এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -০১+২

“অপূর্ব ভাই, বরপক্ষের কান ফোঁড়ানো ছেলেটা আমার ময়না পাখির গলা চে/পে মে/রে ফেলেছে। এখন আমি সারাদিন কার সাথে কথা বলব?”
টেবিলের উপর রাখা ময়না পাখিটাকে ইঙ্গিত করে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম শব্দগুলো। পরক্ষণে ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। অপূর্ব ভাই সবে দরজা ভিরিয়ে শার্ট খোলার উদ্বেগ নিয়েছে। উপরের দু’টো বোতাম খুলেছে। আমার কণ্ঠস্বর শোনা গেল বলে মনে হলোনা, প্রতিক্রিয়া নেই। তবে আচমকা আমায় দেখে বেশ বিস্মিত। ভেরানো দরজার ছিটকিনি তুলে দিল দ্রুত। পুনরায় বোতাম লাগাতে লাগাতে এগিয়ে এলো নিকটে। পাশে বসে থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “তুই বদ্ধ ঘরে কী করছিলি?”

অতঃপর পুনরায় দরজা ও আমার দিকে তাকালেন। অশ্রু মিশ্রিত চোখে ঝাপসা দেখলাম তাকে। বাঁধ ভাঙা গলায় বললাম, “মামুনি আমাকে আটকে রেখেছে অপূর্ব ভাই। ঐ পাজি ছেলেটা আমার ময়নাকে গলা চে/পে মে/রে ফেলেছে। দেখুন।” অগোছালো শাড়িটা উঁচু করে টেবিল থেকে ময়না পাখি হাতে নিলাম। হাত থেকে ময়না পাখি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “তুই তাঁর কী ক্ষতি করেছিলে যে, তিনি এই কাজ করেছেন?”

শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ নাক মুছতে মুছতে বললাম, “আমি কিছু করেনি বিশ্বাস করুন। ময়না পাখিটা উড়ে হঠাৎ তাঁর কাঁধে গিয়ে বসল। তিনি রেগে ময়নাটাকে ধরে দুহাতে গলা চে/পে ধরলেন। আমি কত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি ছাড়লেন না অপূর্ব ভাই। উল্টো ধাক্কা দিয়ে আমার হাঁটু ছিলে ফেলেছে।”

“বড়োরা কেউ ছিলনা? তাদের বলতি?” অপূর্ব ভাইয়ের ভ্রু কুঁচকানো কথায় ঠোঁট উল্টে বললাম, “বলেছি তো মামুনিকে, তিনি আমাকে ধমকে আপনার ঘরে আটকে রেখেছেন।”

অপূর্ব ভাই ময়না পাখির পেটে তর্জনী চেপে রাখলেন। অতঃপর অপ্রস্তুত গলায় বলেন, “মনে হয় বেঁচে আছে, তুই একটু পানি নিয়ে আয়।”

দ্রুতি পায়ে অগ্ৰসর হলাম ডাইনিং-এ। মাঝপথে অপূর্ব ভাইয়ের ডাকে থেমে গেলাম, “ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস আরু। ওয়াশরুম থেকে নিয়ে আয়।”

আমি ওয়াশরুমে গেলাম। শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ঘরে এলাম। অপূর্ব ভাই আঁচল নিগরে পাখির শরীরে দিলেন। পেটে আলতো চাপতে শুরু করেন। তার মেডিসিন বক্স থেকে ইনজেকশন বের করে পুশ করলেন ময়নার দেহে। অতঃপর উঁচু স্থানে পাখিকে রেখে বললেন, “কাঁদিস না, তোকে আমি আরও একটা পাখি কিনে দিবো।”
মলম বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “হাঁটুতে লাগিয়ে নে। সেরে যাবে।” কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলাম মলম। শাড়িটা একটু উঁচু করে ব্যথার্ত স্থানে লাগাতেই জ্বলে উঠল। মৃদু আর্তনাদ করলাম। হাত নেড়ে জানালাম, “লাগাব না।”

