এক জোড়া নুপুর পর্ব -০৮

#এক_জোড়া_নুপুর (৮)

শাহানের শরীর থেকে মিষ্টি একটা সুবাস আসছে। ছেলেটা শ্যামরঙা হলেও একটু বেশিই সুন্দর। তার জোড় ভ্রু এর প্রতি নির্বার অধিক দূর্বলতা। সে কাছে আসতেই শাহান এর বন্ধুরা সরে গেল। কেন গেল নির্বা জানে না। শাহান একটুখানি হেসে বলল, “বাচ্চা মেয়ে,কেমন আছ?”

অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল নির্বা। সে উত্তর দিতে পারল না। হাত ঘেমে এসেছে।
“তুমি ঠিক আছ?”

“জী।”

“এক্সামের প্রিপারেশন কেমন?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“বেশ,মন দিয়ে এক্সাম দাও। ইদানীং তো গান ও করো,বেশ সুন্দর গাও তুমি।”

“থ্যাংক ইউ। আপনার উপহারটা এখনো দেওয়া হলো না।”

মনে না পড়ার ভঙ্গিতে শাহান বলল, “কিসের কথা বললে?”

“আপনার জন্মদিনের উপহার।”

হো হো শব্দে হেসে ফেলল শাহান। নির্বা ইষৎ লজ্জিত হলো। আরক্তিম হয়ে উঠল তার সুন্দর মুখ্রশী।

“পরে দিও। এমনিতেও দেড় দু বছর পেরিয়ে গেছে।”

“হুম।” বলেই চুপ হয়ে গেল নির্বা। শাহান ফোনে কিছু একটা করছে। কি করছে সেটা নির্বার ভেতরকার সত্ত্বাকে চেপে ধরল। সে এদিক সেদিক চেয়েও দেখতে পারছে না।
“নীলের মায়াবিনী এটা তোমার আইডি?”

হঠাৎ করেই প্রশ্ন ছুড়ল শাহান। নির্বা চট করেই তাকাতে পারল না। গলা শুকিয়ে এসেছে। শাহান বিগত দিনের ম্যাসেজ গুলো চেইক করছে। একটা ম্যাসেজ দেখিয়ে বলল, “রাত তিনটে বাজেও জেগে থাকো?”

লজ্জায় নত হয়ে এল মুখ। নির্বা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”সব সময় না। মাঝে মাঝে জাগি।”

“হু,ভালো। ফেসবুকে বেশি একটিভ নও।”

শাহানের থেকে সরে এসে শ্বাস ফেলল নির্বা। হঠাৎ করেই ধরা পরে যাওয়ায় বুকের ভেতর কেমন করতে লাগল। মানুষটা কি ভাবল!

প্রতিটা পরীক্ষায় শাহানের মুখ দর্শনের ভাগ্য হয়েছে নির্বার। তবে কথা বলা হয়নি। সেদিন এর পর নির্বা আর ম্যাসেজও দেয় নি। এত লজ্জা লাগছে ওর। হেরা বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পেল না। আজ ওদের শেষ এক্সাম। অনেক বেশি ভীড় জমেছে। এলাকার ছেলেপেলেদের ভীড় বেশি। এমনিতেও বোর্ড এক্সামের সময় আশপাশ থেকে ছেলেরা ভীড় করে। এই যন্ত্রণায় চলাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। নির্বা পরীক্ষা শেষ করে অন্য মনস্ক হয়ে ঘুরছিল। হঠাৎ করেই শাহান তার বাইক নিয়ে চলে গেল। খানিক বাদেই গন্ডগোলের আওয়াজ এল। শাহান যে পথে গিয়েছে সেখান থেকেই চেচামেচি আসছে। নির্বার বুকের ভেতর ছ্যত করে উঠল। তার যে কি হলো সে পাগলের মতো ছুটতে লাগল। ভীড়ের মধ্যে উন্মাদের মতো একটা মুখ খুঁজে চলেছে সে। কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। দু চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না।

“এখানে কি করছো?” কথা শেষেই সজোরে টান পড়ল নির্বার বাহুতে। শাহান তাকে টেনে সরিয়ে নিল। ততক্ষণে গন্ডগোল আরো বেড়ে গেছে। পাশের পুলিশ স্টেশন থেকে পুলিশ এসে গেছে। নির্বা টলটলে চোখে দেখছে সামনে থাকা মানুষটাকে।
“ঠিক আছ?”

