এক বুক ভালোবাসা পর্ব -০১

#আইরাত_বিনতে_হিমি
#এক_বুক_ভালোবাসা
#পর্বঃ০১

কিশোরী কন‍্যা লাল বেনারসি পড়ে চোখ বন্ধ করে দুহাত দিয়ে শাড়ি খামচে ট্রেন লাইনের সামনে দাড়িয়ে আছে। সামনে ট্রেন সাইরেন বাজিয়ে ঝকঝক শব্দ করে তার দিকে আসছে। মেয়েটির মুখে মলিনতা মনে বিষন্নতা। বুকের মধ‍্যে উঠেছে উত্থাল ঢেউ। ভেতর থেকে কেউ যেনো বার বার বলছে তোর বাঁচার অধিকার নেয়। কোনো অধিকার নেয়। এই সমাজ তোকে বাঁচতে দিবে না। ট্রেনের ভেতরে চালক চেয়েও ট্রেন থামাতে পারছে না। অনেক মানুষ হাত দিয়ে ইশারা করে মেয়েটিকে সরে যেতে বলছে। কিন্তু মেয়েটি এই দুনিয়ায় নেয়। মেয়েটির খুব কাছাকাছি ট্রেনের অবস্থান। যেকোনো সময় ধাক্কা লাগবে। সব শেষ হবে। চিরতরের জন‍্য দুনিয়া অন্ধকার হবে। মেয়েটি মনে মনে একবার
” লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ ”
টা পড়ে নিলো। শেষবারের মতো আল্লাহর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিলো। কিন্তু মেইন স্পটে মেয়েটিকে একটি ছেলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কিশোরী কন‍্যা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। সাইট দিয়ে জোরে আওয়াজ করে ট্রেন চলে যাচ্ছে। ট্রেনের হাওয়ায় মেয়েটির এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে। ছেলেটি মেয়েটির কোমড়ে দুহাত রেখে তাকে আগলে ধরে আছে। আর মেয়েটি ছেলেটির শার্ট খামচে ধরে আছে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও কোনো কিছু না হওয়া মেয়েটি মনে মনে বলে,

– আমি কি এখনো মরিনি। কি হলো ট্রেনের আওয়াজ তো আর আসছে না।

তাই মেয়েটি ঝট করে চোখ মেলে তাকায়। তাকিয়ে দেখে সুন্দর গড়নের এক পুরুষ তাকে ধরে দাড়িয়ে আছে। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চোখ দুটো লার বর্ণ ধারণ করেছে। নাকের ঢগায় ইষৎ ঘামের দেখা মিলেছে। গালে খোচা খোচা দাড়ীর আবিষ্কার হয়েছে। মেয়েটিকে এইভাবে তাকাতে দেখে ছেলেটি কিশোরী কন‍্যাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। চিৎকার করে রাগী স্বরে বলে,

– আর ইউ মেড। পাগল হয়ে গেছেন নাকি। এইভাবে কেউ ট্রেনের সামনে দাড়িয়ে থাকে। কি সমস্যা। মরার পাকনা গজিয়েছি নাকি। স্টুপিট গার্ল।

মেয়েটি ইষৎ হেসে মলিন কন্ঠে বলে,

– বাঁচার জন‍্য নিশ্চয় কেউ চলন্ত ট্রেনের সামনে দাড়ায় না।

ছেলেটি এইবার আরও রেগে যায়। মেয়েটির দিকে তেড়ে এসে বলে,

– জীবনের মায়া নেয়। এতোই মরার শখ নাকি। এইটুকু মেয়ে জীবনের কি বুঝো। যে মরতে আসছো। এখনো নাক টিপলে দুধ বেড়োবে আর সে আসছে মরতে।

– তো কি করব শুনি। এই নোংরা সমাজে বেঁচে থাকবো। কার জন‍্য বেঁচে থাকব আমার তো কেউ নেয়।

কথাগুলো বলতে গিয়ে মেয়েটির গলা ধরে আসে। এতে ছেলেটির একটু মায়া হয়। সে নিজেকে একটু শান্ত করে বলে,

