#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১০
স্নিগ্ধ সকালের সূচনা। ভোরের রক্তিম সূর্য এখন প্রখরতা ধারন করছে সময়ের সাথে সাথে। কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা রাস্তায় ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। কিন্তু সুন্দর সকাল উপভোগ করার সময় নেই গাড়িতে থাকা তিনজন মানুষের। সকাল সকাল নয়নতারা বেগমকে দেখতে বেরিয়ে পড়ে প্রয়াস ও নাবিলা। সাথে জেসিও আছে। এমিলি এবং অলিভার সকালের ফ্লাইটেই আবার ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। অয়নের খোজ এখনো পাওয়া যায়নি।
অলিভার কিংবা এমিলি কাউকেই মানবে না অয়নের পরিবার, ছাফ জানিয়ে দিয়েছেন অয়নের মা। দিশা বাচ্চাটার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। নাতিকে একটিবারের জন্য কাছে টানেনি তারা কেউ। অলিভারের মুখটা দেখে নিজের রক্ত বলে বুকের ভেতর ধক করে উঠলেও মান সম্মান বাচাতে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে অয়নের পরিবার। যত চেপে রাখা যায় ততই মঙ্গলজনক। যদিও তা খুব একটা সম্ভব হবে না তারা জানে।
এমিলি অবশ্য অয়নকে তার লাইফে আর চায় না। দুই মা ছেলে দিব্যি আছে। এবং সে যাওয়ার আগে বলেও গেছে তার ছেলেকে কেউ তার থেকে নিতেও পারবে না। বাবা হিসেবে অয়ন অলিভারের যা সম্পর্ক রেখেছে সেটুকুই থাকবে। বাবা ছেলের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করলেও অলিভারকে সে অয়নের কাছে দেবে না কখনোই।
হাসপাতালের সাদা মলিন বিছানায় এক ভঙ্গুর দেহ শুয়ে আছে। সাদা চুলের এই মানুষটার প্রতিটা চামড়ার ভাজ পড়েছে যার জন্য ভেবে তারই থেকে আজ দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। ভাজ পড়া চামড়ার মলিন মুখটা দেখে নাবিলার বুকের ভেতর যেন একটা ধাক্কা খেলো। এক রাতেই মানুষটার বয়স যেন বেড়ে গেছে। একদম নেতিয়ে পড়েছে। হাতে স্যালাইন চলছে। সেটা প্রায় শেষের দিকে।
নাবিলার মনে হলো অনেকদিন দাদিকে ভালো করে দেখা হয় না। মন খুলে গল্প করা হয় না। মাথায় তেল না দিলে বকা খাওয়া হয় না। কুচকানো হাতটা মাথায় বিলি কেটে দেয় না অনেকদিন। কোকড়ানো চুলের জট ছাড়াতে কেউ চিরুনি নিয়ে তাড়া করে না। টানটান করে বিনুনি করাও হয় না এখন।
‘কোথায় হারালো দিনগুলো!’ অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করলো নাবিলা।
প্রয়াস পেছন থেকে নাবিলার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বললো,
‘হারায়নি। শুধু লুকিয়ে গেছে। এখন সেই দিনগুলো খুজে বের করার সময় এসে গেছে।’
নাবিলা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো প্রয়াসের দিকে। প্রয়াস চোখের কপাট আলতো বন্ধ করে, মাথা দুলিয়ে আশ্বাস দিলো ওকে।
‘নাবিলা এসেছিস?’
