এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৫০+৫১

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫০
সময় খুব বিস্ময়কর একটি বিষয়। এটাই একমাত্র জিনিস যা কয়েক পলকের ব্যাবধানে অনেককিছু পাল্টে দিতে পারে। ১ সপ্তাহ হয়ে এসেছে খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় ফিরেছি আমরা। এই ১ সপ্তাহর মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে অনেককিছু। আমরা যেদিন ঢাকায় ব্যাক করছিলাম সেদিনই শিউলি ভাবির পেইন শুরু হয় যেদিকে ডেলিভারি ডেট আর দশদিন পর ছিলো। আমি বা আনভীর কেউই এ ব্যাপারে জানতাম না। জানতামই বা কিভাবে যেখানে আজরান ভাইয়া , মা-বাবা সবাই ভাবিকে নিয়ে তৎপর হয়ে ছিলো। দীঘিনালা থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে আনভীর অনবরত কল করে যাচ্ছিলেন সবাইকে। কিন্ত কেউই কল রিসিভ করছিলো না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন অনেক। সেই সাথে আমিও।বাস খাগড়াছড়ি শহর ছাড়িয়ে অনেকদূর যাওয়ার পরই মায়ের ফোন আসাতে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলেন আনভীর। মায়ের মোবাইল দিয়ে আসলে কল দিয়েছিলেন নুড়ী আপা। জানালেন কিছুক্ষণ আগেই ভাবির পেইন শুরু হয়েছে। তাই সবাই দ্রুত ভাবিকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছেন।আমাদেরও বলছে দ্রুত ঢাকায় বাড়িতে না এসে হসপিটালে যেতে। ভাবির অবস্থা নাকি খুব বেশি ভালো না।

আনভীরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো নুড়ী আপার কথা শুনে। বাসের পুরোটা পথ উনি খুব চিন্তামগ্ন ছিলেন। আমি উনাকে কি বলে শান্তনা দেবো আসলে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পুরোটা পথই আমরা ছিলাম চুপচাপ। তারপর ঢাকায় ফিরে আসার পর আমাদের ব্যাগপত্রগুলো ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন আনভীর। তারপর আমরা দু’জন চলে গেলাম হসপিটালে। বাবাকে ফোন দিয়ে জানতে পারলেন সবাই তিনতলায় ওটির রুমের সামনে আছে। সেখানেই গিয়েই আমার পা চলা যেনো বন্ধ হয়ে গেলো। আজরান ভাইয়া একপাশে বসে আছেন ভারসাম্যহীনভাবে। চোখজোড়ার নিচে ছানি পড়ে গিয়েছে। ঠোঁট চেপে পাথরের ন্যায় বসে আছেন। হয়তো নিজেকে সামলানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে মগ্ন। আজরান ভাইয়াকে এমন রূপে প্রথম দেখলাম আমি। উনি স্বভাবতই হাসিখুশি মানুষ। কেউ বা মন খারাপ হলেও নিমিষেই নিজের হাস্্যোজ্জল কথাবার্তা দিয়ে মানুষদের মাতিয়ে রাখতে পারেন। আর আজ সেই মানুষকেই এতটা ভেঙে পড়তে দেখে আমার বুক মোচড় দিয়ে ওঠলো। আনভীর এগিয়ে গেলেন ভাইয়ার কাছে। আমি মা’কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে হয়েছেটা কি।

মা অশ্রুসিক্ত হয়ে বললেন যে, অসাবধানতাবশত সকালে স্লিপ খেয়ে পড়ে গিয়েছিলো ভাবি। তখন থেকেই প্রচন্ড ব্যাথা। বাচ্চা বেঁচে আছে কি না এই নিয়েও ডাক্তার সিউর ছিলো না। পরে আল্ট্রাসনোগ্রাফি আরও কয়েকটা মেডিক্যাল টেস্ট করে দেখলো যে তেমন একটা ইন্জুরি হয়নি। তবে ডেলিভারির কাজটা আজই করতে হবে। এতে প্রচন্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আজরান। কারন শিউলির হেল্থ অতটাও ভালো না যে দশদিন আগেই এত বড় একটা সিদ্ধান্তে সে রাজি হতে পারবে। শিউলি একেবারেই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো পড়ে যাওয়ার ফলে। ব্লিডিং ও হচ্ছিলো প্রচন্ড। পরে ডাক্তার সিজারের পরামর্শ দিতেই আজরান রাজি হতে বাধ্য হলো।

