“এখনো_ভালোবাসি”
|ইয়াসমিন তানিয়া|
|পর্ব-২|
আরভিনের অপরেশন ভালোমতো হয়ে গিয়েছে।ডাক্তার আরো বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পরামর্শ দিলো।প্রিয়ু আরভিনকে দেখে,ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিজের বাসায় চলে আসলো।খুব ক্লান্ত শরীর,মাথাটাও জিম জিম করছে।শাওয়ারের নিচে বসে প্রিয়ু চোখদুটো বন্ধ করে অতিতের মাঝে ডুব দিলো।
“প্রিয়ুসী জান্নাত,ওরফে প্রিয়ু।পিতা আশিষ রহমানের মেয়ে।প্রিয়ুর বয়স যখন ১০ বছর মা জাহানারা বেগম পরকাল গমণ করেন।আর রেখে যান,পিচ্ছি এক বছরের ভাই আরভিনকে।মা মারা যাওয়ার পরই প্রিয়ুকে ভাইয়ের জন্য মা হতে হয় ওই এতোটুকু বয়সে।”
–আর সেদিনই প্রথম প্রিয়ুর সাথে আয়নের দেখা হয়।ছোট্ট একটি পিচ্ছি মেয়ে কেঁদে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে,অথচ কোলে তার পিচ্ছি ভাইকে পরম যত্নে সামলাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যেই আয়নের প্রিয়ুর প্রতি একটা মায়া কাজ করলো।এতোটুকু একটা মেয়ে যে নিজেই এখনো বাচ্চা, সে নাকি আবার এই বাচ্চা ভাইকে সামলাবে।সেদিন এতো মানুষের মাঝে প্রিয়ুর দিকে স্নেহের প্রথম হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো আয়ন।
“সেদিন প্রিয়ুও প্রথম আয়নকে দেখে।কারণ প্রিয়ুর বাবার সাথে আয়নের পরিবারের কারো কোনও যোগাযোগ ছিলো না।আয়নের মাই রাখেনি।একই শহরে থেকেও আয়ন জানতোই না,এই শহরে ওর মামা আর তার পরিবার থাকে।তবে জাহানারা বেগমের মৃত্যুর খবর পেয়ে এবার প্রিয়ুর ফুফু আসমা বেগম না চাওয়া সত্যেও আসতে হলো।সব আত্মীয় স্বজনের চাপে পরে।”
–সেদিন থেকেই আয়ন হয়ে যায় ছোট্ট প্রিয়ুর ছায়া।মায়া নাকি ভালোবাসা তা জানা নেই তবে প্রিয়ুর ছোট বড় সব আবদার বিনা সংকোচে পূরণ করতে লাগলো আয়ন।ছায়ার মতো পাশে থেকে ছোট্ট প্রিয়ুকে সব সময় আগলে রাখতো।আয়নের সাপোর্ট পেয়ে প্রিয়ুও নিজেকে আর আরভিনকে সামলানো শিখে গিয়েছিলো।আয়নের সহযোগিতা তখন প্রিয়ুর খুব প্রয়োজন ছিলো কারন মা মারা যাওয়ার পর প্রিয়ুর বাবা কেমন উদাসীন হয়ে গিয়েছিলো।আর কাছের আত্মীয় স্বজন কেউ আর প্রিয়ুদের কোনও খোঁজ খবর নেয়নি।আর প্রিয়ুর বাবা মানসিক ভাবে অসুস্থ থাকায় প্রিয়ু আর প্রিয়ুর ভাইয়ের ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত সে মন দিয়ে নিতে পারতো না।তাই সেই দায়িত্বও আয়ন নিজের কাধে নিয়ে নেয়।এরপর থেকেই প্রিয়ুর জীবনের সব ডিসিশনে আয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ্য ভাবে জরিয়ে পরে।