দাদি ভাঙা গলায় ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো। জ্ঞান ফিরেছে ভোরেই।
প্রয়াস নাবিলা দুজনেই ভেতরে তাকালো। নয়নতারা বেগম মলিন দুর্বল চোখে চেয়ে আছে। নাবিলা কাছে গিয়ে দাদির ডান হাতটা চেপে ধরে বসলো।
‘দাদি একটুও ভালো না। তাইনারে! তোকে একটুও ভালোবাসি না।’
নাবিলা ঢুকরে কেদে উঠলো। দাদির হাতটা গালে চেপে ধরে বললো,
‘আমার দাদির মতো দাদিই হয়না। তার মতো করে আমায় কেউ ভালোবাসতেই পারবে না কোনোদিন।’
নয়নতারা বেগম কিছুক্ষন মৌন রইলেন। তারপর বলতে লাগলেন,
‘আমার যখন বিয়ে ঠিক হয় জানতে পারি তোর দাদু ছিলেন বদরাগী একজন মানুষ। খুবই কড়া স্বভাবের ছিলো। বাবা মা আমার মতের তোয়াক্কা না করেই বিয়েটা দিয়ে দেয় ওনার সাথে। প্রথম প্রথম খুবই সিটিয়ে থাকতাম ভয়ে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই তার আচরণে বিস্তর ফারাক ধরা দিলো। মানুষটার বদরাগী স্বভাব বদলে কেমন ঠান্ডা স্বরে কথা বলা শুরু করলো।
হয়তো প্রিয় মানুষকে ভয় পেতে দেখেই কিংবা আমার প্রতি ভালোবাসায় সেই আমূল-পরিবর্তন এসেছিলো তার। দেখতে তেমন আহামরি সুন্দর ছিলাম না আমি। তথাকথিত সমাজের শ্যামলা বরণ মেয়ে ছিলাম। গায়ের রঙ চাপা হওয়ায় সবাই বলতো ভালো বর পাবো না। অথচ পেয়েছিলাম একটা রত্ন। আমার সংসারে যখন আবার একজন শ্যামাঙ্গিনী এলো ভাবতে লাগলাম কিভাবে তাকে সমাজের কটু কথা থেকে বাচাবো। কিভাবে তাকে সবার থেকে আগলে রাখবো।
যুগের ধরন পাল্টেছে। আমাদের বেলা যেমন কথা শুনতাম তার কিছুটাও শুনতে দেইনি তাকে। বুকে আগলে রেখেছিলাম। তার দাদু যখন একজন রাজপুত্রের সন্ধান আনলো, ভাবলাম তারই মতো একজন রত্ন হবে সে। আমার ভালোবাসার নাতনিকে আগলে রাখবে। তাইতো উঠে পড়ে লেগেছিলাম। একটাবারও ভাবতে পারিনি আমরাও ভুল হতে পারি।
নাতনির বিরক্তিমাখা চেহারা দেখে ভাবতাম আমারই প্রতিচ্ছবি। বিয়ের পর সবই সুন্দর চলবে। ঠিক যেমনটা চলেছিলো আমার বেলা। অথচ কত বড় ভুলটাই না করতে যাচ্ছিলাম। মানুষটা মরার আগে যদি একটিবার জানতো ভালো পরিবারের বখে যাওয়া ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করেছেন তবে খুবই কষ্ট পেতো। মানুষটাকে ভালোবেসে, তার একটা ইচ্ছাকে আগলে রাখতে গিয়ে আমার নাতনিটার ইচ্ছেটা দেখিনি। ভীমরতিতে পেয়েছিলো আমায়। বয়স হয়েছে কিনা।’
নয়নতারা বেগমের চোখের কার্নিশ ঘেঁষে বেয়ে চলা উষ্ণ ধারাটা নাবিলা মুছে দিলো আলতো করে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘ভুলে যাও দাদি। সব ভুলে যাও। আমার আগের দাদি হয়ে ফেরত আসো। অনেকদিন মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও না। নিজের হাতে খাইয়ে দাও না। এবার সুস্থ হয়ে সকল দায়িত্ব আবার বুঝে নাও তো।’
‘আমায় ক্ষমা করিস বোন?’
