#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৭
দুইদিন পর বিকেলে মেডিকেল কলেজ থেকে বাসায় এসে দেখল দরজা খোলা! বিদ্যুৎ নেই বলেই হয়তো সদর দরজাটা খোলা! দরজার বরাবর সোফায় এক অচেনা মধ্যবয়সী মহিলাকে বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকাল তিতির। আচার-ব্যাবহারে তার মায়ের সাথে বেশ সখ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই পরিলক্ষিত হচ্ছে তার কাছে। ব্যাপারটা তিতিরের বোধগম্য হচ্ছে না। দুইদিন যাবত পড়ার চাপে মা ও হিয়া কারও সাথেই ঠিকঠাক কথা হয়ে উঠছে না। তিতিরের নজর যায় তার দিকে পোছোন করা সিঙ্গেল সোফাটাতে একজন পুরুষ বসে আছে। পুরুষটির মুখাবয়ব দৃশ্যমান না।
তিতির দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই দেখল হিয়া একটা ট্রেতে করে কিছু আনছে। তিতিরের ধারণামতে দই-মিষ্টি। হিয়া উনাদের উদ্দেশ্য করে বলে,
“একটু পরেই বিদ্যুৎ চলে আসবে। বাড়িওয়ালা বলেছে সন্ধ্যার দিকে লোডশেডিং হলেও বেশি সময় হয় না।”
মধ্যবয়সী মহিলাটি বললেন,
“সমস্যা নাই। তুমি বসো। তোমার মেয়েটা কিন্তু খুব শান্ত। কী সুন্দর চুপচাপ কোলে বসে আছে।”
“মানুষ দেখলে ভদ্র হয়ে যায়। এই আরকি! আমাকেই বুঝায় সে কেমন!”
হিয়ার দুঃখ ভরা কণ্ঠস্বরে সবাই হেসে ওঠল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিতিরও হেসে ফেলে। হিয়া তিতিরের হাসির শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আরে তিতির, তুই এসে পড়েছিস? ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় ঘরে আয়।”
তিতির দৃঢ় পায়ে সোফার কাছে এগিয়ে গেলো। সামনাসামনি মধ্যবয়সী মহিলার মুখশ্রী এবার পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়। কিছুটা চেনাচেনা লাগলে খানিক মাথা খাটিয়ে ধরতে পারলো ইনি ছবির মহিলাটি। তিতির মৃদু হেসে সালাম দিল। সালাম বিনিময়ের পরক্ষণেই তিতির পাশ ফিরে সিঙ্গেল সোফায় দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! মাশরিফ! তিতির হকচকিয়ে ওঠে। তিতিরের অভিব্যক্তি দেখে মাশরিফ সৌজন্য হেসে আবার সামনের দিকে নজর ঘুরিয়ে নেয়। তার সৌজন্য হাসিতেও গম্ভীর্যতা পরিলক্ষিত!
নাজমা বেগম হাস্যজ্জল মুখে মহিমা বেগমকে দেখিয়ে বললেন,
“দেখ তিতির, ইনি হচ্ছে তোর মহিমা খালামনি। আর মহিমা আপার ছেলেই মাশরিফ! আমি তো চিনতেই পারিনি। অবশ্য চিনব কী করে? কখনো দেখিনি তো।”
মাশরিফের পরিচয় শুনে তিতিরের মা*থা যেনো ঘুরে উঠল! সে খানিক ভারসাম্য হারিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে! বিড়বিড় করে বলল,
“এই ধা*ন্ধাবাজ লোক আমার খালাতো ভাই! কী সাংঘা*তিক লোক! এক লহমায় পিছনে পরা লোক থেকে কাজিন হয়ে গেল!”
নাজমা বেগম তিতিরকে অন্যমনস্ক দেখে বাহুতে হাত দিয়ে ডেকে বলে,
“কীরে? কই হারালি? কী বিড়বিড় করছিস?”
তিতির হাসার চেষ্টা করে বলে,
“না কিছু না। এমনিতে ভাবছিলাম।”
“কী ভাবছিস আবার?”
