#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১৭
হাবিবুল মিয়া ভয়ের চোটে কেদেই ফেললেন। তিনি বুঝতে পারছেন নিশ্চই বড় কিছু ঘটেছে। নাহলে এতো বছরেও যারা কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি তারা কেনো এভাবে ধমকে কথা বলবে!
বাবার বয়সী মানুষকে কাঁদতে দেখে প্রয়াসের হুশ ফিরলো। চিন্তা এবং রাগে কিভাবে কথা বলা উচিৎ সব গুলিয়ে যাচ্ছে ওর। নিজেকে কিছুটা সামলানোর চেষ্টা করে বললো,
‘দেখুন চাচা আমরা একটা বিপদের মধ্যে আছি।আপনাকে যা জিজ্ঞেস করছি শুধু তার সঠিক উত্তর দিন। ভয়ের কারন নেই।’
বিপদের মধ্যে আছি কথাটা শুনে হাবিবুল মিয়া এবার সত্যি সত্যিই প্রচন্ড ভয় পেলেন এবং প্রয়াস কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই গড়গড় করে বলে দিলেন।
হাবিবুল মিয়ার ভাষ্যমতে, কাল রাতে হুট করেই তার বাধ ভাঙা ঘুম পায়। অনেক বছর ধরে নাইট ডিউটি করার ফলে তিনি এখন নিদ্রাহীন ভাবেই আরামে রাত পার করতে পারে। কিন্তু কাল রাতে তিনি কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে না পেরে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। ফজরের আযান কানে আসতেই বহু কষ্টে চোখ মেলে ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। শামীমকে তাই আজ একটু আগে থেকেই উঠে যেতে হয়েছে।
প্রয়াস হাবিবুল মিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো ঘুম লেগে আছে চোখে। প্রয়াসের সন্দেহ আরো এক ধাপ শক্ত হলো। জিজ্ঞেস করলো,
‘হুট করে আপনার এমন ঘুম পাওয়ার কারন?’
‘জানি না। আমি কিছুই জানি না বাজান। বিশ্বাস করো! আমি কিছু করি নাই। এতো বছর ধইরা এইহানে চাকরি করি। আমি তোমাগো ক্ষতি চাইনা বাবা।’
কথাটা সত্যি। হাবিবুল মিয়াকে প্রয়াসের কলেজে থাকাবস্থায় এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। বয়স বেড়ে গেলে সাধারণত বয়ষ্কদের কর্মী হিসেবে অনেক কর্মক্ষেত্রেই নিতে চায় না। তখন সংসার চালাতে নাইট গার্ড অথবা দারোয়ানের চাকরিই করতে হয়। হাবিবুল মিয়া ও তেমনি একজন। প্রয়াসের হাবিবুল মিয়ার চোখের পানি এবং অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো লোকটা মিথ্যা বলছে না। সে আবার বললো,
‘একটু ভেবে বলেন চাচা। আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছিলো? বাড়ি থেকে মনির পাঠানো খাবার ছাড়া আর কিছু খেয়েছেন বা শুকেছেন কি?’
হাবিবুল মিয়ার কান্না থেমে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
‘খাইছিলাম। এগারোটার পর মুড়ি-চানাচুর আর মোজো খাইছি। পাশের বিল্ডিংয়ের গার্ড মনিরুল্লাহ খাওয়াইছে।’
‘মনিরুল্লাহ!’
প্রয়াস অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো। তারপর আবার বললো,
‘তিনি কি প্রায়ই আপনাকে খাওয়ায় এসব?’