‘আহ! আবার সেই কথাই বলছো? ভালো লাগছে না কিন্তু। আমি সব ভুলে গেছি তুমিও ভুলে যাও।’
এমন সময় প্রয়াস প্রবেশ করলো। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে নাবিলার মাথায় চাপড় মেরে বললো,
‘হ্যাঁ দাদি জলদি সুস্থ হও। এই পাগলকে মানুষ বানাতে তোমায় সুস্থ হতেই হবে। তোমার নাতনির চুলের জট ছাড়াতে পারে না। মাথায় তেল না দিতে দিতেই বোধ হয় চুল এমন খড়ের মতো হয়ে গেছে।দেখো কেমন পাগলের চুলের মতো হয়ে আছে।’
নাবিলা মুখ ফুলিয়ে তাকালো। নয়নতারা বেগম মৃদু হেসে নাবিলার এক হাত জড়িয়ে ধরলেন।
‘সব আদরতো নাতনিকেই করে যাচ্ছো। আমাকে কারো চোখেই পড়ে না।’ প্রয়াস অভিমান করে বললো।
নয়নতারা বেগম হাত বাড়ালেন প্রয়াসের দিকে। প্রয়াস নিচু হয়ে দাদির কাছে মাথা নিতেই তিনি রুগ্ন হাতে প্রয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এই কয়েক মুহূর্তেই যেন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তিনি। প্রয়াস নরম এবং মৃদু স্বরে দাদির কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললো,
‘তোমার নাতনিকে তোমার মতো করে আগলে রাখার মানুষের কাছেই রাখবো দাদিজান। তুমি একদম চিন্তা করো না।’
জেসি বাহিরেই দাঁড়িয়ে ওদের খুনসুটি দেখলো। কি সুন্দর সম্পর্ক ওদের। অন্যদিকে জেসি, বড় হয়েই ওরা খুজেছে স্বাধীনতা। নিজের মতো চলার মর্জি। পেয়েছেও। কিন্তু দিনশেষে একটা শূন্যতা থেকে যায়। সেটা বুঝি এই রকম একটা পরিবারের জন্যই! কিন্তু তা উপলব্ধি করতে সময়, অভিজ্ঞতাও বয়ে যায় অনেক। জেসিও এখন বুঝতে পারছে পরিবারের গুরুত্ব। জেসির মা একজন বাঙালি এবং বাবা কানাডিয়ান। মায়ের সূত্রেই বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছে জেসি। ওদের জীবনে কারো সাথে বনিবনা না হলে নিজেরাই মুভ অন করে। অথচ এখানে মানুষ মানিয়ে নিয়ে, একে অন্যের ভুল ক্ষমা করে একইসাথে থাকার প্রচেষ্টা করে যায়। জেসি যেন একটা সৌন্দর্য উপভোগ করছে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। পরিবারের খুনসুটিময় সৌন্দর্য।
________
সারাদিন জেসিকে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখালো প্রয়াস। মায়ের সূত্রে ছোটবেলায় ঢাকায় এসেছে দুইবার। কিন্তু তেমন কিছুই দেখা হয়নি। তাদের সাথে আছে নাবিলা। ও আসতে চায়নি কিন্তু জেসির জোরাজোরিতে আসতে হলো। হাজার হোক এই মেয়েটার সূত্র ধরেই ওর জীবন একটি কালো অধ্যায় থেকে বেচেঁছে।
গাড়ির সামনের সিটে প্রয়াস এবং জেসি বসে রাজ্যের আলাপ জুড়েছে। পেছন থেকে নাবিলা অসহায়ের মতো তা গলাধঃকরণ করছে। প্রয়াসের ফ্রন্ট মিরর নাবিলার দিকে তাক করা। বেশ কয়েকবারই চোখাচোখি হয়েছে দুজনের। প্রয়াসের চাহনিতে অন্য সময় হলে খুশিতে ফেটে পড়তো কিন্তু এখন বিরক্ত হচ্ছে নাবিলা । জেসি আসলে কে হয় তা এখনো খোলাসা করেনি প্রয়াস। তারওপর একটু পরপর দেখে যাচ্ছে ওকে। নাবিলা নিজেও কি দেখছে না? নিজের দোষ শিকার করতে মন চাইলো না।
‘জেসি আপু তুমি এখানে কতদিন থাকছো?’ নাবিলার প্রশ্ন।
‘আমিতো সারাজীবনই থাকতে চাই। কিন্তু তা সম্ভব না। তাই বিয়ে অবধি থাকছি।’
‘বিয়ে!’
অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো নাবিলা। এতক্ষনের এক চিলতে আশাতেও ভাটা পড়লো এবার।
‘তারমানে ভাইয়া আর জেসি বিয়ে করে কানাডা চলে যাবে? তাহলে কেনো বলেছিলো যে আর বিদেশের মাটিতে পা দেবে না? সব মিথ্যা। আমাকে শ্যামবর্ণ নিয়ে লেকচার দিয়ে নিজে সাদা চামড়া পছন্দ করছে। করবেই তো। তার সাথে তো অমন সুন্দরীই মানায়। আমি কি আর সুন্দর নাকি।’
নিজের কথার বিরোধিতা নিজেই করলো আবার।
‘সুন্দর নইতো কি! জেসি আপুর মতো গায়ের রঙ না হোক দেখতে শুনতে মোটেও খারাপ নই আমি। কিন্তু আফসোস! এই সৌন্দর্য তার চোখে পড়লো না।’
নিজের মনেই কথাগুলো ভেবে গাল ফুলিয়ে রইলো নাবিলা। আর দেখবে না প্রয়াসকে। দেখলেই কষ্ট বাড়বে। চোখ ঠেলে কান্না আসছে। চোখ বন্ধ করে তা আটকানোর বৃথা চেষ্টায় মগ্ন থাকতে থাকতে একসময় ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো নাবিলা।
ঘুম ভাঙতেই নিজেকে প্রয়াসের বাহু বন্ধনে আবিষ্কার করলো নাবিলা। নাবিলার মাথা প্রয়াসের কাধের ওপর। আর হাতে প্রয়াসের কোমড় জড়ানো। নিজের অবস্থান বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো ওর। যখন বুঝতে পারলো ভরকে গিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। সামনে তাকাতেই দেখলো ড্রাইভিং সিটে জেসি বসে আছে। রাস্তাঘাট চেনে না। প্রয়াস পেছন থেকে বলে দিচ্ছে কোনদিকে যেতে হবে।
‘তুমি এখানে?’
নাবিলা জানতে চাইলো। ঘুমানোর আগে তো প্রয়াস ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে ছিলো। তাহলে পেছনে…
ভাবনার মাঝেই প্রয়াস উত্তর দিলো,
‘ঘুমালে তো হুশ জ্ঞান সব হারিয়ে ঘুমাস। সব যায়গা কি তোর বিছানা যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবি? আমি না এসে ধরলে ঘাড়টা ভাঙতো আজ।’
নাবিলা মুখ কাচুমাচু করে নিলো।
‘হুশ জ্ঞান থাকলে কি আর ঘুম হলো নাকি?’
কথাটা বলে আড়চোখে তাকালো প্রয়াসের দিকে। প্রয়াসের শান্ত দৃষ্টি ওর ওপরই নিবদ্ধ। আবার মুখ সরিয়ে নিলো নাবিলা। এটা সত্যিই যে ঘুমালে নাবিলার হুশ থাকে না। তবে ঘুম থেকে উঠে এভাবে নিজেকে আবিষ্কার করবে তাও ভাবতে পারেনি। এর আগে গাড়িতে যতবার ঘুমিয়েছে মা কিংবা দাদির কাধেই মাথা দিতো।
‘প্রয়াস ভাইয়া আমায় জড়িয়ে ছিলো তাও নিজের গার্লফ্রেন্ড এর সামনে? এটা তো হতে পারেনা। জেসি আপু মেনে নিলো? নাকি আমি ভুল ভাবছি!’
নাবিলা জেসির মুখ ভঙ্গি দেখার চেষ্টা করলো। একদমই শান্ত মুখে ড্রাইভ করছে সে।
‘অনেকক্ষন তোমায় ড্রাইভ করতে হলো। এবার আমায় দাও। এই মেয়ে এখন আর ঘুমাবে না। টানা দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে কাধ ব্যথা করে দিয়েছে আমার।’
বলে প্রয়াস হাত দিয়ে বারকয়েক কাধ মালিশ করলো। নাবিলা আড়ালে ভেঙচি কাটলো। জেসি ড্রাইভিং সিট ছাড়তেই প্রয়াস বসে পড়লো। বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো এবার। জেসি মিষ্টি হেসে নাবিলাকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ঘুম কেমন হলো তোমার?’
‘ভালো।’
‘তোমাদের ভাইবোনের সম্পর্ক খুবই সুন্দর। প্রয়াস তোমার ব্যপারে খুবই কেয়ারফুল। অবশ্য প্রয়াস বরাবরই দায়িত্বশীল। পরিবারের প্রতিও বন্ধুবান্ধবদের প্রতিও। আমার প্রতিও।’
নাবিলার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
‘ ভাই-বোন! এজন্যই বুঝি জেসি আপু কিছু মনে করেনি। ওরাতো হয়ই ফ্রি মাইন্ডের। ভাইয়া জেসি আপুর প্রতিও এতো কেয়ারফুল! হবেই তো স্পেশাল মানুষ বলে কথা। আর আমি ভাবলাম…ধুর।’
নাবিলা মনে মনে আবার আফসোস করলো।
চলবে…