এ তুমি কেমন তুমি পর্ব -০৯

#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৯

সময় নদীর স্রোতের মতো। কারো জন্য অপেক্ষা না। সব মেয়েরা হলুদ দিতে এসেছে ফারহানকে। তাদের সাথে অনুও এসেছে। কাঁচা হলুদ আর সবুজ রঙের কম্বিনেশনে জামদানী শাড়ি গায়ে জড়ানো। মাথায় হিজাব, মুখে হালকা সাঁজ আর হাতে একটা রজনীগন্ধা আর গোলাপের মালা পেঁচানো। অতি সাধারণ সাজে মায়াবী লাগছে অনুকে। মুখে লেগে আছে কৃত্রিম হাসি। একে একে সবার হলুদ ছোঁয়ানো শেষে অনুর পালা এলো। কিন্তু অনু যেতে চাইছে না।

তামান্না হেসে বললো, “কী গো ননদিনী লজ্জা পাচ্ছো নাকি? লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, এক সম্পর্কে বউয়ের বড় বোন হলেও অন্য সম্পর্কে কিন্তু তুমি ফারহানের ছোট বোন হও। তাই ছোট বোন হয়েই নাহয় হলুদ লাগাও।”

ফারহান তাকালো অনুর দিকে। অনু কাচুমাচু করছে ফারহানের কাছে যেতে। অনুকে দেখে ফারহান চোখ সরিয়ে নিলো। ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। তবে অনুর আচরণে বেশ অবাকও হলো। অনু তার কাছে আসতে কাচুমাচু করছে কেনো? তবে কী অনুর দিক থেকেও কোনো অনুভূতি ছিল? ফারহান আবার তাকালো অনুর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই অনু চোখ সরিয়ে নিলো। এগিয়ে এসে একটু হলুদ নিয়ে কাঁপা হাতে ফারহানের গালে ছুঁইয়ে দিলো। ফারহান অনুভব করতে পারলো অনুর কাঁপুনি। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো অনুর দিকে। অনু দ্রুত সরে গেলো ফারহানের কাছ থেকে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই খাওয়াদাওয়া করছে তখন অনু চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে তার। হঠাৎ ফারহান তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

অনু শুকনো ঢোক গিলে বললো, ” কিছু বলবেন ভাইয়া?”

তখন তুই ওভাবে কাঁপছিলি কেনো?

কখন, কোথায় কাঁপছিলাম আমি?

আমাকে হলুদ লাগানোর সময় তোর হাত এত কাঁপছিল কেনো অনামিকা?

গলা শুকিয়ে এলো অনুর। এতদিন যখন অনু চাইতো ফারহান তার অনুভূতি বুঝুক তখন বোঝেনি কিন্তু আজ যখন অনু নিজের অনুভূতি লুকাতে চাইছে তখন কেনো সন্দেহ করছে ফারহান?

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো অনু, “আসলে যদি হঠাৎ ধমকে দেন তাই ভয় পাচ্ছিলাম।”

আমি তোকে চিনি অনামিকা। মিথ্যা বলার সময় তোর গলার সর কাঁপতে থাকে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর অভ্যাস তোর মিথ্যা বলার সময়। কিন্তু আমি সত্যিটা জানতে চাইছি।

অনু চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক করতে লাগলো, “আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছু না?”

তুই কী করে জানলি আমি কী ভাবছি?

এই যে আপনি ভাবছেন আমি মিথ্যা বলেছি সেটাই বুঝিয়েছি আমি। আমি মিথ্যা কিছু বলছি না। এত মানুষের সামনে আনইজি লাগছিল। সবার হয়তো খাওয়া হয়েছে। আমাদের যেতে হবে এখন।

অনু ফারহানকে পাশ কাটিয়ে একটু এগুতেই ফারহান বললো, “তুই কী আমাকে ভালোবাসিস অনামিকা?”