– সরি আমি বেশি রিয়াক্ট করে ফেলছি। কিন্তু আমি কি জানতে পারি এইভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে কেনো উদয় হলো।

কিশোরী কন‍্যা এইবার ট্রেন লাইনের পাশে ঘাসের রাস্তায় ধপ করে বসে পড়ে। পাদুটো সামনে দিয়ে তার উপরে দুহাত রেখে বসে আছে। যেনো কিছুই হয়নি। কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। ছেলেটি বুঝলো মেয়েটি কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। মানসিক যন্ত্রণায় আছে। তাই সেও মেয়েটির পাশে বসে পড়লো। ছেলেটির বয়স বেশি না। সদ‍্য যৌবনে পা দিয়েছে। আশেপাশে কেউ নেয়। একদম নিস্তব্ধ একটা পরিবেশ। মেয়েটি ছেলেটির দিকে না তাকিয়ে বললো,

– পড়ের ট্রেন কখন আসবে? তুমি কি জানো?

মেয়েটির এমন কথায় ছেলেটি ভরকে গেলো। মনে মনে বললো,

– এখনো মরার চিন্তা করছে। একে স্বাভাবিক করতে হবে।

তাই সে মেয়েটিকে বলে,

– তুমি কি এই এলাকায় থাক?

– নাহ তো।

– তাহলে এখানে কি করছো।

মেয়েটির সোজাসাপ্টা উত্তর

– মরতে এসেছি।

ছেলেটি একটু হেসে বলে,

– তুমি কি বিষ খেতে ভয় পাও। বা পানিতে ঝাপ দিতে। গলায় ছুরি বসাতে। গাড়ির নিচে পড়তে।

মেয়েটি এইবার ছেলেটির দিকে ঘুরে একটা হাতের শাহাদাত আঙুল উঁচু করে বলে,

– কি সমস্যা তোমার। আমার কষ্টে তোমার হাসি পাচ্ছে। মজা নিচ্ছো। যাও এখান থেকে।

– এই এই না না মজা নিচ্ছি না। প্লিজ রাগ করো না। আসলে তুমি এতগুলো পথ রেখে ট্রেনের নিচে পড়ে মরতে চায়ছো তো তাই আর কি।

– আমার ইচ্ছে তাই।

– ওহ।

তারপর কেটে যায় অনেকক্ষণ। কোনো শব্দ নেয়। কোনো কথা নেয়। দুজনের মধ‍্যেই চলে পিনপতন নিরবতা । ছেলেটি এইবার গলাটা একটু ঝেড়ে বলে,

– তুমি কি পড়ের ট্রেনের জন‍্য অপেক্ষা করতে চায়ছো?

মেয়েটি কিছু বলে না। শুধু বিরুক্তি নিয়ে ছেলেটির দিকে একবার তাকায়। ছেলেটি মুখ টিপে হেসে বলে,

– আচ্ছা ট্রেন আসতে আরও অনেক দেড়ি। তার আগে একটু চল না ঘুরে আসি। ঐ দিকে শুনেছি নদীর পার। আমি ঐখানে যাওয়ার জন‍্যই এসেছিলাম। কিন্তু যাওয়া হলো না।

মেয়েটি বিরুক্তি নিয়ে বলে,

– তোমাকে ধরে রাখছে কে?

– নাহ আসলে। তুমি এখানে একা বসে থাকবে। তার থেকে চলো একটু ঘুরে আসি। কিছুক্ষণ পর তো মরেই যাবে। তার আগে লাইফটা একটু ইনজয় করে নাও। দেখো আমি কথা দিচ্ছি ট্রেন চলে আসার আগে তোমায় আমি এইখানে নিয়ে আসবো।

মেয়েটি কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর উঠে দাড়ায়। ছেলেটি দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বলে,

– যাবে?

