#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪১
আরও দুটো দিন পেরোল। গতকালকে পৌঁছে মাশরিফরা আজ থেকে সিলেটে ত্রাণের বাহানায় নিজেদের লক্ষ্যের নিকটে এগুচ্ছে। এদিকে প্রায় ৪ দিন যাবত মাশরিফের কোনো খবরাখবর না পেয়ে তিতিরের মনের মধ্যে সার্বক্ষণিক অস্থীরতা বিরাজ করছে। ক্লাসে অমনোযোগীতার কারণে মাত্রই প্রফেসর ওকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। তিতির বিনা প্রতিবাদে চুপচাপ মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছে। ক্লাসে বসা ওর বন্ধুরা অবাক নয়নে তিতিরকে বেরিয়ে যেতে দেখল। ওরা বুঝতে পারছে না, হুট করে কয়েকদিন ধরে তিতির কেমন মনমরা হয়ে থাকে। মন খারাপ কীনা জিজ্ঞেসা করলেও কথা কাটিয়ে যেত। আর আজ ক্লাসে এতোটা অমনোযোগী যে প্রফেসর ওকে ক্লাস থেকে বের করে দিল! নেহাত একটা গুরুত্বপূর্ণ টপিক পড়াচ্ছে, তাই ওরা কেউ বের হতে পারছে না।
তিতির ক্লাসরুমের থেকে বের হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার একাকি কোনো খোলামেলা জায়গায় যেতে ইচ্ছে হলো বলেই সে লেক পাড়ে গেল। সেখানে ঘাসের উপর বসে এক ধ্যানে শান্ত জলের দিকে নিমগ্ন হয়ে আছে। প্রায় ঠিক মাথার উপর সূর্যটা অবস্থান করছে করছে অবস্থা। তপ্ত রোদে মিনিট খানিক দাঁড়ালেই ত্বক পু*ড়ে যাওয়ার দশা হয়, সেখানে তিতির প্রায় অনেকটা সময় নীরবে এক ধ্যানেই বসে আছে। হঠাৎ উড়ন্ত পাখির মুখ থেকে কংকর শান্ত জলধিতে পতিত হওয়ার দরুণ শান্ত জলাশয় আন্দোলিত হয় যার বদৌলতে তিতিরের ধ্যান ভঙ্গ হয়। তিতির নিজে নিজেই করুণ স্বরে স্বগতোক্তি করে,
“খুব জলদি ফিরে আসুন। আমার এই আশংকা, ভয়-ভীতি, অস্থিরতার সমাপ্তি টানুন। আর তো হারাতে চাই না। আমার এখন নিজের ভাগ্যকে নিয়েই শংকা! আমার ভাগ্যের জন্য না আবারও এক মায়ের কোল খালি হয়! আমি জানি এসব ভাবা ঠিক না কিন্তু না চাইতেও আমার অবচেতন মনের ভীতি আমার চেতনাতে আ*ঘা*ত করছে। আমি কিছুতেই মন লাগাতে পারছি না। আমার সকল প্রার্থনাতে আপনি রাজ করছেন। প্লিজ ফিরে আসুন।”
বলতে বলতেই তিতির হাঁটু মুড়ে নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে নিজের অশ্রধারা লুকাতে ব্যাস্ত।
ক্লাস শেষে কিছুক্ষণ পর তিতিরকে খুঁজতে খুঁজতে ওর বন্ধুরা শেষমেশ লেক পাড়ে উপস্থিত হয়। নাদিয়া ছাতা মা*থায় তিতিরের পাশে বসে বলে,
“এই তীব্র রোদের মধ্যে তুই বসে আছিস! তোর কি মা*থা খারাপ হয়ে গেছে? তুই এখানে বসে আছিস আর আমরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়েছি। একটু বলে তো দিবি! মেসেজ তো করে দিবি যে কোথায় আছিস।”
তিতির জবাব দিল না। চুপচাপ লেকের পানির দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। ওকে এরকম চুপ করে থাকতে দেখে জারিন মৃদু ধা*ক্কা দিয়ে বলল,
“কী-রে কী হয়েছে তোর? এমন করে বসে আছিস কেন? দুইদিন ধরে লক্ষ্য করছি তুই কেমন মনমরা হয়ে আছিস! তোকে জিজ্ঞাসা করলেই কিছু জবাব দিচ্ছিস না আবার বলছিস কিছু হয়নি। আর আজকে ক্লাসে এতটাই অমনোযোগী হয়ে গেলি যে স্যার তোকে ক্লাস থেকে বের করে দিতে বাধ্য হলো! বুঝলাম না আমি কিছু। আমাদের সাথে শেয়ার কর। শেয়ার করলে তোর মনটা হালকা হবে। বল কি হয়েছে?”