অনুর মনে হলো পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। সে পরে যাবে এখনই। কানে বাজছে ফারহানের বলা শব্দগুলো। ফারহান কী তবে বুঝে গেছে অনুর অনুভূতি? কিন্তু অনু তো এখন আর সেটা চায় না। অনু নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছে। ফারহান তার জন্য নয় সেটা নিজের মনকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। আর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে, এখন আর কিছুই করার নেই। এখন সত্যিটা সামনে এলে সমস্যা বাড়বে ছাড়া কমবে না। দু’টো পরিবারের মধ্যে ভাঙন ধরতে সময় লাগবে না। আর লিজা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। অনু তো বুঝতে পারছে চোখের সামনে নিজের পছন্দের মানুষকে, নিজেরই বোনের সাথে দেখার, সে কী নিদারুণ কষ্ট। অনুর তো সব কেবল স্বপ্ন ছিলো কিন্তু লিজার সামনে যদি সবটা বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েও হারিয়ে যায় মেয়েটা সামলাতে পারবে না। নাহ অনু নিজের সুখের জন্য দু’টো পরিবার, দু’টো পরিবারের এতগুলো মানুষ, এতগুলো সম্পর্ক এলোমেলো করতে পারবে না, কখনো না।

কী হলো কথা বলছিস না কেনো অনামিকা? আমি তোকে খুব সহজ একটা প্রশ্ন করেছি।

অনুর ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে মনে মনে বললো, “আপনি যদি বুঝতে পারতেন পৃথিবীর সবচাইতে জটিল প্রশ্নটাই এই মুহুর্তে আপনি আমাকে করেছেন। কিন্তু সেটা বুঝার ক্ষমতা তো আপনার নেই।”

অনু চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ফারহানের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, “আপনার মাথা ঠিক আছে ভাইয়া? রাত পোহালে লিজার সাথে আপনার বিয়ে আর আপনি আমাকে বলছেন আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা? প্লিজ ভাইয়া এসব কিছু বলবেন না, কেউ শুনতে পেলে অনেক বড় ঝামেলা হয়ে যাবে।”

ফারহান খেয়াল করলো অনু তার চোখে চোখ রাখছে না। কেমন দৃষ্টি লুকাতে চাইছে। কথায় আছে মানুষ মুখে মিথ্যা বললেও চোখ মিথ্যা বলতে পারে না।

আমি এসব কিছু শুনতে চাইনি। তুই আমার চোখে চোখ রেখে হ্যা বা না বলে উত্তর দিবি।

অনু এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো, “আমাকে যেতে হবে।”

অনামিকা তুই আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিলে, তোকে এখান থেকে একটা পাও নড়তে দিবো না আমি। আমার সম্পর্কে তোর ভালো করেই জানা আছে।

অনুর রাগ উঠে গেলো এবার। চোখে চোখ রাখলো ফারহানের, “কীসের উত্তর চাইছেন আপনি আমার কাছে বলুন?”

তুই কী আমাকে ভালোবাসিস?

অনু হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে শক্ত গলায় বললো, “না।”

ফারহান নির্বাক তাকিয়ে রইলো অনুর দিকে। সে মনে হয় অনুর থেকে অন্য উত্তর আশা করেছিলো নিজের অজান্তেই।

আপনার উত্তর আপনি পেয়ে গেছেন এবার আমি আসছি। দয়া করে এসব উদ্ভট কথা আর বলবেন না। আপনার কাছে আমি কেবল আপনার মামাতো বোন হলেও আমার কাছে এখন আপনার আরো একটা পরিচয় আছে। আমার ছোট বোনের হবু স্বামী। তাই সম্মানের জায়গাটা বজায় রাখবেন আশা করি।

অনু আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না ফারহানের সামনে। কেন জানি অনুর শক্ত কথাগুলো নিতে পারছে না ফারহান। জ্বলছে বুকের ভেতরটা, খুব জ্বলছে। বাড়িতে একান্ত সময় কাটানোর মতো নিরিবিলি জায়গা নেই। পকেট হাতড়ে গাড়ির চাবি খুঁজতে লাগলো। না পেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো চাবি আনতে। যাওয়ার সময় তামান্না আর অনু সামনে পড়লো।

তামান্না বলছে, “হ্যা গো ননদিনী এবার তুমিও বিয়েটা করে নাও।”

অনু আঁড়চোখে ফারহানকে দেখে মুচকি হেসে বললো, “হ্যাঁ ভাবি এই পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই ভাবছি বিয়ে করে নিবো। ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আমি আর বাদ থেকে কী করবো?”