আমার নিজেরও প্রচন্ড ভয় হচ্ছে এ কথাগুলো শুনে। মনে জেঁকে বসেছে নানা নেগেটিভ চিন্তা। পরক্ষণেই আমি নিজেকে স্থির রাখলাম। আজরান ভাইয়া এবার আনভীরকে বললেন,

-দু’ঘন্টা ধরে অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে আছে ও আনভীর? এতক্ষণে সিজারের কাজ শেষ হওয়ার তো কথা। এখনও ডক্টর বের হচ্ছে না কেনো? ও-ওর আর ব-বাচ্চার কিছু হয়ে যাবে না তো?

আনভীর কোনো কথা বললেন না। উনি নিজেও দু’হাটুর ওপর নিজের কনুই ভর করে বসে চোখ বন্ধ করে আছেন। এই মানুষটার কাছে মায়ের পর চরম ভরসাযোগ্য স্থান হলো ভাবিমণি। মা মাঝে মাঝে উনার সাথে বকাঝকা করলেও ভাবি সবসময়ই তা সামলে নিয়েছিলেন। এমন একজনের এ অবস্থা কিভাবে মেনে নিবেন উনি?

অবশেষে ওটি থেকে বেরিয়ে এলো ডক্টর। আমরা সবাই হতদন্ত হয়ে গেলাম ডক্টরের কাছে। আজরান ভাইয়ার শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাপছে। উনি এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে ছিলেন যে ভালোমতো কথাই বলতে পারছেন না। পরন্ত আনভীর আজরান ভাইয়াকে শান্ত করে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন,

-ড-ডক্টর! প-পেশেন্টের এখন কি অবস্থা?

-উনি আপাদত কিছুটা আশঙ্কামুক্ত আছেন। তবে,,,,

-তবে কি ডক্টর?

ভঙ্গগলায় প্রশ্ন ছুড়লেন বাবা। ডক্টর বললেন,

-দেখুন আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। বেবির বাচাঁর চান্স একেবারেই কম। তাই আপনাদের স্ট্রং থাকতে হবে দুঃসংবাদ শোনার জন্য।

কথাটি আমাদের সবার মনেই চরম দুঃখ বয়ে নিয়ে এলো। আজরান ভাইয়া এতটাই ভেঙে পড়লেন যে কোনো কথা বলেই থ মেরে বসে পড়লেন পাশের বেঞ্চটিতে। উনার চোখমুখে জড়তা, কেমন যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন। মায়ের চোখ বেয়েও ক্রমশ পানি পড়ছে। আমার প্রচন্ড খারাপ লাগলো এ দৃশ্য দেখে। যেদিকে ভাইয়া আর ভাবির তাদের বেবিকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো সব কি নিমিষেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে?আজরান ভাইয়া দ্বিরুক্ত হয়ে বললেন,

-তোর ভাবিকে কথা দিয়েছিলাম আনভীর? যে আমি বেবির সবকিছুর টেক কেয়ার করবো। আর আজ আমার অবহেলাতেই ওর এ অবস্থা। ওকে বাসায় রেখে আমি যদি অফিসে না যেতাম তাহলে শিউলির এত বড় দুর্ঘটনা মোটেও হতো না রে! সব আমার দোষ! আমি এবার কি জবাব দিবো ওকে?