তাও তিতিরের কোন ভাবান্তর হলো না দেখে ফাইজা কিছুটা আইডিয়া করে বলল,
“তুই কি কোন ভাবে মাশরিফ ভাইয়ার জন্য চিন্তিত? উনি যাওয়ার পর থেকেই তুই কেমন খোয়া খোয়া ভাব! মানে বিয়ের পর থেকেই। এতো চিন্তা করছিস কেন?”
তিতির লেকের শান্ত জলের থেকে এ অবিরত আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। এক তিক্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মন থেকে। সে বলল,
“শূণ্য কলসিই বুঝে তার শূণ্যতার মানে।”
“হেয়ালি করিস না। আমাদের সাথে শেয়ার কর।”
জারিনের সাথে তাল মিলিয়ে জুলিয়া আদুরে কণ্ঠে বলল,
“কী হয়েছে তিতির? হোয়া হ্যাপেন্ড ডিয়ার?”
ইমরান ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়ে নিজের দুই হাত মাথার নিচে রেখে আয়েশি ভঙ্গীতে বলে,
“স্বামীর বিরহে রমণী মূর্ছা যাবে যাবে অবস্থা। রমণী এখন দিন দুনিয়া ভুলিয়া তৃষ্ণার্ত ফটিকের ন্যায়… এই ফটিকই হবে না?”
ইমরান নিজেই নিজের পঙক্তির ভুল ধরে মা*থা চু-লকাতে চু*লকাতে উঠে বসে। রণক ওর মাথায় চা*টা মে*-রে বলে,
“চাতক পাখিটা বেশি যায় তবে তিতির পাখিও বলতে পারিস।”
লিরা সাবধানী সুরে বলে ওঠে,
“নো নো নো! তিতির পাখিতো কারও পারসোনাল রাইট। উই শুড কেয়ারফুল এবাউট দিস।”
“ওহহো! মাশরিফ জিজুওও!”
নাদিয়ার রম্য টানে তিতির মুখ ঢেকে হেসে ওঠে। তিতিরের বন্ধুরা এখনকার মতো ওর দুঃখী ভাব শূণ্যে উড়িয়ে দিয়েছে। আবারও হাসি-খুশি হয়ে ওঠেছে।
________
পরের দুই দিন আবারও ত্রাণ বিতরণ চলছে। আইডিকার্ডের নাম্বার ভ্যালিড কী-না সব চেক করে তবেই দেওয়া হচ্ছে। তাই জন্য দেরীও হচ্ছে। তিন দিনে কার্যকর্ম প্রায় শেষ। ঝড়-বৃষ্টির কারণে একদিন পর মুক্ষোম জায়গায় অ্যা*টাক করতে অগ্রসর হচ্ছে। মাশরিফরা প্রথমে দিনের বেলায় ওদের পজিশন বুঝে নজরে নজরে রেখেছে। তাছাড়া কাশফা, সুজন, পলাশের ফোনের মাধ্যে তথ্য জানা তো আছেই। টেরো*রিস্ট*রা যাতে লোকেশন ট্র্যাক না করতে পারে তাই অতিদ্রুত ওদের লোকেশন ঠিক রাখা হয়েছে। তারপর গভীর রাতের দিকে সেইসব ঘরে আ*গু*ন দিয়েছে। তার আশেপাশের বাড়ি ঘরের মানুষজন ভয়ে সরে গেছে। তাদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেও আসা হয়েছে। তারপর শুরু হয় গো*লা বর্ষণ!
