এখানেই শেষ নয় পর্ব -০৮

#এখানেই_শেষ_নয় (০৮)

#অপরাজিতা_রহমান (লেখনীতে)

আজ থেকে আট বছরের আগের ঘটনা। আমি তখন নতুন নতুন ড্রাইভিং শিখেছি। ডিসেম্বরে আমার পরীক্ষা শেষ করে আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই মিলে গ্ৰামে ঘুরতে যাই আমার দাদু বাড়ি। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে তাকিয়া সহ আরো দুইটা মেয়ে ছিল।গ্ৰামের পরিবেশ আসলেই ভিন্ন। আমরা শহরে চার দেয়ালের বন্দি থেকে সেই ভিন্নতা অনুভব করতে পারি না।গ্ৰামে ভোর বেলা পাখির কিচিরমিচির শব্দ, দূর থেকে মক্তবের বাচ্চাদের কুরআন তেলাওয়াতের মধুর কন্ঠে ঘুম ভেঙ্গে যায়। শহরের মতো গ্ৰামে ঝর্না নেই,আছে পুকুর। যেইখানে মুক্ত হাঁসের মতো সাতড়ে বেড়ানো যায়।গ্ৰামে বিদ্যুতের আনাগোনা নেই, আছে আকাশ ভরা জোছনা।আর রান্নার কথা না বললেই নয়। এইখানে মাটির উনুনে রান্না করা হয় ,যার স্বাদ শহরের গ্ৰাসের চুলায় রান্না করা খাবারের স্বাদ কে হার মানিয়ে দেই। এইভাবে মজার মজার খাবার,গ্ৰামীন পরিবেশ, হাঁসি ঠাট্টা মজা খুঁটশুটি তে কখন যে গ্ৰাম থেকে বিদায় নেয়ার সময় হয়ে যায় বুঝতে পারি নি।গ্ৰামে সাধারণ ঘোল পাওয়া যায়।যা অনেক টা নেশা জাতীয়।গ্ৰাম থেকে ফেরার পথে আমরা সবাই মজার ছলে ঘোল খাই।যা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। সেই ভুল প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে।দিন শেষে আমার মনে হয় আমি অপরাধী। আমার অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। এইটুকু বলেই শায়ান গ্লাসে রাখা শরবত খেয়ে নিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি শায়ানের কন্ঠ কেঁপে উঠছে।

তারপর কি হলো? তুমি কি এমন করলে তার জন্য নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে আছো?

খু*ন

মানে কি?

মানে আমি খু”ন করেছি। হ্যাঁ আমি একটা খু”নি। আমার জন্য দুইটা প্রাণ শেষ হয়ে গেছে।আর সেই খু”নে”র ঘটনা ধামাচাপা দিতেই তাকিয়া আমাকে ব্লাকমেইল করে আমার থেকে টাকা নেয়।

শায়ান প্লিজ হেঁয়ালি না করে বল তারপর কি হয়েছিল?

ঘোল খাওয়ার কারণে আমার মধ্যে অনেক টা নেশা প্রভাবিত হয়। শহরের মধ্যে প্রবেশ করতেই ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই যার যার গন্তব্যে স্থলে নেমে যায়।আর তাকিয়ার বাসা আমার বাসার কাছাকাছি হ‌ওয়ায় তাকিয়া থেকে যায়। গাড়ি চলছিল আপন গতিতে। হঠাৎ আমার মাথা ঘুরাতে শুরু করে,চোখ মুখ ঝাপসা হয়ে আসে। অতিরিক্ত ঘোল খাওয়ার প্রভাবে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আমার এইটুকু মনে আছে জ্ঞান হারানোর আগে আমি বেসামাল ভাবে গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম।আর হুট করে কালো রঙের একটা গাড়ি আমার গাড়ির সামনে চলে আসে। এরপর কি হয়েছিল আমি জানি না। জ্ঞান ফেরার পর তাকিয়া বলেছিল আমার জন্য নাকি ঐ গাড়ি তে থাকা দুটো প্রাণ শেষ হয়ে গেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি অনেক টা ঘাবড়ে যাই। তাকিয়া বারবার পুলিশ কে সবটা বলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। আমি তাকিয়া কে হাতজোড় করে বলি ও যেন বিষয় টা ধামাচাপা দিয়ে রাখে‌।না হলে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেত।মম ,ড্যাড মানসিক ভাবে খুবই আঘাত পেত। কিন্তু তাকিয়া শর্ত দেয় ওকে ওর চাওয়া অনুযায়ী টাকা দিতে হবে। আমি ও নিজেকে বাঁচাতে তাকিয়ার শর্তে রাজি হয়ে যায়।যার ফলস্বরূপ তাকিয়া বলা মাত্র ওর একাউন্টে আমার টাকা ট্রান্সফার করতে হয়।

শায়ানের কথা শুনে আমি যেন পাথর হয়ে গিয়েছি। আমার পুরোনো অতীত আবার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।তার মানে শায়ানের কথা অনুযায়ী সেদিন ট্রাকে আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয় নি। স্বয়ং শায়ানের কারণে আমার আব্বু আম্মুর মৃ”ত্যু হয়েছে। হ্যাঁ শায়ান আমার বাবা মায়ের খু”নি।আর আমি কি না আমার বাবা মায়ের খু”নি”র সাথেই সংসার পেতে বসেছি? হঠাৎ করে কেমন যেন অস্বস্তি হয়ে মাথা ঘুরে উঠলো। আমি পরে যেতেই শায়ান আমাকে ধরে ফেলে।

সিনিয়র বেবি কি হলো তোমার?