– চলো।

ছেলেটি আর মেয়েটি পাশাপাপাশি হাঁটছে। কারো মুখে কথা নেয়। নিরবতায় ভোরপুর চারপাশ। হঠাৎ নিরবতা ছিন্ন করে মেয়েটি বলে,

– তুমি কি এই গ্রামের?

মেয়েটির কথা বলার ইচ্ছে দেখে ছেলেটি হাসে। সে বলে,

– নাহ।

মেয়েটি দাড়িয়ে পড়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,

– তাহলে এইখানে কি করো?

– কাউকে বাঁচানো মানুষটা নিশ্চয় এইখানে কাউকে খুন করতে আসবে না।

– সোজাসাপ্টা বলো?

– এইখানে ফোটোসুট করতে এসেছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি। প্রতি মাসেই কলেজ ছুটির ফাকে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ছবি তুলি। ছবি তুলা টা আমার শখ বলতে পারো। এইখানে শুনেছি ইচ্ছামতি নদীর পাড়টা খুব সুন্দর। তাই এসেছি ছবি তুলতে। কিন্তু পথেই তোমার সাথে দেখা। আচ্ছা তোমার নাম কি?

মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে বলে,

– পূর্ণা।

পূর্ণা। মনে মনে দুবার উচ্চারণ করে নামটি ছেলেটা। তারপর হেসে বলে,

– খুব সুন্দর নাম।

পূর্ণা হাতে একটা লাঠি নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলে,

– তোমার নাম কি?

পূর্ণার আগ্রহ দেখে ছেলেটির ভালো লাগে। সে গলায় ঝুলে থাকা ক‍্যামেরাটা অন করে বলে,

– কৌশিক।

এরপর আর কোনো কথা হয় না। কৌশিক প্রকৃতির ছবি তুলতে ব‍্যস্ত হয়ে যায়। আর পূর্ণা সে অন‍্যমনস্ক হয়ে হাটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তারা নদীর পাড়ে এসে পৌছায়। নদীর পাড়ের হাওয়ায় পূর্ণার ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো উড়ছে। কি সুন্দর হাওয়া। শীতল হাওয়া। মন ছুয়ে যাচ্ছে পূর্ণার। মনের বিষাদটা একটু কম কম অনুভূত হচ্ছে। এইদিকে তেমন কেউ নেয়। তাই পূর্ণা দৌড়ে নদীর স্বচ্ছ পানির কাছে গিয়ে নিজের পা ভেজায়। পূর্ণার পায়ে জুতো নেয়। সে খালি পায়ে পানিতে পা রেখেছে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করছে। আর এইদিকে ক‍ৌশিক ছবি তোলায় ব‍্যস্ত। ছবি তোলার এক পর্যায়ে তার ক‍্যামেরা একটি মেয়ের দিকে আটকে যায়। সে ক‍‍্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়। দেখে পূর্ণার হাস‍্যজ্জৌল চেহারা। সে প্রকৃতির সাথে খেলা করছে। পূর্ণার গায়ে লাল বেনারসি। তবে মুখে কোনো কৃত্তিম সাজ নেয়। ঠোটে লিপস্টিক না থাকলেও। দেখে মনে হচ্ছে রক্ত রঞ্জিত ওষ্ঠদ্বয়। চোখে মেঘের কাজল পড়া। লাল ওষ্ঠের কিঞ্চিয় নিচে অবস্থান করছে কালো রঙের একটা তিল। ধবধবে সাদা পূর্ণা। ঘন কালো রেশমি চুল তার। কোমড় ছোয়া সেই চুল। সেই চুলগুলো বাতাসের সাথে তার মিলিয়ে উড়ছে। মারাত্মক সুন্দরী পূর্ণা। যে কেউ এক দেখায় তার রূপের প্রেমে পড়ে যাবে। কাছে পেতে চাইবে। কৌশিক পূর্ণাকে দেখে মৌহে আটকে যায়। এতক্ষণ মেয়েটাকে লক্ষ না করলেও এখন বেশ করছে। কিন্তু পরক্ষণেই কৌশিকের কি যেনো মনে হয়। সে মনে মনে বলে,

