#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৬
✨কাহিনীর আসল মোড়✨
ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছে স্পৃহা। পেপারের তৃতীয় পৃষ্ঠার শেষাংশে মোটা কলমে ‘আদ্র ইশরাক’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। হাত থেকে আলগা হয়ে কাগজগুলো ফ্লোরে পড়ে গেল। আদ্র ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে? কী করে পারলো ও এটা করতে? আদ্র-ও মিথ্যে ছিল তাহলে? ওর বলা সব প্রতিশ্রুতিগুলো মিথ্যে ছিল! অনুভূতিহীন যন্ত্রের মতো বসে আছে স্পৃহা।
স্পন্দন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-বলেছিলাম না ও একটা ব্যক্তিত্বহীন ছেলে! নিজের মাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। বাবার পছন্দের ওপর সবসময়ই আমার ডাউট থাকে। উনি মানুষ চিনতেই পারেননি।
বলেই স্পৃহার দিকে তাকালো স্পন্দন। স্পৃহাকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে বললো,
-ঐ আদ্রের জন্য একদম কষ্ট পাবি না তুই! ওর কাছে নিজের পরিবারটা-ই সবার আগে। সেটা না হয় মেনেই নিলাম। কিন্তু তোর অপূর্ণতা-টা ওর কাছে এতোটাই বড় হয়ে গেছে যে, তোকে ছেড়ে দিতেও ওর বাঁধে নি। একবার বললেই পারতো, ‘ভাইয়া, যা হওয়ার হয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি স্পৃহার পাশে সবসময় থাকবো। ওকে আর কষ্ট পেতে দিবো না।’ আদ্র যদি আমায় এভাবে একবার বলতো আমি সত্যিই মেনে নিতাম। তোকে যেতে দিতাম ওর সাথে। আমার বোনের সংসার ভাঙুক, এটা আমি কখনোই চাইনি! কিন্তু ও তো এসব কিছুই বললো না। উল্টো কী বললো? তার নাকি সময় লাগবে! ও তোকে কোনোদিন-ই ভালোবাসেনি, পিহু। যদি বাসতোই, তাহলে এই দুঃসময়ে তোর হাত এভাবে ছেড়ে দিতো না। তোকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করতে পারতো না! জাস্ট শেইম অন দিস কাইন্ড অফ পারসন!!
স্পন্দনের বলা এতো লম্বা বক্তব্য স্পৃহার কানে ঢুকেও ঢুকলো না যেন! এখনো নড়চড় হীন ভাবে বসে আছে ও। হলদেটে ফ্যাকাসে মুখটার উপরিভাগে থাকা বিস্তৃত অক্ষিদ্বয়ের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে কোনো অজ্ঞান লক্ষ্যের পানে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। আদ্র শুধু মাত্র ওর অপূর্ণতার কথা ভেবেই ওকে ছেড়ে দিলো? কারন এটাই যে, ও কখনো মা হতে পারবে না! মাতৃত্ব আজ আদ্রের কাছে এতো বড় হবে গেল যে, এর জন্য নিজের দেওয়া কথাগুলোও ভুলে গেল! বিশ্বাস ভাঙ্গার সাথে সাথে স্পৃহার পুরো পৃথিবীটাই উল্টেপাল্টে দিল। আহিরের মতো আদ্রও কি আবার নতুন করে নিজের জীবন সাজাবে? ভুলে যাবে স্পৃহা নামক মানবীর কথা? মানুষ কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি কাউকে ভুলে যেতে পারে? স্থবিরতা বজায় রেখেই শুকনো ওষ্ঠ দ্বয় নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে স্পৃহা বললো,
-আবার ঠকে গেলাম আমি! আবার!! মানুষ কীভাবে এতো স্বার্থপর হতে পারে, ভাইয়া?
