#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_৯
হাসপাতালের করিডোর ধরে পায়চারি করছে প্রয়াস। নয়নতারা বেগম হার্ট অ্যাটাক করেছেন। নিশুতি গভীর হয়ে মাঝ পথে এসেছে। নয়নতারা বেগমের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। হাসপাতালে এখন নাবিলা, প্রয়াস এবং তারেক হোসেন এবং সায়মা বেগম রয়েছে। তারেক হোসেন গেছেন ডাক্তারের সাথে।
শত বলেও নাবিলা এবং মনিকে বাড়িতে পাঠাতে পারেনি প্রয়াস। একটার পর একটা ধকল সইতে না পেরে পুরো পরিবার নেতিয়ে গেছে। প্রয়াস ধীর পায়ে হেটে সায়মা বেগমের পাশে বসলো। সায়মা বেগম এতক্ষন কাদার ফলে এখন কিছুটা ফোপাঁচ্ছে। প্রয়াস সায়মা বেগমের ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
‘আমি দেরি করে ফেলেছি তাই না মনি! আমার আরো আগে সব জানানো উচিৎ ছিলো। তাহলে হয়তো দাদি এভাবে কষ্ট পেতো না।’
সায়মা বেগম কিছুক্ষন চুপ রইলো। তারপর লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,
‘তোর কোনো দোষ নেই বাবা। মা একটু বেশি আশা করে ফেলেছিলো। তাই নিরাশা মেনে নিতে পারেনি। সারাজীবন নাতনির জন্য তিনি সেরাটাই করেছে। তাই ভেবেছে এবার ও সেরাটাই হবে। ভুল করে নাবিলার ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো এটা তিনি মানতে পারেননি। সেই মনঃকষ্ট থেকেই এই অবস্থা।’
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও। সব জেনেও অভিনয় করে গেছি সবার সাথে।’
‘ধুর বোকা ছেলে। নিজেকে ছোট ভাবিস না। । আমার মেয়ের জীবন রক্ষা হয়েছে তোর সাহায্য। তুই যে কত বড় একটা উপকার করলি। একদম তোর মায়ের মতোই হয়েছিস। একবার তোর মা আমার মেয়েকে বাচালো, এবার তুই বিপদ থেকে রক্ষা করলি।’
কথাটা শুনে দুই চেয়ার পরে বসে থাকা নাবিলাও কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকালো।
নাবিলা প্রশ্ন করলো,
‘ মামনি কি করেছিলো মা?’
সায়মা বেগম সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই প্রয়াস বললো,
‘চোখে কি হয়েছে তোর?’
প্রয়াসের কথায় সায়মা বেগম নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলার চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে।
‘আসলে লেন্সটা খোচাচ্ছে। অনেকক্ষন ধরে পড়ে আছি তাই..’
নাবিলা কথা শেষ করতে পারলো না। সায়মা বেগম এবং প্রয়াস দুজনেই রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।
‘কতটা কেয়ারলেস হলে এমন কথা বলে কেউ! এক্ষুনি খোল বলছি।’
রেগে বললো প্রয়াস। এর পর সায়মা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘মনি আমায় অনুমতি দাও। বাড়ি গিয়ে ওর সব লেন্স জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলবো আমি। এমন কেয়ারলেসদের জন্য লেন্স নয়। অন্ধ হয়ে বসে থাকবে।’
নাবিলা চুপসে গেলো একেবারে। হসপিটালের ওয়াশরুমে গিয়ে কোনোমতে লেন্সটা খুলে ফেললো। তারপর অয়নকে কয়েকটা গালি দিয়ে লেন্স জোড়া ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। চোখে বেশ কয়েকবার পানির ঝাপটা দেওয়ার পর কিছুটা আরাম বোধ করলো।
তারেক হোসেন এসে জানালো নয়নতারা বেগম এখন আশঙ্কা মুক্ত। সবাই চিন্তা মুক্ত হলো। তিনি নাবিলা এবং সায়মা বেগমকে চলে যেতে বললে সায়মা বেগম বাধা দিয়ে বললো,
‘প্রয়াস বরং নাবিলাকে নিয়ে চলে যাক। মাকে সুস্থ না দেখে আমি যেতে পারবো না।’
তারেক হোসেন সহমত পোষণ করলেন। প্রয়াসের বাধ্য হয়ে রাজি হতে হলো। নাবিলার চোখের যত্ন এবং বিশ্রাম প্রয়োজন। চোখ লাল হয়ে আছে। প্রয়াস মনি ও কাকাই এর জন্য খাবার কিনে দিলো। যাওয়ার সময় সায়মা বেগম নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘যা হয়েছে ভুলে যাও। তোমার জীবনে আর কেউ কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করবে না। দাদিকে নিয়ে ভেবো না। তিনি খুব জলদিই সুস্থ হয়ে যাবে। দুই ভাইবোন বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিও।’
‘ভাই-বোন’! প্রয়াসের হঠাৎ কাশি উঠে গেলো। নাবিলা ভ্রু তাকালো। প্রয়াস কোনোমতে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। প্রয়াস নাবিলার উপকার করলেও নাবিলার মেঘ ঘনানো আকাশ ভেদ করতে পারেনি। ওর মনের হাজারটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে। যার সবটাই প্রয়াস এবং জেসিকে নিয়ে।
‘প্রথমত, প্রয়াস ভাইয়া যদি সত্যি বলে থাকে জেসি তার বান্ধবী, তাহলে জরিয়ে ধরলো কেনো? প্রয়াস ভাইয়াতো এমন নয়। নাবিলাকেও হালকাভাবে একহাতে ধরেছিলো মাত্র। সেখানে জেসিকে একদম…
দ্বিতীয়ত, জেসি যদি বন্ধুই হবে তাহলে সেদিন কেনো বললো জেসি তার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির কারন?’