– না কৌশিক। মেয়েটি বিপদগ্রস্ত। আগে জানতে হবে সে কেনো নিজেকে শেষ করতে চায়। তাছাড়া পর নারীকে নিয়ে ভাবা পাব।

কৌশিক অন‍্যদিকে মনোযোগ দেয়। আর পূর্ণা এত চেয়েও নিজের ভেতরে কিশোরী আত্নাকে দূরে ঢেলে রাখতে পারলো না। মনের ভেতরে এত দুশ্চিন্তা থাকার পরও সে। পানির সাথে খেলা করছে। লাল বেনারসি টা অর্ধেক পানিতে ভিজে গিয়েছে। তবে সেইদিকে তার হুশ নেয়। সে আপন মনে পানির সাথে খেলা করছে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে,

– এত সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত রেখে কেউ মরতে চায়।

পূর্ণা ভ্রু কুচকে পেছনে তাকায় দেখে কৌশিক। এত কিছুর মধ‍্যে সে ভুলেই গিয়েছিল কৌশিক আছে তার সাথে। আর সে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। পূর্ণা কুচকানো ভ্রু নিয়ে বলে,

– কি বলতে চাও?

কৌশিক পূর্ণার হাত ধরে পানি থেকে উপড়ে নিয়ে আসে। তারপর বলে,

– দেখো পূর্ণা। আমি জানি না তুমি কেন মরতে চায়ছো। কিন্তু পূর্ণা তুমি একবার ভেবে দেখছো মৃত্যু ই কি সবকিছুর সমাধান। আচ্ছা যার জন‍্য বা যেই কারণে তুমি মরতে চায়ছো। তুমি মরলে কি তার সমাধান হবে। বা সেই লোকটার শাস্তি হবে। পূর্ণা জীবন ছেলেখেলা নয়। আমাকে দেখো বাসায় থেকে রাগারাগী করে আসছি। আম্মু রাগ করে বলছে তুই মর। তাই বলে কি আমি মরে যাব। না। কারণ আমি মরলে সেই বেশি কষ্ট পাবে যেই আম্মু আমাকে মরতে বলছে। বুঝছো। আল্লাহ্ এত সুন্দর দুনিয়াটা আমাদের দেখতে পাঠিয়েছেন এমনটা না। এই দুনিয়াতে আমাদের কষ্ট করে বেঁচে থাকতে পাঠিয়েছেন। নিজের অনুভূতি নিজের চোখ সবকিছু সুন্দর করে এই দুনিয়াটাকে দেখতে বলেছে। খারাপ অধ‍্যায় পেছনে ফেলে ভালো অধ‍্যায় তৈরি করতে বলেছে। এই দুনিয়াতে খারাপ মানুষ আছে বলে যে ভালো মানুষ নেয় সেটা ভাবা ভুল। দেখো পূর্ণা আমি তোমার জীবনের ঘটিত ঘটনা জানতে চায়ব না। শুধু বলবো নিজেকে শেষ করার আগে যার জন‍্য তুমি এই পৃথিবীর মুখ দেখছো তার কথা ভাব। আত্মহত্যা কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। এই মৃত্যুতে না আছে পৃথিবীতে শান্তি না আছে আখিরাতে শান্তি। তুমি মরে গিয়েও শান্তি পাবে না। আল্লাহ্ আত্মহত্যাকারীরকে কখনো শান্তি দেয় না। তাকে কখনোই ক্ষমা করেন না। এখন তোমার সিদ্ধান্ত। বেঁচে থেকে জীবন উপভোগ করবে নাকি মরে গিয়ে আল্লাহর শাস্তি পাবে। নাও ইউর ডিসিশন।