তুই স্পর্শ করবি না আমাকে। তুই একটা খু”নি।

কি বলছো কি তুমি?

সেদিন তোর ফুর্তি করার জন্য এক্সিডেন্ট আর কারো নয় স্বয়ং আমাদের গাড়ি তে হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গেলেও আমার বাবা মা বেঁ”চে ফেরে নি।

সরি ফর এভরিথিং।

সরি বললেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যায় না। আমি তোকে ক্ষমা করে দিলেই কি তুই পারবি আমার বাবা মাকে ফিরিয়ে দিতে?পারবি বাবা মায়ের থেকে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে?বাবা মা মা”রা যাওয়ার মামির কাছে দিন রাত অ”ত্যা”চা”রে”র শিকার হয়েছি।এমনকি আশ্রীতা ছিলাম বলে বিয়ের আসর ছেড়ে বর চলে গিয়েছিল।পারবি সেই অপমান ফিরিয়ে নিতে।এ কথা বলতেই শায়ান আমার পা জড়িয়ে ধরলো।

একি! তুই আমার পায়ে হাত দিয়েছিস কেন?পা ছাড় বলছি। আমি তোকে না মানলেও তুই আমার স্বামী। স্বামী হয়ে স্ত্রী পায়ে হাত দেওয়া টা বেমানান দেখায়।

তুমি আমাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি তোমার পা ছাড় নি না সিনিয়র বেবি। তুমি আমাকে যে শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিব। তবু ও তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

তুই যা করেছিস তাতে আদৌ কি তুই ক্ষমার যোগ্য?

বলছি তো আমার ভুল হয়েছে।এই ভুলে প্রতিনিয়ত আমি নিজে ও শেষ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি কিভাবে শিওর হলে ঐ টা তোমাদের‌ই গাড়ি ছিল?

কারণ কালো গাড়ি তে আমরা ছিলাম।আর দুই জন লোক আমার বাবা মা ছিল। তুই যা তো এইখান থেকে।ভালো লাগছে না আমার।আমাকে একটু একা থাকতে দে।
কুয়াশা কে এই অবস্থায় দেখে শায়ানের মোটেও ভালো লাগছে না।কষ্ট হচ্ছে কুয়াশার জন্য।ওর এই অবস্থার জন্য শায়ান নিজেকে দায়ী করছে।শায়ান ভাবতে লাগল কিভাবে কুয়াশার মন ভালো করা যায়? পরক্ষণেই মনে হলো কুয়াশার তো বিরিয়ানি খুব পছন্দের । বিরিয়ানি দেখে নিশ্চয় একটু মন ভালো হবে। যদিও কুয়াশার সামনে দাঁড়ানোর কোন মুখ নেই,।শায়ানের তবু ও একটু তো চেষ্টা করতে পারে মেয়েটার মন ভালো করার। কিন্তু শায়ান রান্না জানা তো দূরের কথা কখনো কিচেনে ও যায় নি। পরক্ষণেই মনে হলো ইউটিউব তো আছেই ইউটিউব থেকে শিখে রান্না করবে। কিন্তু কথায় আছে না অভাগা যে দিকে যায় সে দিকেই জল শুকিয়ে যায়।শায়ানের ও অবস্থা হয়েছে এমন। ইউটিউবে ভিডিও প্লে করতে গিয়ে বুঝতে পারল কারেন্ট নেই যার কারনে ভিডিও প্লে হচ্ছে না। বেচারা কি করবে বুঝতে না পেরে তার মমের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,মম বিরিয়ানি কিভাবে রান্না করতে হয়?

কেন ? তুই জেনে কি করবি?

রান্না করবো।

সিরিয়াসলি।

এতো প্রশ্ন কেন করছো?বললে বলো না বললে নাই।

আরে এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?তোর যে বিরিয়ানি খেতে মন চাইছে আমাকে বলতে পারতি আমি রান্না করে দিতাম।

আমি খাওয়ার জন্য রান্না করছি না।

তাহলে কার জন্য রান্না করতে চাচ্ছিস?তাকিয়ার জন্য?

না । তোমার একমাত্র সিনিয়র বৌমার জন্য।

মানে কি? আমি ঠিক শুনছি তো।

হ্যাঁ মম।জোর করে বিয়ে দিয়েছ সিনিয়র একটা বেবির সাথে।যে কি না শ্রেয়াশ আবরার শায়ান কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। এখন আবার তার পুরনো কথা মনে করে মন খারাপ হয়েছে।তাই তার মন ভালো করার জন্য আমার এই সুক্ষ্ম প্রচেষ্টা।

আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বলছি তুই নোট করে নে।

ঠিক আছে মম।

অবশেষে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর শায়ান সক্ষম হলো বিরিয়ানি রান্না করতে।একটা প্লেটে বিরিয়ানি ,ডিম,সালাত সাজিয়ে রুমে নিয়ে এলো। রুমে এসে দেখে কুয়াশা শুয়ে রয়েছে।

সিনিয়র বেবি।

আবার কেন এসেছিস?

খুব তো কান্না কাটি করলে , এবার ওঠো তো।

তুই আমার সামনে আসবি না শায়ান। যতবার তুই আমার সামনে আসবি ততবার আমার বাবা মায়ের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠবে।আর আমার ততবার মনে হবে আমি একটা খু”নি”র ব‌উ।

তুমি আমাকে যা মন চায় বলো। তবু ও ওঠে দেখ তোমার জন্যে কি নিয়ে আসছি?

কুয়াশা ওঠে শায়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে শায়ানের গালে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল।

চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here