মা আশ্বস্ত করতে থাকলেন ভাইয়াকে। যে ডক্টর বাচার চান্স কম বললেও নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। হয়তো মিরাকেল করে ভালোসংবাদও এসে পড়তে পারে। আমি একপাশে চুপ হয়ে বসে দেখতে থাকলাম মা ছেলের এমন দৃশ্য। আনভীর এসে বসলেন আমার পাশে। ভার কন্ঠে বললেন,

-দেখেছো আজরান ভাইয়ার কি অবস্থা? তোমার এমন কিছু হলে তো একেবারেই মরে যাবো আমি। মনে আছে সেদিন তুমি রিক্সা থেকে পড়ে পায়ে কড়া ব্যাথা পেয়েছিলে? ক্ষত জায়গাটি থেকে রক্ত পড়া কিছুতেই কমছিলো না, আমি-আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর এমন জায়গায় তুমি এলে তো তার থেকেও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। আমি, আমি মরে যাবো আহি। সুসংবাদ শোনার আগেই উদ্বিগ্নতায় আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো।

হঠাৎ ভেতরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজেই থমকে গেলাম আমরা সবাই। আমার বুক রীতিমতো ধড়ফড় করছে। আজরান ভাইয়াও নিজের বোধ ফিরে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন বসা থেকে। সত্যিই মিরাকেল হয়েছে এবার। যেখানে বেবির বাচাঁর চান্স ৯৮ শতাংশ ছিলো না সেখানে একটা সুস্থ ছেলে বেবির জন্ম দিয়েছে ভাবি। আজরান ভাইয়া এই সংবাদে এতটাই বিস্মিত হয়ে ছিলো যে কোনো কথাই বলতে পারলো না। আমি এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। সবার চোখে মুখেই একটা প্রাপ্তির হাসি। আর হবেই না বা কেনো, ঘরে একটি নতুন পৃথিবীর আগমন হয়েছে যে?

________________________

তারপর দেখতে দেখতে ১ সপ্তাহ পার হয়ে গেলো তড়িৎ গতিতে। আমরা যেহেতু বেশ কয়েকদিনই ঢাকার বাহিরে ছিলাম তাই ঢাকায় ফিরে আসার পরপরই আনভীর নিজের কাজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। উনি ইদানীং এতটাই ব্যস্ত যে ঘরে টাইম মতো খাওয়া-দাওয়া করারও ফুরসত নেই। এতদিনের জমা সব পরীক্ষার খাতাগুলো দেখা, আবার ভার্সিটিতে ওভারটাইম ক্লাস, টিচার্স মিটিং , ট্রেনিং সব মিলিয়ে উনি বড্ড ক্লান্ত। বেবি হওয়ার উপলক্ষে আজরান ভাইয়া ঘরে আত্নীয়দের দাওয়াত দিয়ে ছোটো খাটো একটা অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলো কিন্ত সেটাও স্থগিত হয়ে আছে আনভীরের কাজের চাপের জন্য। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে আগামীকাল ঘরে ছোটো করে একটি অনুষ্ঠান করা হবে।

আমি তাই ফটাফট উঠে গেলাম ঘুম থেকে। শিউলি ভাবিকে মা কড়াকড়িভাবে রান্নাঘর থেকে দূরে থাকার আরোপ করেছেন।তাই আপাদত রান্নাঘরের সব কাজ আমি আর নুড়ী আপা মিলমিশেই সামলাচ্ছি। আজকে শিউলি ভাবির মায়ের বাড়ির আত্নীয়রাই মূলত থাকবে। আর আজকেই বেবির নামকরণ করা হবে। আজকে তাই আমি সব চাইনিজ আইটেম রান্না করেছি । চিকেন ফ্রাইড রাইস থেকে শুরু করে গারলিক চিকেন ফ্রাই, বিফ মাঞ্চুরিয়ান , মাশরুফ ভেজিটেবল আরও অনেক কিছু। রান্না করাটা একচুয়্যালি আমার প্যাশন বললে চলে। তাছাড়া ছোটবেলাতে আর কিছু না শিখলেও রান্নাটা ভালোভাবেই শিখতে হয়েছে চাচির ভৎসনা থেকে বাঁচার জন্য। আমি রান্নাঘরে একসাইডে সালাদ কাটছিলাম তখনই পেছন থেকে কেউ বললো,

-আমি হেল্প করবো মিসেস আহি!

মাথাঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম আমি। আনভীর কিচেন কেবিনেটের উপর বসে আছেন। সিক্ত চুলগুলো দেখতেই বুঝতে পারলাম উনি সবেমাত্র গোসল সেরে এসেছেন। চোখে-মুখে স্নিগ্ধতা। সাজেকের সেই রাতের পর থেকে উনি ইদানীং আমায় সবসময়ই ‘মিসেস আহি’ মিসেস আহি’ বলে সম্বোধন করেন। জানিনা কেনো তবে উনার এই ডাকটি মাত্রাতরিক্ত ভালোলাগে আমার। আমি তবুও সরু গলায় বললাম,

-আপনি কি হেল্প করবেন? আদৌ জীবনে একটা লেবু কেটেছেন? আসছেন আবার হেল্প করতে!

শেষ কথাটি ব্যঙ্গস্বরূপ বলে আমি আমার কাজ মন দিলাম। আনভীর কিছুক্ষণ বোকা বনে ছিলেন এতে। তারপর আমার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে বললেন,

-লেবু কাটিনি তো কি হয়েছে। আজ কাটবো। দরকার পড়লে তোমার সাথে রান্নাও করবো। এমন পিচ্চি বউকে হেল্প না করে থাকা যায়?

-সরেন তো! রান্নার র ও আপনি জানেন না আবার বলছেন হেল্প করবেন। এখান থেকে বেরিয়ে যান এখন। কেউ কি বলবে আপনি মাত্র গোসল সেরে এসেছেন? অলরেডি কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে এখানে থাকার কারনে। উফফফ!

আমি চরম বিরক্ত হয়ে ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে মুছে দিলাম উনার কপালের কাছটা। আনভীরের মুচকি হেসে রান্নাঘর থেকে চলে যাওয়ার পরই আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

_____________________

পুরো বাড়িতেএখন রমরমা ভাব। আজরান ভাইয়ার শ্বশুড়বাড়ির সব লোকজনই মোটামোটি এসে পড়েছেন বাড়িতে। শিউলি ভাবি সোফার এককোণে বসে আছে আর আমার কোলে সুন্দর বেবিটি। শিউলি ভাবির ছেলেটা একেবারেই আজরান ভাইয়ার মতো হয়েছে। সেই বড় বড় চোখ , গৌরবর্ণ গায়ের রঙ ইসসস! কত সুন্দর। শিউলি ভাবির মা তো অনেকক্ষণ নিজের নাতিনকে কোলে নিয়ে দোয়া দুরুদ পড়ে ফু দিয়ে দিলেন। সেই সাথে আমার জন্যও দোয়া করলেন যাতে আমার কোল জুড়েও একটি ফুটফুটে সন্তান হোক। আর এই বেবি হওয়ার খুশিতে সবচেয়ে বেশি খুশি ছিলেন আনভীর আর আজরান ভাইয়া। একজন বাপ আর একজন চাচ্চু হওয়ার খুশিতে দুইভাই মিলে পুরো কলোনিতে মিষ্টি বিতরণ করে বেরিয়েছন।
এখনও এসব নিয়েই ব্যস্ত আছেন দুজন। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পরই আমরা সবাই গোলত্র হয়ে ড্রইৎরুমে বসে পড়লাম বেবির নাম ঠিক করার জন্য। প্রায় লম্বা সময় শলা পরামর্শের পর বাবার দেওয়া নামটিই পছন্দ হলো সবার। ‘তৌহিদুর রহমান’ আর শিউলি ভাবির কথা অনুযায়ী নিকনেম হবে অয়ন। বেবিটার সাথে নাম পুরো খাপে খাপ যায়। আমাদের এ নিয়ে আর কোনো আপত্তি নেই।

তিথিরা সবাই চলে যাওয়ার পর আমি সবকিছু গোছগাছ করে ড্রইংরুমে অয়নকে কোলে নিয়ে বসে পড়লাম। ভাবি ওয়াশরুমে গিয়েছে। তাই আমি ওকে কোলে নিয়ে আনমনে খেলা করছি। অপরপাশেই সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন আনভীর। হঠাৎ টিভি অফ করে আমার দিকে তাকিয়ে নিদারুন গলায় বললেন,

-তুমি তো ইদানীং সময়ই দাও না আমাকে। সারাদিন ওকে কোলে নিয়ে ঘুরো, আদর করো। বলছি যে তোমার সামনে যে এই জলজ্যান্ত মানুষটি পড়ে আছে, তাকে দেখে তোমার মায়া হয় না?

