এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব -৪৩+৪৪ ও শেষ

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৩(প্রেমময় প্রহর)
বান্ধবীর হোস্টেলে গিয়ে আসরের নামাজটা পড়ে প্যাকেটটা খুলে দেখে তাতে সিগ্রীন ও ব্ল্যাক এর মিশেলে একটা সুন্দর শাড়ি। তিতির শাড়িটা উলটে-পালটে দেখছে। তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে শাড়িটা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

“ওহো ভাইয়া তবে নিজের পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচিং করে তোর জন্য শাড়ি এনেছে। যাই বল আর তাই বল লোকটার কালার সেন্স জাস্ট অসাম।”

নাদিয়ার কথায় বাকিরাও মজা নেয়। তিতির তাড়া দেখিয়ে বলে,
“আমি যে উনার কাছ থেকে ১৫ মিনিট চেয়ে এনেছি এই শাড়ি পড়তেই তো আমার ১৫ মিনিটের বেশি চলে যাবে। তারপর আবার হিজাব, কাজল এগুলো করতে হবে তো!”

ফাইজা বলে,
“চিন্তা করিস না। ১৫ মিনিটকে ২ দ্বারা গুন করে নিতে হয়। এটা সাধারণ ম্যাথ। প্রত্যেক ছেলেকে এটা জানতে ও বুঝতে হয়।”

“না আমার বেশি দেরি করা যাবে না। পরে যদি..!”

“তুই হুট করে এতো জেলাস হয়ে গেলি কেন বুঝতে পারলাম না। ভাই তো শুধু তোকেই ভালোবাসে তাতো তুই ভালো করেই জানিস।”

জারিনের প্রশ্নের তিতির কোন উত্তর দিল না। জারিন আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ওকে তৈরি হতে বলে।

________

প্রায় আধাঘন্টা পর তিতির মাশরিফের সামনে এসে দাঁড়াল। মাশরিফ কিছু মুহূর্ত অপলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর তিতিরের বান্ধবীদের হাসির শব্দে স্বাভাবিক হয়ে ঘড়িতে সময় দেখে বলে,

“এই তোমার ১৫ মিনিট? ৪০ মিনিট হতে চলল।”

“ভাইয়া আপনি দিবেন শাড়ি! তো ১৫ মিনিটে শাড়ি পড়া হয় নাকি! গাউন, বোরখা, থ্রিপিস নাহয় ৫ মিনিটে পড়া হয়ে যায়। এই চৌদ্দহাত পেঁচানো শাড়ি পড়তেই চৌদ্দ প্যাঁচ খেতে হয়।”

ফাইজার কথা শুনে মাশরিফ হালকা কেঁশে বলল,
“ঠিক আছে। সমস্যা নাই। সন্ধ্যা হতে আরও সময় বাকি।”

এই বলে মাশরিফ তিতিরকে ইশারায় রিকশাতে উঠতে বললে নাদিয়া বলে ওঠে,
“এই ভাই দাঁড়ান। আমরা যে আপনার বউকে এতো সুন্দর করে সাঁজালাম, তার জন্য আমরা কী পাব?”

মাশরিফ বোকার মতো বলে,
“কী পাবে?”
“কী আর! ট্রিট পাব। আমাদের সবাইকে আপনার ট্রিট দিতেই হবে।”

মাশরিফ হেসে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাই? অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে।”

তিতিরের বান্ধবীরা বেশ খুশি হলো। জারিন এসে তিতিরের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বেস্ট অফ লাক! ফিরে এসে বলবি কিন্তু তোর ডেট

তিতির জারিনকে মা*রতে উদ্দত হলে সে হাসতে হাসতে সটকে পরে।

________

পড়ন্ত বিকেলে পার্কের রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে মাশরিফ ও তিতির। আশেপাশে অনেককে যুগলবন্দী অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ তাদের বাচ্চাদের সাথে করে নিয়ে এসেছে। দুই-একজন বৃদ্ধ দম্পতিকেও একসাথে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। সূর্যের হালকা রশ্নিতে আকাশের পরিছন্নতা পরিলক্ষিত। অথচ দুপুর পর্যন্ত আকাশ কেমন ঘোলাটে ছিল। মনে হচ্ছিল আজ আকাশের মন খারাপ। যেকোনো মুহূর্তে তার বুক চিঁড়ে দুঃখ বর্ষণ করবে। মৃদু সমিরণে তিতিরের শাড়ির আঁচল বারবার মাশরিফের বাহুতে এসে বা*ড়ি খাচ্ছে। দুজনেই অনেকক্ষণ যাবৎ নীরব হয়ে হাঁটছে। এই নীরবতাকে মাশরিফই প্রথমে ভাঙল। সামনে একটা আইসক্রিমের ফেরিওয়ালা দেখিয়ে বলল,