ফারহান আর শুনতে পারলো না, হনহনিয়ে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। চাবি নিয়ে বেরিয়ে এলো একটু পর।

যাওয়ার সময় তামান্নাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ভাবি আমার একটা কাজ পরে গেছে। এখনই যেতে হবে। তুমি মাকে ম্যানেজ করে নিও। মা জানলে যেতে দিবে না।”

তামান্না অবাক হয়ে বললো, “আজকের দিনে কীসের কাজ? তুমি তো ছুটিতে আছো?”

একটা সমস্যা হয়েছে, অফিস থেকে কল দিয়েছিল।

কিন্তু।

তামান্না আর কিছু বলার আগেই ফারহান লম্বা কদমে বের হয়ে গেলো। তামান্না আর অনু কেবল তাকিয়ে রইলো ফারহানের যাওয়ার দিকে।

১৫.
অনু গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। আজকের ফারহানের সাথে আগের ফারহানের মিল পাচ্ছে না৷ বুঝতে পারছে না আজকে ফারহানের এমন অদ্ভুত আচরণ করার কারণ। অনু ভাবছে সে হয়তো নিজের অজান্তে এমন কোন আচরণ করেছে যার জন্য ফারহানের সন্দেহ হয়েছে তার উপর। কিন্তু অনু যখন ফারহানের মুখের উপর না করে দিলো তখন ফারহানের রিয়াকশন স্বাভাবিক ছিলো না।

অনু ভাবছে, “আচ্ছা ফারহান ভাইয়াও কী আমাকে ভালোবাসে?”

পরক্ষণে নিজের মাথায় থাপ্পড় মেরে বললো, “এসব আমি কী ভাবছি? সেই স্কুল লাইফ থেকে নাকি ফারহান ভাইয়া লাভ লেটার পেত। সেটা নিয়ে আহির ভাইয়া আর মাহির ভাইয়া কী মজাই না নিতো? তবু কোনোদিন কাউকে একসেপ্ট করেনি ফারহান ভাইয়া। আহির আর মাহির ভাইয়ার গার্লফেন্ড থাকলেও তার কোনদিন গার্লফ্রেন্ড ছিলো না। সেটা আহির ভাইয়াই বলতো সবসময়। এতো সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে রেখে আমাকে কেনো ভালোবাসতে যাবে? অনু তোর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।”

অনু নিজের ফোন বের করে আজকে হলুদের ছবি দেখতে লাগলো। সাদা পাঞ্জাবিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল ফারহানকে আজ। একদম রুপকথার রাজপুত্র আর তার রাজকন্যা লিজা চৌধুরী। অনামিকা চৌধুরী নয়, কখনো নয়। লিজাকেও কী আজ কম সুন্দর লাগছিল নাকি?

অনু বিড়বিড় করে গেয়ে উঠলো,

“যার লাগিয়া খোদা তুমি দাও নাই আমার জান
তার লাগিয়া কান্দে কেন আমার মনও প্রাণ
যার লাগিয়া খোদা তুমি দাও নাই আমার জান
তার লাগিয়া কান্দে কেন আমার মনও প্রাণ
রাত জাগিয়া চান্দের দিকে হাত বাড়াইয়া চাই
খোদা কেন আমার লাগি তোরে বানায় নাই
খোদা কেন আমার লাগি তোরে বানায় নাই”

অনু হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলো। চোখের কোণে পানি আর ঠোঁটের কোণে হাসি অদ্ভুত লাগছে দেখতে।

