#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৬
রুনি আপুর সাথে চরম অস্বস্তি নিয়ে ছাদের একপ্রান্তে বসে আছি। উদ্দেশ্য আজ আমি আনভীরের কাছে যাবো না। কিছুতেই যাবো না। এমনিতেও তখন দুপুরের দেওয়া আইসক্রিম টাইপ ওয়ার্নিং এ আমি বেশ ভয় পেয়েছি। তাই তারপর থেকে উনার মুখোমুখি থাকলেও ভয়টা তেমন একটা প্রকাশ করলাম না।
কনেকে নিয়ে এ বাড়িতে ফিরে এসেছি বিকেলের পরপর দিয়ে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা মজা চললেও আনভীর এর ধার কাছেও আমি ছিলাম না। তারপর রাতে ভাবীকে বাসরঘরে রেখে আসা হলো। রুনি আপু সহ আরও বেশ কয়েকজন আজগুবি সব এডভাইস ও দিলো ভাবিকে। আফসোস! আমি কিছুই বলতে পারলাম না। যেদিকে আমি বিবাহিত মেয়ে আর আমার বড় গলায় এডভাইস দেওয়ার কথা সেদিকে আমি চুপসে আছি। কারন বাসররাত নিয়ে একজন মানুষকে আদৌ কেমন ধরনের এডভাইস দেওয়া যায় তা আমার জানা নেই। চরম হতাশা নিয়ে আমি সবার সাথে বেরিয়ে এলাম। তবে বাকিরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যাতে রাফিদ ভাইয়া,আসতেই বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পারে।আমি তাই ক্লান্তি নিনির্মেষে বসে পড়ি ড্রইংরুমে সোফায়। আনভীর ওদিকে মামুন ভাইয়াকে নিয়ে ও বাড়ি থেকে যা আনা হয়েছিলো সেগুলো এক এক করে নিয়ে আসতে ব্যস্ত। আমি দূর থেকে গভীর চোখে দৃষ্টিপাত করছি উনার ব্যস্তময় মুখটা।
হাতে বেশ কয়েকটা বড় বড় কার্টন থাকার কারনে উনার চেহারা ভালোমতো দেখা যাচ্ছে না। নীল পান্জাবি পরিহিতা এই মানুষটিকে দেখতে তবুও ভালোলাগছে আমার। উনি এবার সব সামলিয়ে রেখে সোফয় বসে পড়লেন আমার পাশে। এইতো একটা সুযোগ উনার মাথা থেকে শাস্তির ব্যাপারটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার৷
আমি মুখোমুখি হয়ে বসলাম উনার। আনভীর চোখ বন্ধ করে সোফায় শরীর এলিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। যার দরুন ওঠানামা করছে উনার প্রশস্ত বুক৷ আমি আলতো হাতে উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে টেনে দিলাম। বললাম,
-কিছু খাবেন আপনি?
-না।
আনভীর তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন মিহি কন্ঠে। আমি নিজের কাজ অব্যাহত রেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,
-তাহলে পানি নিয়ে আসি? না,,,না, শরবত নিয়ে আসি। শরবত খেলে ভালো লাগবে আপনার।
আমি উঠেই পড়েছিলাম প্রায়,তবে আনভীর টেনে আমায় আবার নিজের পাশে বসিয়ে দিলেন। চোখেমুখে উনার অবাকের রেশ, সেই সাথে বিদ্যমান সীমাহীন কৌতুহলতা। উনি ভ্রু উচিয়ে বলে ওঠলেন,
-ব্যাপারটা কি আহি? তোমার এই অতিরিক্ত টেনশন আমাকেও রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে কিন্ত।
আমি শুকনো ঢোক গিললাম অগোচরে। মানুষটা কিছু বুঝে গেলো না তো? আমি তবুও নিজের সাথে উনাকেও ধাতস্থ করে বলে ওঠলাম,
-আরে, এতে আপনাকে ভাবতে হবে কেনো? আমি কি আপনার জন্য টেনশন করতে পারি না?
-তোমার টেনশন কেনো যেনো ইনটেনশন মনে হচ্ছে আমার।
উনি চাপা গলায় কথাটি বললেন। চোখজোড়ায় এখনও সীমাহীন সন্দেহ। আমি অবগত হলাম উনি হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। এখন নিজেকেই নিজের চড় মারতে ইচ্ছে হলো আমার৷ কেমন মেয়ে আমি, নিজের বরকেও ভালোমতো পটাতে পারি না?