“আইসক্রিম খাবে?”

তিতির মাশরিফের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। অতঃপর হালকা হেসে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিল। মাশরিফ তিতিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে একাই আইসক্রিম কিনতে গেলো। আইসক্রিম কিনে আসতে আসতে দেখে তিতিরের সামনে পাঁচ কি ছয় বছরের একটা বাচ্চা উদোম গায়ে কতগুলো ফুলের ক্রাউন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত তিতিরকে ক্রাউন কিনতে বলছে। মাশরিফ সেখানে পৌঁছে বাচ্চাটিকে শুধাল,

“কি হয়েছে বাবু? তোমার হাতের ক্রাউন গুলো তো খুব সুন্দর।”

“নেন না ভাইজান, দুইটা ব্যান্ড নেন। একটু আগে মায় বানায় দিছে। নেন না ভাইজান।”

বাচ্চাটির আকূল অনুরোধে মাশরিফ হালকা হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা তোমার ক্রাউন গুলো কত করে?”

“একটা ৩০ টাকা কইরা।”

“আচ্ছা আমাকে একটা দাও। আমার তো একটাই বউ! তাই আমার একটা ক্রাউনেই হবে। তবে তোমাকে আমি দুইটা ক্রাউনেরই দাম দিব। একটা তোমার মাকে পড়াবে।”

মাশরিফের প্রথম কথাটার রেশ ধরে তিতির তার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। কিন্তু শেষোক্ত কথায় মুচকি হাসল। মাশরিফ ওকে রাগাতে রম্য সুরে বলে,
“আমি কি কিছু ভুল বলেছি? সত্যি বলেছি না বল? আমার তো একটাই বউ! তো একটা বউয়ের জন্য একটা ক্রাউনই তো যথেষ্ট। তাই না?”

তিতির কিছু বলল না। মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে ফিরল। মাশরিফ বাচ্চা ছেলেটিকে দাম পরিশোধ করে দেওয়ার পর বাচ্চাটি চলে গেলে মাশরিফ তিতিরের মাথায় ফুলের ক্রাউনটা পরিয়ে দেয়। তারপর হাতে আইসক্রিমটা দিয়ে বলে,

“নাও এখন আইসক্রিম খাও। এত মুখ ফুলিয়ে থাকতে হবে না। আমি আমার একমাত্র বউকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার আর দ্বিতীয় কোন বিয়ে-টিয়ে করার ইচ্ছেও নেই। কেউ এসে গলায় ঝুলে পড়লেও তাকে আমি বিয়ে করব না। মেজর মাশরিফ ইকবাল এক নারীতে আসক্ত। বুঝলে? তাই তুমি অযথা চিন্তা করে নিজের ব্লাড প্রেসার বাড়িও না।”

তিতিরের হঠাৎ হাসি পেল। সে মুখ চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু তাতে সে ব্যর্থ হয়। হাসি আটকাতে আইসক্রিমের কৌটাটা খুলে এক চামচ ভর্তি আইসক্রিম মুখে পু*ড়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ ঠান্ডায় দাঁত ও নাসা গহ্বর শিরশির করে ওঠে। যার দরুণ চোখ-মুখ কুঁচকে আসে। মাশরিফ হেসে বলে ওঠে,

” তুমি যখন নাক-মুখ কুঁচকে ফেল তখন তোমাকে কিউটি বাচ্চার মতো লাগে। বাচ্চাদের মুখে যখন লেবু দেওয়া হয় তখন ওদের রিয়াকশন এমনটাই থাকে।”

“কী বললেন আপনি এটা!”