আমি বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ উনার দিকে। এসব বলছে কি মানুষটা? আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-সিরিয়াসলি আনভীর! আপনি নিজের সাথে এই মাসুম বাচ্চাটার তুলনা করেছেন?

-তা নয়তো কি করবো হ্যাঁ? কই সারাদিন মায়ের সাথে সময় কাটিয়ে বাপকে জ্বালাবে আর এই পুচকে মশায় চাচির কাছে এসে চাচ্চুকে চাচির আদর থেকে বিতাড়িত করছে। আমাদের বেবি হলে তো দেখা যাবে তুমি ভুলেই গিয়েছো যে এই আনভীর নামের তোমার একটি বর আছে।

আমার আর কিছু বলার নেই। এই লোক নিজে তো পাগল আমারেও পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। একটা মানুষ কতটা ওভারপজেসিভ হলে নিজের ভাতিজাকে হিংসা করতে পােরে ,, ভাবা যায়?
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫১
ভার্সিটির লাইব্রেরিতে বসে বসে ক্লাসের নোটগুলো এক এক করে লিখছি। বাহিরে স্টুডেন্টদের সমাগম। শুধু লাইব্রেরিটাই একটু ফাঁকা আর শব্দহীন হয়ে পড়ে আছে। আমার কানে ইয়ারফোন গুজা আর সেখানে একটা সফ্ট সং বেজে চলছে। আমি এতদিনের সব জমা ক্লাসের পড়াগুলো নোট করতে ব্যস্ত। আনভীর অনবরত কল করে চলছেন মোবাইলে। আমি শেষমেষ বিরক্ত হয়ে মোবাইল ভাইব্রেট করে রাখলাম। উনাকে দু’চোক্ষে দেখার মতো বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমার মন ভেঙে এখন আমারেই কল করা হচ্ছে হুহ! আসলে গতকাল উনার সাথে তুমুল সংঘর্ষ লেগেছে আমার। গতকাল বিকেলে আমি উনার সাথে সুপার শপে গিয়েছিলাম কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য। তারপর বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখা পাই মিস রোজনীলের। আনভীর তখন বলেছিলেন যে মিস রোজনীলের বাসা নাকি এই এলাকাতেই। যদি এই কথাটা আমি আগে জানতে পারতাম তাহলে কখনোই এই পথে পা বাড়াতাম না। ঘটনা এখান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হলেও হতো , কিন্ত ঘটনা এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়নি। মিস রোজনীল আনভীরকে দেখার মাত্রই ছুটে চলে এলেন আমাদের সামনে। আমায় ইগ্নোর করেই বলে ওঠলেন,

-আরে মিঃ আনভীর, আপনি এখানে? হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ। আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি?

-অ্যাহ! শখ কত। আমার বরের তো আর কাজ নাই যে আপনার সাথে দেখা করতে আসবে।

কথাটি বিড়বিড়িয়ে বললাম আমি। আনভীর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। কেননা মিস রোজনীল স্বভাবসুলভের তুলনায় একটু বেশি এক্সপেক্টেশন নিয়েই আলাপচারিতা করেন আনভীরের সাথে। আনভীর শীতল স্বভাবতই বললেন,

-আসলে এখান থেকে কিছু জিনিস কিনতে এসেছি , আমার ভাবিমণির কিছু জিনিস দরকার তো , তাই?

-ওহ্।

মলিন করে প্রতিউত্তর দিলেন মিস রোজনীল। তারপর আমার দিকে তাকােই উনার ভ্রু কুচকে এলো। যাক! এতক্ষণে তাহলে উনার নজর পড়েছে আমার প্রতি। নাহলে এসেই যেই পকপক শুরু করেছেন, দেখলে মনে হবে যে এখানে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। উনি এবার আমায় দেখিয়ে আনভীরকে বললেন,

-এই বাচ্চা মেয়েটি কে মিঃ আনভীর? আপনার বোন হয়?