আনভীর বাকা হাসি দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলেন,
-তুমি যতই এসব আজগুবি কাজকর্ম করে আমার প্ররোচিত করার চেষ্টা করো না কেনো, শাস্তি তো তোমার পেতেই হবে মিসেস ওয়াইফি। আমি আইসক্রিম টাইপ না কি করলা টাইপ সেটা আমার প্রমাণ করতে হবে তো!
ব্যস!তখন থেকেই আমি আনভীরের শতভাগ দূরে। উনার কথাগুলো শুনে আমি যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েলাম। এখন নিজেরই আফসোস লাগছে কেনো ওই ছেলেটার সাথে যেচে পড়ে কথা বলতে গেলাম৷ শুরুতে আমি বিবাহিত জানিয়ে দিলে হয়তো আমায় আর বিরক্ত করতো না, বরং আমিই তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছি।
এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। এসময় খাগড়াছড়িতে হালকা একটু শীতের আমেজ। আমি রুনি আপু, মামুন ভাইয়া সাথে বাকিরাও ছাদে রেলিং য়ের একপ্রান্তে বসে আছি৷ ঠান্ডার প্রকোপ খুব একটা বেশি না হলেও আমার পাতলা জামা এই ঠান্ডা মানিয়ে নিচ্ছে না৷
ছাদে গোল বৈঠক করার কারন হলো সবাই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে সম্ভবত সেটা বাস্তবায়ন হবে না কিছু বিশেষ কারনের জন্য৷ একেতো রাদিফ ভাইয়ার সবেমাত্র বিয়ে হলো, তারওপর তাদের পারিবারিক আরও কিছু কার্যক্রম রয়েছে, তাই হয়তো এবার আর না-ও যাওয়া হতে পারে।
আমি তাদের প্রত্যেকটি কথারই নীরব দর্শক। কেননা আমি জানি আমার তাদের সাথে যাওয়া সম্ভব না। এমনিতেও আজরান ভাইয়া আনভীরকে বহুত জোরাজোরি করে পাঠিয়েছেন এখানে৷ তার ওপর আনভীর সরাসরি বলে দিয়েছেন উনি তিনদিনের বেশি থাকবেন না। আমি উনাকে অনেক বলেছিলাম আরও কিছুদিন থাকি কিন্ত আমার বরসাহেব তার সিদ্ধান্তে অনড়।
আমার ভাবনার ইতি টেনেই হঠাৎ আনভীর ছাদে আমায় পেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ আমি প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যাই। সাথে বাকিরাও৷ আমি অবাক প্রসন্ন গলায় কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি ক্ষিপ্র কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-রেলিংয়ে বসতে গিয়েছো কেনো? সুসাইড করার প্ল্যান আছে? প্ল্যান থাকলে বলো , আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই।
আমি চোখমুখ কালো করে ফেললাম উনার ধমকে। উনার তো সেদিকে ধ্যানই নেই। উনার ঐতিহাসিক স্টাইলে চোখ রাঙানি দিতে আমার আর কিছু বলার সাহস হলো না। উনি মানুষটা আসলেই একটু অদ্ভুত , রেলিংয়ে বসেছি বলে এভাবে ধমক দিতে হবে?সুন্দর করে বললেই তো পারতো। নাহিদ ভাইয়া আমতা আমতা করে বলে ওঠলো,
-ইয়ে মানে , ভাই , রেলিংয়েই তো বসছে। এতে এমনে ধমক দিতে লাগে?