তিতির এবার আর হাসি আটকাতে পারে না। মাশরিফ তিতিরের থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে ওর একটা হাস্যজ্জল ছবি ক্যামেরা বন্দি করে নেয়। অতঃপর ওর কাছে এসে ফোনের স্ক্রিনে ছবিটা দেখিয়ে বলে,

“দেখো হাসলে তোমাকে কতটা সুন্দর লাগে। আর তুমি কী-না কালেভদ্রে হাসো!”

তিতির ছবিটা এক পলক দেখে নিয়ে মাশরিফের দিকে দৃষ্টি সরায় ঠোঁট কোলে তার ফুটে আছে মৃদু হাসি। মাশরিফ স্ক্রিনেই ছবিটা জুম করে দেখছে। তিতির বলে,

“আপনি আমাকে খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করেন তাই না?”

“বারে! করব না কেন? আমার একমাত্র বউ বলে কথা।”

তিতিরের মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করছে। সে দৃষ্টি নিচু করে বলে,
“জানেন? আপনি মিশনে যাওয়ার পর আমি প্রতিটা মুহূর্ত ঘাবড়ে ছিলাম। মনের মধ্যে একগাদা ভয়-আশংকা ঘিরে ছিল। আপনার খোঁজ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। অবশেষে যখন ফোনে আপনার কণ্ঠস্বর শুনলাম তখন মনের সব ভয়-আশংকা নিমিষেই কর্পূরের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।”

মাশরিফ ওদের মধ্যকার দূরত্ব কমালো। তিতিরের এক হাত মুঠোবন্ধি করে বলে,
“লম্বা সফরের জন্য এই হাত ধরেছি। এতো সহসা তোমার পিছু ছাড়ছি না।”

তিতির নিজের অক্ষিকোণে জমে উঠা জলবিন্দু গুলোকে আকাশের দিকে মুখ করে শুষে নিতে চাইল কিন্তু অবাধ্য জলকণা অশ্রু রূপে কপোল বেয়ে নিজের জেদ বজায় রাখল। মাশরিফ আচমকা তিতিরের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে দ্রুত হস্তে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা তাদের গতি রোধ করে বলল,

“আজকে অন্তত কাঁদবে না। আমার সামনে তো নাইই। তোমাকে কাঁদতে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না। সবসময় হাসবে। তোমার চোখের পানি আমার হৃদয় অম্বরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ ঘটায়। আর হাসলে, মনে হয় সূর্য হেসে তার প্রেমময় মৃদু রোদ বর্ষণ করছে। যেমনটা আজকের বিকেলে সূর্য আজ ভীষণ খুশি।”

“আমার ভয়ের কারণটা আপনি জানেন। আগেরবারও বিয়ের পরপর উনি মিশনে গিয়েছিলেন। তারপর আর ফেরেননি। তাই এবারও বিয়ের পরপর আপনি মিশনে যাওয়াতে মনের মাঝে না চাইতেও ভয় ভর করেছিল। আমি বলে বুঝাতে পারব না যে …!”

মাশরিফ আচানক তিতিরের ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ওর মুখনিঃসৃত বাক্য অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য করল। অতঃপর তিতিরের কপালে নিজের অধর যুগলের উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বলল,
“পুরোনো কথা বাদ দাও। একদম ভুলে যাও। আমরা নতুন শুরু করেছি। সবটা নতুন ভাবে। আরেকবার যদি তুমি ওসব মনে করো তবে আমি তোমার সাথে রাগ করে আবারও এক সপ্তাহ তোমার সাথে যোগাযোগ রাখব না। আসলে এর বেশি হয়তো পারব না!

