#এসো_বৃষ্টি_হয়ে(৯)
#writer_sayuri_dilshad
মোবাইলের রিংটোনের তীক্ষ্ণ শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বেলির। উঠে বসে সে।চারদিকে ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসছে। বাহিরে কল চাপার শব্দ আসছে। বোধহয় কেউ অজু করছে। বেলি না দেখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কানে ধরে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কান্না মিশ্রিত কন্ঠ ভেসে আসে। মুহূর্তেই বেলির ঘুম উড়ে যায়, ধক করে উঠে বুকটা কারো কোনো বিপদ হয় নি তো। কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে একবার নাম্বারটা দেখে নেয়। সুখনের নাম্বার। বেলি অবাক হয়, মেয়েটা কে!কে কাঁদে? কি হয়েছে? রাতের ঘটনাটা তার মনে পড়তেই সে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা কানে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
– হ্যালো!
ওপাশ থেকে ভেসে আসে চারটি অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ।
– বেলি, মা মারা গেছে।
বেলির মুখে রা আসে না। সে মোবাইলটা কানের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে রাখে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে যেন নিশ্বাস নিতেও ভুলে যায়। খানিকবাদে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাথে গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে নোনাজলের ধারা। অনেক কষ্টে বলে,
– কখন?
ওপাশের কান্না থেমে যায়। এবার সুখনের গলা স্পষ্ট হয়। বলে,
– এইতো কিছুক্ষণ আগে। তুমি ফোন দেওয়ার পর আমি বাসায় গিয়ে দেখলাম অচেতন অবস্থায় পরে আছে। আমি মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সুমিকে জানানোর পর তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম। সুমি বললো তোমাকে পরে জানাতে। কিন্তু এখন তো..
– এখন কোথায় আছো তুমি!
– আমরা হাসপাতাল থেকে বেরুবো।
– সুমি আসছে!
– ও রাতেই এসে পড়েছে।
– ও আচ্ছা।
বেলি মোবাইলটা নামিয়ে রাখলো।এতক্ষণ সে অনেক কষ্টে কথা বলেছে। চোখ দিয়ে তার অনবরত পানি পড়ছে। সুখন তাকে কোনোদিনও ভালোবেসেছে কিনা সে জানে না। কিন্তু তার শাশুড়ী তাকে খুব ভালোবাসতো। এটা তিনি তার কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করে দিয়ে গেছেন। বেলির কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। তার ভালোবাসার মানুষগুলো একে একে দূরে সরে যাচ্ছে। সে বিছানা ছেড়ে দরজা খোলে বাইরে বের হয়। আহমেদ শেখ ফজরের নামাজ পড়ছে বারান্দায়। বেলি সেখানে গিয়ে ধীর পায়ে দাঁড়ায়। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না তার পা কাপছে, বসে পড়ে সে। আহমেদ শেখ সালাম ফিরিয়ে বেলিকে কাঁদতে দেখে থমকে যায়৷ জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে? কাঁদো কেন!
বেলি শব্দ করে কেঁদে উঠে বলে,
– সুখন ফোন দিয়েছিল আম্মা মারা গেছে।
আহমেদ শেখ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। বিরবির করে পড়ে ” ইন্না-লিল্লাহ……”
তারপর বলে,
– কি হয়েছিলো জানো কিছু!
বেলি গতকাল রাতের ঘটনা সে খুলে বললো। আহমেদ শেখ বললেন,
– জানাজা কয়টায়?
বেলি মাথা নেড়ে বলে,
– জানি না। ওরা মাত্র হাসপাতাল থেকে বেরুচ্ছে।
আহমেদ শেখ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
– যাও নামাজ পড়ে। কিছু খেয়ে দেয়ে সবাইকে নিয়ে তৈরি হও।
বেলি উঠে দাঁড়ালো। সে এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। সে ভেবেছিলো তাকে বুঝি যেতে দিবে না। আহেমদ শেখ জায়নামাজে বসে দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলেন। ভদ্রমহিলা অনেক ভালোছিলেন। আফসোস হয় তার। ভালো মানুষগুলোই পৃথিবী ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়।
—–
বিরক্ত নিয়ে প্রতীক মোবাইল কানে ধরলো প্রতীক।
বললো,
– কে?
ওপাশ থেকে পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে প্রতীক উঠে বসলো। না দেখেই মোবাইল রিসিভ করেছিলো। এবার প্রতীক নাম্বার টা দেখে ফুপা কল দিয়েছে। প্রতীক সালাম দিলো। তারপর ভ্রু কুচকে ওপাশের সব কথা শুনলো। সব শেষে বললো,
– সমস্যা কি! যাবেন সবাই মিলে। তারপর আবার নিয়ে আসবেন।
ওপাশ থেকে আবার কিছু একটা বলায় প্রতীক বললো,
– না না সমস্যা হবে কেন! একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি!