আনভীর সরু চোখে নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বিয়ে কর ব্যাটা, তারপর বুঝবি যে আমি এমন কেনো করেছি।রাফিদের বিয়ে শেষ না , এবার তোর দিন ঘনিয়ে আসবে। টেনশনে রাতের ঘুম হারাম। আর তুমি, (আমায় উদ্দেশ্য করে) এখানে যে সন্নাসীর মতো বসে ছিলো এট এনি চান্স পড়ে গেলে কি হতো ভেবে দেখেছো? আর যাই হোক তৈমায় নিয়ে রিস্ক নেওয়াটা অসম্ভব আমার জন্য। একেবারেই অসম্ভব।
আনভীরের কথা শুনে সবাই মিটমিটিয়ে হেসে উঠলো এবার। আমি এবারও কথা বললাম না। উনি এবার সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলেন,
-ঘুমাবি না তোরা ? এত রাতে ছাদে ভূত দেখা হলে জলদি ঘুমাতে চলে যা। আমি আহিকে নিয়ে যাচ্ছি।
রুনি আপুর বড় বোন রম্য সুরে বলে ওঠলো,
-বুঝি রে ভাই! বুঝি! যে তোর কিসের এত তাড়া।
লজ্জায় আমার গালে রীতিমতো রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। আপুর কোথায় বাকিরা সশব্দে হেসে উঠলেও আনভীর আড়চোখে তাকাতে চুপসে গেলো একেবারে। উনি এবার আমার হাত চেপে মিহি কন্ঠে বললেন,
-রুমে চলো আমার সাথে। এখানে অনেক ঠান্ডা।
বলেই উনি রীতিমতো আমায় টান দিয়ে ছাদ থেকে নিয়ে আসলেন। সবাই উল্টাপাল্টা ভাবলেও উনি যে ঠিক কি কারনে আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন এটা ভালোমতই আমার জানা আছে। রুমে আসা মাত্রই উনি সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিতেই আমায় মনে ভয়ের দানা বেধেঁ গেলো। আমার পা দুটো ফ্লোরের সাথে একেবারে যেন আটকে আছে প্রায়। আমি ভীত সতন্ত্র থাকলেও তেমন একটা প্রকাশ করলাম না। উনি খাটে বসে পড়লেন আয়েশ করে। ঠোঁটে বাকা হাসির প্রবল রেশ। অতঃপর ইশারা করলেন আমায় কাছে আসার জন্য। আমি না নড়তেই উনি বলে ওঠলেন,
-কি হলো আসছো না কেনো? আমি কি উঠে আসতে পারবো না?
সাথে সাথেই আমি উনার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি টেনে আমায় নিজের পাশে বসালেন। কানের কাছে গম্ভীর ফিসফিসালো কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-তো বলো তো তোমায় কি শাস্তি দেবো আমি? আজ শাস্তিটা তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।
আমি শুকনো ঢোক গিললাম পরপর দু’বার। মেকি হেসে বললাম,
-আমি তো বলবো আমায় শাস্তিই দিতে না। এই পিচ্চি বউকে শাস্তি দিতে আপনার খারাপ লাগবে না?
শেষ কথাটা ইনোসেন্ট ফেস করে বললেও মনে হয়নি যে উনি গলেছেন। বলে ওঠলেন,
-পিচ্চি বউ হলেও শয়তানের হাড্ডি তুমি। ওই ছেলেরে কিভাবে ব্যাকাঁ করে দিলে ভাবা যায়? আর তোমার সাহস কি করে হলো ওই ছেলের সাথে ফ্লার্ট করার? লিসেন , এই আমি থাকতে তুমি অন্য কারও কথা ভাবতে পারবে না, অন্য কারও সাথে ফ্ল্যার্ট করতে পারবে না আর ঠোঁট কামড়ানো তো দূরের কথা। তুমি তোমার এই ছোট্ট কাজটা দিয়ে কতবার আমার নিয়ন্ত্রন হারিয়েছি এটা তুমি জানো?
আমি উনার কথার কোনো প্রতিউত্তর দিলাম না।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম খাটে। আমার এমন মুখানা দেখে উনি হুট করে কোলে তুলে বারান্দায় নিয়ে রেলিংয়ে বসিয়ে দিলেন আমায়। ঘটনাটা এতই আকষ্মিকভাবে হয়েছে যে আমি রীতিমতো স্তব্ধ। উনার চোখে এতক্ষণ যেই চাপা রাগ আর শয়তানি হাসি দেখতে পাযছিলাম মুহূর্তেই সেটা রূপ নিয়েছে অন্য এক দৃষ্টি নেশায়। উনি আমায় রেলিংয়ে বসানো অবস্থাতেই কোমড় চেপে কিছুটা কাছে আনলেন। মিহি কন্ঠে বললেন,
-তখন ছাদে তোমায় বকেছিলাম কেনো জানো? কারন তুমি রেলিংয়ে একা বসে ছিলে। এট এনি চান্স কোনো দুর্ঘটনা হলে আমার কি হতো ভেবে দেখেছো? তবে এখন কিছু বলবো না। কারন আমি নিজেই এখন তোমার সিকিউরিটি গার্ড মাই ওয়াইফি!