স্পন্দন চোখ তুলে স্পৃহার মুর্তিবৎ মুখশ্রীর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-মানুষের ধর্মটাই এমন! ঠকাতেই তারা বেশি ভালোবাসে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটা ভেঙে দিতে মানুষের বাঁধে না। আর যাকে ঠকাবে, তার মুখোমুখি হতেও ভয় পায়। এই যে, আদ্রকে দেখ। তিনদিন সময় নিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে হসপিটালে পাঠিয়ে দিল! কিন্তু তোর সামনে এসে দাড়ানোর সাহস পেল না।
স্পৃহা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলো। কাঁদতে অনেক ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু কান্নাও আজ তার সাথে শত্রুতা করছে যেন। এক ফোঁটা পানিও চোখে আসতে চাইছে না। কোথাও আঁটকে গেছে তারা! ঠিক সেভাবেই আঁটকে গেছে, যেভাবে থেমে গেছে স্পৃহার জীবনটাও। তবুও কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে! খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে! প্রচন্ড রকমের অসহনীয়, অসহ্যকর সে কষ্ট। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন! একটু কাঁদলে কি এই কষ্ট থেকে কিছুটা পরিত্রাতা পাবে স্পৃহা? হয়তো হ্যাঁ! হয়তো বা নয়! কিন্তু এই আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করার সামর্থ্য ও ইচ্ছে, কোনোটাই স্পৃহার নেই।
_________________________
টানা দশদিন হাসপাতালে কাটিয়ে আজ ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে স্পৃহাকে। স্পন্দন হাসপাতাল থেকে সরাসরি নিজের বাড়িতেই নিয়ে এসেছে বোনকে। স্পন্দনের মা-বাবার কিছু বলার মুখ নেই। কিন্তু স্পৃহার ফুপু অনুপমা কারো ধার ধারেন না। আর স্পৃহার ব্যাপারে তার বিরক্তিটা একটু বেশিই। তাই কোনো রকম ভণিতা না করেই সরাসরি বলে ফেললেন তিনি,
-আমি জানতাম, এই মেয়ের দ্বারা সংসার হবে না। সাধে কি আমি ওকে অপয়া বলি? দেখলি তো! বাচ্চাটাকে তো খেলোও! সাথে সংসারটাও গেলো! এখন না আবার কোনোদিন মা-ও হ……
-জাস্ট শাট আপ!
স্পন্দনের ধমকে সবাই কেঁপে উঠলো। অনুপমাও থেমে মুখ বাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্পৃহা কিছু না বলে ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে ওর! এ বাড়িতে থাকলে এই সমাজ ওকে বাঁচতে দেবে না। রোজ রোজ-ই লোকে আঙুল তুলে ওকে কথা শোনাবে। যখন ঘরের মানুষ-ই অপয়া, ডিভোর্সি, অলক্ষ্মী এসব বলতে পারে, তাহলে বাইরের মানুষ থেমে থাকবে কেন?
স্পৃহা চলে যেতেই স্পন্দন অনুপমাকে উদ্দেশ্য করে রাগী স্বরে বললো,
-কী সমস্যা তোমার, মনি? বলতে পারো? মেয়েটার মানসিক অবস্থা এমনিতেই ঠিক নেই! তার ওপর এসব কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না?
অনুপমা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-যেটা সত্যি, সেটাই তো বলেছি! এখানে বিবেকে বাধার কী আছে?
স্পন্দন হাতে হাত ভাজ করে বললো,
-আচ্ছা? তাহলে আমিও কিছু সত্যি কথা বললে তোমার ভালো লাগবে তো?
অনুপমা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-কী বলতে চাইছিস তুই?
-জাস্ট তোমায় কিছু সত্যি মনে করিয়ে দিতে চাই। তোমার বিয়ের পর ফুপাও কিন্তু তোমায় পছন্দ করতেন না, মনি। এজন্যই বাবার কাছে তুমি বছরের বেশিরভাগ সময় কাটাতে। আর ফুপার মৃত্যুর পর তোমার একমাত্র ছেলেও তোমায় ত্যাগ করেছে এন্ড এখনো তুমি আমাদের বাড়িতেই পড়ে আছো। সুতরাং সত্যিটা এটাই যে, সংসার কিন্তু তোমার কপালেও জোটেনি। সো, পিহুকে কিছু বলার আগে নিজের দিকটা একবার ভেবে নিও!