গভীর রাত হওয়াতে টে*রো*রি-স্টরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তাছাড়া যেই হোটেল ঘর থেকে ওদের খাবার সাপ্লাই গেছে সেটাতেও কিছুটা নে*শা দ্রব্য মেশানো হয়েছিল। হোটেলের মালিক বুদ্ধিমান বলেই মাশরিফদের টিমকে সাহায্য করেছেন। বেশ কয়েকজন টে*রো*রি*স্টের স্পট ডে*থ হয়েছে। আর বাকি কয়েকজনকে আ*ট*ক করা হয়েছে।
________
সিলেট থেকে ষষ্ঠ দিনের মিশন শেষে ওরা সেনানিবাসে ফিরে আসে। সময় কম লাগার কারণ এবার আর্মি সদস্য প্রতিবারের তুলনায় বেশি ছিল এবং গুপ্তচ*রবৃত্তি!
টে*রো*রি*স্টদের রা-ষ্ট্রদ্রো-হীতার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়। আর আর্মি সদস্যদের দুই দিনের জন্য সেফটির জন্য সেনানিবাসে থাকার জন্য বলা হয়।(আমি জানিনা কতোদিন থাকতে হয় বা হয়তো থাকতে হয়ই না!)
মাশরিফ তার মাকে প্রথমে ফোন করে জানিয়ে তারপর তিতিরকে ফোন করতে উদ্দত হয়। মনের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে ব্যাপারটাতে। তিতিরের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা তাকে কল্পনা করাচ্ছে। নানারকম কল্পনা-ঝল্পনা শেষে মাশরিফ ফোন করেই বসে।
তিতির তখন আনমনে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখছিল। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ঘোর ভাঙে। ফোনটা হাতে নিয়ে কাঙ্খিত নাম্বার থেকে কল দেখে মন আনন্দে নেচে উঠে আবার পরক্ষণেই ভয় হতে শুরু করে। ঝড়-বৃষ্টির জন্য টিভির ঢিশ ঠিক নেই। ফোনেও নেটওয়ার্ক সমস্যা তাই খবরটা সে জানেনা। ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করে একদম চুপ হয়ে থাকে। দুই পক্ষেই কট্টর নিরবতা বিরাজমান। প্রায় মিনিট খানেক এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর তিতিরের অস্থির নিঃশ্বাস যেন ক্রমবর্ধমান। মাশরিফই প্রথমে নিরবতা লঙ্ঘন করে।
“কেমন আছো তিতির?”