“শাড়িটা উঁচু কর, আমি সাহায্য করছি।” বলেই মেঝেতে বসলেন। তাকে বাঁধা দিয়ে টানটান করে স্বযত্নে নিজেই মলম লাগালাম।
এবার অপূর্ব ভাইকে ঝাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম, “জানেন, ময়না পাখিটা তিনটা ডিম দিয়েছিল। এবার ডিমগুলোর কী হবে? বাচ্চা ফুটবে না।”

“ছেলেটাকে দেখাবি চল।” দৃঢ় করে হাত ধরে অগ্ৰসর হলেন।
আমি আরশি। সকলে আরু বলে ডাকে। আজ আমার খালাতো বোন তিস্তা আপুকে দেখতে পাত্রপক্ষ এসেছে। কয়েকদিন পর তার বিয়ে। অপূর্ব আমার মামাতো ভাই, সাইকোলজিস্ট। আলাদা কিছু ক্ষমতার জন্য দেশে তার প্রচুর নামডাক। মন পড়তে তার ঝুরি মেলা ভার। মনের ডাক্তার হিসেবে তিনি পরিচিত। পাত্রপক্ষ সবে এসেছে। শাড়িটা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমার পোষা কথা বলা ময়না পাখিটা আমাকে ডেকে বলে, “আরু সুন্দরী।”

আমি হাসি দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলাম ময়নাকে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পাত্রপক্ষের কান ফোঁড়ানো একটি ছেলে। নাম জানা হয়নি। ভিড়ের কারনে আমার চুলগুলো আটকে যায় তার শার্টের। এগিয়ে যাওয়ার সময় টান পড়ল চুলে। জোরে টান দিতেই বোতাম খুলে এলো চুলের সাথে। ছেলেটা ধমক দিল, “অসভ্য মেয়ে, দেখেছ আমার শার্টের কি অবস্থা করেছ? ইচ্ছে করছে ঠাস ঠাস দু’গালে লাগিয়ে দেয়।”

চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বললাম, “স্যরি, আমি দেখিনি।”

“চোখ আকাশে রেখে হাঁটছ যে, দেখোনি?” প্রত্যুত্তর না দিয়ে হাঁটা দিলাম সামনে দিকে। ময়না উড়ে ছেলেটিকে কাঁধে বসল তৎক্ষণাৎ। তিনি প্রচণ্ড ক্ষোভে ময়নাকে দুহাতে ধরে গলা চে/পে ধরলেন। ‘আরু’ বলে দু’বার ডেকে থেমে গেল ময়না। পেছন ফিরে ময়নাকে নিচে পড়া অবস্থায় পেলাম। সাড়া দিল না। কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল। ময়নাকে জড়িয়ে নিয়ে উচ্চস্বরে বললাম, “আপনি আমার ময়নাকে মা/রলেন কেন?”

ছেলেটি দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বলে, “তোর ময়না তো, তাই মে/রেছি। যা ফোট।”
ধাক্কা দিল বাহুতে। ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম নিচে। মামুনির কাছে ছুটে গেলাম। অভিযোগ জানালাম। তিনি এলেন সাথে। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে বাক্যটি করলেন না। উল্টো পাশের ঘরে বন্দি করে রাখলেন।

বসার ঘরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম, “ঐ ছেলেটা।”
অপূর্ব ভাই হাত ছেড়ে ছেলেটির দিকে হাত বাড়ালেন। হাতে হাতে হ্যান্ডশেক করলেন। মিথ্যা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, “পিয়াস, আরু তোমার নামে কি-সব বলছে। তা কি সত্যি?”

“ভাই বাচ্চা মানুষ বলে ফেলেছে। আমাকে কি আপনার উমম্যাচিউড মনে হয়? মনে হয়, নিজে মে/রে আমার নাম দিচ্ছে।”

সৌজন্য হাস দিয়ে বলে, “মানুষের আচার আচরণ দেখে ৫০% আমি ধারণা করতে পারি। তাই কে কী করতে পারে তার কিছুটা ধারণা আমি করতে পারি।”

অপূর্ব ভাই তাদের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে গেলেন। অদূর থেকে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছি সবকিছু। দুজনকেই উচিত শিক্ষা দিবো আমি। ধীরে ধীরে সরে এলাম দূরে। ধাক্কা লাগল শেফালীর সাথে। সন্দিহান গলায় বললাম, “কড়াই গাছের আঠালো কষ এখনো আছে শেফু?”