কোনো মতে দু পাশে মাথা দোলাল নির্বা। শাহান মেয়েটির মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরল! হৃদস্পন্দনের গতি প্রবল। নির্বা ভুলে বসল সে শাহানের বুকের মধ্যে। শুনতে লাগল লাবডাব শব্দ গুলো। কারো বুকের মধ্যে এত শান্তি থাকে?

এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া উপ রাস্তা দিয়ে চলছে ওরা। শাহান একদমই চুপচাপ। থেকে থেকে কম্পিত হচ্ছে নির্বা। সে ভীষণ ভয় পেয়েছে।
“ঐদিকে গিয়েছিলে কেন?”

শক্তপোক্ত কণ্ঠটা শুনে নির্বার বুকের ভেতর কেমন করে উঠল। সে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। মনে মনে কথা সাজাতে গিয়েও পারল না।
“কথা বলছো না কেন?”

“আপনাকে যেতে দেখেছিলাম।”

“তো?”

“অতো চেচামেচি হচ্ছিল।”

দম আটকে এল নির্বার। সে আর কথা আগাতে পারল না। শাহানের অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না। তার ফোনে কল এসেছে। সে কথা বলতে বল‍তে একবার পেছনে তাকাল। নির্বা মাথা নত করে চলছে। কথা শেষ করে নির্বার নিকটে এল শাহান। মুখটা অসম্ভব রাগে ভরে উঠেছে।
“নেক্সট এমন করবে না।”

“জী।”

“ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দিচ্ছি। আর আগের নাম্বারটায় কল দিবে না।”

নির্বা অবাক হয়ে রইল। কয়েকবার শাহানকে কল করেছে সে। মানুষটার কণ্ঠ শুনেই রেখে দিয়েছে। সেটাও ধরে ফেলল!
“বাসায় গিয়ে পড়াশোনায় মন দিবে। অন্য কিছু ভেবে থাকলে সাইড করে ফেল।”

বুদ্ধির সাথে কথা শেষ করল শাহান। সব কিছু যেন কয়েক সেকেন্ডেই ঘটে গেল। নির্বাকে কেন্দ্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে উল্টো চলতে লাগল। মেয়েটির ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। প্রিয় মানুষের প্রত্যাখ্যানে টলটল করছে দুটি নয়ন। এভাবেও মানুষ হারাতে পারে!

সিদ্ধান্ত’র সাথে নির্বার পরিবারের সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ছেলেটার স্বভাব অন্যরকম। মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় চট করেই আপন হয়ে যায়। তেমনটাই ঘটেছে নির্বার পরিবারের সাথে। নিশু তো হা হয়ে তাকিয়ে। এই সময়ের সেরা সিঙ্গার,তাদের বাড়িতে আসবে! সপ্তম শ্রেনিতে পা দেওয়া নিশুর কিশোরী হৃদয় পুলকিত। মনের খুশি ধরে রাখতে পারল না। বান্ধবীদের সাথে বলে ফেলল কথাটা। ওর বান্ধবীদের মুখ হা হয়ে গেছে।
“কি বললি সিদ্ধান্ত হক তোদের বাসায় আসবে!”

“হুম। আমার বুবু তার সাথে কাজ করবে।”

“মিথ্যে বলছিস না তো?”

