#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৭
এতো দিন পর আদ্রকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে কিছুটা থমকে গেল স্পৃহা। পলক ফেলাও যেন ভুলে গেল মুহুর্তেই! আদ্রের মুখ নিঃসৃত বাক্য স্রোত কানে ভেসে আসতেই প্রকৃতস্থ হলো সে। সাথে সাথেই মাথায় এলো, আদ্র এখানে কী করছে? নিশ্চয়ই ওর সাথে দেখা করাটাই আদ্রের উদ্দেশ্য। আদ্রের অবাকতা মিশ্রিত চাহনি স্পৃহাকে স্পর্শ করতে পারলো না। মুখে ফুটে উঠলো কাঠিন্য আর চাহনি জুড়ে শুরু হলো তাচ্ছিল্যের বিচরণ। মুখ ঘুরিয়ে পুনরায় ভেতরের দিকে বড় বড় কদম ফেলে চলে গেল। পরিস্থিতির কারণে বাইরে যাওয়ার চিন্তাটা মস্তিষ্কতে আর ধরা দিলো না স্পৃহার।
স্পৃহার এমন তাচ্ছিল্য ভরা চাহনি দেখে আদ্র থমকালো। তার চেনা স্পৃহা তো এমন নয়! মানসিক ভাবে দৃঢ় হলেও এমন কঠিন মননের অধিকারিনী নয় সে। বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্পৃহার এগিয়ে চলা পৃষ্ঠদেশের দিকে।
আশফিকে কোলে নিয়ে আনিলার ঘর থেকে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নিচে আসতেই স্পৃহাকে ক্রোধান্বিত মুখে ভেতরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলো প্রণব। খানিকটা অবাক হয়েই বললো,
-আপনি না ক্লাসে যাচ্ছিলেন, মিসেস নিস্তব্ধতা? আবার ব্যাক করছেন কেন?
স্পৃহা কথাটা শুনলো কিনা সেটা ওর আচরণে ঠিক ধরতে পারলো না প্রণব। কারণ স্পৃহা ওর পাশ কাটিয়ে গটগট করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেছে। আশফি ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কিউট মাম্মা কি রেগে আছে, মিস্টার রকস্টার?
প্রণব ঠোঁট উল্টিয়ে না জানার মতো ফেস করে বললো,
-জানি না তো, চ্যাম্প! তোমার কিউট মাম্মার মনে কখন কী চলে সেটা বোঝা মুশকিল!
বলে সামনে তাকাতেই দরজার বাইরে আদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল প্রণব। মুখে হাসি ফুটে উঠলো ওর। কিন্তু আদ্রকে ওভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
-চলে এসেছিস! বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।
প্রণবের ডাকে খানিকটা চমকে উঠলো আদ্র। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরে প্রবেশ করলো। আদ্র সোফায় বসতেই প্রণবও ওর বিপরীতে আশফিকে কোলে নিয়ে বসে বললো,
-এতো ফর্মালিটি কেন দেখাস তুই? আমার বাসায় আসতে তোর প্রব্লেমটা কোথায়?
-তেমন কিছু না। জাস্ট কখনো আসিনি, তাই ……
-সো হোয়াট? কখনো আসিসনি বলে আর আসবি না নাকি? যাইহোক, কফি আনাবো নাকি চা?
আদ্র চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ওর ভাবনা জুড়ে শুধু স্পৃহা-ই ঘোরাঘুরি করছে। কোনোরকমে বললো,
-এখন কিন্তু তুই ফর্মালিটিস দেখাচ্ছিস!!
প্রণব হাসলো। বললো,
-কফি ছাড়া আড্ডাটা জমবে না। তুই বরং আমার ঘরে গিয়ে একটু বস। আমি আশফিকে নিয়ে একটু বাগানে যাবো। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো, ওকে?
আদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই প্রণব ওর রুমটা দেখিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ালো। আদ্রও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রণবের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু প্রণবের পাশের ঘর থেকে স্পৃহা বেরিয়ে আসতেই আবার মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় দুজনের। আদ্রের শীতল চাহনির মুখাবয়ব সামনে দেখতে পেয়েই বিরক্তি নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো স্পৃহা।
সাথে সাথেই আদ্র বলে উঠলো,
-তুমি এ বাড়িতে কী করছো, স্পৃহা?
স্পৃহা পা থামিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে একবার তাকিয়ে আবার এক পা এগোতেই আদ্র ওর হাতের কব্জি আঁকড়ে ধরলো। স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই আদ্র ওকে নিয়ে স্পৃহার ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
আদ্রের এমন কাজে স্পৃহার রাগের মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেল। ঝাড়া মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো আদ্রের মুঠো থেকে। আদ্র ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-আমার সাথে কি কথাও বলা যায় না, স্পৃহা? এমন কঠোর ব্যবহার করছো!! এভাবে আমায় এভয়েড করছো!!!
স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আদ্রের দিকে। ওর হলদেটে মুখটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-ঘৃণা হয় কথা বলতে। তাই এভয়েড করছিলাম।
আদ্র আহত দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে। স্পৃহার কথাটা ওকে আঘাত দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে শুধু নিজের দিকটাই বিবেচনা করলো সে। বললো,
-আমায় ঘৃণা করো তুমি?
-এছাড়া আর কোনো কিছু কি ডিজার্ভ করেন আপনি?
আদ্র খানিকটা অপমানিত বোধ করলেও কথাটা তেমন গায়ে মাখলো না। বললো,
-তোমার সাথে যোগাযোগ করার কত চেষ্টা করেছি আমি, জানো? ভার্সিটির গেটের সামনে রোজ দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু তোমাকে দেখতে পারিনি একদিনও।
বলতে বলতে স্পৃহার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর গাল স্পর্শ করতে নিলেই স্পৃহা ঝামটা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো। রক্তচক্ষু নিয়ে বললো,
-ছোঁবেন না আমায়। ডোন্ট এভার ডেয়ার টু টাচ মি!
বলেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল স্পৃহা। আদ্র হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । স্পৃহা চাপা চিৎকার দিয়ে বললো,
-আর কী যেন বলছিলেন? আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন! কেন চেয়েছিলেন? আমায় ঠকিয়ে, দুমড়ে-মুচড়ে দিতে ঠিক কতটা সফল হয়েছেন, সেটা দেখার জন্য?
আদ্র বললো,
-ডিভোর্সের পর তোমার সাথে তো আর কথা হয়নি আমার! তাই……
-তাই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কথা বলতে চাইছিলেন? বলতেন যে, ইউ ওয়্যার সর্যি ফর এভ্রিথিং! আপনি ভাবলেন কী করে এতো কিছুর পরও আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো? কথা বলবো? এতো সস্তা মনে হয় আমাকে আপনার?
স্পৃহার কড়া গলায় বলা কথা গুলো শুনে আদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। হতবিহ্বল কন্ঠে বললো,
-স্পৃহা, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো!
