এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -০৩+৪+৫

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩

“অপূর্ব ভাই, আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি? বাড়ির রাস্তা তো রেখে এসেছি।” বলতে বলতে পা চালালাম। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি ইতোমধ্যে।
আমাদের বড়ো একটা দিঘির আছে। দিঘির চারদিকে বড়ো বড়ো নারিকেল গাছ ও তাল গাছ। তাল আমার প্রিয় ফল। দুই নারিকেল গাছের দূরত্বের মাঝে টমেটো গাছ। অদূরে সারিবদ্ধভাবে কলা বাগান। অপূর্ব ভাই দাঁতের সহায়তায় কলার পাতা ছিঁড়ে আনলেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন, “টমেটো বেশি পেঁকে লেওয়া হয়ে গেছে। যা দ্রুত টমেটো গুলো তুলে নে।”

“অপূর্ব ভাই আমার মনে হয়, কিছু টক বেগুন পঁচে গেছে‌। কেমন বিশ্রী গন্ধ আসছে।” বলতে বলতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কথার সমাপ্তি টেনে আমি দ্রুত হাতে টমেটো সংগ্রহ করতে লাগলাম। দিঘিতে আমাদের রাজা হাঁস, চিনা হাঁস সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ দিঘির পানিতে কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। এজন্যই বলে হাঁসের শীত নেই। অথচ বিড়ালকে জীবনে একবার পানিতে ফেললে মনে হয়, শীতে সে বাঁচবে না।

“অপূর্ব ভাই, সবগুলো টক বেগুন এই বরকে আঁটবে না।” পরক্ষণেই অপূর্ব ভাই দিলেন এক রাম ধমক, “গরু এটা টমেটো, নট টক বেগুন। কলা পাতা, বরক নয়। শুদ্ধ ভাবে উচ্চারণ কর।”

কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “ছিঃ অপূর্ব ভাই, ছিঃ। টক বেগুন আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষা। এই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে আমার ভাই। তার বোন হয়ে আমি ইংরেজি বলতে পারব না।”

অপূর্ব ভাই নাক কুঁচকে বললেন, “তোর ভাই এলো কোথা থেকে? পৃথিবীতে আসার আগেই জীবন দিয়েছে, না-কি তোর সৎ ভাই দিয়েছে? শুনেছি তোর বাবার একটা ছেলে হয়েছে।”

টমেটোগুলো পেঁচিয়ে হাঁটতে লাগলাম। আমার সাধ্যমতো সংগ্রহ করেছি। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “শুনেন, শহীদেরা তো আমার ভাই হয়। আমি কবিতায় পড়েছি, ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা শহীদ ছেলের দান, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা ফেব্রুয়ারির গান।’ কী তাই তো?”

অপূর্ব ভাই হাত থেকে টমেটোগুলো কেড়ে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ! তাই তো! তাই তো!” পরক্ষণেই কোমর দিয়ে স্বজোরে দিল এক ধাক্কা। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম দিঘির জলে। মাটি স্পর্শ করে উপরে ভেসে উঠলাম। শীতে কাঁপতে কাঁপতে পাড়ে আসার প্রচেষ্টা করলাম। পানি এতো ভেজা কেন? পরতেই ভিজিয়ে দিল। বাবারে বাবা, কে এই দিঘিতে বরফ ভিজিয়ে রেখে গেছে? সাঁতরে সাঁতরে সিঁড়িতে গিয়ে উঠলাম। অপূর্ব ভাই ততক্ষণে পৌঁছে গেছে সেখান। পকেট থেকে সাবান বের করে বলেন, “যা, সাবান মেখে টুস করে আরেকটা ডুব দিয়ে আয়। শরীর থেকে মোরগ পঁচা গন্ধ আসছে।”

দ্বিগুন তেজ নিয়ে বললাম, “আপনার শরীর থেকেও আসে। দামী দামী সুগন্ধি মেখে গন্ধ আড়াল করেন।”

“তোর সুগন্ধি নেই, তুই গোসল করবি। যা দ্রুত।”