আমার চোখ রীতিমতো বেরিয়ে আসার উপক্রম। আনভীর তো শুকনো কাশি দিতে দিতেই কাহিল হয়ে গিয়েছেন। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে। আনভীর অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললেন,

-ও কোনো বাচ্চা মেয়ে না মিস রোজনীল। আমার ওয়াইফ। মিসেস আহি আনভীর খান। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম ওর কথা।

মিস রোজনীল যেন কোনো ক্রমেই বিশ্বাস করতে পারলেন না উনার কথা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-বলেন কি মিঃ আনভীর? আপনি তো বলেছিলেন যে আপনার ওয়াইফ আমাদের ভার্সিটিরই ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে পড়ছে। আহিকে দেখে তো মনেই হয়না যে এমন কিউট বাচ্চা টাইপ মেয়ে আপনার ওয়াইফ। আমি তো প্রথমে আপনার বোন ভেবেছিলাম। সরি ! সরি!

আমার গলা ছেড়ে ভ্যা ভ্যা করে কাদতে মন চাচ্ছিলো উনার কথা শুনে। পিচ্চি পর্যন্ত তো ঠিক ছিলো তাই বলে বোন বানিয়ে দিবে? মিস রোজনীল এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলেন,

-তুমি অনেক লাকি আহি এমন সুইট একটা হাজবেন্ড পেয়েছো। পিচ্চি বউ হলে এই একটা মজা। বরের অনেক আদর পাওয়া যায়। আনভীর বিবাহিত বলেই বেঁচে গেছে। আজ ব্যাচেলর হলে আমি ঠিকই উনাকে আমার ফাঁদে ফেলে দিতাম।

উনি এ কথা বলেই খিলখিলিয়ে হাসছেন এবার। আর আমার রীতিমতো দাউদাউ করছে মাথা।আমার সামনেই আমার বরকে ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি! এজন্যই, এজন্যই আমি কখনও চকলেট টাইপ ছেলেদের বিয়ে করা তো দূরের কথা, প্রেমও করতে চাইনি। আনভীরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর আমি মোটামুটি শিউর ছিলাম আর যাই হোক, এমন চকলেট, ঠোঁটকাটা টাইপ লোককে তো ইন্নাল ইল্লাহ হয়ে গেলেও বিয়ে করবো না। আর কপাল আমার! সেই লোকটাই আমার ভাগ্যে চেপে বসেছে। আনভীর আমার রেগে থাকা আড়নজরে দেখে বিদায় দিতে চাইলো মিস রোজনীলকে। কিন্ত মিস রোজনীল তো ছাড়বার পাত্রী নন। আমাদের নিজের বাসায় নিয়ে এককাপ চা না খায়িয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। অনেক কষ্টে উনাকে ম্যানেজ করলেন আনভীর। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই মিস রোজনীল আনভীরকে বলে ওঠলেন,

-আপনাকে এই প্রথম ক্যাজুয়াল লুকে দেখলাম মিঃ আনভীর। বলতে হবে অনেক সুন্দর লাগছে আপনাকে।

-আপনিও কম সুন্দর না কিন্ত ! তাই শুধু শুধু আমার প্রশংসা করতে হবে না।

আমার রাগ আর পায় কে। একপ্রকার হতদন্ত হয়েই উনাকে ছেড়ে আমি এগিয়ে গেলাম। আমার এগোনো দেখে আনভীরও দ্রুত উনাকে বিদায় জানিয়ে পিছু পিছু এলেন আমার। আমি অনড়।আমি যদি কারও সাথে কথা বলতাম ভালোই তো ক্ষেপে যেতেন। উনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত পরিমাণ হিংসা যে আমায় নিজের ছোট্ট কিউট ভাতিজার সাথে দেখলেও উনার ভালোলাগে না। আর আজ উনি ওই রোজনীল মিসকে কমপ্লিমেন্ট দিলেন যেদিকে আমার আদৌ মনে পড়ছেনা যে উনি কখনও আমায় কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন কি না। একে তো বোন নামক বিভ্রান্তি আবার মিস রোজনীলের সাথে উনার কথা শুনে রাগে ক্ষোভে আমার কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সারাত আমি উনার সাথে কথা বললাম না। এমনকি রাতে আজরান ভাইয়াকে জোর করে উনার সাথে ঘুমাতে বলে আমি ভাবি আর অয়ন কিউটুসটার সাথে ঘুমাতে গেলাম। রাত পেরিয়ে সকাল হলো, ভার্সিটি যাওয়ার পথেও আমি নির্বিকার। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আনভীরের সাথে আমার কথা হয়নি যেহেতু এখানে আমাদের সম্পর্ক স্টুডেন্ট স্যার এর মতো। তবে উনি যেই হারে ফোন দিচ্ছে , বুঝলাম উনার এখন অফ টাইম। আমি তাই তপ্তশ্বাস ছেড়ে লাইব্রেরি থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম তখনই মুখোমুখি হলাম আনভীরের। হয়তো আমার উপস্থিতি এখানে জেনেই ছুটে চলে এসেছেন। উনি এবার শীতল কন্ঠে বললেন,

