এক জোড়া নুপুর পর্ব -০৯

#এক_জোড়া_নুপুর (৯)

সিদ্ধান্ত হক বর্তমান সময়ের বেশ পরিচিত একটি নাম। অনেকের ধারণা বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতার সুবিধা গ্রহণ করে থাকে সে। আসলে তেমন কিছুই নয়। যারা সিধান্তকে শুরু থেকে অনুসরণ করছে তারাই জানে গায়ক হওয়ার জন্য কতটা লড়াই করতে হয়েছে তাকে। কত পরিশ্রমের পর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে অবহেলাও তো কম পায় নি। সেই সিদ্ধান্ত আজ তরুণ গায়কদের মধ্যে অন্যতম। গায়কের আগমনে নির্বার পরিবার যতটা না ব্যস্ত তার থেকে অধিক ব্যস্ত আত্মীয় স্বজনরা। ভোর থেকেই আসতে শুরু করেছে তারা। নির্বার চাচাতো বোন সুরভীর মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনা বড়ো চোখে লাগে। সে কাজ কর্ম তো করছেই না উল্টো কাজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নির্বা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। মেয়েটি ওকে ধরে বসিয়ে দিল।
“আমার অনেক কাজ আছে সুরভী বু।”

“কোনো কাজ নাই। তুই বোস আগে।”

“মা বকা দিবে।”

“আমি সামলে নিব।”

“কি বলবে দ্রুত বলো প্লিজ।” বসেও ছটফট করছে নির্বা। তার হাতে অনেকগুলো কাজ। তাছাড়া সুরভীর কথা শোনার আগ্রহ ও নেই। সুরভী তার ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করল। চোখ যেন স্বর্গ দেখতে পেয়েছে।
“সিদ্ধান্ত’র গার্লফ্রেন্ড আছে?”

“আমি কেমন করে জানব। এটা তো তার পার্সোনাল বিষয়।”

“তুই দেখিস নি কখনো?”

“না। মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে ওনার সাথে। এত কিছু জানার দেখার সময় কোথায়।”

“তাহলে চান্স আছে।” বলেই হাসল সুরভী। নির্বা শুনেও না শোনার ভান করে বেরিয়ে গেল। মা এক গাদা বাসনপত্র বের করেছেন। এদিকে কলপাড়ে অন্য কাজ চলছে। সাহায্য’র জন্য দুজন মহিলা নেওয়া হয়েছে। তাদের নিয়ে পুকুরের কাছে এল সে। কাজ গুলো ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল পা ছড়িয়ে। হাতে কুল মাখা। খেতে খেতে নানান বিষয় কল্পনা করছিল। সিদ্ধান্ত’র প্রতি হুটহাট জেগে উঠা স্বীয় অনুভূতির নাম দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে শাহান এসে আটকে দিচ্ছে। ওর কিশোরী হৃদয় এত বখে যাবে কল্পণাও করে নি। অথচ শাহান তাকে গ্রহণ ই করল না! বরং সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তাড়িয়ে দিল। নির্বার দুটি চোখ আজকাল কাঁদতে ভুলে গেছে। এখন আর চোখ থেকে জল নামে না। তবে কি অনুভূতি হারিয়ে গেল? উহু অনুভূতি তো হারায় নি। অনুভূতিরা চাপা পড়ে গেছে। একটা অসহ্য বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরল নির্বা। সুমিতা ওকে গোসল করতে বললেন। খানিক বাদেই গোসলের জন্য লাইন লেগে যাবে। বাড়িতে পা রাখার জায়গা নেই যেন। কিলকিল করে আত্মীয়স্বজনে। ঝড়ের গতিতে গোসল করে বেরিয়ে এল নির্বা। শুভ্র সুন্দর মুখে বিন্দু কয়েক পানি লেগে আছে। আশেপাশের নারীরা আড়চোখে দেখে নিচ্ছে ওকে। সত্যি বলতে এই জগৎ এ রূপের পাগল নয় এমন কেউ নেই। অনুভূতি যেমন সত্য ঠিক তেমন সত্য রূপের মোহ। সুরভী সেজে গুজে বিবি হয়ে বসে আছে অনেকক্ষণ। মনে হচ্ছে ওর বিয়ের আয়োজন চলছে। নির্বা মুখের ক্রিম লাগাতে লাগাতে বলল, “সুরভী বু তোমার না বি এফ ছিল?”