‘না কালকে আইনা কইলো রাইতে যাইগা থাহি এগুলা খাইলে সময় কাটবো ভালা। আমিও তাই খাইয়া নিছিলাম।’
‘চাচা আপনি আসুন আমার সাথে।’
প্রয়াস ব্যস্ত পায়ে আবার ছুট লাগালো পাশের বিল্ডিংয়ের মনিরুল্লাহর উদ্দেশ্যে। সাথে গেলো হাবিবুল মিয়া।
মনিরুল্লাহকে গিয়ে মাথা নিচু অবস্থায় পেলো প্রয়াস। অসহায় ভাবে মাথা নুইয়ে আছে মনির। তাকে অনবরত বকে যাচ্ছে সেই বাড়ির কর্ত্রী। প্রয়াস বকার কারন জানতে চাইলে মহিলাটি জানালো কাল সারারাত পাহারা না দিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে। সকালে নামাজ পড়ে হাটতে বের হতেই মহিলাটি ঘুমন্ত অবস্থায় পায় তাকে। পরে মনিরুল্লাহ নিজের মুখেই শিকার করে সে সারারাত ঘুমিয়েছে। প্রয়াসের হিসেবে আরো একটা মজবুত তথ্য যোগ হলো।
প্রয়াস এগিয়ে গিয়ে মনিরুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলো সে মোজা আর মুড়িমাখা কোথা থেকে এনেছে। মনিরুল্লাহ বললো কাল রাত এগারোটার দিকে একজন লোক হাতে করে এসব এনেছিলো। লোকটা বলেছে সে এলাকার সব গার্ডকেই দিচ্ছিলো খাওয়ার জন্য। গার্ডসরা রাত জেগে পাহারা দেয়, সেবা করে এসব নিয়ে অনেক বাহ্ববা দিয়ে গিয়েছে। খাবারগুলো পাশের বাসার গার্ডসদের সাথে ভাগ করে দিতে বলেছে। লোকটার নাকি জনে জনে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। মনিরুল্লাহও সরল মনে তা গ্রহন করেছে। নিজেই মুড়ি এবং চানাচুর মাখা বানিয়েছে এবং হাবিবুল মিয়ার সাথে মিলে ভাগ করে খেয়েছে। তবে মোজো খাওয়ার পরেই মনিরুল্লাহ ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।
প্রয়াস জিজ্ঞেস করলো,
‘লোকটা দেখতে কেমন ছিলো?’
মনিরুল্লাহ কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিলো,
‘আপনের মতোই উঁচা লম্বা। আর দেখতেও সুন্দর। এর বেশি কইতে পারি না।’
প্রয়াস যা বোঝা বুঝে গেলো। ছুটে বাড়ি ফিরলো আবার। নাবিলার কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে উদ্ধার করতে হবে।
নাবিলাদের বাড়ি ঢুকতেই দেখলো তারেক হোসেন ফোনে কারো সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে আছেন। প্রয়াস কাছে যেতেই বুঝলো তারেক হোসেন ইতিমধ্যেই অয়নের পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলেছেন।
অয়নের পরিবার বারবার বলে যাচ্ছে অয়নের সাথে তাদের বর্তমানে যোগাযোগ নেই। কিন্তু তারেক হোসেন হুমকি ধামকি দিচ্ছেন, পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন। নয়নতারা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সায়মা বেগম গুনগুন করে কেদেই চলেছে। প্রয়াস সবাইকে শান্ত হতে বললো কয়েকবার। যদিও সে নিজেই শান্ত হতে পারছে না।তারেক হোসেনকে বললো অয়নের নামে মামলা করে আসতে। তারেক হোসেন তাই করতে গেলেন। কিছু একটা মনে পড়তেই প্রয়াস আবার ছুটলো নাবিলার ঘরে।
___________
জ্ঞান ফিরতেই নাবিলা মাথা চেপে উঠে বসার চেষ্টা করলো। মাথা ব্যথা করছে খুব। চোখ মেলে চারিদিকে তাকাতেই নিজেকে একটি পরিপাটি এবং বিলাসবহুল রুমে আবিষ্কার করলো। ঘরটা নাবিলার অচেনা। রাতের কথা মনে হতেই তরাক করে উঠে গেলো বিছানা ছেড়ে।
রাতে প্রয়াস এসেছে ভেবে ঘাপটি মেরে ঘুমের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলো নাবিলা। হুট করেই সেই আবছা মানুষটা অত্যাধিক কাছে চলে আসায় তার গায়ের গন্ধে নাবিলা বুঝতে পারে সে প্রয়াস নয়। যখনই উঠে চিৎকার করতে যাবে তার আগেই ওর নাকে রুমাল চেপে ধরা হয়। আর কিছুই মনে নেই ওর।
নাবিলার ভাবনার মাঝেই দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে ঢুকলো৷ নাবিলা সেদিকে তাকিয়ে খুব একটা অবাক হলো না। সে জানতো এই একজন শত্রু তার আছে। তাই বলে এভাবে অপহরণ করে আনবে? নাবিলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
‘সো মিস। সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?’
ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে জানতে চাইলো অয়ন।
‘আপনার মতো মানুষের কাছে অন্তত এটা আশা করিনি। আপনাকে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ভাবতাম। ছিঃ!’
অয়ন আয়েশ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললো,
‘বাহ বেশ সুন্দর করে কথা বলছো তো। আমি ভেবেছিলাম চিৎকার করে কান্নাকাটি না জুড়ে বসো।’
‘আপনার জন্য চোখের জল ফেলে সেই জলের অবমাননা করতে চাই না। বিপদ যিনি দিয়েছেন তিনিই রক্ষা করবেন ইনশাআল্লাহ।’
‘হুম কনফিডেন্স! আ’ লাইক ইট। তবে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে শীগ্রই। আমিই সেই পথ দেখাবো তোমায়?’
‘মানে কি বলতে চাইছেন আপনি? আমাকে ধরে এনে আপনি কিসের প্রতিশোধ নিতে চাইছেন? আপনার গোপন কথা জেনে ফেলার প্রতিশোধ? নাকি আপনার মুখোশ উন্মোচন করার প্রতিশোধ? কোনটা?’
‘উহু। ধোকাতো তুমিও আমায় দিয়েছো। আমার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পরও তুমি প্রয়াসের সাথে প্রেমে মজে ছিলে। সেসব ভুলে যাও। আমিতো তোমায় একটা সুন্দর লাইফ গিফট করতে চলেছি। যেখানে আমি তোমার সাথে যা খুশি করতে পারবো। আর কেউ কিছু বলতেই পারবে না। তোমার প্রেমিকও না।’
নাবিলা অয়নের এমন কথায় ভয় পেয়ে গেলো। সে এমনিতেই ভেতর ভেতর ভয় পাচ্ছে। কিন্তু অয়নকে তা দেখিয়ে নিজেকে দুর্বল প্রমান করতে রাজি নয় সে। আবার এমন কথায় স্পষ্ট কিছুর ইঙ্গিত দিলো অয়ন। যা নাবিলার ভয় আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। নাবিলার চোখে কিছুটা ভয় দেখে অয়ন যেন খুব খুশি হলো। ঠোঁটের হাসি প্রসারিত করে বললো,
‘আরে ভয় পেয়ো না। আমি আর অন্যায় কিছু করবো না। এবার যা হবে সব বৈধ।’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে আজ তোমার আর আমার বিয়ে হবে। সেদিন তুমি আর তোমার প্রেমিক মিলে দিলেতো বিয়েটা ভেস্তে! ভাগ্যিস আগে ভাগে তোমাদের বাড়ির সব খবর রেখেছিলাম । আমার এবং আমার পরিবারের সম্মান তো চলেই গেছে। তোমাকে, তোমার পরিবারকে এবং তোমার প্রেমিককে একসাথে শাস্তি দিতে হলে এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। হা হা।’
অয়ন শব্দ করে হাসলো। বিশ্রী হাসি। নাবিলার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। একটা মানুষ এতোটা নোংরা হয় কি করে?
‘আপনার একটা ছেলে আছে। আপনি কেনো এমিলিকে বিয়ে করে ছেলের সাথে জীবন পার করছেন না। ওদের জন্য আপনার একটুও টান নেই? কেমন বাবা আপনি?’