আমি সাবান মেখে দু সিঁড়ি নেমে কচু পাতার মতো ডুব দিলাম। কচু পাতা যেমন ভিজে না, আমিও ভিজলাম না বোধহয়। উঠে বাড়ি চলে গেলাম। কী শীত! কী শীত! দৌড়ে অপূর্ব ভাইয়ের ওয়াশরুমে। আমাদের বাড়িতে একমাত্র অপূর্ব ভাইয়ের ঘরেই ওয়াশরুম আছে। আর আছে মায়ের ঘরে।

কাঁথার ভেতরে ঢুকে কাঁপছি খকখক করে। টিনের ঘরে শো শো করে বাতাস বইছে। কেঁপে কেঁপে উঠছি। দুপুর পেরিয়ে এসেছে। ঠান্ডায় পেট ভরা। আমাদের স্কুল দশটা থেকে চারটা। তুর ও শেফালী স্কুল থেকে ফিরে গোসল সেরেছে। ছোটো মামার মেয়ে শেফালী। লেফালী তাড়া দিয়ে বলে, “বড়ো চাচি তোকে খুঁজছে, দ্রুত যা। দুপুরে খানসি শুনলাম।”

তেজ দেখিয়ে বললাম, “একদম দরদ দেখাবি না তুই। অপূর্ব ভাই আমাকে জোর করে গোসল করিয়েছে। আমি কিছুতেই তার মায়ের হাতে খাবো না। খাবো না মানে খাবো না।”

দরজা খোলার শব্দ পেলাম। কাঁথার ভেতর থেকে উঁকি দেওয়ার স্পৃহা নেই। কণ্ঠস্বর শ্রবণ হওয়ার দরুন বুঝলাম, বড়ো মামি খাবার নিয়ে হাজির। আদুরে গলায় ডাকলেন, “আরুসোনা কোথায়? খেয়ে নে সোনা পাখি আমার।”

মুখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলাম। কিছুতেই খাবো না। মামি আমাকে সামলাতে লাগলেন‌। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলো তুর। দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তিয়াস ভাই কড়ইগাছে উঠেছে। বড়ো একটা কলাগাছ দিয়ে দোলনা বানাচ্ছে। আমরা ছয় ভাইবোন একসাথে দোলনায় চড়তে পারব। কী মজা। দেখবি আয়।”

আমি কাঁথা থেকে মুখ বের করলাম। কাঁথা না সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছুটলাম সেদিকে। কিন্তু হায়। কাঁথাসহ মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। গতরাতের ক্ষতটা পুনরায় তাজা হয়ে উঠল। মামি এসে ধরলেন আমায়। কাঁচুমাচু করে কাঁথা উঁচু করে ধরে ছুটে গেলাম বাইরে। বাড়ির সামনেই বড়ো কড়ই গাছ। ইয়া-বড়ো একটা কলাগাছ দিয়ে দোলনা করছেন। তিয়াস ভাই গাছে উঠেছে আর অপূর্ব ভাই নিচ থেকে বলছেন কীভাবে করতে হবে। আমি খুশিতে নেচে ফেললাম। অপূর্ব ভাই আমাকে দেখে বিরক্ত হয়েছে বেজায়। সন্দিহান গলায় বলেন, “সমস্যা কী তোর? এখানে কী, ঘরে যা।”

“আমি দোলনায় চড়ব।” আমার কথায় অপূর্ব ভাই জানায়, “দোলনা আমার। তাই আমি যাকে চাইব, তাকেই উঠতে দিবো। যে আমার কথা শুনবে আমি তাকেই উঠতে দিবো।”

‘ছলছল নয়নে হাসিমাখা বদনে’ – অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম, “আমি আপনার সব কথা শুনি। আপনি আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গেছেন, যাই নি? গোসলে সাবান মেখে ডুব দিতে বলেছেন, দেইনি? তাহলে..