তিতির অশ্রুসিক্ত চোখেই হেসে ফেলল। মাশরিফ বলে,

“আমি আসলাম তোমাকে নিয়ে একটু হাঁটতে আর তুমি কী-না আগের কথা ভেবে নিজের চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছ। দিস ইজ নট ডান। দেখো, তোমার কান্নায় আইসক্রিম বেচারাও গলে গেছে।”

দুজনে একসাথে গলে যাওয়া আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। ওদের যুগলবন্দী হাসির সাক্ষী রৌদ্রজ্জ্বল নীলাভ অন্তরীক্ষ।

চলবে ইনশাআল্লাহ,#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৪
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেছে। মাশরিফ আবার সেনানিবাসে যাওয়ার আগেরদিন তিতিরদের বাড়িতে স্বপরিবারে এসেছে। এবার রিতিকাও সুযোগ পেয়েছে তিতিরের সাথে কথা বলার। সেদিন সায়ানের হুট করে জরুরী কাজ পরে যাওয়ার কারণে রিতিকাকেও পরেরদিন সকালে সায়ানের সাথে চলে যেতে হয়েছিল।
তিতির ও হিয়া, নাজমা বেগমের সাথে রান্নাঘরে কাজে ব্যাস্ত। তখন রিতিকা এসে তিতিরের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

“রান্না থেকে তো বেশ সুঘ্রাণ বের হচ্ছে।”

তিতির রিতিকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে আবারও রান্নায় মনোযোগ দেয়। রিতিকা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,
“আমি তোমার সাথে সবসময় রুড বিহেভ করেছি। একটু ভালো করে কথাও বলিনি। আমি যা করেছি তা একদমই অনুচিত। তাই আজ আমি সেসব রুডনেসের জন্য সরি বলতে এসেছি।”

তিতির কিঞ্চিত অবাক হলো। অতঃপর বলল,
“আমি তো কিছু মনে করিনি আপু। আপনি শুধু শুধু গিল্টি ফিল করছেন।”

“শুধু শুধু না তিতির, আমি নিজে বুঝতে পারছি ওসব বেশ রুড ছিল। তোমাকে মাশরিফ পছন্দ করে শুনেই রুড হয়েছিলাম।”

তিতির মাংসের পাতিলে পানি দিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে তোয়ালেতে হাত মুছে নিয়ে রিতিকার হাত ধরে শান্ত স্বরে বলে,
“ওসব পুরোনো কথা ভুলে যান আপু। প্রথম দেখায় তো সবার সবাইকে ভালো লাগবে না। আমি তো ওসব মনেই রাখিনি। আপনি আমার বড়ো। আমার বড়োবোন। ছোটোবোন হয়ে যদি বড়োবোনের এটুকু ভুলতে না পারি, তবে কি চলে?”

রিতিকার চোখের কোণে জলবিন্দু জমে ওঠে। সে হালকা হেসে বলে,
“তুমি আমার ছোটো হলে কী হবে? চিন্তাভাবনায় আমার বড়ো। আমাকে আর আপনি-আজ্ঞা করো না তো। তুমি করে বলো। আপন আপন লাগে।”

তিতির মুচকি হেসে বলে,
“আচ্ছা আপু। তুমি রিয়ানের কাছে যাও। আমি মা ও হিয়াকে একটু সাহায্য করে আসছি।”

রিতিকা মৃদু হেসে চলে যায়। তিতির দ্রুত হাতের কাজ গুলো সারতে শুরু করে।

________

দুপুরের খেতে বসে সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেল। তিতির সবার জন্য নিজ হাতে রসমালাই বানিয়েছিল সেটাও সবাইকে দেওয়ার পর সে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। মাশরিফ তো আড়ালে গিয়ে তিতিরের হাতে চুম্বন পর্যন্ত করেছে! মাশরিফের এই কাণ্ডে তিতির বাকরুদ্ধ হয়ে হতচকিত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে ছিল। মাশরিফ কিছু না বলে মুচকি হাসতে হাসতে ড্রয়িংরুমে ফিরে যায়।

নাজমা বেগম মাহিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আপা, তোমাকে, রিতিকা ও সায়ান বাবাকেও কিন্তু আজ থাকতে হবে। আমরা তো বড়ো বাসা নিয়েছিই। এবার থাকার ঘর নিয়ে অতো ঝামেলা হবে না। মাশরিফ তো থাকবেই, সেই সাথে তোমরাও।”

“কী বলিস নাজমা! আমার কালকে রবিবার, সকালে ক্লাস আছে।”

“থাকুক ক্লাস। তিতিরও তো দুপুরের ক্লাসটা করেনি। কিছু হবে না। তাছাড়া সকাল সকার রওনা করলে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবে।”