“এই কী, কেমন কাকতালীয় সব! অচেনা থেকে এখন আত্মীয় হয়ে গেল! কতো বছর পর হারানো বোনকে এভাবে ফিরে পেলে।”
তিতিরের কথায় নাজমা বেগম ও মহিমা বেগম হাসেন। মহিমা বেগম বলেন,
“আমি তো কল্পনাও করিনি কখোনো নাজমাকে দেখতে পাব! রেহমানের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ার পর থেকে কারও সাথে যোগাযোগ নেই। অবশ্য যোগাযোগের মুখ তো আমি রাখিনি! তবে আমার দুই সন্তানকে আমার বাবা বাড়ির সবার ছবি দেখিয়ে চিনিয়েছিলাম। সেখান থেকেই মাশরিফ নাজমাকে দেখেছে। ও যখন তোমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এসে চেনা চেনা লাগলে গ্রাম, ঠিকানা জিজ্ঞেসা করে চিনতে পারে। আমাকে তো গতকাল রাতে বলেছে সব। নাজমা যখন মাশরিফকে ফোন করেছে, তখন। আজ সকালেই টাঙাইল থেকে মির্জাপুর এসেছি। তারপর ক্লাস নিয়ে দুপুরে এখানে রওনা করেছি।
নাজমা বেগম বলেন,
“কীভাবে কীভাবে যে মিলে গেল। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য। এই তিতির, দাঁড়িয়ে না থেকে যা এবার হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়।”
তিতির হাসি বিনিময় করে চলে যায়। ভেতরের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে হিজাব খুলতে খুলতে বিছানায় বসল। তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকে,
“এজন্যই সে ‘খুব জলদি দেখা হবে’ বলেছিল। সে তো সব জানতোই। আমিই বো*কা। যাই করুক। কাজিন বলে বেশি বাড় বাড়লে অবস্থা খারাপ করে দিব। উনার জন্য সিনিয়ররাও আমার সাথে মুখ কালো করে রাখে! ”
কথা গুলো বলার মাঝেই হিয়া হায়াতকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তিতিরের শেষোক্ত কথা শুনে শুধাল,
“কার জন্য তোর সিনিয়ররা তোর সাথে মুখ কালো করে রাখে?”
তিতির হতচকিত হয়ে হুঁশে ফিরে। তারপর আমতা আমতা করে বলে,
“কারও জন্য না!”
“তুই মাত্রই তো বললি!”
“হায়াতের কান্নায় তুই এখন কানে বেশি শুনিস!”
তিতিরের বিরক্তিকর কণ্ঠের জবাবে হিয়া প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। লম্বা শ্বাস ফেলে হায়াতকে ফিডিং করাচ্ছে। এদিকে তিতির অন্যমনা হয়ে ছটফট করছে। হিয়া বিষয়টা লক্ষ্য করে পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেসা করে,
“কেউ হয়তো ভুলে যাচ্ছে আমি তার বেস্ট ফ্রেন্ড!”
তিতির কথাটা শুনল। বান্ধবী প্লাস ভাবীর বুলিতে যেনো অভিমান ঝড়ে পরছে। মুচকি হেসে বলল,
“তুইও তো আমাকে কাল রাতে বলিস নাই যে মা উনাদের ফোন করেছে। তবে আমি কোনো বলব?”
হিয়া এবার অক্ষিগোলক ছোটো ছোটো করে বলল,
“তুইও তো আমায় কিছু বলিস না। তাছাড়া ইদানীং যা ব্যাস্ত তুই!”
তিতির হেসে ফেলে। হিয়ার কাঁধ জড়িয়ে আহ্লাদীপনা করে বলে,
“কী করব বল? মেডিকেলের প্রেশার তো জানিসই। আর টিউশনিও খুঁজতেছি।”
হিয়া তিতিরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবদারের সুরে বলল,
“বল না। কী হয়েছে?”
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে তিতির বলতে শুরু করে,
“ওই যে একজন অচেনা লোক আমাকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছিল না?”