শেষ কথাটা উনি বললেন একেবারে আমার কানের কাছে , ফিসফিসিয়ে। আমার সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেলো। উনি মানুষটা অন্যরকম। সবসময় রসকষহীন টাইপ মুড নিয়ে থাকেন আর মাঝে মধ্যে নিজের দৃষ্টি নেশা দিয়ে অন্য এক পৃথিবীতে নিয়ে যান আমায়।উনি হয়তো এমন একজন যে কখনোই মুখ ফুটে আমার উদ্দেশ্যে ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলতে পারেননি। তবে নিজের সবটুকু দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে আমি আমি উনার কাছে ভালোবাসার চাইতেও বিশেষ কিছু। উনি চাপা স্বরে বললেন,
-আহি?
-হুম !
-তোমার ওই সফট লিপস দুটো খুব টানছে আমাকে।
উনি আমার ওষ্ঠ্যদ্বয় স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে খানিকটা ঝুকতেই হঠাৎ উনার প্যান্টের পকেটে ফোন বেজে ওঠলো। এতে চরম বিরক্তি হলেন উনি। আহাজারি হয়ে বলে ওঠলেন,
-ফোন বাজার আর সময় পেলো না।
স্ক্রিনে আজরান ভাইয়ার নাম দেখে কল রিসিভ করলেন। স্পিকারে রেখেই ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। তো কেমন কাটছে তোদের দিনকাল? রাফিদের বিয়ে ঠিকঠাকমতো হয়েছে তো?
-হ্যাঁ।
স্বস্তি পেলেন ভাইয়া। তারপর বললেন,
-তোকে বলেছিলাম না যে তোর আর আহির জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখেছি? সেটার জন্যই কল দিলাম।
-মানে? তুমি সিরিয়ালি বলেছিলে কথাটা? কি সারপ্রাইজ?
আশ্চর্য হয়ে বললেন আনভীর। তারপর আমি আর আনভীর যা শুনলাম সেটা ভেবে অবাক না হয়ে পারলাম না। আজরান ভাইয়া সাজেক ভ্যালিতে একরাতের জন্য রিসোর্টের এক রুম বুক করেছেন আমাদের জন্য । তাও আবার কাপল রুম। আনভীর হতবুদ্ধি হারিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন এর কারন কি। আজরান ভাইয়া বললো আমরা তো আর হানিমুনে যাইনি তাই এক দিনের একটা ট্যুর সেট করলো আমাদের জন্য। হানিমুন ট্যুর না হলেও একটা নরমাল ট্যুর তো দেওয়াই যায়। আজরান ভাইয়ার জোরাজুরিতে আর না করতে পারলেন না আনভীর। অতঃপর কল কেটে আমার উদ্দেশ্যে কৌতুহলী স্বরে বলে ওঠলেন,
-তোমার ঠোঁটে কি জাদু আছে মেয়ে?তোমারে কিস না করতেই এদিকে ভাইয়ের কাছে চরম গিফট পেয়ে গেলাম , তাহলে ভাবো তোমারে কিস করলে কি হতো?
বিব্রত হয়ে পড়লাম আমি। বুঝলাম এই লোক সাজেক না যাওয়া পর্যন্ত এই পুরোটা রাত আমায় জ্বালিয়ে মারবেন। বিড়বিড়িয়ে তাই বলে ওঠলাম, ‘অসভ্যটা!’