“একদমই না। গতবার গান করল দেখলি না।”

“তুই খুব লাকি রে।”

গর্ব হলো নিশুর। মনে মনে বোনকে ধন্যবাদ দিতে লাগল। ভাগ্যিস এই মেয়েটা তার বোন হয়ে জন্ম নিয়েছে। ফেরার পথে আইসক্রিম কিনল নিশু। পরীক্ষার পর আর বের হয় নি নির্বা। স্কুলে আসার পথে বার বার করে বলে দিয়েছে আইসক্রিম নিয়ে আসার জন্য। বিল দিবে সেই মুহূর্তেই শাহানকে দেখতে পেল।
“ভাইয়া কেমন আছেন?”

সিগারেট জ্বালিয়ে শাহান বলল, “ভালো। স্কুল ছুটি হয়ে গেল?”

“না না। আমি ছুটি নিয়েছি।”

“আচ্ছা। পড়াশোনার কি অবস্থা?”

“বেশ ভালো।”

“মন দিয়ে পড়ো। বাসায় যাবে তো?”

“হুম।”

“দুপুর বেলা গাড়ি তো পাবে না। দাঁড়াও রিক্সার ব্যবস্থা করি।”

কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠশ নিশুর চোখ। শাহান কিছু দিন ধরে স্কুল কমিটির একটি পদে নির্বাচিত হয়েছে। সেই থেকেই পরিচয়। সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার। দেখলেই আপন মনে হয়। কথায় কথায় সিদ্ধান্ত’র কথা বলল নিশু। শুরুতে আগ্রহ না দেখালেও এবার শাহান বলল, “তোমার আপু বেশ নাম করবে।”

“দোয়া করবেন ভাইয়া। তাই যেন হয়। সিদ্ধান্ত ভাইয়া বুবুকে খুব ভালোবাসেন। ওনি না থাকলে এত কিছু হতোই না।”

শাহান কিছু বলল না। খানিক বাদে রিক্সা এল। নিশুকে উঠিয়ে দিয়ে ভাড়া দিয়ে দিল। নিশু কি বলবে বুঝতে পারছে না। যাওয়ার সময় সে বলল, “সময় করে আমাদের বাড়ি আসবেন ভাইয়া।”

শাহানের উত্তর দেওয়ার পূর্বেই রিক্সা চলতে লাগল। বাড়ি ফিরে বিষণ্ন মুখে বসে থাকা নির্বাকে দেখে নিশু লাফিয়ে উঠল।
“বুবু কি হয়েছে তোমার?”

নিরুত্তর রইল নির্বা। সে উঠানের এক কোণে গুটি মেরে বসে আছে। চোখের সামনে রাখা মাছের গামলা। হরেক রকমের মাছ রাখা সেখানে।
“মা, ও মা বুবু ভর দুপুর বেলা মাছ নিয়ে বসে আছে কেন? ওকে ভূতে ধরল না তো।”

সুমিতা সবজির বাগানে ছিলেন। নিশুর চিল্লাচিল্লিতে ছুটে এলেন।
“বুবুর কি হয়েছে?”

“কি হয়েছে মানে!”

“মাছ নিয়ে বসে আছে। কথা ও বলছে না।”

“কই দেখি।”

সুমিতাও দেখল নির্বা বসে আছে। চুল গুলো উসকো খুসকো। ভয় হলো ওনার। মেয়েটার আবার কি হলো?
হঠাৎ করেই হো হো করে হেসে উঠল নির্বা। সুমিতা ও নিশু চমকে উঠল। নির্বার হাসি যেন থামার ই নয়।

“তোমরা কি ভাবলে বলো তো। ভূতের ভয় এখনো গেল না।”

“উফ বুবু!”

“তুই এত ভীতু রে নিশু!”

“এখন কোনো কথা নয়। অনেক কাজ বাকি। যা দু বোন ঘর গুছিয়ে গোসল করে নে।”

নিশু আর নির্বা কথার সমাপ্তি দিয়ে ঘর গোছানোর কাজে লেগে পড়ল। আগামীকাল সিদ্ধান্ত আসবে। ভীষণ কাজ। হরেক রকমের খাবারের আয়জোনের সাথে ঘরের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।

চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here