“হম আছে, বাবা আমাকে ফেলতে বলেছিল। ভুলে গেছি। কেন?” প্রত্যুত্তর না করে আঁচল কোমরে গুঁজে বের হলে এলাম। আঠালো কষ বালতিতে রাখলাম। শীতের রাত ঠান্ডায় অবিলম্বে জমে যায়। গুটি গুটি পায়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।‌ অপেক্ষায় রইলাম পাত্রপক্ষ বের হওয়ার। পিয়াস নায়ক ছেলেটা সবার পরে বের হলো। নিকটে অপূর্ব ভাই দাঁড়ানো। মামারাও দাঁড়িতে আছেন তাদের বিদায় দিতে‌। উপর থেকে আঠালো কষ ফেলে বালতি রেখেই ছুটে গেলাম ঘরে। শীতের ব্যথা অনুভব বেশি হলেও তোয়াক্কা করলাম না। ঘরে গিয়ে চুপচাপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। তুর বই পড়ছে। আমাকে দেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। বলে, “ভাই তোকে সেই কখন পাঠিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

মন খা/রা/প করে পাখির খাঁচার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম, “পিয়াস ছেলেটাকে হেব্বি দিয়ে এসেছি। অহংকারে মাটিতে পড়ছে না, দিয়েছি চুলগুলো শেষ করবে। পরের বার আসলে টাক নিয়ে আসবে। হি !হি! হি!”

“কী করেছিস?” দরজা দিয়ে প্রবেশ করল শেফালী। থমথমে তার গলা। পরক্ষণে সেই বলে, “পাত্রের ভাইয়ের গায়ে উপর থেকে কে জানো কষ ছুড়েছে। ছেলেটা চোখ মেলতে পারছে না। বেশ হয়েছে। ময়নাকে মা/রা, বুঝ কেমন লাগে।”

তুর আমার দিকে তাকাল। টেবিল ছেড়ে দরজার কাছে এলো। ভিরিয়ে দিয়ে বলে, “তারমানে তুই এটা করেছিস? বুদ্ধি হবে না তোর?”

দুহাতের আঙুলগুলো ভাঁজ করতেই শব্দ হলো বেশ। ফুঁ দিয়ে ছোটো ছোটো চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বললাম, “এগুলোকে বলে বুদ্ধি। এই বাড়িতে একমাত্র আমারই বিশটা আঙুলে ত্রিশটা ফুটে।”

দুহাত গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তুর বলে, “হাতে আঠা দেখছি না, ফেললি কীভাবে?”

“বালতিতে করে।”

দুহাত বুকে গুজে বলে, “তা বালতি কোথায়?”

“ছাদে, এইরে গেছে। ছাদে রেখে এসেছি।”

“তোর আঙুল ফুটেও লাভ হলো না। আসলে যাদের বুদ্ধি নেই, এইসব নিয়ে তারাই শান্ত থাকে।”
বলেই তুর পড়তে বসল। দরজায় করাঘাত পড়ল। ওপাশ থেকে অনবরত বলছে, “দরজা খোল দ্রুত।”

“বলছি, আমি ঘরে নেই।”
দ্রুত বিছানায় উঠে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শেফালী দরজা খুলতেই হুরমুড়িয়ে অপূর্ব ভাই ঢুকলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “গরু কই?”

“তোমার গরু কাঁথার ভিতরে।”

কাঁথা থেকে মাথা বের করে নিভু নিভু চোখে দেখলাম। হাউসী দিয়ে বললাম, “আপনি আমাকে মোটেও গরু বলবেন না।‌ আমি আরু।”

অপূর্ব ভাই এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, “কী করছিলি তুই?”

“ঘুমাচ্ছিলাম, আপনি এসে ডেকে তুললেন?”