উপর থেকে দড়ি ফেললেন তিয়াস ভাই। অপূর্ব ভাই দড়ির সাথে বাঁধলেন কলাগাছ। বললেন, “দুপুরে খেয়েছিস? না খেয়ে দোলনায় উঠলে যদি পড়ে যাস, তার দায় কে নিবে? স্যরি, আমি তোকে উঠতে দিতে পারছি না।”

মামি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। অপূর্ব ভাইকে ধমকে বললেন, “এখনই তোর দোলনা বানাতে হবে? সবে আরুকে খাওয়াতে গেছিলাম।”

অপূর্ব ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন। আমি মামির কাছে গেলাম। কলাগাছের পাতাগুলো মাটিতে রেখে বসার জায়গা করে নিলাম। মামিকে বসিয়ে হা করলাম। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাও। ওরা দোলনায় উঠে যাবে।”

মামি অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মনে মনে ধন্যবাদ জানালেন। আমাকে সবসময় শর্ত দেয়। খেয়ে উঠে বসলাম দোলনায়। তিস্তা আপুর মন অজানা কারণে ভালো নেই। কাল থেকে ঘরে বসে আছে। যদি মন ভালো হতো একসাথে ছয়জনে চড়তাম। এখন আমরা পাঁচজনে একসাথে উঠেছে। ‘ছোপ, ছোপ’ করে দিঘির জলে কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। মাঝখানে বসা আমি কৌতুহল নিয়ে বললাম, “এই সন্ধ্যায় কে গোসল করতে গেল? মনে হয় সে ‘হাঁস বংশের’ বংশধর।”

তিয়াস ভাই বললেন, “মনে হয় তাল পড়েছে।”

অপূর্ব ভাই তাল মিলিয়ে বলেন, “হ্যাঁ। টমেটো তুলতে গিয়েছিলাম, তখন গাছে পাকা তাল দেখেছি।”

“দোলনা থামাও দোলনা থামাও।” বলে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম। থামতেই ছুটে গেলাম সেদিন‌। তালের পিঠা, তালের রস, তালের বিচি সব আমার প্রিয়। কী মজা লাগে। পেছন থেকে শুনতে পেলাম তুর বলছে, “কী একটা ফল পেয়েছে মেয়েটা। তালের জন্য কেউ এমন পা/গ/ল হয়?”

শেফালী বিদ্রুপ করে বলে, “গরু বলে কথা। তবে গরুর চারটা পা। আরুর চারটা পা হলে ঘোড়ার মতো ছুটতো।”

অপূর্ব ভাই চুপ থেকে ছড়ার সুরে বলেন,

‘আরু, আমাদের বোন গরু
গরুর হচ্ছে চারটা পা,
আরুর কেন দুইটা পা?
কেন! কেন!’#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৪

“তিস্তা আপু ফোনে তুমি দুলাভাইয়ের ছবি দেখছ? শুনো বিয়েটা করলে শীতে করে ফেলো। তুমি বলতে না পারলে আমি বলে দিচ্ছি।” কাঁথা মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উপস্থিত হলাম তিস্তা আপুর ঘরে। হাতে চায়ের কাপ। ট্রেতে তিনটা কাপ রয়েছে। শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে সে। আমার কথায় সৌজন্য হাসল। আমিও হাসলাম। চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রাখলাম। উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বলে, শুনলাম অপূর্ব ভাই তোকে জোর করে গোসল করিয়েছে‌। এই পৌষ মাসেই এই অবস্থা, মাঘে কী করবি তুই?”

“মাঘের শীত বাঘের গায়ে। পৌষ আমার কাছে শীত লাগে।”

“তাহলে তো, পৌষের শীত তুষের গায়ে।” আপুর কথাতে আমি পড়লাম ফ্যাসাদে। আপু হেসে বলে, “কাছে আয় পাকা বুড়ি।”

আমি ধপাস করে বসলাম পাশে। ঠোঁট উল্টে বললাম, “এখন কাছে ডাকছ, আসছি। পরে কিন্তু দুলাভাই ছাড়া কাউকে কাছে ডাকবে না। মনে থাকবে?”

“ঠিক আছে।” আপু সাথে শান্ত কণ্ঠে বললেন। আমি পুনরায় বললাম, “তোমার প্রয়াস ভাইকে কেমন লাগে? আমার কিন্তু হেব্বি লাগে। যেন নব্বই দশকের জীবন্ত সালমান শাহ্। কিন্তু তার ভাই পিয়াস, শা/লা শ/য়/তা/নের হাড্ডি। ইচ্ছে করে শেওলা গাছের পে/ত্নির মতো ঘাড় ম/টকে দেই।”

তিস্তা আপু বললেন, “কাল রাতে জব্বর দিয়েছিস, কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে। আমাদের বাড়িতেই ছিল। আজ ভোরে গেছে।”

ফট করে বললাম, “মানে?”