স্পৃহা তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-ভুল তো আমি আগেই বুঝেছি আপনাকে! জাস্ট সেটা উপলব্ধি করতে দেরী হয়ে গেছে আমার। আপনাকে নিজের সবটুকু দিয়ে বিশ্বাস করেছিলাম আমি, ভরসা করেছিলাম। আপনার প্রতি কতোটা শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভক্তি ছিল আমার, সেটা শুধু আমি জানি। কিন্তু আপনি তো সেটা কোনোদিন উপলব্ধি-ই করতে পারেননি! দিনশেষে কী করলেন? আপনার প্রতি আমার মনে আগলে রাখা শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাসটাকে অতি যত্নের সাথে ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন!! ভাগ্যিস, আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি আমি। নয়তো বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে যেত।
কথাগুলো মাথা নিচু করে শুনলেও শেষের কথাটা শুনে আদ্র মাথা তুলে তাকালো। অবাক কন্ঠে বললো,
-ভালোবাসতে পারোনি মানে? আমি তো তোমাকে ভা……
স্পৃহা আদ্রকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-অনুগ্রহ করে আপনার মুখ দিয়ে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা উচ্চারণ করে শব্দটার গায়ে কলঙ্ক লেপন করবেন না! আর আপনাকে ভালোবাসবে কীভাবে বলুন তো? আপনার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টির মতো কোনো কাজ করেছেন আপনি। আপনি তো নিজেই আমাকে ভালোবাসেননি কোনোদিন! কখনো আমার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন? আমার বিন্দু মাত্র খেয়াল রেখেছেন? সারাটা দিন আপনার বাড়িতে আমার দিন কেমন কাটে জানতে চেয়েছেন কোনোদিন? কোনো কিছু নিয়েই আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। আজও নেই। কারণ আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলাম। আপনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। বিয়েটা যেহেতু হয়েই গিয়েছিল, আর অতীত আঁকড়ে বাঁচতে চাইনি আমি। সম্পর্কটাকে একটা দায়িত্ব ভেবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। যদিও একটা ছেলে আর একটা মেয়ে দীর্ঘদিন একসাথে থাকলে তাদের মনে অনুভূতি জাগাটা স্বাভাবিক। আমার মনেও জেগেছিল। কিন্তু সেটাকে ‘ভালোবাসা’ বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। কারণটা পরে বুঝতে পেরেছি। সেটা কী বলুন তো? আপনাকে কেউ ভালোবাসুক- এটা আপনি ডিজার্ভ-ই করেননা!
বলেই স্পৃহা একটা জোরে শ্বাস নিয়ে আবার বললো,
-যাইহোক, এতো এক্সপ্লেনেশন- এর কোনো প্রয়োজন নেই। সম্পর্কটা তো কলমের আঁচড়ে ভেঙে দিয়েছেন! এখন এসব প্রসঙ্গ কোন আসছে? আর আপনিই বা আমার সাথে কথা বলার জন্য এতো উদগ্রীব হয়ে আছেন কেন? আপনার আমার মাঝে তো আর কোনো কথা থাকার কথা নয়! এতোদিনে তো আপনার বিয়েও করে ফেলার কথা! অহেতুক আমার পেছনে ঘুরে নিজের ব্যক্তিত্বকে আর সস্তা বানাবেন না।
বলেই আদ্রের পাংশুটে চেহারার দিকে সুক্ষাগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওর পাশ কাটিয়ে চলে গেল স্পৃহা। কিন্তু ওর বলা কথাগুলো যে আদ্রের মনে গভীরভাবে আঁচড় কেটে ফেলেছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। ক্রোধে চোখ মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে আদ্রের। কী কারণে এতো রেগে গেল সে, নিজেও বুঝতে পারছে না!!
ঘর থেকে বেরিয়ে স্পৃহা প্রান্তির ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে ওর। কেন তার জীবনটা-ই এমন এলোমেলো হলো? কেন ভালোবাসার মানুষটা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল? কেন ভাগ্য আদ্রের মতো একজনের সাথেই ওর সংসার জুড়ে দিয়েছিল? কেন তারই নারীত্বে এতো বড় ব্যর্থতার কলঙ্ক লেগে গেল? কেন লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি ফেলাটা-ই তার নিত্যদিনের সঙ্গী হলো?
প্রশ্ন গুলো মনে জাগতেই দরজা ঘেঁষে ফ্লোরে বসে শব্দ করে কেঁদে উঠলো স্পৃহা। ওপর দিয়ে যতই শক্ত দেখা যাক না কেন, শত আঘাতপ্রাপ্ত ভগ্ন হৃদযন্ত্রটার রক্তক্ষরণ শুরু হলে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা যে ওর নেই। তাই মুখে হাত চেপে কান্নামাখা গলায় নিজেই নিজেকে বললো,
-খুব কি ক্ষতি হয়ে যেত যদি আহিরের সাথে সাথে আমারও পৃথিবীর পাঠ চুকে যেত?
# চলবে……
✘কপি করা নিষেধ✘
[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]