এই কথা বলে কৌশিক চুপ হয়ে যায়। আর পূর্ণা বালিময় নদীর পাড়ে ধপ করে বসে পড়ে। মনে মনে নানান কথা চিন্তা করে। কি করবে সে। কৌশিক তো ভুল কিছু বলেনি। ছোট বেলায় আম্মা বলছিলো আত্মহত্যা মহাপাপ।আজ কিনা সেই আত্মহত্যার মতো বড় কাজই সে করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু মরা ছাড়া তো তার কোনো উপায় নেয়। এই পৃথিবীতে তো তার কেউ নেয়। এখানে সে কার কাছে থাকবে। জীবনের এই খেলায় কম কিছু তো সে দেখলো না। সবাই তো সুযোগ লুটতে চায়। জীবন দিয়ে যাকে ভালোবাসলো সেও ধোঁকা দিতে দুবার ভাবলো না। সবাই স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ নিয়ে সবাই ভাবে। এই স্বার্থের দুনিয়ায় সে ভীষণ একা। কি করে নিজের ভীত মজবুত করবে। পূর্ণার বেশ ক্লান্ত লাগছে। মন মস্তিষ্কে এখন শুধু একটা কথায় বাজছে। নিজেকে শেষ করে দিস না পূর্ণা। জীবনের এই যুদ্ধে তোকে লড়াই করেই হবে। এসেছিস একা যাবিও একা। তাহলে খনিকের সময়ের জন‍্য কেন কাউকে পাশে চাচ্ছিস। যেই জায়গায় আমরা একা জন্মালাম আর একা মরবো সেই জায়গায় জীবনে বাঁচার জন‍্য কারো আশা করাটা বোকামি না। পূর্ণার গলা শুকিয়ে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা মিলছে। পূর্ণার শরীর মৃদ কাপছে। অস্থির লাগছে। কেউ গলা অবধি চেপে ধরে আছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। বুকের মধ‍্যে ধরাস ধরাস আওয়াজ হচ্ছে। পূর্ণার এমন হাল দেখে কৌশিক তার পাশে বসে পড়ে।পূর্ণার হাতে হাত রেখে বিচলিত কন্ঠে বলে,

– পূর্ণা কষ্ট হচ্ছে। পানি খাবে। পানি দেবো। দাড়াও আমি পানি নিয়ে আসছি।

কথাটা বলে কৌশিক দৌড়ে তার ব‍্যাগের কাছে যায়। যেখানে সে বোতলে করে পানি নিয়ে আসছে। আর পূর্ণা গভীর দৃষ্টিতে কৌশিককে দেখে। আজ অবধি কেউ পূর্ণার জন‍্য এতটা বিচলিত হয়নি। সবাই শুধু কথা শুনিয়েছে। অবজ্ঞা করেছে। ময়লা-আবর্জনা ভেবে ডাস্টবিনে ফেলেছে। আজ কেউ সেই ময়লা আবর্জনার কদর করছে। পূর্ণার দৃষ্টি স্থির। কৌশিক এসে পূর্ণার হাতে পানির বোতল দিলে। পূর্ণা ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি শেষ করে ফেলে। তারপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আমি বাঁচতে চায় কৌশিক।

কৌশিক মৃদ হাসলো। তারমানে কথাগুলো কাজে দিয়েছে। কৌশিক বললো,

– এখন তাহলে কোথায় যেতে চায়ছো?

– জানি না।

কৌশিক ভ্রু কুচকে বলে,

– মানে।

পূর্ণা আকাশের দিকে তাকিয়ে ব‍্যথাতুর কন্ঠে বলে,

– আমার যে যাওয়ার জায়গা নেয়।

পূর্ণার কষ্ট দেখে কৌশিকের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। সে বলে,

– ঠিকাছে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আমাকে বিশ্বাস করো তো?

পূর্ণা কৌশিকের দিকে তাকায়। তারপর বলে,

– বুঝতেছি না।

কৌশিক আবারো হাসে। তারপর বলে,

– বিশ্বাস করলে আমার সাথে চলো।

– কোথায়?