তখন সায়ান বলে ওঠে,
“খালাজান ঠিক বলেছে মা। আমি আপনাকে ও রিতিকে পৌঁছে দিব। তারপর ঢাকা যাব। আমার অফিসের কাজ দুপুরে পরেছে।”

“না বাবা, তোমার ঝামেলা হয়ে যাবে।”

“কিছু হবে না মা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। খালাজান কতো শখ করে আপনাকে রাখতে চাইল। থেকে যান।”

তিতিরও বলে,
“জি মনি, থেকে যান প্লিজ।”

তিতিরের সাথে হিয়াও তাল মেলাল। সবার এতো অনুরোধে মহিমা বেগম থেকে যেতে রাজি হোন।

________

রাতে তিতির নিজের সাদা এপ্রোনটা ধুঁয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে মেলতে এসে দেখে মাশরিফ এক ধ্যানে আকাশপানে চেয়ে আছে। তিতির যে এসেছে তাতে তার কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হলো না। এপ্রোনটা মেলে দিয়ে তিতির মাশরিফের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“আপনার কি মন খারাপ? এতো উদাসীন কেন?”

“কোথায় উদাসীন? আঁধারচিত্র অম্বরের রূপ আস্বাদন করছি। দেখো কী সুন্দর হীরা খচিত কালো শাড়ির ন্যায় এই আঁধারে পুরো আকাশটা ছেয়ে আছে।”

মাশরিফের মুগ্ধতার মাঝে করুণতার ছাঁপ যেন আড়ালে দৃশ্যমান। তিতির রেলিংয়ের উপর কনুইতে ভর দিয়ে মাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম বুঝলাম! মেজর সাহেবের কাল চলে যাবে বলে ভীষণ মন খারাপ। এই চন্দ্রমা বিহীন অম্বরে কী তবে দুঃখ বিলাশ করবেন?”

“দুঃখ না। প্রেমবিলাশ করব!”

মাশরিফের প্রত্যুত্তরে তিতির খানিক লজ্জা পায়। সেই রেশ বিদ্যমান থাকা অবস্থাতেই মাশরিফ তিতিরকে হেঁচকা টানে নিজের সামনে নিয়ে আসলো। অতঃপর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তিতিরের কাঁধের খোলা অংশে উষ্ণ ওষ্ঠ ছুুঁইয়ে নির্বিকার চিত্তে অন্তরিক্ষে দৃষ্টি সরায়। আচমকা এহেনো কাণ্ডে তিতিরের বুকের ভিতরে শীতল কম্পন বয়ে চলেছে। মাশরিফ সম্মোহিত কণ্ঠে বলে,

“আমার আঁধারপ্রিয়া! তারার দেশে আপনাকে স্বাগতম। আজ চন্দ্রমার আড়ালে আপনার জন্য অগণিত তারার মেলা নিয়ে এই কৃষ্ণ অম্বরে আমার ভালোবাসা উজার করেছে। যদি আপনার একটু..!”

“সব মনজুর!”

তৃষ্ণার্ত হৃদয় আজ পরিপূর্ণ। মিটিমিটি তারকারাজি ওদের ভালোবাসার সাক্ষী।

______

জুলাই মাস। বাংলা বর্ষপঞ্জীতে শ্রাবণ মাসের আজ তৃতীয় দিন। প্রকৃতিতে বর্ষাঋতুর দাপট বিরাজমান। তিতির চোখ বুজে মেডিকেল কলেজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের প্রথম বর্ষণে হাত ভিজাচ্ছে। সেই সাথে তার বান্ধবীরাও। আজকেই প্রফ শেষ হলো ওদের। মনে একপ্রকার স্বস্থি কাজ করছে। তখনি পেছন থেকে কেউ বলে ওঠল,

“হেই গার্লস! হোয়াটসআপ?”

তিতির, নাদিয়ারা চকিত দৃষ্টিতে পেছনে ফিরে দেখল অর্ক, রাফি, মাশরিফ, শুভ, রাতুল, রনিত ও অভী দাঁড়িয়ে আছে। জারিন অবাক কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনারা? কখন এসেছেন?”

“এই তো মাত্রই। তোমরা তো বৃষ্টিবিলাশে মগ্ন। তাই খেয়াল করোনি? কেমন আছো সবাই? আজ তো প্রফ শেষ হলো?”