সাথে সাথে তিতির তার নয়ন জোড়া বন্ধ করে নেয়। সরু জলধারা মূহুর্তেই কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে। তিতির নিজেকে ধাতস্থ করে ভাঙা স্বরে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন মেজর?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। এখন তোমার কণ্ঠস্বর যেন আরও স্বস্থি দিচ্ছে। আমার অনুপস্থিতিতে যে কারো কণ্ঠ স্বরে তার হৃদয়ের লুকানো অনুরুক্তি প্রকাশ পাবে তা কেবল আমার কল্পনাতেই ছিল।”
মাশরিফের এহেনো সম্বোধনে তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। মাশরিফ আবারও বলল,
“আমার নামের প্রেম তোমার হৃদয় ও সর্বাঙ্গে বর্ষিত হোক তিতিরপাখি! যখন আমার আলতো ছোঁয়ায় তা অনিন্দ্য আবির রাঙা হয়।”
তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড ব্রীড়াতে ফোনটা কানে রাখাও যেন অসম্ভবপ্রায় হয়ে পরেছিল। খট করে কল কে*টে দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে।
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
মাশরিফ আজকে সেনানিবাস থেকে মির্জাপুরে ফিরল। প্রথমে মায়ের চিন্তিত মুখে স্বস্থি ফেরাটা তার দেখার ইচ্ছে। পরেরদিন তিতিরদের ওখানে যাবে। মায়ের কোয়াটারে গিয়ে দেখল তার বোন রিতিকাও সেখানে আছে। মাশরিফকে দেখামাত্রই মহিমা বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। মনের ভয়টা নিমিষেই শূণ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। ছেলের জন্য আজ তার ভীষণ গর্ব হচ্ছে। ছেলে যে তার বাবার কথা রাখতে পেরেছে। সায়ান এসে মাশরিফকে আলিঙ্গন করে বাহবা দিল। কিন্তু রিতিকা এখনো সোফায় এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে। মাশরিফ বোনের এই নীরবতা দেখে খানিক অবাক হলো। অতঃপর বোনের কাছে গিয়ে বোনের পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল,
“কী হয়েছে তোর আপু? তোর কি কোন কারনে মুড অফ? তুই কি আমাকে দেখে খুশি হসনি?”
রিতিকা হকচকিয়ে ওঠল। সে দ্রুত তাড়াহুড়ো করে জবাব দিল,
“না না আমি খুব খুশি হয়েছি। তুই সুস্থ ভাবে বিজয়ী হয়ে ফিরেছিস। আমি ভীষণ খুশি। তুই পারলে আমাকে মাফ করে দিস। আমি জানতাম না যে কাশফা এতটা নিচু মনের মেয়ে। আমি জানতাম না ও তোর ক্ষতি করতে চাইবে। সত্যি জানতাম না। জানলে আমি কখনোই ওর পাশে থাকতাম না। আমার এখন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। এই কাশফার জন্য আমি তোর সাথে, মায়ের সাথে, সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। আর এই কাশফা কিনা আমার নিজের ভাইকেই মে*রে ফেলতে চেয়েছিল!”
মাশরিফ মুচকি হাসল। তার বোনটা যে সহজ সরল সে তা বোঝে তার বোনকে যে কেউ নিজের কথায় মায়াজালে জড়িয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া কাশফা মেয়েটাই এমন যে অন্যকে নিজের মায়াজালে জড়াতে বাধ্য করে। মাশরিফ তার বোনের গালে হাত রেখে বলল,
“আপু, আমি তোর প্রতি একটুও রেগে নেই। বলতে গেলে আমার তোর সাথে কোন বিবাদই ছিল না। আমি তো জানতাম কাশফা মেয়েটাই আমার বোনকে নানা কথা বুঝিয়ে এরকমটা করেছে। না হলে আমার বোন এরকম না।”
রিতিকা মলিন কন্ঠে বলল,
“তিতিরও নিশ্চয়ই আমাকে মনে মনে খুব খারাপ ভাবছে। তাই নারে? আমি ওর কাছে গিয়ে মাফ চাইব। আজকে যাবি? আমিও তোর সাথে যাব। আমি গিয়ে মাফ চাইব ওর কাছে। আমি ওর সাথে ঠিকমত কথা বলিনি, হাসি মুখে কথা বলিনি। আমি জানি ওর খারাপ লেগেছে। আমার যে কি হয়েছিল! যে কাশফা যা বলতো তাতেই আমি ইমোশনাল হয়ে পরতাম। ওর প্রতি একটা সফট কর্নার সব সময় মনের মধ্যে থাকত।”