“হ্যাঁ”
“তিনিই মাশরিফ ইকবাল মানে মায়ের বোনের ছেলে। সে আমাকে ভালোবাসে। আর বাবা মানে রাহানের বাবাও উনাকে শেষ চিঠিতে আমার সাথে থাকার কথা ও আমাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করা এসব বলেছে। তাছাড়া মাশরিফ ইকবাল আমার মেডিকেলের সিনিয়রদের ফ্রেন্ড। তার লাস্ট আরেকটা চিঠিটা কিছুদিন আগে পেয়ে আমি কয়েকটা ইকুয়েশন মিলিয়ে বুঝতে পেরেছি চিঠির মালিকই উনি। তারপর সেদিন সে পূর্ণাঙ্গ স্বীকারোক্তিও দিয়েছে।”
“এইজন্য তুই ফোন করতে চাসনি?”
তিতির এবার বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় জানালার কাছে গিয়ে উদাস মনে বাহিরে বিকেলের ডুবুডুবু অরুণের র*ক্তিম আভা দেখতে দেখতে বলে,
“কী করব আমি? আমার হতাশ লাগে। জীবনে কম কিছু তো দেখিনি।”
হিয়া তার ঘুমন্ত মেয়েকে এবার শুইয়ে দিয়ে তিতিরের কাছে আসে। আলতো ভাবে তিতিরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তোকে অতীত ভুলতে হবে। তোর ভাগ্যে রাহান ভাইয়া ছিল না বলেই শুরুতেই বিচ্ছেদ হয়েছে। আমি বলব না যে তোকে এখনি নতুন জীবন শুরু করতে। সময় নে। মাশরিফ ভাইয়া যদি তোর পাশে থাকতে চায় তবে ক্ষতি কী?”
“লাভ-ক্ষতির হিসেব করতে ভালো লাগে না। তাছাড়া কাউকে মিথ্যে আশ্বাস দিতে ও নিতে আমার ভালো লাগে না। তোর কি মনে হয়? একজন বিধবাকে পুত্রবধূ কে করতে চায়? সমাজের চোখের আমি অশুভ! বিয়ের দুইদিনের মাথায় স্বামীকে খে*য়ে ফেলেছি! এমন মেয়েকে কোন মা তার পুত্রবধূ করতে চায়? মাশরিফ ইকবাল আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন করছে। যখন সমাজের রূঢ়তা বুঝবে তখন ঠিক নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে। তাই এসবে পাত্তা না দেওয়াই ভালো।”
তিতিরের কথাতে হিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা মিথ্যাও বলেনি। সমাজের রূঢ় বাস্তব তার বুলিতে। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান না তেমনি সবাই এক না। হিয়া প্রত্যুত্তরে বলে,
“মহিমা আন্টি মেনেও নিতে পারেন। তাই না? তাছাড়া তিনি এখন আমাদের আত্মীয় হয়।”
“আত্মীয় বলেই আরও ভয়। জোড়া লাগা সম্পর্ক আমার কারণে ভাঙার ভয়। প্লিজ এসব বাদ দে। সময় বলে দিবে সব। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা আগে থেকে কে জানে!”
এটা বলেই তিতির হায়াতের পাশে বসে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। সারাদিনর ক্লান্তিতে ঘুমও আসছে বেশ। আজান পড়বে একটু পর।
_______
মাগরিবের নামাজের পর মহিমা বেগম ও মাশরিফ বিদায় নিয়ে মির্জাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিদায় বেলায় নাজমা বেগম ও মহিমা বেগমের মাঝে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মাশরিফ ড্রাইভ করতে করতে মাকে একবার দেখল। মহিমা বেগম কেমন উদাস দৃষ্টিতে বাহিরে দেখছে। মাশরিফ জিজ্ঞেসা করে,
“কী হয়েছে মা? তোমার কী আরও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল? কিন্তু কাল তোমার ক্লাস আছে তাই চলে আসলাম। তাছাড়া আমি আগামীকালই আর্মি কোয়াটারে চলে যাব। কতোদিন ছুটি কাটালাম।”
মহিমা বেগম মাশরিফের কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। তিনি এখনও অন্যমনা হয়ে আছেন। মায়ের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে এবার মায়ের বাহুতে হাত দিয়ে আলতো ডেকে বলে,
“মা, কোথায় হারালে?”