“সময়ের সাথে আরভিনকে মায়ের আদর যত্নে বড় করতে লাগলো প্রিয়ু।খুব ছোট বয়সে ওকে এই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়।আর ছোট্ট প্রিয়ু তার দায়িত্ব গুলো খুব সুন্দর ভাবে পালনও করছিলো।এসবের মাঝেও প্রিয়ু খুশি ছিলো।আর তার কারণ হলো পাশে ছায়ার মতো থাকা আয়ন।প্রিয়ুর আয়নদা।যে সব সময় প্রিয়ুকে ভরসা দিয়ে বলতো,
‘আমি তো আছি পাগলী, তাহলে এতো টেনশন কিসের।”
__________
আয়ন সম্পর্কে প্রিয়ুর ফুফু আসমা বেগমের বড় ছেলে।সেই সূত্রে আয়নের যখন তখন প্রিয়ুর বাড়ীতে আসা যাওয়ার কোনও সমস্যা ছিলো না।মামার সাথেও আস্তে আস্তে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো আয়নের।
আয়নদের বাড়ীর সবাইও প্রিয়ুকে অনেক আদর করলেও কেনো জানি আসমা বেগম তেমন একটা পছন্দ করতো না প্রিয়ুকে।আয়নের প্রিয়ুর প্রতি এতো টান তার একদমই পছন্দ হতো না।তবে আয়ন আর আয়নের বাবা ইরফাত মাহম্মুদ এর জন্য কিছু বলতে পারতো না।বয়সে আয়ন ছিলো প্রিয়ু থেকে আট বছরের বড়।তবুও প্রিয়ু আয়নকে তুমি বলেই ডাকতো।প্রিয়ুর মুখে তুমি শুনতে আয়নেরও অনেক ভালো লাগতো।
–প্রিয়ু দেখতে খুব সুন্দর ছিলো।বলিউডের কোনও নায়িকার মতো।লম্বা ঘন কালো চুল,টানা টানা চোখ,ঠোঁট দুটো যেনো গোলাপের পাপড়ীর মতো। শরীরের গঠনও ছিলো একদম পার্ফেক্ট। তাইতো ছোট থাকতেই প্রিয়ুর আগে পিছে অনেক ছেলেরাই ঘুড়তো।কিন্তু কেউ প্রিয়ুর সামনে এসে কিছুই বলতে পারতো না।তার একমাত্র কারণ ছিলো আয়ন।
“সময়ের সাথে প্রিয়ুও বড় হতে লাগলো।সাথে সাথে আরো সুন্দর হয়ে উঠলো।আর দিন দিন প্রিয়ুর প্রতি আয়ন অনেকটা পজিসিভ হয়ে যাচ্ছিলো।প্রিয়ুর দিকে কেউ তাকানোও যেনো পছন্দ হতো না আয়নের। আয়নের এমন আচরণে প্রিয়ুও অনেকটা বিরক্ত হতে লাগলো।তবে আয়নের ভয়ে কিছুই বলতে পারতো না।”
–ছোট থাকতেই আয়ন একটু রাগী স্বভাবের ছিলো। ওর পছন্দের জিনিসটি কারো সাথে শেয়ার করা একদম পছন্দ না ওর।আর প্রিয়ুকে তো একদমই না।প্রিয়ু আয়নের এমন আচরণ কখনোই বুঝে উঠতে পারতো না।দিনদিন আয়নের রাগটাকে প্রিয়ু নিজেই ভয় পেতে লাগলো।
আয়নের যখনই খুব রাগ উঠতো,তখনি ও চলে আসতে প্রিয়ুদের বাসায়।আর প্রিয়ুর কাজ তখন যেমনেই হোক আয়নকে শান্ত করার।একমাত্র প্রিয়ুর সঙ্গই পারতো আয়নকে শান্ত করতে।
“হঠাৎ ফোনের শব্দে প্রিয়ু অতীত থেকে ফিরে আসে।আজকের আয়নের দেওয়া কষ্টটা মনে করে প্রিয়ু ডুকরে কেঁদে উঠে আবার।নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃর্ণা লাগছে।কি করেছে আজ ও।কেনো এতোটা অসহায় হলো। আজ মেয়ে বলে সমাজের নিকৃষ্ট মানুষগুলো নোংরা চোখে দেখার সাহস করে।এসব নোংরা মানুষগুলো থেকে একসময় তুমিই তো রক্ষা করে এসেছিলে,তাহলে কেনো আজ রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে গেলে আয়নদা, কেনো?
আমি কখনো তোমাকে ক্ষমা করবো না।ঘৃর্ণা করি তোমায়।ঘৃর্ণা! শুনছো আয়নদা, ঘৃর্ণা!