“কোথায় ডাকলাম।”

এই যা। আমতা আমতা করে বললাম, “আমার নামে কেউ নিন্দা করলে আমি বুঝে যাই। আপনার বোন বলে কথা।” অপূর্ব ভাই চুপটি করে রইলেন। বলতে আসার কথাটা হয়তো ভুলে গেছেন। থমথমে গলায় বলেন, “বই কোথায় তোর? পড়তে বসিস নি কেন?”

বত্রিশ পাটি মেলে দিয়ে বললাম, “তিন বিষয়ে ফেল করেছি। স্যার দশম শ্রেণিতে উঠাবে না। কে আবার নবম শ্রেণিতে পড়ে? তাই আর স্কুলে যাবো না। ভালো করেছি না? হি! হি! হি!”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২

‘ফেল করলে বিয়ে দিবে, এজন্যই ফেল করি। শীতে জামাই ছাড়া থাকা যায়?’
অপূর্ব ভাই বাচ্চাদের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করলেন। পরক্ষণেই চ্যাঁচিয়ে বললেন, “মহান কাজ করেছেন আপনি। পুরস্কার হিসেবে ইচ্ছে করছে ধরে পি/টা/ই। তোর নাম কাজেই গরু। গরুর গোবর থাকে গরুর মূত্রনালীতে আর তোর মাথায়। এই গোবর সবচেয়ে নিম্নমানের। গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়, গোবর সার হিসেবে ব্যবহার করলে ফসল উৎপাদন হয় ভালো। মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, মাটিতে চুলায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তোর মাথার গোবরে মাছি ভনভন করে। কোনো কাজের না।”

কাঁচুমাচু মুখ করে নখ খুঁটতে লাগলাম। অপূর্ব ভাই আঙুল তুলে বললেন, “কথায় কথায় ছাপ্পান্ন পাটির দাঁত রোদে শুকিয়ে দিস। দাঁতের অবস্থা দেখেছিস।”

‘ই’ করার ভঙ্গিতে দাঁত মেলে দিলাম। একত্রিশ পাটির দাঁত আমার। এখনো চারটা বাকি আছে। তিনটাই গজ দাঁত। অপূর্ব ভাই নাক কুঁচকে বললেন, “দাঁত তো চিকচিক করছে, নির্ঘাত টুথপেস্ট ঘসতে ঘসতে শেষ করে ফেলেছিস। বি/শ্রী লাগে দেখতে। দাঁত আর দাঁত। বিয়ে করবে কে তোকে, শুনি? ছাপ্পান্ন পাটির দাঁত আবার ফেলটুসি।”

ভাব নিয়ে বললাম, “আমার জন্য রাজকুমার আসবে। ‘সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে সে থাকে’ – নানিমা বলেছেন।”

অপূর্ব ভাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। শেফালীও যোগ দিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিঃশব্দে উচ্চারণ করলাম, ‘শেফালী, মিষ্টি কুমড়ার ফালি। তোকে মিষ্টি কুমড়ার মতো ফালি ফালি করে কা/ট/ব, অপূর্ব ভাই যাক একবার।’

তুর বলে, “আমাদের সবার জোড়া আছে। আরুরও আছে।”

“দক্ষিণ পাড়ার বিশ বিঘার আম বাগানের মালিক কুদ্দুস তালুকদার আছে না? আমারে আরুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিছে।” অপূর্ব ভাইয়ের কথা থামার পূর্বেই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। তাহলে সারাদিন আম গাছে চড়ে থাকতে পারব। কী মজা! বিচলিত হয়ে বললাম, “সত্যি? সারাদিন আম খাবো।”

অপূর্ব ভাই বিদ্রুপ করে বললেন, “পুরোটা শুনে নে আগে, কুদ্দুস তালুকদারের ছোটো ভাই। রিকশা চালায়। তার সাথে বিয়ে দিবো। সারাদিন রিকশায় চড়ে ঘুরবি‌।”

“না। আমি বিয়ে করব না।” বলে এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম। অপূর্ব ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, “কেন? এতক্ষণ তো দিব্যি নাচছিলি।”

“আমি রাজকুমার বিয়ে করে ঘোড়ায় চড়তে চাই, রিকশায় না।”