মহিমা বেগম ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
“আমার দোষেই এসব হয়েছে। শুরুটা তো আমাকে দিয়েই। অবশ্য যার নিয়তিতে যা আছে তা হবেই। তাও কেনো জানি মনে হচ্ছে, আমি ভালো থাকার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলাম বলেই আজ আমার বোনের জীবনের এই দশা! আমাদের বংশ মর্যাদা অনুযায়ী নাজমার বিয়ে আরও বড়ো ঘরে হতে পারতো। কিন্তু বাড়ির এক মেয়ে পালিয়ে গেলে সেই সময়ে ও এখনও সমাজে সেই পরিবারের বংশ মর্যাদাটা আর অক্ষুণ্ণ থাকে না। আমার বোনটার জীবনে যা ঘটলো, স্বামী-ছেলে ও মেয়ের জামাই, কেউই জীবিত নেই। জন্ম-মৃত্যু এসব নিয়তি কিন্তু তাও আমার খারাপ লাগছে।”
মাশরিফ মায়ের হাত ধরে। অতঃপর আশ্বাস দিয়ে বলে,
“বিগড়ানো সবটা না পারলেও কিঞ্চিত তো আমি ঠিক করতে পারি। আমি করব ইনশাআল্লাহ। তুমি শুধু আমার পাশে থাকবে তাহলেই হলো।”
“কী করবি?”
মায়ের প্রশ্নাত্মক বুলিতে নজর লুকালো মাশরিফ। কিন্তু মহিমা বেগমের দৃষ্টি অনড়! তার অবিচল দৃষ্টিতে মাশরিফ ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
“তোমায় কিছু বলার আছে।”
“হ্যাঁ বল।”
“আসলে আমি…”
“কী?”
মহিমা বেগমের কন্ঠে আগ্রহের আভাস। মাশরিফ কিছুটা সময় নিয়ে গাড়ি জায়গায় থামালো। সেখানে আগে থেকে দুয়েকটা বাস ও ট্রাক থামিয়ে রাখা আছে। হঠাৎ গাড়ি থামানোতে মহিমা বেগম ভ্রুঁকুটি করে প্রশ্ন করেন,
“গাড়ি থামালি কেনো?”
মাশরিফ লম্বা শ্বাস নিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের হাত ধরে বলে,
“তোমাকে বলেছিলাম মনে আছে? আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি!”
“হ্যাঁ আছে। কেনো কী হয়েছে এখন?”
মাশরিফ এবার মায়ের চোখের দিকে তাকায়। মায়ের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা তাকে নজর ফেরাতে বাধ্য করল। মাশরিফ দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
“সেই মেয়েটা তিতির! তুমি কিছু বলার আগেই আমি বলে রাখি, আমি সব জেনেশুনেই ওকে ভালোবেসেছি। ও যতো সময় নিক তাতে আমার কোনো প্রবলেম নাই। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত।”
এক শ্বাসে পুরোটা বলে তবেই থামল সে। মহিমা বেগম স্তম্ভিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চেয়ে আছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না এসব! তিনি বললেন,
…..