“মানে আবার কী? ঠান্ডায় কাঁপছিল, বাবা চাচারা যেতে দেইনি। সকালে গেছে। পিয়াসের চুল একভাবে টাক। আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবি.. কথাটা অসমাপ্ত রেখেই থেমে গেলেন তিস্তা আপু। চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রইলাম। আপু নিজেকে সামলে বললেন, “আমাদের লজিং মাস্টার আছে না? কিছুদিনের জন্য তিনি বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। আমি তাঁকে ভালোবাসি। তিনিও আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মতো বড়লোক নয় তাঁরা, গরীব ঘরের সন্তান। যদি বাড়ির সবাই রাজি নাহয়, এই ভয়ে কাউকে বলতে পারছি না।”

এজন্যই তিস্তা আপুর মন ভালো নেই। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “মামারা অনেক ভালো, তুমি আগে বলে দেখো আপু।”

“না আরু, আমি পারব না। তাঁরা যদি আমাদের ভালোবাসা অস্বীকার করে আর সুজনকে পড়ানো থেকে ছাড়িয়ে দেয়। তখন? তখন ওর পরিবার না খেয়ে ম/র/বে। ভালোবাসি বলে এতবড় স্বার্থপর হতে পারব না।”

আমি নিচু হয়ে থাকলাম। অপূর্ব ভাইকে জানালে তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন। তিনি তো মনের ডাক্তার। তিনদিন পর শহরে ফিরে যাবেন‌। তার আগেই জানাতে হবে‌। আমি উঠলাম। তিস্তা আপু হাত ধরে বলে, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“অপূর্ব ভাইকে জানাতে।” তিস্তা আপু হাতটা ছেড়ে বললেন, “দিব্যি রইল আরু। প্লীজ বলবি না। যা।”

চায়ের ট্রে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তিস্তা আপুর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। ইঙিয়ে বিঙিয়ে হোক অপূর্ব ভাইকে বোঝাতেই হবে। মায়ের ঘরে গেলাম। মাকে বিছানায় হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে‌। জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে। ফুল নামক মেয়েটা ফোনে কথা বলছে। আমি ঘরে ঢুকে ডাকলাম, “আপনার চা।”

টেবিলের উপর রেখে মায়ের দিকে তাকালাম। বয়সের সময় দেখতে হেব্বি ছিল। কিন্তু এখন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। চায়ের কাপ ঠান্ডা হয়ে গেল বলে। পা বাড়ানোর পূর্বেই ফোন রেখে মেয়েটি আমাকে ডাকল, “আরু, আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো। তুমি কি একটু তোমার মায়ের কাছে থাকবে?”

“হম। আমার মায়ের কাছে আমি থাকব না।” মেয়েটি চলে গেল। আমি মায়ের কাছে গেলাম। মাকে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে রইলাম। আবদার করে বললাম, “মা, আমাকে দুই টাকা দিবে?”

আরু শেফালীকে দেখতাম এভাবে মামিদের কাছে আবদার করতে। মামি মাছ কাট/ত আর ওরা আবদার করত। কখনো হয়তো মায়ের মুখে শুনতে পারব না আরু ডাকটা। কখনো হয়তো মায়ের আঁচলে মুখ মোছা হবে না। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম, “মা তোমার চার ভাই আমাকে আগলে রাখছে। ভাগ্য করে এমন ভাই পেয়েছ।”

ফুল মেয়েটা চলে এসেছে। চায়ের কাপ নিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের ঘরে গেলাম। ফোন দেখে দেখে বিছানায় শুয়ে কাগজে লিখে চলেছেন কিছু। আমাদের বাড়িতে দুই ভাইয়ের স্মাটফোন রয়েছে। মহিলা বা মেয়েরাদের ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। তবে বাড়িতে একটা পুরোনো ল্যান্ডফোন রয়েছে। প্রয়োজনে এটা ব্যবহার করা যায়। চায়ের কাপ সামনে দিয়ে বললাম, “আপনার চা।”

“তুই খেয়েছিস?”