অর্ককে প্রত্যুত্তরে ফাইজা বলল,
“হ্যাঁ। স্ট্রেস ফ্রি লাগছে, তাই ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের কতোদিন পর দেখলাম। আর রাফি ভাই? আপনি মনে হচ্ছে আরও শুকিয়ে গেছেন?”

রাফি হালকা হেসে বলে,
“না। অনেকদিন পর দেখলে তো তাই মনে হচ্ছে।”
“তাও হতে পারে।”

অর্ক সবার মনোযোগ আকর্ষণে বলে,
“গাইজ! গাইজ! যে কারণে এখানে আসা তা তো শুনো।”

তিতির জিজ্ঞেসা করে,
“কী কারণে ভাইয়া?”
“সামনের শুক্রবার আমার বিয়ে!”

অর্কের কথায় সবাই অবাক হয়ে যায়। ওরা সমস্বরে বলে ওঠে,
“সত্যি? ওয়াও!”

“তোমরা সবাই যাবে। আর তিতির তো এমনিতেই যাবে। বন্ধুর বউ বলে কথা। তোমরা আমার ছোটো ভাই-বোন তোমাদেরকে যেতেই হবে।”

“অবশ্যই যাব ভাই। বিয়ের তিনদিন আগে গিয়ে বসেও থাকতে পারি।”

“যবেই যাও, বিয়ে এটেন্ড করতেই হবে।”

“ইনশাআল্লাহ ভাইয়া।”

“তোমরা বৃষ্টিবিলাশ করো, আমি যাই ইনায়াদেরও বলে আসি। তা ওরা কোথায় এখন?”

নাদিয়া কিছু ভেবে বলল,
“হসপিটালে মেবি। আপু তো এখন বিকেল টাইমে হসপিটালেই থাকে। ওয়ার্ডে ডিউটি শুরু যে।”

“আচ্ছা তাহলে থাক। তবে আমার বন্ধুকে দয়া করে যদি তোমাদের বান্ধবীকে একলা ছেড়ে দিতে! খুব উপকার হতো।”

সবাই হেসে উঠলে তিতির লজ্জা ও রেগে মাশরিফের বাহুতে বেশ জোড়েই চি*মটি কা*টে। মাশরিফ মৃদু আর্তনাদ করতে নিয়েও তিতিরের তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে থেমে যায়।
অতঃপর মাশরিফ তিতিরকে নিয়ে তিতির একটা অপূর্ণ ইচ্ছে, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মাশরিফের সাথে ঝাল ঝাল ফুচকা খাওয়া। সেটা পূরণ করতে একই ছাতার নিচে দুজনে বেরিয়ে পরল। অভী, রণিত ও রাতুল তিনজনে ক্যান্টিনে চলে গেল চা-কফি খেতে।

♣♣
রাফি ও অর্ক ইনায়াকে খুঁজতে হসপিটালে যায়। প্রতিটা ওয়ার্ডে খুঁজে খুঁজেও পায় না। হঠাৎ রাফির কানে খুব চেনা কারও হাসির ঝংকার আসলে সেই সূত্র ধরে করিডোরের শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখে, ইনায়া ও একজন সাদা এপ্রোন পরিহিত ছেলে বৃষ্টি দেখে হেসে হেসে চা উপভোগ করছে। ওদের হাসির মাত্রায় বুঝা যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গ তাদের কাছে বেশ ভালোই জমেছে। রাফির হঠাৎ ভীষণ রাগ হলো। রেগে উলটো দিকে ফিরে চলে আসল। বেচারা অর্ক একদিকে ইনায়াকে ইনবাইট করবে নাকি বন্ধুর পিছনে যাবে তা নিয়ে দোটানায় পরে গেল। অতঃপর রাফির পিছনে যাওয়া ধরল।

রাফি ক্যান্টিনে গিয়ে দুই তিনটা চেয়ার বেশ শব্দ করে সরানো বললে ভুল হবে ফেলে দিয়ে অভীদের পাশে বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। ক্যান্টিনে উপস্থিত অন্যান্যরা কৌতুহল নিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে। তা দেখে রাফি হুংকার ছাড়ে,

“কী সমস্যা? নিজেদের খাবার খাও নয়তো বেরিয়ে যাও!”