-ফোন ধরছো না কেনো?

-শুনিনি তাই।

আমাদের টাইম যেহেতু শেষ তাই উনার সাথে পার্কিং সাইডে আমি যেতে থাকলাম। সেখানে যাওয়া মাত্রই উনি চেপে ধরলেন আমার হাত। থমথমে গলায় বললেন,

-ভার্সিটিতে ছিলে বলেই বেঁচে গিয়েছো তুমি। অনত্র হলে আমায় কল রিসিভ না করার ফল সুদে আসলে বুঝিয়ে দিতাম। এত স্টুপিড কেনো তুমি? গতকালের সামাণ্য ঘটনার জন্য এমন রাগ করতে লাগে?

-সামাণ্য ঘটনা?

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি আমি বললাম।

-কোনটা সামাণ্য ঘটনা মনে হয় আপনার? আপনি উনাকে, ওই রোজনীল মিসকে কিভাবে আমার সামনে সুন্দর বলতে পারলেন আপনি যেখানে আমাকে তো কখনোই সুন্দর বলেননি? আর মহিলাটা কত্তো বড় বজ্জাত। আমার সামনেই আপনাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ধান্দা! আপনি কি হিসেবে সুন্দর বলেন উনাকে?

-আরে আমি তো ভদ্রতার খাতিরে জাস্ট বলেছি। উনি যেহেতু আমায় নিয়ে মন্তব্য করেছেন এজ অ্যা ডিসেন্ট পারসন হিসেবে আমাকেও তো তা বজায় রাখতে হবে তাইনা?

উমি পুরোটা পথে ড্রাইভ করছেন আর বুঝাচ্ছেন আমায়। আমিও কোনোরূপ কোনো কথা বাড়ালাম না। উনি বাড়ির লিফ্টের মধ্যেও একনাগাড়ে শান্তনা দিচ্ছেন আমায়। শেষমেষ ধৈর্যহারা হয়ে বললেন,

-আরে এতে রাগ হওয়ার কি হয়েছে আহি? আমি তো উনাকে জাস্ট সুন্দর বলেছি। এর বেশি তো কিছু বলিনাই। আমি তোমায় ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর কল্পনাও করিনা মেয়ে। তো এসব করার কোনো মানে আছে?

উনি জীবনেও বুঝবেন না একজন মেয়ের এই কষ্টটা যখন হাজবেন্ট তার ওয়াইফের সামনে অন্য মেয়েকে সুন্দর বলে। একটা উচিত শিক্ষা এবার উনাকে দিতেই হবে। ভাগ্য হয়তো সহায় ছিলো আমায়। বাড়িতে গিয়েই দেখলাম ধ্রুব ভাইয়া এসেছেন অয়নকে দেখতে। আমায় মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেলো। আনভীরকে বললাম,

-আপনি দেখতে চাচ্ছিলেন না যে আমার এত রাগের কারন কি? এখনইই দেখাচ্ছি……….

তারপর ধ্রুব ভাইয়াকে বলি,

-আরে ধুব ভাইয়া,,, হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ। আপনাকে আজ তো অনেক সুন্দর লাগছে?

আনভীরের মুখের রঙ ক্রমান্বয়েই পাল্টাতে লাগলো। ধ্রুব ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,

-এই প্রথম আমার লুকের প্রশংসা করলে তুমি আহি!