“আরেহ আপু, তিতির তোকে কিছুই মনে করেনি। তুই তো আর ওকে কটু কথা বলিসনি। হ্যাঁ তোর কণ্ঠে একটু রূঢ়তা অবশ্যই ছিল। এখন পরেরবার ওর সাথে দেখা হলে হাসিমুখে সুন্দর করে কথা বললেই দেখবি ও আগের সব ভুলে গেছে।”
মাশরিফ রিতিকাকে বোঝানোর সময় রিয়ান বলে ওঠে,
“মা তুমি চিন্তা করো না। মামি অনেক সুইট। সে তোমাকে ব*কবে না। জানো সে আমাকে কতো আদর করে।”
ছেলের কথা শুনে রিতিকা হালকা হাসে। ওদের কথা-বার্তার মধ্যেই মহিমা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,
“এই তোরা জলদি হাত-মুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি টেবিলে খাবার লাগাচ্ছি। আর মাশরিফ তুই ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় বদলে ফ্রেস হয়ে দ্রুত নামাজটা পড়ে আয়। বিকেল হয়ে যাচ্ছে।”
মাশরিফ মাকে একবার জড়িয়ে ধরে ফ্রেশ হতে চলে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে তিতিরকে মেসেজ করে দিল সে পৌঁছে গেছে।
এদিকে তিতির মাশরিফের দেওয়া মেসেজটা পড়ে মুচকি হাসল। এতটা সময় সে এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এখন সে তার ফ্রেন্ডের বলছে,
“এই ক্যান্টিনে চল। ভীষণ খিদে পেয়েছে।”
ইমরান বলে ওঠে,
“আধা ঘন্টা আগে যখন আমরা খেতে গিয়েছিলাম তখন গেলি না কেন? তখন লাইব্রেরী তো চলে আসলি কেন পড়ার জন্য? তখন তো খুব বলেছিলি তোর পেটে খিদে নেই। তো এখন আবার খিদে কোত্থেকে আসল? আধা ঘণ্টার মধ্যেই খিদে পেয়ে গেল?”
তিতির কি বলবে? আমতা আমতা করছে সে। সে বোকার মত হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তখন খিদে ছিল না। তাছাড়া আমরা মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমাদের বুঝতে হবে, সবার পরিপাক ক্রিয়া এক সময় হয় না। মাঝেমাঝে কিছু কারণে তেরি হয়। তখন খিদেও দেরিতে লাগবে। স্বাভাবিক না!”
“হুম খুব স্বাভাবিক। এখন নিজে গিয়ে নিজের স্বাভাবিক খাবার খা। আমাদের সাথে এতো বলার পরও একটু অস্বাভাবিক ভাবে খেতে গেলি না। এখন তোর জন্য যা স্বাভাবিক তা আমাদের জন্য অস্বাভাবিক।”
ফাইজা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তিতিরকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কথাটা বলল। তিতির ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
“ঠিক আছে। আমি একাই যাব। থাক তোরা।”
নাদিয়া বলে ওঠে,
“হইছে থাম। চল। আমিও যাব।”
একে একে সবাই একই কথা বলে। জারিন বাঁকা হেসে বলে,
“তুমি যে তখন কেন যাও নাই তা কি আমরা বুঝি নাই? মেসেজ দেখে এখন বলো যাবা। একটা গান আছে না? বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা! শুধু পার্থক্য একটাই, প্রকৃতিতে বসন্ত চলে গেছে কিন্তু তোর মনে বসন্ত রাঙিয়ে গেছে।”
জারিনের এহেনো কথায় বন্ধুমহলে হাসির রোল পরল ঠিক কিন্তু একজন লজ্জাবতী লতার ন্যায় চুপসে গেছে।
________
খেতে বসে মহিমা বেগম বলেন,
“কাশফার পরিবার নাকি ওদের টাঙাইলের বাড়িটা বিক্রি করে দিবে। ওদের মামা নাকি খালা কে যেন কানাডাতে আছে। সেখানে চলে যাবে। কাশফাকে জেল থেকে মুক্তি দিলেই চলে যাবে। মেয়ের জন্য ওদের দুর্নাম রটে গেছে। এখন বিবাহ উপযোগ্য মেয়েকে তো এই দেশে বিয়ে দিতে পারবে না। তাই চলে যাবে।”
মাশরিফ খেতে খেতে বলে,
“এতোটা আদর ও ছাড় দিয়েছে বলেই এই অবস্থা। মেয়ের স্বভাবে যদি প্রথমেই লাগাম টানত তবে আজ এসব হতোই না। কিন্তু উনারা তো মেয়ের আবদারের জন্য অন্যের পায়ে ধরতেও রাজি হয়ে যায়, হোক সেটা অন্যায় আবদার!”