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৮
মহিমা বেগম বেশ অবাক হয়ে বললেন,
“তোকে কে বলেছে আমি বাধা দিব? আমি তো মসে মনে চাইছিলাম নাজমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিব যাতে ওর চিন্তা কমে। কিন্তু তোর যে পছন্দ আছে, সেটা জানতাম বলে কিছু বলিনি। তোর পছন্দ যে তিতির তাতো জানতাম না। আমার কোনো সমস্যা নাই এতে। আমার তো গর্ব হচ্ছে তোর উপর। তুই গতানুগতিক ধারাতে বয়ে যাসনি।”
মাশরিফ হা করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মহিমা বেগম হাসলেন। অতঃপর ছেলের মাথায় আলতো মা*রা*র ভাণ করে বললেন,
“আরে আমার পা*গ*ল ছেলে! আমি কখনোই তোকে বাধা দিতাম না। কারণ আমি জানি আমার ছেলে যথেষ্ট বুঝদার। তার পছন্দ যে খারাপ হবে এটা তো আমি কল্পনাও করতে পারিনা। তাইতো দ্বিধাতে পরে গিয়েছিলাম। আমি চাইছিলাম আমার বোনের কষ্ট ও চিন্তা কিছুটা হলেও কমাতে কিন্তু এদিকে তোর পছন্দ! তার জন্য তোকে বলতেও দ্বিধা করেছিলাম। কারণ আমি চাই না আমার নিজের ছেলের কাছে একজন খারাপ মা হিসেবে সারাটা জীবন থাকতে। আমি নিজের ক্ষেত্রে যা মানতে পারিনি সেটা তোর ক্ষেত্রে কিভাবে মানব! কিন্তু এখন জেনে খুব শান্তি লাগছে যে তোর পছন্দ আমার পছন্দ মিলে গেছে। এটা যে কতটা স্বস্থির সেটা এক মা বুঝে।”
মাশরিক ফুঁস করে সকল অস্বস্থির নিঃশ্বাসগুলো ঝেড়ে ফেলল। অতঃপর হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলল,
“একটা চিন্তা কমলো তবে! এখন শুধু তিতির রাজি হওয়া বাকি। ”
“কেন তিতির রাজি না? ”
মাশরিফ হেসেই মাথা দুলায়। মহিমা বেগম বললেন,
“হয়ে যাবে চিন্তা করিস না। তাছাড়া আমি তো আছি তোর পক্ষে। মেয়েটা মেবি স্পেস চাইছে।”
“হ্যাঁ। আমি ওকে কথা দিয়েছি, ও না ডাকলে ওর সামনে যাব না। তবে তোমাকে নিয়ে যাওয়াতে সামনে পরতে হয়েছে কিন্তু আমি ওর সাথে যেচে কথা বলতে যাইনি। আত্মীয়তার সুবাদে সামনাসামনি দেখা তো হবে।”
মহিমা বেগম ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তোকে কিন্তু ওর সিচুয়েশনটাও বুঝতে হবে। মেয়েটা আর দশটা মেয়ের মতো নরমাল সিচুয়েশনে নেই। সময় নিক। আমারও এখনি পুত্রবধূ আনার তাড়া নেই।”
এই বলে মহিমা বেগম হাসলেন। মাশরিফও হেসে গাড়ি স্টার্ট করল।
________
কয়েকদিন পর ইনায়ারা তিতিরকে ডেকে পাঠাল। হঠাৎ সিনিয়রদের থেকে ডাক পেয়ে এর কারণ সে ধরতে পারল না। সে তো এমন কিছু করেনি যে আবার ডাকাবে। এসব ভাবতে ভাবতে নানারকম কল্পনা-ঝল্পনার মধ্যেই তিতির ইনায়াদের সামনে গিয়ে সালাম দিল। ইনায়া তিতিরকে দেখে মিষ্টি হেসে সালামের প্রত্যুত্তর করল। অতঃপর বলল,
“কেমন আছো তিতির? আমি ডেকেছি বলে ভয় পেয়েছিলে?”