“রাজকুমার তো অশিক্ষিত কাউকে বিয়ে করবে না।”

“আমি পড়বো এখন থেকে।” বলতেই অপূর্ব ভাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। বই খাতাগুলো টেবিলে গুছিয়ে রাখলেন। সকাল নয়টা বাজে তৈরি থাকতে বলে বেরিয়ে গেলেন ধপাধপ পায়ে। আমি বের হলাম। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখলাম তিনি ঘুমাচ্ছেন। মা প্যারালাইড হয়েছে আমার তখন চার বছর। মামা বাড়িতেই মানুষ। বাবা নতুন সংসার পেতেছেন। মাকে দেখার জন্য আয়া রেখেছে। নাম তার ফুল। তিনি মায়ের পাশেই ঘুমান। তিস্তা আপুর বিয়ের জন্য ফুলকে বাড়ি পাঠিয়েছেন। আমি মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম।
___
প্লেটে দুটো রুটি। আলু ভাজি দিয়ে আয়েশ করে খাচ্ছি। পরনে আকাশি রঙের ফ্রক। স্কুল ফ্রক টা খুঁজে পাচ্ছিনা। দুমাসের মতো হয়েছে স্কুলে যাই না। কোথায় রেখেছি তা-ও জানি না। নানা নানি এলেন। সকালে পানি দেওয়া পান্তা ভাত খেয়েই তারা প্রশান্তি অনুভব করে। মামুনি ভাতের থালা দিয়ে বলেন, “আম্মা, আব্বা। এই শীতের সকালে পান্তা ভাত না খেলে চলে না। এমনিতেই বয়স হয়েছে‌। কাশতে কাশতে নাজেহাল অবস্থা হলো বলে, গতরাতে পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থিত হলেন না।”

নানি মা পান্তা ভাত নিয়ে লঙ্কা ও পেঁয়াজ দিয়ে খেতে লাগলেন। নানাভাই রঙ চায়ের কাপ হাতে নিলেন। টেবিলের উপর রাখা পেপারটা পড়তে পড়তে বললেন, “মান্দাতার আমল থেকে পান্তা খেয়ে আসছি। না খেলে শান্তি পাই না। কী তাই তো?”
আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘কি তাই তো?’ নানাভাই-এর মুদ্রা দোষ আছে। প্রতিটি কথার শেষ ‘কি তাই তো’ বলার। আমি কপাল গুছিয়ে বললাম, “হ্যাঁ তাই তো! তাই তো! তাই তো! আমি তো মান্দাতার আমলে ছিলাম, তুমি যে অন্যের বাড়ির ডাব চু/রি করে বিক্রি করেছ সেটাও দেখেছি। কি তাই তো?”
শেষ কথাটা নানা ভাইকে ব্যঙ্গ করে বললাম। ছোটো মামুনি মধ্যম আওয়াজে হেসে উঠলেন। নানাভাই চোখ গরম করে তাকালেন। মামারা সবাই উপস্থিত হয়েছে।মাকে হুইলচেয়ারে করে ফুল এনেছে। আমার চার মামা। নানি মায়ের আট সন্তান ছিল। সাতজন ছেলে, একজন মেয়ে। তিনজন মা/রা গেছে ছোটো বেলায়। সাত ভাইয়ের এক বোন বলে নাম পারুল। বাড়ির নাম মিলিয়ে রেখেছেন, ‘সাত ভাই চম্পা।’ মামারা সবাই এক এক করে মায়ের কপালে চুমু খেল। মায়ের অসুস্থতার পর আমাদের বাড়ির সবাই অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। এক বোন হওয়ার সুবাদে মামারা বোনকে নিজেদের কাছে রাখে। নয়নের মণির একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে আমার অবস্থান সবার উপরে।

‘ছোটো বোন পারুলের হাতে রেখে হাত
সাত ভাই চম্পার কে/টে যাক রাত’

সবাই খেতে বসল। আমাকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে ছোটো মামা বললেন, “কি-রে বড়ো ময়নাটা, এত সকালে তোর ঘুম ভাঙল কীভাবে?”