অর্ক ওর পিঠে হাত রেখে শান্ত করতে বলে,
“শান্ত হ রাফি।”
“চুপ থাক। আমার মা*থা গ*রম হয়ে আছে।”

রাফির হঠাৎ রেগে যাওয়ার কিছুই বুঝল না অভী, রাতুলরা। রাতুল অর্ককে জিজ্ঞেসা করে,
“কী হয়েছে? হঠাৎ রেগে গেল কেন?”

অর্ক কপাল চা*পড়ে বলে,
“আরেহ! কী আর হবে! ইনায়াকে একজনের সাথে খুব হাস্যপরিহাস করে নিরব জায়গায় বৃষ্টি উপভোগ করে চা খেতে দেখেছে। তাতেই বান্দা..!”

রাফি রেগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,
“ও নাকি আমাকে ভালোবাসে? এই তার নমুনা?”

রণিত ট্যাড়া ট্যাড়া কণ্ঠে বলে,
“তুই মনে হয় মেয়েটার ভালোবাসা খুব গ্রহণ করছ! নিজে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছিস, আবার মেয়েটা অন্যকাউরে পছন্দও করতে পারব না!”

“আমি ফিরিয়ে দিতাম আগে। এখন তো ফ্রেন্ড আমরা।”

অভী খোঁ*চানো স্বরে বলে,
“এহ আসছে ফ্রেন্ড! তোর ফ্রেন্ড তুই রাখ! ঢং করবা তুমি আর মেয়েটা একটু চা খেলেই দোষ!”

রাতুল সবাইকে থামিয়ে বলে,
“উফ থাম তোরা। আমরা তো জানি রাফি ইনায়াকে ভালোবাসে। তাহলে এখন কী করা যায় তাই বল।”

আচমকা রিনি শুভর সাথে এসে বলে ওঠে,
“সরাসরি বিয়ে!”

রাফি সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে শুধায়,
“মানে?”
রাফির প্রশ্নের জবাবে রিনি বলে,
“মানে খুব সহজ। আজ এই বাদল দিনে আপনি ইনুকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিবেন।”

শুভ তাল মিলায়,
“আমি রিনির সাথে সম্পূর্ণ একমত। তোরা কী বলিস?”

“আমরাও। দাঁড়া মাশুরে কল করি। ওরেও তো জানাতে হবে।”

রণিতের এরকম উৎসাহ দেখে রাতুল ওর মা*থায় চা*টা মে*রে বলে,
“এই বেয়া*ক্কল! মাশরিফ আর তিতির বৃষ্টির মাঝে ফুচকা ডেটে গেছে। তুই মাঝখান দিয়ে বিঘ্ন ঘটাতে চাস কেন!”

“একটা ফোনই তো করব।”

“পরে করিস। একটু পর ওরা নিজেরাই আসবে।”

***
ঝুম বৃষ্টির ছন্দে ছন্দে ঝাল ঝাল বো*ম্বাই ম*রিচ দেওয়া ফুচকা দেখে তিতির আর লোভ সামলাতে পারছে না। ফুচকার টকের উপর এক ফোঁটা বৃষ্টির জল টুপ করে পরল। তিতিরের হাতে ফুচকার প্লেটটা আসা মাত্রই টপাটপ পরপর দুটো মুখে পু*ড়ে নিয়েছে সে। তা দেখে মাশরিফ ছাতা হাতে হাসছে। এই সুযোগে তিতির টুপ করে মাশরিফের মুখেও একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ মাশরিফের নয়নযুগল থ হয়ে যায়! অমনি ফুচকাটা অতিরিক্ত ঝালের কারণে মুখ থেকে ফেলে দিতে নিলে তিতির ওর মুখ চেপে ধরে বলে,

“উহুম। খেতে হবে এটা। ঝাল বেশি কিন্তু এতো টেস্ট যে না খেলেই মিস!”