ঝর্ণার নিচে বসেই প্রিয়ু মুখে হাত দিয়ে ডুকরিয়ে ডুকরিয়ে কাঁদছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে প্রিয়ুর তবে শরীরের যন্ত্রণা থেকে মনের যন্ত্রনাটা অনেক বেশি।”
___________
আয়ন বার বার প্রিয়ুকে কল করছে,কিন্তু প্রিয়ু ফোনটা না ধরার কারণে রাগে ফোনটা সামনের দেয়ালে ছুড়ে মারে।নিজের আঙ্গুলের সাহায্যে চুলগুলো টানতে টানতে বিছানায় বসে পড়লো।রাগে আয়নের চোখ দুটো লাল হয়ে গিয়েছে।সাহস খুব বেশি তোর প্রিয়ু।আমার রাগ তোর সব কিছু কেড়ে নিয়েছে,তবুও আবার আমাকে রাগাস তুই।এতো সাহস কোথায় পাস।এতোদিন লুকিয়ে ছিলি বলে বেঁচে ছিলি।কিন্তু এখন কি করবি।কোথায় লুকাবি।
–প্রিয়ু ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে ফোনটা চেক করলো।আননোন নাম্বার বলে,আর কল ব্যাক করলো না।বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো,কেনো জানি ভীষন ঘুম পাচ্ছে।শরীরে শীত শীত ও লাগছে।মনে হয় জ্বর আসবে।সারাদিন পেটে কিছু যায়নি,এখনো কিছু না খেয়েই শুয়ে পরেছে প্রিয়ু।এখন আর জোর করে কেউ ওষুধ খাওয়াবার মানুষ নেই।প্রিয়ুর চোখ বন্ধ করে সেদিনের কথাগুলো মনে পরে গেলো।
“প্রিয়ু তখন সবে মাত্র ক্লাশ টেন এ উঠেছিলো।স্কুল থেকে ফেরার সময় হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে।বৃষ্টিতে ভিজার লোভ সেদিন প্রিয়ু সামলাতে পারেনি।বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই প্রিয়ু সেদিন বাসায় আসলো।আর বাসায় এসেই প্রিয়ুর নাক দিয়ে পানি পরা শুরু হয়ে গেলো।প্রিয়ুর একটু ঠাণ্ডা লাগলেই সর্দি শুরু হয়ে যাবে,নাক বন্ধ হয়ে যাবে,গলাও ভেঙ্গে যায়।আর রাতে আসবে জ্বর।
-আয়ন প্রিয়ুর সাথে ফোনে কথা বলেই বুঝতে পারে প্রিয়ু বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছে।কিছুক্ষণ পরই একজন মহিলা ডাক্তার নিয়ে হাজির হয়ে যায় প্রিয়ুর বাসায়।
-প্রিয়ু জানতো এমনি হবে,তাই চুপচাপ বসে ডাক্তার আর আয়নের কথা শুনতে লাগলো।আর মনে মনে ভাবছে আজ মনে হয় আয়নদা আমাকে ছাদে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে।কোনও ভরসা নেই।নিজেকে শান্ত করতে সারা দুনিয়া জালিয়ে দিতে পারবে এই মানুষটি ।”
–সেদিন সারারাত আয়ন প্রিয়ুর সেবা করেছে।প্রিয়ুর রাতে সত্যিই কাপানি দিয়ে জ্বর এসেছিলো।সারারাত আয়ন পাশে বসে জলের পট্টি দিতে লাগলো।পাশে বসে থাকা ছোট আরভিনও ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।আয়নের মামাও সারারাত ড্রয়িংরুম এ বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।শুধু ঘুম ছিলোনা সেদিন আয়নের চোখে।ভোররাতে প্রিয়ুর জ্বর চলে গেলে,পারুলকে ডেকে প্রিয়ুর কাছে বসিয়ে দিয়ে আয়ন বাসায় চলে যায়।
“পারুলকে আয়নি এনেছিলো।বয়সে প্রিয়ুর থেকে কয়েক বছর বড় হবে।প্রিয়ু আর আরভিনের সাহায্যের জন্য পারুলকে এই বাসায় রেখেছে আয়ন।পারুল আয়নের বাড়ীর দারোয়ান এর মেয়েছিলো।ছোট বেলায় মা মারা গিয়েছে,আর বেশ কয়েক বছর হলো বাবাও মারা গেলো।এতিম পারুলকে আয়ন প্রিয়ুর বাসায় নিয়ে আসে।এতে পারুলও আশ্রয় পায়,আর আয়নও কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়।