তিতির দারুণ অস্বস্থিতে পরে গেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“না আপু। এমনিতেই। আপনি বলুন।”
“তবে শোনো যেই কারণে ডেকেছি। আমার পরিচিত এক আপু আছেন। যার শাশুড়ির ট্রিটমেন্টের জন্য হসপিটালে প্রায়ই আসেন। সেখান থেকেই পরিচয় আরকি।”
এটুকু বলে ইনায়া থামল। তিতির বুঝে পেলো না, এসব তাকে বলার কারণ কী! সে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ইনায়া আবার বলতে শুরু করে,
“আপুর বাচ্চাটা ক্লাস সিক্সে পড়ে। বাচ্চাটা দৌঁড়াদৌঁড়ি করে টিউশন করতে করতে সিক হয়ে যাচ্ছে তাছাড়া বাচ্চাটার ব্রেন একটু.. বুঝোই তো। অনেকবার একই পড়া পড়াতে হয় যা ধৈর্য্যের ব্যাপার। আপু তাই তার মেয়ের জন্য বাসায় এসে ধৈর্য সহকারে পড়াবে এমন টিউটর খুঁজছেন। দুই মাসে দুইটা টিচার বদলিয়েছে। উনারা বাচ্চাটাকে ভালো করে ট্রিট করতে পারছেন না আসলে বাচ্চাটা পড়া ক্যাচ করতে পারছে না। এখন টিউটর লাগবে বাচ্চাটার জন্য। তুমি পড়াতে পারবে? আগেই বলে রাখি যে দিনে কম করে হলেও দুই-আড়াই ঘণ্টা পড়াতে হবে। বেতন নিয়ে চিন্তার কিছু নাই। সিক্সের সব সাবজেক্ট পড়াতে হবে তাই বেতনটা ভালোই দিবে। এই ধরো, ছয়-সাত! এর বেশি দিতে পারবে না। প্রতিদিন পড়াতে হবে না কিন্তু সপ্তাহে চার দিন মাস্ট। পারবে?”
তিতির অবাক হলো। এখনি টিউশনির খোঁজ কেউ তাকে যেচে দিতে আসবে তা সে ভাবতেও পারেনি।
তিতিরকে চুপ থাকতে দেখে ইনায়া আবারও বলল,
“বাচ্চাটাকে যেহেতু অনেকটা সময় পড়াতে হবে তাহলে বাচ্চাটাকে কোনো কিছু পড়তে দিয়ে তুমি নিজেও নিজের পড়া পড়তে পারবে। তুমি ওকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে পড়তে বলবে তারপর তুমিও পড়লে।”
তিতির কিছু ভেবে বলল,
“সমস্যা নাই আপু। আমি পারব। উনাদের বাড়ি কি বেশি দূরে?”
ইনায়ার ঠোঁটে হাসি ফোটে। সে বলে,
“উম! না। রিকশাতে গেলে পনেরো-বিশ মিনিট। আর হেঁটে গেলে জানিনা। আমি তবে আপুকে বলে দেই। তুমি নাহয় সামনের মাস থেকে পড়ানো শুরু করো। কয়েকটা দিনই বাকি এই মাসের। কাল বিকেলে নাহয় তোমাকে নিয়ে বাড়িটা চিনিয়ে দিয়ে আসব।”
তিতির কৃতজ্ঞতার স্বরে বলল,
“ধন্যবাদ আপু। আপনারা আমাকে এতো সাহায্য করছেন তা আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শেষ করতে পারব না। আমি টিউশনি খুঁজছিলাম। আর আপনি খোঁজ পাইয়ে দিলেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু।”
“আরে ধন্যবাদ দিতে হবে না। সিনিয়র-জুনিয়র বন্ডিংটাই এমন। যাও এখন ক্লাসে যাও। আমার একটু কাজ আছে।”
ইনায়া হালকা হেসে চলে যায়। তিতির সেখানেই কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রৌদ্রদীপ্ত নীল আকাশের দিকে তাকায়। মাথা থেকে যেন একটা চিন্তা নেমে গেল। এখন আরেকটা টিউশনি জোগাড় করতে পারলেই আর চিন্তা থাকবে না।
এদিকে ইনায়া রাফির কাছে গেলো। রুষ্ট স্বরে বলল,
“তুমি যা করছ তা কি ঠিক করছ? আমাকে বললে একটা টিউশনি খুঁজতে। খুঁজলাম। কিন্তু তোমরা কেনো তিতিরের সাথে কথা বলো না? ওর কী দোষ?”
রাফি ইনায়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নজর ফিরিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“ইচ্ছে হয়না বলিনা। আমাদের আগে দেখেছ? জুনিয়র মেয়েদের সাথে বেশি কথা বলতে? দুয়েকজন বাদে দরকার ছাড়া কথা বলিনা। আর তিতিরের সাথে বলতাম আমার ফ্রেন্ডের জন্য। তাও জানো। তবে?”