“ছিল কি,এখনো তো আছে।”

“তাহলে সিদ্ধান্ত হককে আবার….”

“বোকা,সিদ্ধান্ত হচ্ছে আমার ক্রাশ। বি এফ আছে বলে কি অন্য কাউকে ভালো লাগবে না?”

“বি এফ থাকা সত্ত্বেও অন্য কাউকে ভালো লাগলে সেটা তার সাথে অন্যায় হয়ে গেল না?”

সুরভী শ্বাস ফেলল। এই মুহূর্তে নির্বা বড়ো বিচলিত। সে চাইছে সুরভীর সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে। প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত হয়ে বসল সে। এই অনুভূতি গুলো বড্ড জ্বালা দিচ্ছে।
“অনুভূতির বিরোধীতা করা বড়ো কঠিন। কেউ স্বীকার করি আর না করি এই পৃথিবীতে সবাই একাধিক মানুষের প্রেমে পড়ে কিংবা মোহ জাগে। এখন দু একজন ব্যতিক্রমের উদাহরণ টানা উচিত হবে না।”

সবটা বুঝেছে এমন একটা ভঙ্গি করে মাথা দোলাল নির্বা। তারপরই শুধাল,”তাহলে তো এই পাপ সবাই করছে।”

সুরভী হেসে ফেলল। নিজের চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলল, “শোন নির্বা,এই জগৎ এর নব্বই ভাগই পাপ। আর সবথেকে বড়ো পাপ হয় মুখশের আড়ালে। যে যত ভালো মানুষ তার ভেতরে তত প্যাঁচ। আবারো বলছি ব্যতিক্রম কিছু আছে থাকবেই। তবে অনুভূতি,মায়া,ভালোবাসা,প্রেম এসব বিচিত্র জিনিস। ভালোবাসলেই কি সে জীবনসঙ্গী হয়ে যায়? আবার মায়া না থাকা সত্বেও অনেক সময় একে অপরের জীবনসঙ্গী হতে হয়। ক্রাশ,ভালোবাসা,প্রিয়জন এসব আলাদা আলাদা বিষয়। তবে এক জনের উপর ও এই সবগুলো বিষয় কাজ করতে পারে।”

সুরভীর কথা গুলো মস্তিষ্কের শেষ অবধি গেঁথে নিল নির্বা। আসলেই এ দুনিয়া পাপের কারখানা।

সিদ্ধান্তকে রিসিভ করার জন্য নির্বাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে সুরভী। মেয়েটি একটু বেশিই চঞ্চল। বড়ো সড়কে এসে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সে এক স্থানে স্থির থাকতে পারছে না। রীতিমতো কাঁপছে সে। আচানাক নিশুর ডাক শোনা গেল। নিশু দৌড়ে আসছে। কাছে এসেই বলল, “সিদ্ধান্ত ভাইয়া কল করেছে। ফোন রেখেই চলে এসেছ।”

তড়িৎ গতিতে ফোন নিল নির্বা। সিদ্ধান্ত জানাল সে কাছেই এসে গেছে। আর দশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। কথাটা শুনে সুরভী লাফিয়ে উঠল। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে এবার এইচ এস সি দিবে!