নাবিলা মনে মনে চাইছে ওর ধারনা যেনো মিথ্যা হয়। জেসি যেনো শুধুই বন্ধু হয়। এখনতো অয়ন নামের কাটাটাও নেই।
‘কি হলো? কি ভাবছিস এতো?’
প্রয়াসের ডাকে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো নাবিলা। নিজেকে সামলে বললো,
‘জেসি আপু তোমার কি হয় ভাইয়া?’
প্রয়াস এমন প্রশ্নে অদ্ভুত হাসলো।
‘কেনো? বলেছিতো বান্ধবী হয়। ‘
‘শুধুই বান্ধবী?’
‘না খুব কাছের বান্ধবী। ও আমার জন্য খুব লাকি বুঝলি।’
‘বুঝলাম।’
ভাঙা গলায় উত্তর দিলো নাবিলা। শেষ আশাটা বুঝি ডুবতে বসেছে। সরাসরি জিজ্ঞেসও করতে পারছে না প্রেমের কথাটা নিয়ে। কিন্তু সংকোচ রেখে লাভটা কি?
‘উনি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড?’
প্রয়াস নিঃশব্দে হাসলো। কোনো উত্তর দিলো না। নাবিলা কিছুক্ষন উত্তরের আশায় প্রয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রয়াসের পুরো মনোযোগ ড্রাইভিংয়ে। যখন বুঝলো প্রয়াস ওর প্রশ্নের উত্তর দেবে না তখন হতাশ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসলো নাবিলা।
‘তোর হাটুর নিচের সেলাইয়ের দাগটা কি মিলিয়ে গেছে?’
‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ নাবিলা যেন আকাশ থেকে পড়লো।
‘সেলাইটা কি জন্য পড়েছিলো জানিস?’
‘হ্যা। মা বলেছে ছোটবেলায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো আমার। আবছা মনে আছে। হাটুর নিচে গভীরভাবে কেটেছিল তাই সেলাই পড়েছে।’
‘তোর তখন চার বছর বয়স। ভীষণ দুষ্ট ছিলি। সুযোগ পেলেই সবার চোখ ফাকি দিয়ে মেইন রোডে চলে যেতিস। গাড়ি চলা, হর্ন এর শব্দ, রাস্তার পাশের মামাদের নানা রকম খাবারের দোকান সব তোকে অাকৃষ্ট করতো। তাই সবসময় দাদি তোর পাশে পাশে থাকতো।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরতেই শুনি তুই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস। দাদির ঘুমে চোখ লেগে যাওয়ায় সবার চোখ ফাকি দিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়েছিলি। বাইকের সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশের রড হাটুর কাছটায় ঢুকে গেছিলো। তোর খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে রক্তাক্ত তোকে দেখে মনি সাথে সাথেই মূর্ছা যায়। দাদি তো পুরো এলাকা জড়ো করে ফেলেছিলো চিৎকার করে।
দাদু, দাদি, কাকাই, মনি সবাই হাসপাতালে ছোটে। আমিও স্কুল থেকে ফিরে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি দাদি পাগলের মতো কাদছে সবার সামনে। তোর শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। যার ফলে রক্ত দিতে হবে।
একমাত্র দাদির সাথেই তোর রক্তের গ্রুপ মিল ছিলো। এবি নেগেটিভ। হাসপাতালে সেই মূহুর্তে এই গ্রুপের রক্ত ছিলো না। যোগার করতে অনেক সময় লেগে যাবে। দাদি পাগলের মতো চিৎকার করে বলছিলো আমার রক্ত নাও। আমার দাদুটাকে বাচিঁয়ে দাও। কিন্তু দাদির রক্ত নেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারন তার কিছুদিন আগেই দাদির কাধে একটা টিউমার অপারেশন হয়েছিলো। যার ফলে তিনি প্রচন্ড দুর্বল ছিলেন।
কাকাই যেখানে পারছিলো দৌড়াচ্ছিলো। আত্মীদের কারো রক্তের গ্রুপ মিলে গেলেও দিতে রাজি হচ্ছিলো না। বাহানা দিচ্ছিলো। তোর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো ক্রমশ। তা দেখে দাদি ছুড়ি দিয়ে ডাক্তারকে শাসায় তার রক্ত নিতে। সেই মুহূর্তে দাদিকে দেখে যে কেউ বদ্ধ উন্মাদ ভাবতো। আমি নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই দিশেহারা অবস্থা থেকে সবাইকে উদ্ধার করে আমার মা। মানে তোর মামনি।’
‘মামনি!’