“কী করবে বল। বাবা-মায়ের ভালোবাসা এমনি। দোয়া করি মেয়েটা শুধরে যাক।”
মাশরিফ আর কিছু বলে না। খাওয়া-দাওয়ার পর আসরের নামাজ পড়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।
_____
তিতির বাড়ি ফিরতেই হিয়া উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে ওঠল,
“জানিস তিতির, হায়াত হাঁটতে পারে।”
“সত্যি? ও তো শুধু একটু সময় দাঁড়াতে পারে।”
তিতিরের অবাক কণ্ঠ শুনে হিয়া হেসে বলে ওঠে।
“এক কদম বাড়িয়ে পরে যায়। আমি একটু আগে দেখলাম।”
তিতির খুশি হয়ে ফ্রেশ না হয়েই হায়াতকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে তারপর ওর হাত ধরে সারা ঘরে হাঁটায়। তিতিরের ইচ্ছে হায়াত একদিনেই পুরো হাঁটা শিখে যাক!
পরের দিন বিকেলে মাশরিফ তিতিরের জন্য হসপিটালের গেইটে অপেক্ষা করছে। বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। হসপিটালের অন্যান্য মেয়ে স্টুডেন্ট, ডাক্তার ও ভিজিটররা যাওয়া আসার সময় হা করে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মাশরিফ মেয়েগুলোর এক্টিভিটি দেখে বিরক্ত হলো। আজকে সে একটা সিগ্রিন রঙের পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে। হাতে একটা ব্যাগ আছে যাতে একটা সিগ্রিন ও কালোর মিশেলে শাড়ি ও তৈরি হওয়ার জিনিসপত্র আছে। সব সিগ্রিন। তিতিরকে এসব পড়িয়ে বিকেল বেলা একসাথে হাত ধরে হাঁটার ইচ্ছে তার। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তিতির বের হলো। গেইটের বাহিরে মাশরিফকে দেখে বিস্মিত নয়নে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। কতো সুন্দর দেখাচ্ছে তার বরটাকে। নজর হটানো যেন অসম্ভব হয়ে পরেছে। সিগ্রিন রঙে যে কাউকে এতোটা সুদর্শন লাগতে পারে তা তিতির আজ প্রথমবারের মতো অনুধাবন করল। কনুইয়ের একটু নিচ অবধি পাঞ্জাবির হাতা গুটানো। কর্লারের দিকে দুই একটা বোতাম খোলা। চোখে সানগ্লাস! কালো জিন্স প্যান্টের সাথে চকলেট কালার ক্যাজুয়াল শু। পুরো নায়ক লাগছে। তার কাছে এসব কেমন ভ্রম মনে হচ্ছে। একবার ভালো করে চোখ মুছে নিয়ে একই নাজারা দেখে খুশি তো হলোই কিন্তু আশেপাশের আসা-যাওয়াতে মেয়েগুলোর এরকম বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে রাগও হলো ভীষণ। দ্রুতপদে মাশরিফের কাছে গিয়ে ঝাঁ*ঝালো কণ্ঠে বলল,
“আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি যে আসবেন আমাকে তো বলেননি! এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন হ্যাঁ?”