-সেদিন যাওয়ার পর, রাগ করে আয়ন প্রিয়ুর সাথে এক সপ্তাহ কথা বলেনি।অবশেষে প্রিয়ু কান ধরে সরি বলার পর আয়নের রাগ কিছুটা কমেছিলো।”
__________
এসব চিন্তা করতে করতে প্রিয়ুর চোখ দিয়ে এমনেই কিছু নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।ফোনটা এখন আবার বাজা শুরু করছে।কিন্তু ফোন ধরার শক্তি বা ইচ্ছা কোনটাই নেই প্রিয়ুর।কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয়ুর চোখ দুটো লেগে গেলো।
–আয়ন নতুন একটা ফোন দিয়ে প্রিয়ুকে কল করছে,কিন্তু এবারও ফোন রিসিভ না হওয়ায়,রবিনকে কল করে।
রবিন,প্রিয়ু কোথায় এখন।
“স্যার,ম্যাডাম কিছুক্ষণ আগেই বাড়ীতে এসেছে।এতোক্ষন হাসপাতালে ছিলো।”
–ওকে,প্রিয়ুর বাড়ীর এড্রেস সেন্ড করো,রাইট নাউ।
“ওকে স্যার।”
–আয়ন গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেলো।এড্রেস পেয়ে সোজা প্রিয়ুর বাসায় পৌঁছে গেলো।গাড়ী থেকে নেমে আয়ন আতকে উঠলো।এ কেমন জায়গায় তাকে প্রিয়ু। ওদের বাড়ীর দারোয়ানও এর থেকে ভালো জায়গায় থাকে।খুব পুরোনও একটা বাড়ী।বাড়ীর পরিবেশটাও তেমন ভালো না।আয়ন ভাবছে,কিভাবে থাকছে প্রিয়ু এখানে।আয়নের পিছে পিছে আয়নের দুজন বডিগার্ড ও এসে পরেছে।তারা আসেপাসে জিঙ্গেস করে আয়নকে প্রিয়ুর রুমটা দেখিয়ে দেয়।আয়ন অনেকবার দরজা টোকা দেওয়ার পরও যখন প্রিয়ু দরজা খুলছে না।তখন আয়নের মনে খটকা লাগে,আয়ন তৎক্ষণাৎ কিছু চিন্তা না করেই দরজা ভেঙ্গে ফেললো।
“আয়ন ভেতরে ডুকে,দেখতে পারে প্রিয়ু একটা কাঠের চকিতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।আয়ন প্রিয়ুর কাছে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে যা ভেবেছে তাই হলো।জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।চুলগুলো এখনো ভেজা,নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে ছিলো।মাথার চুল গুলোও ভালো করে মুছেনি এই মেয়ে। মন চায় তোকে তুলে একটা আছাড় মারি।তারপর যদি একটু শান্তি পাই।
-আয়ন প্রিয়ুকে কোলে তুলে নিলো,প্রিয়ুকে এ পরিবেশে কিছুতেই থাকতে দিবে না।গাড়ীতে বসিয়ে গার্ডকে ইশারা করলো গেস্ট হাউজ এর দিকে জেতে।জ্বরের ঘোরে অসুস্থ প্রিয়ুকে আয়ন একহাতে জরিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরেছে।”
–আয়ন নিজের রুমে বালকানিতে দাঁড়িয়ে,বিছানায় পরে থাকা প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে চেক করে গিয়েছে ।অনেক কস্টে প্রিয়ুকে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো আয়ন।এখন ঘুমিয়ে আছে।
আজও তোর কিছু হলে আমি কেপে উঠি।আজও তোকে এভাবে দেখলে আমার মনটা পুড়ে।
এক দৃষ্টিতে প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে থেকে আয়ন নিজের মনেই বলতে লাগলো,
জানি আজ তোর সাথে যা করেছি,তার জন্য হয়তো কোনও দিনও আমাকে ক্ষমা করবি না।কিন্তু তোকে পাওয়ার জন্য এই আয়ন আরো নিচে নামতে পারে।তোর ধারনারও বাহিরে।
চলবে……।
(কেমন হচ্ছে জানাতে ভুলবেন না।ধন্যবাদ।)
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।