ইনায়া এবার মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
“তোমাদের হুট করে ওকে ইগনোর করে চলাটাতে ও তো অন্যকিছু ভাবতে পারে। তাই না?”
“ভাবুক! কারও ভাবনার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নাই। তাছাড়া আর কয়েকটা দিন পর ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাব নিজ শহরে। তখন এখানে আসা পরবে কী-না জানিনা। তাই অতো লাগাম বাড়ানোর কী দরকার?”
রাফির চলে যাওয়ার কথা শুনে ইনায়ার মন খারাপ হয়ে গেল। সে জানে যে ওরা চলে যাবে। কিন্তু মন মানতে চায় না। ইনায়া করুণ স্বরে বলে,
“আমাকে ভালোবাসা যায় না? তুমি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে, গ্রহণ করলাম। এখন আমি ভালোবাসার হাত বাড়ালে কি তুমি গ্রহণ করবে?”
রাফির দৃষ্টি নিশ্চল! সে কিছুটা সময় ইনায়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করেই চলে গেল। ইনায়া সেই স্থানে দাঁড়িয়ে সম্মুখে প্রিয়র চলে যাওয়া দেখল। নেত্রকোণে জমে উঠা জলবিন্দুকে প্রশ্রয় দিলো না। বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা গতি রোধ করল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও স্থান ত্যাগ করল।
_________
সেনানিবাসে রুটিনের মধ্যেই দিন গুলো অতিবাহিত হচ্ছে মাশরিফ, অভীর। মাশরিফ আসার দুইদিন পর অভী এসেছে। এবার প্রায় অনেকটা ছুটি কা*টিয়েছে তাই আবার পরবর্তী ছুটি বেশ দূরে। বিকেলের সময়টা ঘুরতে বেরিয়েছে মাশরিফ, অভী ও আরও দুইজন মেজর। হাঁটতে হাঁটতে একটা চায়ের দোকানে বসল ওরা। তাদের মধ্যে সাদ নামে একজন বলে ওঠে,
“আপনাকে বেশ অন্যমনস্ক লাগছে মেজর মাশরিফ।”
কথাটা শুনে মাশরিফ ক্ষীণ হাসল। বলল,
“কই নাতো। প্রকৃতি অনুভব করছিলাম। পাখির কলতানে মুগ্ধতাকে হয়তো আপনার কাছে আমাকে অমনোযোগী লাগছিল।”
“তা বলতে পারেন। তবে আপনার লক্ষণে প্রেম ভাব সুস্পষ্ট!”
মাঝ দিয়ে অভী বলল,
“তা আপনি কীভাবে বুঝলেন মেজর সাদ? আপনিও কি প্রেমরোগে আক্রান্ত?”
মেজর সাদ হেসে ওঠলেন। বললেন,
“সেসব প্যাঁ*চ-গোচে যাওয়ার ইচ্ছে নাই। সরাসরি বিয়ে করব। মা মেয়ে দেখেছেন। আমিও পছন্দ করেছি। সামনে বাড়ি গেলেই বিয়ে। আপনারা কিন্তু আসবেন। যদি আমার হবু বউয়ের কোনো বোন-টোন থাকে তবে আপনাদের আলাপ পারা যাবে!”
আরেকজন মেজর আদিব সহাস্যে বলে ওঠেন,
“আমার জন্য করা লাগবে না মেজর সাদ। বিয়ে করেই মিশনে গিয়েছিলাম। উনাদের জন্য দেখুন।”
মাশরিফর চায়ের কাপ হাতে নিল। তারপর হালকা হেসে বলল,
“আমার মন কারও নামে দাখিল করা আছে। তাই আপনি অভীর জন্য দেখুন।”
“আরে বাহ! তাহলে দাওয়াত কবে পাচ্ছি?”
“পাবেন যখন সময় হবে।”
কথাটা বলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হেসে গাছের নিম্ন ডালের আড়ালে হেলে পরা সূর্যটার দিকে দৃষ্টি স্থীর করে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,