অপ্রিয় সত্য গুলো অনুপমার গায়ে কাটার মতো বিধলো যেন! তিনি মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্পন্দন সেটা দেখে মৃদু হেসে ভেতরে চলে গেল।
____________________________
নিকষ কালো আকাশটা আজ অনেক ভার হয়ে আছে। তার বুকেই আবার থালার মতো মস্ত বড়ো এক চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জমাট বেঁধে চলা কালো মেঘ গুলো বারবার ঢেকে দিচ্ছে তার সেই উজ্জ্বল সত্তাটিকে। আবৃতকরণে বারংবার ব্যর্থ হলেও অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রকৃতিতে বয়ে চলে মৃদুমন্দ হাওয়া। মাঝে মাঝে দমকা হওয়ায় ও রূপ নিচ্ছে তারা।
খাটে হেলান দিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে এসবই পর্যবেক্ষণ করছে স্পৃহা। মাঝে মাঝে প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছে হয় তার। এই প্রকৃতির এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির প্রতিটি সত্তা-ই বাস্তব, আর মানুষের জীবনের একেকটি দিককে ইঙ্গিত করে।
হঠাৎ বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হতে থাকায় চিন্তাজগতে ভাটা পড়লো স্পৃহার। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা চোখে পড়লো ওর। ‘Adro’ নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে দাঁতে দাঁত খিঁচে বসে রইলো স্পৃহা। কলটা কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাআপনি-ই কেটে যেতেই স্পৃহা জোরে একটা শ্বাস নিলো। ফোনের ব্যাক পার্টটা খুলে সিমকার্ডটা বের করে ফেললো এবং দুই আঙুল দিয়ে ভেঙেও ফেললো। ঝামটা মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো যোগাযোগের মাধ্যমটাকে। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভাবলো,
-মানবমন বড়ই বৈচিত্র্যময়! কখন সেখানে কোন ইচ্ছে জাগে, তা বোঝা দুষ্কর।
স্পন্দন ভেতরে ঢুকতেই স্পৃহাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে কিছু বলতে চেয়েও বললো না। স্পৃহার হঠাৎ চুপ করে যাওয়াটা ভাবাচ্ছে ওকে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সেটা একটুও প্রকাশ করছে না। একবারও কাঁদতে দেখলো না স্পৃহাকে। মেয়েটা কষ্টের কারণে কোনো ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবে না তো!
ভাবতে ভাবতেই চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল স্পন্দন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, কাল ওর কোনো বোনকে নিয়ে আসবে স্পৃহার সাথে রাখার জন্য। আজকের রাতটা নজরে নজরে রাখবে স্পৃহাকে। ভাবতে ভাবতে কখন নিজেই ঘুমিয়ে গেল টেরই পেল না স্পন্দন। ঘুম একটু কাটতেই লাফিয়ে বসে পড়লো স্পন্দন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত একটা বাজে। বেশিক্ষণ ঘুমায়নি সে। ভেবেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু স্বস্তিটা বেশিক্ষণ স্হায়ী হলো না। স্পৃহার ঘরে গিয়েই দেখলো, ঘরটা ফাঁকা। নিজেকে নিজেই গালি দিতে দিতে বললো,
-ওহ্ শিট! যেটার ভয় পাচ্ছিলাম, সেটাই হলো!
এদিকে,
এলোমেলো পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো স্পৃহা। ভেতরের ঘা গুলো এখন তাজা হয়েছে উঠেছে যেন! ঐ বদ্ধ ঘরে নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে ওর। বাইরের মুক্ত বাতাস অনুভূত হতেই হালকা লাগছে এখন। দমকা হাওয়ার তোড়ে ভেতরে জমে থাকা কষ্ট গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। হাত দিয়ে সেগুলো মুছতেও ইচ্ছে করছে না। কেন জীবনটা এতো এলোমেলো হয়ে গেল তার? ভালোবেসে, বিশ্বাস করার শাস্তিটা কি এতোই বসে?
উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ কেউ স্পৃহার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো। স্পৃহা টাল সামলাতে না পেরে তার বুকের ওপর পড়তেই তাদের পাশ ঘেঁষে শা শা করে কয়েকটা ট্রাক গেল। তীব্র গতিতে চলতে থাকা হৃদযন্ত্রের ধুপধাপ শব্দের পাশাপাশি স্পৃহা কানে ভেসে এলো ঝাঁঝালো পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
-হেই ইউ!! স্টুপিড গার্ল!! পাগল নাকি আপনি, হ্যা? এভাবে এই নীরব রাস্তায় এত রাতে একা একা হাঁটে কেউ? আমি না আসলে এতোক্ষণে আপনার অস্তিত্বও পাওয়া যেত না। মরতে এসেছেন এই রাস্তায়?
স্পৃহা কথাগুলো শুনেই মুখ তুলে তাকালো। ল্যাম্পপোস্টর ঝাপসা আলোয় চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচিত অবয়বটিকে অস্ফুটস্বরে বললো,
-প্ প্রণব মেহরাজ চৌধুরী ………
# চলবে…