মাশরিফ গোঙাচ্ছে কিন্তু তিতির তো শোনার পাত্র নহে! অবশেষে ফুচকাটা ওকে পেটের ভিতর চালান করতে বাধ্য করল। মাশরিফের অধিক ঝাল লাগার দরুণ তিতির আশেপাশে একটু নজর বুলাল। অতঃপর আচানক পা উুঁচু করে মাশরিফের হাত ধরে টান দিয়ে সামান্য নিচু করে টুপ করে মাশরিফের নিম্ন ওষ্ঠে নিজের অধর জোড়া ছুঁইয়ে সরে আসল। মাশরিফ হতবাক, হতভম্ব দৃষ্টিতে তিতিরের দিকে চেয়ে আছে। তিতির মুচকি হেসে অন্যদিকে ফিরে ফুচকা খাচ্ছে। এদিকে তুমুল বারিধারার শিথিল হতে ধরেছে।

____

পরাশিষ্টঃ
পরপর পেরিয়ে গেছে চারটা বছর। মাশরিফ ও তার পরিবার ও বন্ধুমহলের সবাই হসপিটালের করিডোরে ভীড় জমিয়েছে। সবাই বেশ অস্থীর হয়ে মনে মনে প্রার্থনা করছে। এখানে সবচেয়ে বেশি অস্থীর অবস্থা মাশরিফের! জানুয়ারির প্রথমার্ধের তীব্র শীতেও সে দরদর করে ঘামছে। পাঁচ বছরের হায়াত ও রিয়ান মাশরিফের দুইপাশে চুপচাপ বসে আছে। তারাও বুঝতে পারছে সবাই খুব চিন্তিত এমনকি ওরা নিজেরাও। তখনি অপারেশন থিয়েটারের লাইট বন্ধ হয়ে দরজা খুলে একজন বেশ অভিজ্ঞ মহিলা ডাক্তার বের হন। মাশরিফ ডাক্তারকে দেখে তৎক্ষণাৎ উঠে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে,

“ডাক্তার আমার স্ত্রী কেমন আছে? আর বাচ্চারা?”

ডাক্তারটি মুচকি হেসে চলে গেলে রিনি ও ইনায়া দুইজনে নিজেদের হাতে করে দুটো বাচ্চা নিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়। মাশরিফ ওদের কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
“তিতির কেমন আছে?”

ইনায়া মাশরিফের কোলে মেয়ে বাচ্চাটা তুলে দিয়ে বলে,
“তিতির একদম সুস্থ। সিজার হয়েছে তাই নড়াচড়াতে সমস্যা হবেই।”

মাশরিফ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সবার মাঝে আনন্দ ধ্বনি ও শুকরিয়ার ধ্বনি। মাশরিফ গভীর দৃষ্টিতে নিজের বাহুতে ছোট্ট তুলতুলে বাচ্চাটাকে দেখছে। তখন রিনি বলে ওঠে,
“ছেলেকেও একটু কোলে নাও। রাজকন্যাকে তো নিলে এবার রাজপুত্রকেও নাও।”

মাশরিফ অনুভূতি প্রকাশে ব্যার্থ! ফ্যালফ্যাল নয়নে মেয়েকে ইনায়ার কোলে দিয়ে রিনির কোল থেকে ছেলেকে নিল। একবার মেয়েকে তো একবার ছেলেকে দেখে তার মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসে, “আলহামদুলিল্লাহ্‌!”
কিছুসময় ওদের নিজের কাছে রেখে তারপর বাচ্চাদের কারও কোলে দিয়ে ছুঁটে গেল তিতিরের স্ট্রেচার দেখে। তিতিরকে কেবিনে দেওয়া হচ্ছে। সবাই মাশরিফের এই পা*গলামি দেখে হেসে ফেলে।

-*-*-*
তিতির ঘার কাত করে দোলনায় তার ঘুমন্ত দুই শিশুকে নয়ন ভরে দেখছে। মাশরিফ নিরবে এসে তিতিরের ললাটে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলে,
“আমাকে এতো খুশি দেওয়ার জন্য তুমি যা করলে তার জন্য আমি মুখে যাই বলি কম হয়ে যাবে। আমার জীবনে এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ হয়ে আসা রমণী তুমি। ভালোবাসি তিতিরপাখি।”

তিতির মুচকি হেসে বলল,
“আমিও ভালোবাসি মেজর সাহেব।

ওদের জীবনের প্রতিটা সায়াহ্ন প্রেমছন্দ আন্দোলিত হোক।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here