নাবিলার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
‘হ্যা মা। মা টিচার ছিলো সেটা তো জানিস। তাকে খবর দেওয়ার কথা কারো মাথায়ও আসেনি। মায়ের রক্তের গ্রুপও জানতো না কেউ। সেদিন টিচার্স মিটিং শেষে বাড়ি ফিরতে মায়ের সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো। তোর খবর শুনে হাসপাতালে এসে দাদিকে শান্ত করে বলে তিনি রক্ত দেবে। মায়ের রক্তের গ্রুপও তোর সাথে মিল ছিলো।
এরপর দীর্ঘ একমাস লেগেছে ক্ষত সারতে। আর ছয় মাস পর্যন্ত দাদি তোকে হাটতে পর্যন্ত দেয়নি। কোলে করে সব যায়গায় নিয়ে যেত। দাদির হাটুর ব্যাথা এমনি এমনি হয়নি। ওটার কারন তুই। তোদের ভালোবাসা দেখলে আমারই হিংসা হতো, কেনো আমার আমার একটা দাদি নেই। কিন্তু দাদি আমাকেও খুব ভালোবাসতেন। যদিও তোর থেকে কম।’
গাড়িটা বাড়ির সামনে থামতেই প্রয়াস নাবিলার দিকে তাকালো মুখ চেপে কাদছে মেয়েটা। বাড়িতে ঢোকার পর প্রয়াস বললো,
‘দাদি মানুষটা খুবই সরল।তোর কোনো ভাই নেই বলে কি দাদিকে কোনোদিন আফসোস করতে দেখেছিস?’
নাবিলা ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। দেখেনি।
‘দাদু মারা যাবার পর দাদি তোকেই আকড়ে ধরে বেঁচে আছে। ভীষণ ভালোবাসে তোকে। মাঝে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিলো শুধু। তাইতো আজকে তোকে ভুল মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার অনুসূচনায় হাসপাতালে শুয়ে আছে। কাকাইও কম অনুসূচনায় ভুগছে না। খেয়াল করবি তোর চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি। এইবাড়ির প্রতিটা মানুষের এক বুক ভালোবাসা তুই। তাই কারো ওপর রাগ করে থাকিস না। মানছি ওদের কিছুটা ভুল ছিলো। কিন্তু বিয়েটা তো হয়ে যায়নি। ছোট থেকে যারা তোর হাজারটা ভুল ক্ষমা করেছে তাদের একটা ভুল নাহয় তুইও ভুলে গেলি। পারবিনা?’
‘পারবো।’
‘এবার মুখটা ধুয়ে আয়। মেকাপ, কাজল লেপ্টে এতোদিনে সত্যিকারের পেত্নী লাগছে। যা ভাগ। বিয়ের আগে মরতে চাই না এই মুখ দেখে।’
নাবিলা মুখ বেকিয়ে রুমে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝাপসা দেখলো। তবুও বুঝলো সত্যিই ভুতের মতো লাগছে। তারাতাড়ি ফ্রেস হয়ে নামতেই প্রয়াস ওর চোখে চশমা ঠেলে দিলো। এটারই অভাববোধ করছিলো এতোক্ষন। হাসপাতাল থেকে আসার আগেই লেন্স খুলে ফেলেছিলো। সবই ঝাপসা দেখেছে পুরোটা সময়।
টেবিলে তাকিয়ে দেখলো প্রয়াস নিজেই খাবার গরম করে সাজিয়ে ফেলেছে। খাবার খাওয়ার পর যাওয়ার সময় প্রয়াস কন্টাক্ট লেন্স এর খুটিনাটি যা আছে সব নাবিলার ঘর থেকে নিয়ে গেলো।
দরজা আটকে দিয়ে শুতে যাওয়ার আগে একটা ভাবনা মাথায় এলো নাবিলার। বিড়বিড় করে বললো,
‘অয়ন এতো সহজে সরে যাবে আমার জীবন থেকে? ও কি মেনে নেবে এমিলি আর অলিভারকে? নাকি আবার কোনো ঝামেলা বাধাবে?’
চলবে…