ফারহানের ছবি জুম করে দেখছে লিজা। যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। এত সুদর্শন ছেলেটা রাত পোহালে তার বর হবে। ভাবতেই অজানা শিহরণে শরীর কেঁপে উঠছে। সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে বুকের ভেতর। ফোনটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো লিজা৷ আজ আর তার ঘুম হবে বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে তানিশার সব বিরক্ত লাগছে। কিছুদিন আগেও যার জন্য মরতে গিয়েছিল আজ তার নাম শুনতেও বিরক্ত লাগছে। বিয়েতেও থাকতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। এদিকে তার মা একবার বোনের বাড়ি আর একবার ভাইয়ের বাড়ি যাচ্ছে আনন্দে নেচে-কুঁদে। তানিশার ইচ্ছে করছে নিজের বাড়ি গিয়ে শান্তিতে ঘুম দিতে। হয়তো মোহ কাটতে শুরু করেছে একটু একটু করে।

নির্জন রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে গাড়ির সামনের দিকে বসে সামনের গ্লাসের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে আছে ফারহান। দৃষ্টি আকাশের ঝলমলে তারার দিকে স্থির হলেও মনটা অশান্ত, অস্থির। ইচ্ছে করছে যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকে চলে যেতে। এই অসহ্য যন্ত্রণা তার ভালো লাগছে না। এখন সবটা হাতের বাইরে চলে গেছে কিছু করতেও পারবে না। সে হয়তো কখনো ভেবেই দেখেনি অনুর জীবনেও কেউ আসবে। অনু তো সারাজীবন এভাবেই থাকবে না। কিন্তু ফারহান তো অনুর পাশে কাউকে কল্পনাই করতে পারছে না। অনুও তো বললো সেও বিয়ে করে নিবে এবার।

এদিকে ইরফান একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে ফারহানকে কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই। চিন্তায় সবার মুখ শুকিয়ে গেছে।

সেলিনা রেগে বললো, “তোমার সামনে দিয়ে গেলো একবার আমাকে ডাকলে না কেনো?”

তামান্না হতাশ গলায় বললো, “মা ফারহান আমাকে কথা বলার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি।”

সেই কখন বেরিয়েছে। তুমি এখন কেনো বলছো, তখনই বললো না কেন?

আসলে মা, আমি ভেবেছিলাম চলে আসবে। আপনাদের বললে শুধু শুধু চিন্তা করবেন।

অপয়া মেয়ে কোথাকার? এই মেয়ে যেদিন থেকে এসেছে, আমার সংসারে ভালো কিছু হলো না।

এবার মুখ খুললো ইরফান, “মা ফারহানের ভুলের জন্য তুমি তামান্নাকে কেনো কথা শোনাচ্ছ?”

ইরফান তুই বউয়ের হয়ে আমার মুখে মুখে কথা বলছিস?

আমি তোমার মুখে মুখে কথা বলছি না মা। শুধু ঠিক ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

সেলিনা ন্যাকা কান্না কেঁদে বললো, “আমি জানতাম এমনই হবে একদিন। বউয়ের আঁচল ধরে আমার সাথে তর্ক করবি। এজন্যই এই মেয়েকে আমি বউ করে আনতে চাইনি।”

মা আমি বউয়ের আঁচল ধরে তোমার সাথে তর্ক করছি না। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বুঝানোর চেষ্টা করছি। এই কাজটা যদি আগে থেকে করতাম তাহলে আজ আমার আর তামান্নার সম্পর্কটা এভাবে নষ্ট হতো না। বাড়িতে যা কিছু হোক তার জন্য তুমি সবসময় তামান্নাকে দ্বায়ী করে এসেছো আর আমিও কিছু বলিনি। তার জন্য আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে আর আজ আমাদের সম্পর্কের এমন অবনতি দেখে ফারহান নিজের ভালোবাসা রেখে অন্য একজনকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে। এখন হয়তো নিজের সাথে আর পেরে উঠছে না তাই বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে, একটু শান্তির জন্য।

ইরফানের কথা শুনে সবাই অবাকের চরম পর্যায় পৌঁছে গেছে। কেউ যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না ইরফানের কথা।

সেলিনা বললো, “নিজের ভালোবাসা রেখে মানে? ফারহান কাকে ভালোবাসে? এসব কী বলছিস তুই?”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here