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪৭
দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পের সামনে খা খা করছে রৌদ্দুরে। আশেপাশে নানা ধরনের মানুষের সমাগম। খাগড়াছড়ি শহর থেকে লম্বা সময়ের যাত্রা পাড়ি দিয়ে আমরা অবশেষে এসে পড়েছি দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পের সামনে৷ আমার বুক উত্তেজনায় কেমন যেন দ্রিম দ্রিম করছে। যাই হোক, সাজেক ভ্যালীতে এটাই আমার প্রথম যাওয়া।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এখানে সকাল আর সন্ধ্যার পর একটু ঠান্ডার প্রকোপ দেখা যায়। প্রকোপটি এমন যে খা খা রৌদ্রময়ের আবরণেও তা কেটে ওঠছে না। বরং আরাম লাগছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্পের রাস্তার একটু পাশে। আনভীর ওপাশে লাইনে দাঁড়িয়েছেন নিজেদের নাম খাতায় লিখানোর জন্য। বলা বাহুল্য, সাজেক ভ্যালী সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার কারনে এখানে ট্যুরিস্টদের সেফটির জন্য প্রত্যেককেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পার্মিশন নিতে হয়। সেই জন্যই আনভীর ওপাশে অন্যদের সাথে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। যাওয়ার আগে বারবার বলে গিয়েছেন আমি যাতে এখান থেকে এক পাও না নড়ি।
সকাল চাচী ফুপি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খারাপ লাগছিলো বেশ৷ কেননা এই তিনদিন উনাদের সাথে সময়টা আমার বেশ কেটেছে। সেই সাথে সাজেক ভ্যালী যাওয়ার জন্য আলাদা এক উত্তেজনাও কাজ করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর এসে পড়লেন আনভীর। আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম,
-এত সকালে আসার প্রয়োজনটা কি ছিলো বলুন তো? আরও কিছুক্ষণ পরে আসলেই তো এত ভিড় পাওয়া যেতো না।
-উহু। সেনাবাহিনীর এসকোর্টের জন্য দুইটা সময় বরাদ্দ থাকে , এক সকাল সাড়ে নয়টা আর নাহয় দুপুর আড়াইটায়। দুপুরে তো আসা ইম্পসিবল তাই সকালেই আসতে হলো।
আমি কথা বাড়ালাম না। উনি আমার গায়ে ভালোমতো চাদর পেচিয়ে দিতে দিতে মৃদু কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-এখন টায়ার্ড হলে চলবে মিসেস আহি?
-আমি টায়ার্ড না। শুধু একটু শীত শীত লাগছে।
পুনরায় শুরু হয়ে গেলো উনার ভাষণ। কারন আমি খুব বেশি গরম কাপড়-চোপড় আনিনি। আরেহ্ আমি কি জানতাম যে আজরান ভাইয়া হ্যুট করে আমাদের জন্য ট্যুর প্ল্যান করবে। আনভীর যেমন রেগে আছেন তেমনিভাবে বিচলিত হয়ে আছেন। কারন উনার ধারনা এভাবে আমার ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা ৯৮ পার্সেন্ট। আমি বিরক্ত না হয়ে পারলাম না। কারন সবকিছু লিমিটেডে থাকাই ভালো , অতিরিক্ত ব্যাপারটা সবসময় বিপদ নিয়ে আসে।আনভীর সত্যিই কেয়ারিং আমার প্রতি , তবে সেটা মাত্রাতিরিক্ত লেভেলের। উনার এসব এগ্রোসিভ কেয়ারিং মাঝে মাঝে আমায় অতীষ্ঠ করে তুললেও কিছু করার নেই। বরটা আমার। তাই আমাকেই সামলাতে হবে এই চশমিশ বিলাইটাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চান্দের গাড়ি রওনা হবে সাজেকের জন্য। সবগুলো গাড়ি এক সারিতে ক্রমানুসারে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা শেয়ারে গাড়ি ভাড়া করেছি। আমি আর আনভীর সহ একদল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরতে এসেছে এখানে। সবমিলিয়ে আমরা ৮ জন। এই ছেলে মেয়েগুলো আসলেই খুব ভালো। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সাথে আমার সখ্যতা হয়ে ওঠেছে, এমনকি আনভীরেরও।
যেই না গাড়িটি চলা শুরু হলো এক অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠলো আমার মনে। সারা শরীরে প্রবল এক ঝিম ধরে গেলো। আনভীর আমায় শান্ত করার উদ্দেশ্যে গভীরভাবে আ্ার হাত চেপে ধরলেন। মিহি কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-সামনে আরও সুন্দর দৃশ্য আছে আহি। এখনই এত এক্সাইটেড হতে হবে না।
-আপনি এর আগে এসেছিলেন এখানে?