– কোনো প্রশ্ন না। শুধু কিছু পথ চলা।

পূর্ণা অনেকক্ষণ চুপ থাকে। মনে তার ঝড় উঠেছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। জীবনে অনেক ঠকছে। আর ঠকতে চায় না। কি করবে সে। যাবে কৌশিকের সাথে। যে প্রাণ বাঁচায় সে কি কখনো খুন করতে পারে। আত্মহরণ করতে পারে। কি জানি হয়তো পারে। পৃথিবী তো রঙ্গমঞ্চ কম তো আর দেখলো না। কিশোরী মন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আসলে এই বয়সে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। কিন্তু এই মুহুর্তে রাস্তায় থাকাটাও তার জন‍্য মঙ্গলজনক হবে না। এর থেকে ভালো কৌশিকের সাথে যাক। দেখাই যাক ভাগ‍্য তাকে আর কি দেখায়। পূর্ণা উঠে দাড়ায়। চোখের পানি মুঝে বলে,

– চলো।

কৌশিত হইহই করে বলে,

– তুমি যাবে পূর্ণা।

– উপায় তো নেয়।

পূর্ণা কৌশিক একসাথে হাঁটছে। অনেক দূর হাটার পর কৌশিক পূর্ণাকে বলে,

– আচ্ছা পূর্ণা কেউ যদি বলে আমরা সম্পর্কে কি হয়। তুমি কি বলবে?

কথাটা শোনার পর পূর্ণা ভাবনায় পড়ে যায়। আসলেই তো কৌশিকের সাথে তো তার কোনো সম্পর্ক নেয়। তাহলে পূর্ণা কি বলবে। পূর্ণাকে এইভাবে ভাবতে দেখে কৌশিক বলে,

– আমি উপায় পেয়েছি?

পূর্ণা উচ্ছুক কন্ঠে বলে,

– কি উপায়?

কৌশিক হাত বাড়িয়ে বলে,

– পূর্ণা বন্ধু হবে?

পূর্ণা এইবার কৌশিকের চোখের দিকে তাকায়। কৌশিক অনেক আশা নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়েছে। আর পূর্ণার ভেতরে বয়ে যাচ্ছে শীতল হাওয়া। এই প্রথম কেউ তার বন্ধু হতে চাইলো। ষোল বছরের এই জীবনে তার কোনো বন্ধু নেয়। ঘটনাটা হাস‍্যকর হলেও সত‍্যি। পূর্ণা ধরা গলায় বলে,

– তুমি সত‍্যি আমার বন্ধু হতে চাও।

– হ‍্যা পূর্ণা। তোমার মতো বন্ধু পেলে আমার জীবন ধ‍ন‍্য হবে।

পূর্ণা আর কিছু ভাবে না। সে কৌশিকের হাতের সাথে নিজের চিকন মসৃণ সাদা হাতটা মিলিয়ে দেয়। কৌশিক রাজ‍্য জয়ের হাসি দেয়। কৌশিকের সাথে পূর্ণাও হাসছে। এই প্রথম কৌশিক পূর্ণাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলো। সে পূর্ণার হাত ধরে হাটতে হাটতে বললো,

– বুঝলি পূর্ণ এখন থেকে আমরা বন্ধু। তাই আমি তোকে তুই করে বলবো আর তুই আমাকে তুই করে বলবি ঠিকাছে।

পূর্ণা মাথা নাড়িয়ে বলে,

– ঠিকাছে।

– আর একটা কথা শোন আমাদের বন্ধুত্বের কমিটমেন্ট হলো আমরা কখনো কাউকে ভুল বুঝবো না। ছেড়ে যাব না। বিশ্বাস রাখবো। বুঝলি।

পূর্ণা খিলখিল করে হাসছে। পূর্ণার হাসি দেখে কৌশিক রাগী চোখে বলে,

– একি তুই হাসছিস।

– কৌশিক তুই হলো তরল পর্দাথের মতো। যেই পাত্রে ঢালবো সেই আকার ধারন করবি। একটু আগে তুই ছিলি প্রাণরক্ষক। তারপর হলি বিজ্ঞ। আর এখন একজন ভালো বন্ধু।