‘ঘুম কী সাদে ভেঙেছে? তোমার আদরের ভাইপো ভাঙিয়েছে।’ মনে মনে আওড়ালাম। পরক্ষণে বললাম, “স্কুলে যাবো মামা। অপূর্ব ভাই নিয়ে যাবেন।”

বড়ো মামিমা মামার প্লেটে রুটি তুলে দিতে দিতে বলেন, “তুই না বললি, আর নাইনে পড়বি না।”

অপূর্ব ভাই ততক্ষণে উপস্থিত হলেন ডাইনিং-এ। শহরে একা থাকেন তিনি। বোনের পাত্র দেখার জন্য পরশুদিন রাতে ট্রেনে করে এসেছে। কাপতে কাপতে বসলেন চেয়ার টেনে। টমেটোর চাটনি প্লেটে নিলেন। গোসল করেছেন। ঠান্ডা একটা হাওয়া আমার শরীরে ধাক্কা লাগল। কাঁপতে কাঁপতে শালটা আরেটু আঁকড়ে ধরে বললাম, “অপূর্ব ভাই আপনি ওপাশে যান, আমার শীত করছে।”

রুটি ছিঁড়ে বলেন, “লাগাব এক চ/ড়। চুপচাপ খেয়ে স্কুলের ফ্রক পর। সপ্তাহে একদিনও তো গোসল করতে দেখি না। মানুষের গোসল দেখলেও তোর এলার্জি। মাঝে মাঝে মনে চায় বিচুটি পাতা ঘসে দেই। সারারাত চুলকাতে চুলকাতে দিঘিতে গিয়ে ডুব দিবি। অন্তত গোসল হবে।
মা, গরুর ডাক শুনলাম। গরু কি গোয়ালে?” তিয়াস ও তিস্তা ভাই বোন। মেঝো মামার ছেলেমেয়ে। তিহাস ভাই খেতে খেতে বলেন, “এই শীতে সকাল-সকাল গরু নামালে ঠান্ডা লাগে‌। সবুজেও ঠান্ডা। কাশতে কাশতে নাজেহাল। তাই বলেছি বেলা করে গরু চড়াতে। খড়কুটো গোয়ালে দিয়েছে।”
সবুজ আমাদের গরু চড়ায়, রাখাল।

শিক্ষক মণ্ডলী কক্ষের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পড়নে গতকালের পোশাক। স্কুলের ফ্রক খুঁজে পাইনি। তা-ও পরনের জামার অর্ধেক ছেঁড়া। ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছি। অপূর্ব ভাই হাতের ইশারায় ডাকলেন কাছে। স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, “অপূর্ব আমাদের স্কুলে চেয়ারম্যানের ছেনে নয় বরং পড়াশোনায় সেরা একজন ছাত্র। তার কথাতেই তোমাকে দশম শ্রেণিতে উঠানো হলো। তবে আমাদের কন্ডিশন আছে, ‘প্রথম সেমিস্টারে সব বিষয়ে পাশ ও টেস্ট পরিক্ষায় ৮০+ মার্ক থাকলেই ফাইনালে এলাউ করা হবে।’ আশা করি চেয়ারম্যান বাড়ির মান ডুবাবে না।”

“যদি এক কম থাকে, তাহলে?” অপূর্ব ভাই চোখ রাঙাতেই থেমে গেলাম।
প্রধান শিক্ষক দত্তরিকে আদেশ দিলেন এক সেট নতুন বই দিতে। কাঁচুমাচু করে হাতে নিলাম। প্রচুর পড়তে হবে‌। হাতে নিতেই নতুন বইয়ের মনমাতানো এক সুবাস নাকে ‌প্রবেশ করল। আমি প্রায় সময় বইয়ের মাতায় নাক ডুবিয়ে রাখি এই সুবাস নিতে। আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করে। অপূর্ব ভাই পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল। দশম শ্রেণির ক্লাসের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। আমি, আরু ও শেফালী একই ক্লাসে। বইগুলো দেখিয়ে পিছুপিছু হাঁটতে লাগলাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here