-একবার স্টুডেন্টদের নিয়ে ট্যুরে এসেছিলাম। বলতে গেলে বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়েই। তবে তখনকার ফিলিংস আর এখনকার ফিলিংস তো আলাদা। আগে তুমি না থাকলেও এখন পাশে তুমি আছো তো , তাই মনে হয় !
উনার এই কথার গভীরত্ব খুব অল্প হলেও আমার হৃদয়ে গভীরমাবে কথাটির প্রভাব বিরাজ করলো। আমি ঘাড়টা সামান্য বাকিয়ে উনাকে দেখে নিলাম। সূর্যের আলো পেছন দিয়ে তেরছাভাবে উনার গায়ে পড়াতে সোনালী রঙ ধারন করেছে গায়ের রঙ। উনি বরাবরই একটা চিকন ফ্রেমের চশমা পড়ে থাকেন। আর এতে উনাকে সবসময় মারাত্নক লাগে যেমনটা আজকে লাগছে। ফর্সা মুখে ছোট ছোট দাড়ি , লালচে পুরু ঠোঁট , খাড়া নাক সবমিলিয়ে উনি অনন্য। আমার প্রতি উনার এক্সট্রিম পাগলামিটার জন্যই আমি উনার প্রতি বড়সড়ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি।
গাড়িটা ওপরের দিকে উঠছে ধীরে ধীরে। অবশেষে তা আরও উপরে উঠতে থাকলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক দূরে। আমাদের সামনে বসা ভার্সিটির ভাইয়া আপুরা চরম রকমের ইন্জয় করছে। এক ভাইয়া খালি গলায় গানও গাচ্ছে। গানগুলো এই যাত্রার সাথে একেবারেই মানানসই। ভাইয়া আমাকেও অনেক অনুরোধ করলেন গান গাওয়ার জন্য । কিন্ত আমি তখন উনাদের আনন্দে মশগুলে বুদ হয়ে ছিলাম। অতঃপর উনাদের ফ্রেন্ড সার্কেল এবার গান গাওয়া শুরু করতেই আমি তাদের সাথে তাল মিলিয়ে গান গাইতে থাকলাম,
সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে,
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে
জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে।
সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে,
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে
জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে।
তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে,
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছুটে
চোখ মেল যদি পারো বুঝতে।
তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে,
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছুটে
চোখ মেল যদি পারো বুঝতে।।
(সে যে বসে আছে-অর্নব)
এ সবকিছুই আমার জন্য ছিলো নতুন এক অনুভূতি। আনভীর পুরোটা পথে গহীন নজরে দেখে চলছিলেন আমায়। উনার হাতজোড়া ছিলো ভাজঁ করা, কপালে সুক্ষ্ণ ভাঁজ, কালো চোখের আড়ষ্ট দৃষ্টি এতটাই দুর্বিষহ ছিলো যে আমায় টনক নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আচ্ছা উনার কি আমায় এভাবে দ্বিধায় না ফেললে ভালোলাগে না? উনি জানেন যে উনার এসব ছোট ছোট কাজকর্ম আমার হার্টবিট মিস করার জন্য যথেষ্ট। তবুও কেনো এসব করেন উনি?
অবশেষে আমরা এসেই পড়েছি মেঘের দেশ সাজেকে। পুরো যাত্রাটা ছিলো একেবারেই মোহনীয়। আমাদের ট্যুরমেটরাও অনেক ভালো পড়েছে। যাত্রাপথে আমার খুব ইচ্ছে ছিলো সে আমি চান্দের গাড়ির ছাদে চড়বো। অনুভব করবো উচুনিচু পথের নৈসর্গিক রৃপ। তবে আমার যদি আনভীরের মতো এমন ওভার প্রোটেকটিভ বরসাহেব থাকে তা কি আদৌ সম্ভব? উনাকে কত্ত রিকুয়েস্ট করলাম যে ওই আপুটাও তো উঠেছে, আমি উঠলে সমস্যা কি। উনি বললেন, ‘ওই মেয়ে কি উনার ওয়াইফ নাকি আমি উনার ওয়াইফ? তাই আমায় নিজের কাছ থেকে একবিন্দুও দূরে সরালেন না।
আমাদের এসব দেখে একজন ভাইয়া অবাক হয়ে আনভীরকে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনাদের কি লাভ ম্যারিজ?