এই পর্যায়ে অয়ন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।
‘তোমাদের জন্য এখন আমার ছেলের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছিনা আমি। আগে একটা সুযোগ ছিলো ওকে নিজের কাছে আনার। তোমাদের জন্য সেই সুযোগটাও হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এমিলি এখন কিছুতেই অলিভারের কাস্টাডি আমায় দেবে না। তাইতো আগে তোমায় বিয়ে করবো তারপর অলিভারকেও ঠিক এমিলির কাস্টাডি থেকে নিয়ে আসবো। আমার বৈধ বউ হবে তার মা। অর্থাৎ তুমি।’
‘আপনি একজন বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ। আপনার ইচ্ছা কখনোই পূরন হবে না।’
____________
কফিশপে বসে আছে প্রয়াস। সাথে জেসি এবং দিশাও আছে। বেলা বারোটা বেজে গেছে। প্রয়াস এখনো নাবিলার কোনো খোজ পায়নি। পুলিশও ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা ভাবছে মেয়ে কারো সাথে পালিয়ে গেছে। এছাড়া মাদক চোরাচালানকারীদের নিয়ে পুলিশরা এখন বেশি ব্যস্ত। তাই অন্যসব কেইসে মনোযোগ দিচ্ছেন না।
নাবিলার রুমে গিয়ে ওর ফোন দিয়ে দিশাকে কল করে দেখা করতে বলে প্রয়াস। একমাত্র দিশা নিজের ভাইয়ের কাজে লজ্জিত এবং নাবিলার পরিবারের পক্ষে আছে। অন্যদিকে ওর পরিবার একে অন্যকে দোষ দিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত।
প্রয়াস ক্লান্ত এবং করুন সুরে বললো,
‘ দিশা তোমার ভাইয়ের কার্যকলাপ যে অন্যায় সেটা তুমি মানো। তাই তুমিই একমাত্র সাহায্য করতে পারো আমাদের।’
দিশা লজ্জিত ভঙ্গিতে জানালো,
‘আসলে ভাইয়া এমনটা করবে তা আমাদের ভাবনার বাহিরে ছিলো। আমি তার কাজের জন্য ভীষণ লজ্জিত। তবে আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সাহায্য পাবেন আপনারা।’
‘ঠিক কবে নাগাদ তোমাদের সাথে অয়নের যোগাযোগ হয়?’
‘ভাইয়ার সাথে আমাদের শেষ যোগাযোগ হয় দেড় সপ্তাহ আগে। ভাইয়া বাড়িতে এসে থেকেছিলো তিনদিন। তারপর আবার চলে যায়। গাড়ি, ড্রাইভার অথবা নিজের জিনিসপত্র, কিছুই নেয়নি সাথে।’
জেসি জিজ্ঞাসা করলো,
‘তোমাদের কোনো বাগান বাড়ি অথবা অন্য কোনো বাড়ি আছে?’
‘আছে। গাজিপুরে আমাদের বাগান বাড়ি।’
জেসি প্রয়াসকে বললো,
‘আমাদের এক্ষুনি সেখানে যাওয়া উচিৎ প্রয়াস।’
‘উহু।’প্রয়াস কাধ ঝাকিয়ে বললো,
‘ওখানে নাবিলাকে পাওয়ার সম্ভাবনা জিরো পারসেন্ট। পরিচিত যায়গায় অয়ন নাবিলাকে নিয়ে যাবে না। এতো কাচা কাজ অয়ন করবে না।’
‘একদম ঠিক।’ দিশা বললো, ‘আমি খোজ নিয়েই এসেছি। ভাইয়া ওখানে নেই।’
জেসি মাথা চেপে বললো,
‘তাহলে এখন ক্লু কিভাবে পাবো? অয়নের ফোন নিশ্চয়ই বন্ধ।’
‘ফোন!’
প্রয়াস কিছু একটা ভাবলো। ওর চোখেমুখে নতুন উদ্যোম খেলে গেলো।
চলবে…