মাশরিফ আশেপাশে নজর বুলালো। কয়েকজন আঁড় নজরে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। মাশরিফ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। বিকেলবেলা আমরা পার্কে ও রাস্তায় একসাথে হাঁটব। কিন্তু তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?”
তখন পেছন থেকে নাদিয়ারা এসে হাজির। ওরা বের হয়েছে ফুচকা খাওয়ার জন্য। তিতিরকে বারবার মাশরিফের কথা বলে পি*ঞ্চ করছিল বলে তিতির ওদের রেখে আগেই বেরিয়ে গেছে। নাদিয়া বলে,
“কেন এমন করছে বুঝেন না ভাইয়া? আপনার বউ প্রচুর জে*লা*স। এইযে আশেপাশের কু*দৃষ্টি সম্পূর্ণ রমণীগন আপনাকে তাদের চোখ দিয়ে গি*লে খা*চ্ছে! তা দেখে আমাদের বান্ধবীর ক’লিজাটা পু*ড়ে ধোঁ’য়া বের হচ্ছে। ওর এই জে*লাসির ধুম্রজালে আপনি তো নিজেকেই খুঁজে পাবেন না ভাইয়া!”
এটা বলা মাত্রই ফাইজা, জারিনরা হেসে ওঠল। তিতির ওদের ধ*মকে বলল,
“বেশি বুঝিস তোরা। ফাজলামি করবি না। উনি এখানে এসে কেন দাঁড়াবে?”
“কেন? দাঁড়ালে কী তোর বরকে কেউ চু*রি করে নিবে?”
ফাইজার টিটকারি শুনে তিতির বিড়বিড় করে বলল,
“বলা তো যায় না! নিতেও পারে।”
মাশরিফ আবছা তিতিরকে কিছু বলতে শুনে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল,
“কিছু বললে?”
“না! চলুন।”
তিতির মাশরিফের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে ধরলে মাশরিফ অবাক তো হয়ই কিন্তু পরক্ষণেই হেসে তিতিরকে থামিয়ে বলে ওঠে,
“আরে মেয়ে দাঁড়াও। কাছে হোস্টেলে গিয়ে এই বক্সের জিনিসপত্র দ্রুত পড়ে আস। বেশি সাঁজগুঁজের দরকার নেই। জাস্ট কাজল ও লিপস্টিক দিলেই হবে। জলদি যাও।”
তিতির সন্দিগ্ধ কন্ঠে শুধায়,
“কী আছে এতে?”
“দেখলেই বুঝবে। জলদি যাও। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।”
“কিন্তু আমার টিউশনি?”
“আজ মানা করে দাও। পরে একদিন পড়িয়ে দিবে।”
তিতির ঘার কাত করে সম্মতি দিয়ে হোস্টেলের দিকে যেতে নিয়েও ফিরে এসে মাশরিফের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“আপনি কি এখানেই থাকবেন?”
“হ্যাঁ কেন?”
“মোটেও না! আপনি এখানে থাকবেন না। এমন কোথাও যান যেখানে আশেপাশের কেউ আপনার দিকে নিজেদের বে*হায়া দৃষ্টি দিবে না।”
মাশরিফ হালকা হাসল। তার বউটার যে ভীষণ হিংসে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সে বলল,
“যথা আজ্ঞা মহারাণী! আমি এমন কোথাও যাচ্ছি। তবে আপনিও একটু কম সময় নিবেন। নয়তো বুঝতেই পারছেন! এতো বে*হায়া দৃষ্টি থেকে বাঁচা কিন্তু খুবই মুশকিল!”
তিতির ভ্রুঁকুটি করে তাকাল। অতঃপর বলল,
“জাস্ট পনেরো মিনিটের মধ্যে চলে আসব। হুহ্!”
এই বলে তিতির দ্রুত পদে জারিনদের নিয়ে হোস্টেলের দিকে চলে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,