অবাক হলাম আমি। সেই সাথে আনভীরও। কেননা এধরনের প্রশ্ন আমাদের কেউই করেনি এর আগে। আনভীর গলা খাকারি দিয়ে বললো,
-উহু ! আমাদের এরেন্জ ম্যারেজ।
উনার উত্তর শুনে আশ্চর্য হয়ে রইলো সবাই। যেন আমাদের এই কথা কোনো ক্রমেই উনাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। তবুও কিছু বললো না তারা। আনভীর এবার মিহি হেসে তাদের বললো,
-বিকেলে দেখা হবে আবার। আমরা আমাদের রুমে যাচ্ছি।
আমাদের রিসোর্টটি সুন্দর। বারান্দা দিয়ে পাহাড়ের চমৎকার একটা ভিউ দেখা যায়। বোঝা গেলো, আজরান ভাইয়া বেশ পরিকল্পনা করেই এখানে পাঠিয়েছেন আমাদের। ভালোই হয়েছে, এতে যদি উনার গোমরামুখো ভাইয়ের একটু সুবুদ্ধি ঘটে। কই বউ নিয়ে ঘুরাঘুরি করবে , তা না, সবসময় পড়ালিখা আর ধমকের ওপর রাখে। সাথে একশো একটা এডভাইস তো ফ্রি। এখানে এসেই আমি আগে শিউলি ভাবিকে জানিয়ে দিলাম যে আমরা গন্তব্যে এসে পড়েছি। আনভীর ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসেছেন ওয়াশরুম থেকে। আমার কথা বলার মাঝেই উনি গহীন কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-ভাবিমণির সাথে পরে কথা বলো আহি। এখানে গিজারের ব্যবস্থা আছে। একটা ফ্রেস গোসল সেরে আসো। ঠান্ডাটা কেটে যাবে।
ওপাশে শুনে ফেলেছিলো সেটা শিউলি ভাবি। ঠোঁট চেপে বললো,
-যাও যাও, মেয়ে ! আমার দেবরের কথা শুনো।
আমি মিহি হেসে কল কেটে চলে গেলা ওয়াশরুমে। কিন্ত গোসল শেষেই হলো এক বিপত্তি। আমি যা জামা কাপড় এনেছিলাম ওয়াশরুমে সবই ফ্লোরে পড়ে ভিজে গিয়েছে। কি একটা অবস্থা ! টাওয়াল পড়ে তো বেরিয়ে আসা অসম্ভব। মাথা উকি দিয়ে বাহিরে তাকালাম আমি। মৃদু কন্ঠে ডাকলাম আনভীরকে।উনার সাড়াশব্দ নেই। খানিকভাদে টের পেলাম উনি বারান্দায় মোবাইলে আলাপ চালাচ্ছেন। আমি ভেজা কাপড় পড়েই বেরিয়ে আসলাম। জামাকাপড় ব্যাগ থেকে বের করতেই আনভীর পেছন থেকে বললেন,
-তুমি এই অবস্থায় আমার ব্যাগ নাড়াচাড়া করছো কেনো?
আমার নিজের মাথায় নিজেরই বারি দিতে মন চাচ্ছে। সেম কালারের ব্যাগ হওয়ায় বুঝতেও পারিনি এটা উনার ব্যাগ। আমি তৎক্ষণৎ উনার দিকে ঘুরে বলে ওঠলাম,
-সরি সরি , আমি আসলে এটা আমার ব্যাগ ভেবেছিলাম।
আনভীর কর্ণপাত করলেন না আমার কথায়। বরং ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে উপর থেকে নিচে আমার শরীরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। আমি নিজেকে দেখতেই থমকে গেলাম। ইয়া আল্লাহ ! আমি এই অবস্থায় কিভাবে দাঁড়িয়ে আছি উনার সামনে। আমি এতটাই বোকা বনে গিয়েছিলাম যে জামাকাপড় না নিয়েই আবার ওয়াশরুমে চলে গেলাম। আমার কান্ড দেখে আনভীর আমায় আরও দ্বিগুন লজ্জা দিয়ে বললেন,
-এখন ওয়াশরুমে লুকিয়েই বা কি লাভ মিসেস আহি? যা দেখার তা তো দেখেই ফেলেছি। প্রয়োজন হলে ওয়াশরুমে এসে আবার দেখে যাবো তোমাকে। কি বলো?
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