রহমত শেখ হেসে বললেন,
– হ্যা হ্যা নিশ্চয়ই।
– যদি ঠিকানাটা দিতেন তাহলে আমিও আসতাম।
রহমত শেখ খানিকটা অবাক হলেন, বিস্ময়ের সুরে বললেন,
– তুমি যাবে!
প্রতীক আমতা আমতা করে বললো,
– না মানে আমার ভদ্রমহিলাকে দেখার খুব শখ।
রহমত শেখ সম্মতি দিলেন ঠিকানা বললেন। প্রতীক হাসলো। সে মিথ্যা বলেছে। তার বেলিকে দেখার জন্য মন আনচান করছে। সে অনেকবার চেষ্টা করেছে বেলিকে মন থেকে মুছে ফেলার জন্য। কিন্তু সে পারছে না। কিছু একটা করতে হবে বেলিকে ভুলার জন্য।
সুমি বেলিকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
– তুমি আসছো ভাবি। তুমি আসছো। মা তোমারে কতো আদর করতো। তুমি এই বাড়িতে আসছো দেখলে কতো খুশি হইতো।
বেলির গাল বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগলো। সুমি থামে না।সে বিলাপের সুরে বলতে থাকে
-শেষের কয়টা দিন খালি ফোন দিয়া কাঁদতো, আর বলতো তোমার জন্য তার মন পুড়ে। তোমার প্রতি আমার ভাইয়ের করা অন্যায় তিনি মানতে পারেন নাই। তোমার সামনে যাইতে নাকি লজ্জা করতো।
সুমি বেলিকে ছেড়ে তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললো,
– ও ভাবি! আমার মা যদি তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে তারে মাফ করে দিয়ো। দাবি রেখো না।
বেলি শব্দ করে কেঁদে উঠে। সুমিকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে বলে,
– আম্মা আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যদি আমি এখানে থাকতাম তাহলে হয়তো এমন হতো না।
বেলি কুলসুম বেগমকে শেষবারের মত দেখতে গিয়ে একটা পাগলের মতো কাজ করলো। সে কুলসুম বেগমের পাশেই লুটিয়ে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে। সুখন এগিয়ে এসে তাকে টেনে তুললো। বললো,
– পাগলামি করো না৷
বেলি ঝাপসা চোখ হঠাৎ সুখনের উপর পরলো। চোখ মুছে সে আবার তাকালো তারদিকে। মুহূর্তের মধ্যেই তার রাগ হলো। সে এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,
– ধরবে না আমাকে তুমি। তুমিই তোমার মায়ের খুনী। তোমার অপকর্মের ভার সহ্য করতে না পেরেই আজকে তিনি চলে গেছেন।
সুখন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো বেলির দিকে। তারপর বললো,
– বেলি চুপ করো এখন।
বেলি সুখনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– চোখ রাঙাবে না একদম।
আরও কিছু বলতে গেলেও আশেপাশের মহিলারা থামিয়ে দিলো। বললো আগে সব কাজ শেষ হোক তারপর এসব কথা। ছেলেরা কুলসুম বেগমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
পেছন থেকে কান্নার রোল পড়লো। হঠাৎ একজন সামনে এসে দাড়ালে কান্না থামিয়ে সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো।
বেলি মায়মুনা দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি এখানে কি করো?
মায়মুনা হেসে বললো,
– আপনি যা করেন।
সুমি এগিয়ে এসে বলে,
– আপনি বেরিয়ে যান এখান থেকে।
মায়মুনা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
– যাব। তার আগে সবাই শুনে রাখেন আমি সুখনের বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি। সবাইকে জানিয়ে রাখলাম, নাহলে তো বলবেন বাজারি মেয়ে কি জানি কার বাচ্চা নিয়ে এসে অন্যের নাম দিচ্ছে।
সুমি এগিয়ে এসে বলে,
– আপনি বেরিয়ে যান।
মায়মুনা বেরিয়ে আসে।বেলিও প্রস্তুতি নেয় বেরিয়ে যাওয়ার, তার এই বাড়িতে থাকার আর কোনো মানে হয় না। সুমি বলে,
– ভাবি একটুক্ষণ বসো। সবাই আসুক, কথা আছে।
একপ্রকার জোর করেই বেলি আর তার পরিবারকে থামায় সুমি।
——-
সুখন উঠে দাঁড়িয়ে পরে সুমীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– মানে কি? আমার অজান্তে এসব কখন হলো? আমি মানি না এসব। বাসা তোর নামে। সম্পত্তির বেশি অর্ধেক বেলির নামে, তারপর তোর নামে আর আমার নামে ছিটেফোঁটা! সব ষড়যন্ত্র । ব্যবসায় যা অর্থ লাভ আসবে তার অর্ধেক লিখনের নামে ব্যাংকে রেখে দিতে হবে। তাহলে আমার কি! আমার কি?
