাগছে। মিস করব খুব।”

“আমার ও খারাপ লাগছে। কিন্তু আব্বু বলল ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করলে পরের লাইফ টুকু সহজ হবে।”

“হুম। যাওয়ার আগে নাম্বার দিতে ভুলিস না।”

রাতের বেলা নির্বা বই পড়ছিল। হঠাৎ করেই শাহানের কথা মনে পড়ল। ছেলেটার জন্য প্রায়শই ওর বুক ভারী হয়। এদিকে সিদ্ধান্ত’র সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে। মন মস্তিষ্কের এই লড়াইয়ে অতিষ্ঠ সে। মাঝে মাঝে নিজের প্রতি খুব রাগ হয়। সে কিভাবে একই সময়ে একাধিক মানুষের উপর আকর্ষণ পেল!

এস এস সি পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিনই শাহানের সাথে দেখা। ছেলেটা বাইকে করে এল! মাঠের দিকে বাইক রেখে বন্ধুদের কল করল। সবাই এক সাথে হলে, আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নির্বার বুকের ভেতর থেকে তপ্ত শ্বাস নির্গত হয়। সে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে দেয়। খানিক বাদে ছুটে আসে হেরা। কাঁপছে সে।

“পানি খা। এত হাপাচ্ছিস কেন?”

“বোট থেকে নেমে সোজা ছুট লাগিয়েছি।”

“নদী পথে এলি?”

“হুম। ভাইয়া বলল রাস্তায় নাকি জ্যাম। তাই বোটে করতে আসতে হলো।”

শাহানের প্রসঙ্গ উঠতেই পুনরায় মন খারাপ করল নির্বা। দুই বান্ধবী পরীক্ষা নিয়ে কথা বললেও মনটা অন্য কোথাও ছুটোছুটি করছে। হেরার মা এসে স্যালাইনের পানি দিলেন। মেয়েটা গত কিছুদিন খাওয়া দাওয়া করে নি একদমই। শরীর ভীষণ দূর্বল। মায়ের থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নির্বার সাথে আড়াল হলো সে। নির্বা তখনো বই পড়ছে।
“দোস্ত একটা হেল্প করে দিবি?”

“হেল্প? এখন আবার কি হেল্প লাগবে?”

“আসলে আমার বয়ফ্রেন্ড এসেছে।”

“তোর বয়ফ্রেন্ড!”

চোখ বড় বড় হয়ে গেল নির্বার। হেরা লাজুক হাসল। তারপর পর ই বলল, “এক মাস ও হয় নি। তোকে জানাব জানাব করে জানানো হয় নি। রাগ করিস না প্লিজ।”

“রাগ করি নি। তবে কে সে?”

হাতের ইশারায় দেখাল হেরা। একদল ছেলের মধ্যে থাকা শাহানকে নজরের এল প্রথমে। হেরা তার বয়ফ্রেন্ডকে দেখালেও নির্বার মন পড়ে রইল শাহানের নিকট।
“এই দোস্ত?”

হুড়মুড়িয়ে তাকাল নির্বা। ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। জ্বিভা দিয়ে লেহন দিতেই সিক্ত হয়ে উঠল।
“বল।”

“আমি ওর সাথে কথা বলব। ততক্ষণ ভাইয়াকে তুই ম্যানেজ করবি।”

চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলেছে নির্বা। মেয়ে বলে কি!
“পাগল হলি?”

“না করিস না দোস্ত। তুই জাস্ট ভাইয়ার সাথে কথা বলবি। ও আমার সাথে দেখা করেই চলে আসবে। সেফটির জন্য বলছি, হুট করেই যদি চলে এল। ভাইয়া তোর সাথে কথায় ব্যস্ত হলে আমরা রিল্যাক্সে কথা বলতে পারব।”

“জ্বালিয়ে মা র লি।”

“একটু সহ্য কর দোস্ত।”

ভয়কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখিয়ে নির্বা যখন শাহানের চার হাত দূরে,তখনি ওর স্পন্দন বেড়ে গেল। পেটের ভেতর কেমন এক অনুভূতি। একটা সুখ আর দুঃখের মিশ্রণে বড়ো চিন্তিত বোধ করল সে। এ জীবনে নতুনের শেষ নাই। প্রতি নিয়তই জীবন তাকে নতুন কিছু দিয়ে বেড়াচ্ছে। যার স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ছে সে।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**নায়িকা মানেই কি শুদ্ধ একটা চরিত্র? কেন নায়িকার মাঝে ভুল থাকতে পারে না? আমি আবার বলছি ব্যতিক্রম কিছু লিখছি। নির্বা কিশোরী,তার কিশোরী অনুভূতি থেকেই লেখা এটা।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here