তিন বোন গল্প করছিল। নিশু গাছ থেকে আম পাড়ার চেষ্টা করছে। কাঁচা আম খেতে দারুণ লাগে। ওর এই কান্ড দেখে নির্বা বকাও দিল। রাস্তার ধার থেকে কিছু ছেঁড়া,সে পছন্দ করে না। তবে নিশু শুনছে না। উচ্চতা কম হওয়ায় ব্যর্থ সে। মুখটা গোমড়া হয়ে এল। ঠিক সে সময়টায় মরুর বুকে বৃষ্টি হয়ে এল শাহান। ছেলেটার বাইকের গতি প্রচণ্ড। গলা ছেড়ে ডাকল নিশু।
“শাহান ভাইয়া….”

ছ্যঁত করে উঠল নির্বার বুক। সে চট করে সামনে তাকাল। শাহানের বাইক থেমেছে। ছেলেটা রাস্তা বদলিয়ে এদিকেই আসছে। ধীম ধীম আওয়াজে নির্বার হৃদপিণ্ড খুলে আসার উপক্রম! নিশু ছুটে গিয়ে বলল,”ভাইয়া আম পাড়তে সাহায্য করুন।”

এর আগেও কয়েকবার আম পাড়তে সাহায্য করেছে শাহান। ওর বন্ধুমহলে শাহান নামটি বেশ শ্রদ্ধার সম্মানের। শাহান একটু করে হাসার চেষ্টা করে গাছের ডাল টেনে নামাল।
“যত ইচ্ছে তুলে নেও।”

লম্বাটে দেহের শাহানের শ্যামরঙা শরীরের দিকে তাকিয়ে নির্বা ‘থ’ হয়ে গেল। তার মন মস্তিষ্কে একটিই প্রশ্ন, শ্যাম রঙকেও কি সুন্দর বলা যায়?

অনেক গুলো আম নিল নিশু। শাহান মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “যাই নিশুমনি।”

“আমাদের বাসায় চলেন না ভাইয়া।”

“অন্য একদিন যাব।”

“আজই চলেন প্লিজ। সিদ্ধান্ত ভাইয়া ও আসবে আজ।”

সিদ্ধান্ত’র কথা শুনে নির্বার দিকে তাকাল শাহান। এত সময় সে এমন ভঙ্গিতে ছিল যেন ওকে দেখতেই পায় নি। নিশু চেচিয়ে বলল,
“বুবু শাহান ভাইয়াও যাবে আমাদের সাথে।”

” না নিশু অন্য এক সময়।”

“এমন করলে চলবে না। আপনাকে যেতেই হবে।”

“তুমি বুঝো একটু,আমার কাজ আছে।”

“একদিন কাজ না করলেও চলবে।” পাশ থেকে বলল সুরভী। ওর সাথে শাহানের পরিচয় রয়েছে। সেই ছোট বেলার কথা। সুরভীকে চিনতে পারল শাহান। সৌজন্যতায় হেসে বলল, “কেমন আছ সুরভী রানী?”

“ভালো আছি। তবে আপনি গেলে আরো ভালো থাকব। কোনো মানা শুনবো না যেতেই হবে। কত দিন পর দেখা হলো বলেন তো। সেই যে স্কুল ছাড়লেন তারপর তো আর দেখলামই না।”

ওদের কথার মাঝে সিদ্ধান্ত’র গাড়ি এসে থামল। পর পর তিনটে গাড়ি। নিজের সুরক্ষার বিষয়ে সে খুবই সচেতন। নির্বা এক পাও এগোলো না। সুরভী পুনরায় শাহানকে বলে এগিয়ে গেল। সাথে নিশুও গেল। নির্বার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এই প্রথম তার দুটি প্রিয় মানুষ একসাথে। সে যেন অনুভূতি হারিয়ে ফেলল। কিশোরী হৃদয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। অনুভূতি এমন কেন?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**শুরুতেই বলেছি এটা ব্যতিক্রম লেখা। সেই মানুষগুলোকে নিয়ে লেখা যারা একই সাথে একাধিক মানুষের মোহে পড়ে থাকে যা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here