এইবার কৌশিকও খিলখিল করে হেসে দেয়। তারপর বলে,

– তুই তো বেনারসি পড়া। এই অবস্থায় তুই যদি আমার বাইকের পেছনে উঠিস। তো যে কেউ ভাববে আমি তোকে বিয়ের আসর থেকে ভাগিয়ে আনসি। কিন্তু এইটা হলে তো চলবে না। শোন পূর্ণা সামনে একটা মল আছে আমি তোর জন‍্য একটা বোরকা কিনে নিয়ে আসি। ততক্ষণ তুই আমার বাইক পাহারা দে।

পূর্ণা প্রজাদের মতো হাতটা সামনে এনে ঝুকে বলে,

– ওকে জাহাপনা।

কৌশিক হাসে। হাসতে হাসতে সে চলে যায়। তার সাথে তাল মিলিয়ে পূর্ণাও হাসে। হঠাৎ হাসির মাঝে পূর্ণার মুখে মেঘলা আকাশ ভর করে। মনের মধ‍্যে অজানা ভয় জেকে বসে। কৌশিককে এতটা বিশ্বাস করা কি ঠিক হচ্ছে। তবে পূর্ণার এই মুহুর্তে কৌশিককে খুব ভালো লাগছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। একটা মানুষ খারাপ হলে কখনো কি কাউকে হাসাতে পারে। কিন্তু কৌশিক পারে। যে লোকটা আমার জন‍্য এতকিছু করছে আমি তাকে ভুল বুঝবো না।

কৌশিক পূর্ণার জন‍্য হাতে করে একটা বোরকা নিয়ে আসে। পূর্ণা বোরকা পড়ে। মুখে নিকাব পড়ে। কৌশিকের বাইকে উঠে পড়ে। কৌশিকও বাইক স্টার্ড দেয়। কৌশিক বলে,

– পূর্ণা ধরে বস। নাহলে পড়ে যাবি।

কিন্তু পূর্ণা সংকোচ বোধ করে। হাজারো জড়তা সংকোচ নিয়ে সে কৌশিকের কাধে হাত রাখে। কৌশিক স্পিড তুলে বাইক চালায়। বাইকটা হাইওয়ে রোডে উঠেছে। নিকাবের বাইরে কিছু চুল এসে বারি খাচ্ছে পূর্ণার মুখে। পূর্ণা খুব বিরক্তবোধ করছে। অনেকটা পথ আশার পর কৌশিক বাইক থামায়। তারপর বলে,

– নাম পূর্ণা। এখানের রেস্তোরাঁয় একটু খেয়ে নেয়।

পূর্ণা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে। দুপুর নেমে বিকেল হয়েছে। সূর্যটার এখন আর তেমন তেজ নেয়। সূর্যটা জানান দিচ্ছে কিছুক্ষণ পর সন্ধ‍্যা নামবে। পূর্ণা ঘেমে একাকার। খিদেও পেয়েছে একটু। কিন্তু এখানে পূর্ণার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই পূর্ণা বলে,

– পড়ে খায়। আগে তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি সেখানে নিয়ে যা।

কৌশিক মাথার হেলমেট খুলে বলে,

– কিন্তু আমার তো ক্ষুদা লাগছে।

পূর্ণা অনুনয় করে বলে,

– প্লিজ কৌশিক এই পরিবেশটা আমার ভালো লাগছে না।

কৌশিক পূর্ণার মনের কথা বুঝতে পারে। সে এখানে অসস্তি ফিল করছে। তাই সে বলে,

– ওকে চল। না খেলাম। বন্ধুর জন‍্য এতটুকু খিদে সহ‍্য করতে পারবো আমি।

এই কথা বলে কৌশিক আবারো বাইক স্টার্ড দেয়। পূর্ণা হাসে। মনে মনে বলে,

– বাহ খুব তো বুঝে গেলো আমার মন কি চায়। কৌশিক তুই বিচিত্র। সবাই মন পড়তে পারে না। তুই পারিস। সত‍্যি তুই বন্ধু হিসেবে অনন‍্য।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here