সুমী গ্লাসে থাকা পানিটা এক টানে শেষ করে বললো,
– সবই তোমার। যদি তুমি ভালো মতো চলো।
সুখন সুমীর কথা বুঝতে পারলো না। সে বোকা বোকা গলায় বললো,
– মানে?
বেলির পরিবার বিস্ময়ের চরমসীমায়। তারা কোনো কথা বলতে পারছে না। কুলসুম বেগমের কর্মকান্ডে তারা হতবাক। তারা ভেবেছিলো হয়তো তিনি আশ্বাস দিচ্ছেন কিন্তু তিনি যে এমন কাজ সত্যিই করে যাবেন এটা কেউ ভাবতে পারে নি। সেদিন কুলসুম বেগম তাকে ডেকে যেসব কাগজে সাইন করিয়েছিলো তাহলে সেগুলো এইসবের কাগজ ছিলো। বেলি ভাবে, সে বুঝতেই পারে নি।
সুখনের চোখ হঠাৎ বেলির দিকে পড়লো। রাগে হিতাহিত জ্ঞান শুন্য হয়ে বেলিকে সোফা থেকে টেনে তুলে দাঁড় করালো সুখন। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– এই তুমি আমার মাকে কি এমন খাইয়েছো যে সব তোমাকে দিয়ে গেছে! আমার সম্পত্তির প্রতি এত লোভ তোমার। এত লালসা!
বেলি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকলো। সে হাতে ব্যাথা পাচ্ছে এমন ভাবে ধরে রেখেছে সুখন।বেলি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
– সম্পত্তির লোভ আমার না তোমার বলেই তোমার মা আমার নামে সব দিয়ে গেছে। তুমি শুধু চরিত্রহীনেই না তুমি হলে অর্থলোভী স্বার্থপর মানুষ। সেটা এখানের সবাই তোমাকে দেখে বুঝতে পারছে।
সত্য কথা সুখনের সহ্য হয় না৷ সে বেলির গালে চড় বসিয়ে দেয়। বেলির পরিবার এগিয়ে আসতে গেলেও থমকে দাঁড়ায় কারণ কেউ একজন তার আগেই সুখনকে ঘুষি মারে। সুখন তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায় লোকটার দিকে।
প্রতীক এগিয়ে এসে বেলিকে বলে,
– ঠিক আছো তুমি?
বেলি অবাক চোখে প্রতীকের দিকে তাকায়। তারপর মাথা নেড়ে বলে,
– হ্যা।
বেলির ঠোঁট জ্বালা করে। হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরতেই প্রতীক বলে উঠে,
– ধরো না, কেটে গেছে।
সুখন উঠে দাঁড়ায় তারপর বেলির উদ্দেশ্যে বলে,
– আজকাল দেখি তোর জন্য সবাই লড়াই করছে। ঘটনা কি! ঘরের মানুষ বাইরের মানুষ! সবাই খালি আমাকে চরিত্রহীন বলে। তোরটা কেউ দেখে না। সব লোকেরাই তোর কথা বলে তোর হয়ে এগিয়ে আসে। কি দিয়েছিস তাদের।
বলেই আবার এগিয়ে আসে বেলির দিকে। প্রতীক সুখনকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। বেলি ঘৃণা ভরা চোখে তাকিয়ে তাকে সুখনের দিকে। প্রতীক বেলির হাত ধরে বলে,
– চলো এখান থেকে।
বেলির বাড়ির সবাই সুখনকে রাগি দৃষ্টিতে দেখে একবার। প্রতীক এগিয়ে না এলে ওর কি হতো কেউ জানে না।
পল্টু গাড়িতে বসে একদৃষ্টিতে প্রতীককে দেখছে। প্রতীক একবার পল্টুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি?
পল্টু বললো,
– সবই বুঝলাম আপনার বিষয়টা বুঝলাম না।
– কি বিষয়?
– এই যে! না মানে বেলি আপার প্রতি আপনার বিষয়টা।
প্রতীক আড় চোখে একবার পল্টুকে দেখে বললো,
– কোন বিষয়টা?
পল্টু কোনরকম ভনিতা ছাড়াই বললো,
– ভালোবাসেন নাকি?
– হয়তো।
প্রতীকের সহজসরল স্বীকারোক্তি। পল্টু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো প্রতীকের দিকে। তারপর বললো,
-যাহ্, তা হয় না৷
প্রতীক হেসে বলে,
– তাহলে হয়তো হয় না।
বাড়ির সবাই বেলির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বেলি আবার বললো,
– আমি সত্যিই সুখনকে ডিভোর্স দিতে চাই। ওর মতো একটা জঘন্য মানুষের সাথে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এরকম মানুষের সাথে আমি থাকতে চাই না যে কিনা কথায় কথায় আমার চরিত্রে আঙুল তুলে। অথচ তারই চরিত্রের ঠিক নেই। আমি এতোদিনের ভুলটা শোধরে নিতে চাই এখন।
চলবে,
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন দয়া করে)