-তো করবো না, আপনাকে আসলেই সুন্দর লাগছে। আর আজ ব্লু টিশার্টে তো আরও চমৎকার। একেবার শাহিদ কাপুর টাইপ।

লাজুক হাসলেন ভাইয়া। আনভীর শীতল কন্ঠে আমার হাত চেপে বলে ওঠলেন,

-ভেতরে চলো।

বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই! আমি শুধু আনভীরকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমার তখন কেমন লেগেছিলো। কিন্ত উনি এবার রুমে এসে আমায় অবাক করে দিয়ে টেনে আমায় দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরলেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

-রিভেন্জ নিতে চাও তুমি আহি , যার জন্য এমন করলে?

-আমি কেমন করলাম আবার? আমি জাস্ট দেখালাম যে আমার কেমন লেগেছিলো কালকে।

-আমি কি মিস রোজনীলকে এমন বলেছি যে উনাকে ব্লু ড্রেসে ক্যাট্রিনা তো অন্য ড্রেসে কারিনার মতো লাগছে। আর তুমি তো রীতিমতো ওই হাবলা কে শাহিদ কাপুরের সাথে তুলনা করলে। হাউ সিলি গার্ল ইউ আর!

আমি নিশ্চুপ। আসলে উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার ওপর আছড়ে পড়াতে তখন অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছিলো। তারপর সময় ঘনিয়ে রাত হয়ে গেলো কিন্ত আনভীর আর তেমন একটা কথা বললেন না আমার সাথে। এমনকি রাগ ভাঙানোরও চেষ্টা করলেন না। আমি বুঝলাম না উনার কি হয়েছে। শেষমেষ ধৈর্যহারা হয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম উনি ডিভানে বসে আনমনে ফোন স্ক্রল করছেন। আমি উনার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম মোবাইলটা। উনি জিজ্ঞেস করলেন,

-এভাবে নিয়ে নিলে কেনো আহি….আমি দেখছিতো।

-অনেকক্ষণ মোবাইল দেখেছেন আপনি। এবার রাখুন।

-তো কি করবো আমি?

-আমাকে………আমাকে দেখুন।

চট করেবলে ফেললাম আমি। আনভীর চোখ সরু করে ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসি হাসলেন। তারপর ওপর থেকে নিচে চোখ বুলিয়ে বললেন,

-উহ্! ভেবেছিলাম তোমার সাথে রাগ হওয়ার ভান করবো তা আর পারলাম কই। এভাবে আমার সামনে আসলে আমার কেনো, যেকোনো ছেলেরই মাথা খারাপ হবে। মাই হট ওয়াইফি!

লজ্জায় কান গরম হয়ে গিয়েছে আমার। আমি ভেবেছিলাম কই উনি রেগে আছেন আর হলোটা কি। আমি অস্বস্তি নিয়ে সরে আসতেই উনি হাত টেনে আমায় নিজের কাছে বসিয়ে দিলেন। কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-আমায় সিডিউস করে কোথায় যাচ্ছো মিসেস আহি? এত সহজে তো আজ নিস্তার পাবে না। এমনিতেও পরপর তুমি আমার কতগুলো কথা অমাণ্য করেছো। আবার ধ্রুবকে বলেছো যে নীল রঙে ওকে শাহিদ কাপুর টাইপ লাগে। আমিও তাহলে কেমন টাইপ সেটা দেখিয়ে দেই?

-দরকার নাই। আমি ধ্রুব ভাইয়াকে শাহিদ কাপুর বলি বা আপনাকে ডিপজল বলি, আপনার কি হুহ? যান ওই মিস রোজনীলের কাছে।

উনি এবার আমায় কোলে তুলে খাটে নিয়ে গেলেন। পাশের লাইটের সুইচ নিভিয়ে দুষ্টু হেসে বললেন,

-তুমি থাকতে মিস রোজনীল কেনো? তোমার মতো পিচ্চি বউ আদর করার জিনিস, রাগ করার জিনিস না। এখন রাগ করোনা। কাম ফাস্ট মিসেস আহি , লেটস লাভ টুগেদার!❤️
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here