“না, রঙ চা খেলে গায়ের রং কালো হয়ে যায়।” অপূর্ব ভাই একগাল হাসলেন। তার গালে টোল পড়ল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। আড়চোখে আমার পানে চেয়ে টেনে চা শেষ করলেন। আমার ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন হলো। হা করে দেখলাম। দ্রুতি কণ্ঠে বললাম, “আস্তে জিভ পু/ড়ে যাবে।”

ট্রে-তে কাপ রেখে বললেন, “এটা আর চা নেই, দিঘির পানিতে রঙ ও চিনি মেশানো শরবত মনে হচ্ছে।”

ঠিকই তো! এতক্ষণে এমন হওয়ারই কথা। মৃদু স্বরে বললাম, “আরেক কাপ করে আনব?”

আদেশ করে বললেন, “না। বস।”
বলেই সবকিছু গুছিয়ে রাখলেন। দু’দিন পর এই ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। বিষাদময় নিঃশ্বাস নিলাম। অপূর্ব ভাই তার ট্রাভেলিং ব্যাগ বের করলেন। একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। খুলে দেখলাম তিনটা টুথপেস্ট, টুথব্রাশ আর কয়েকটা সাবান। আমার ছোটো করা মুখ দেখে বললেন, “এগুলো তোর জন্য এনেছি। ছাপ্পান্ন পাটির দাঁতগুলো ঘসে ঘসে পরিষ্কার করবি আর সাবান মাখবি। তোর শরীর থেকে ভেড়া ভেড়া গন্ধ আসে।”

সবকিছু ফেলে ছুটে এলাম ঘরে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়লাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমি কী ইচ্ছে করে এই দাঁত উঠিয়েছি না-কি? উঠে গেছে। এই দাঁতের জন্য আমি অনেক অ/পমান সহ্য করেছি আর নয়। এবার এগুলোকে জীবনের মতো শেষ করে দিবো।

বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। ড্রয়ার খুঁজে নাইলন সুতা নিলাম। মাছের জাল বুনতে ব্যবহার করা হয়। ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনটা দাঁত ফেলে দিলাম। প্রথম দাঁতে পেঁচিয়ে টান দিতেই ফিকনি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করল। ব্যথায় চোখে পানি এলো। দাঁত ছিটকে পড়ল নিচে। মাথা ধরে গেল। ক্ষোভের কারণে শরীরকে তোয়াক্কা করলাম না। আরও দু’টো দাঁত ফেলে দিলাম। ব্যথায় নিজেকে সামলাতে কিংবা কথা বলতে পারছি না। মাথায় হাত দিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা অবস হয়ে আসছে ক্রমশ।

রাতে শরীর কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জ্বর এলো। ব্যথায় কাতর শরীর নিয়ে ঘুম এলো অতিদ্রুত। গোঙানির শব্দ পৌঁছে গেল অন্যদের কর্ণপথে। রাতে শেফালী আমাকে ডাকল। জ্বর শরীর নিয়ে নিভু তাকালাম। শেফালী কপালে হাত দিয়ে বলে, “আরু তোর শরীরে প্রচুর জ্বর, কীভাবে এসেছে?”

কথা বলার শক্তি পেলাম না। তুর উঠেছে বিছানা ছেড়ে। শেফালীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুই ওকে দেখ, আমি মাকে ডেকে আনছি।”

শেফালী চাপা রাগ নিয়ে বলে, “এজন্য বলি প্রতিদিন গোসল কর। মাসে একদিন গোসল করিস। এজন্যই জ্বর এসেছে।”
#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

“আরু শরীরে ১০৩° জ্বর বাঁধালি কীভাবে? রাতে তুই দিব্যি সুস্থ ছিলি। হঠাৎ কী এমন হয়েছে যে, কিছু ঘণ্টার ব্যবধানে এমন জ্বর বাঁধিয়েছিস?” বলে অপূর্ব ভাই জ্বর পরীক্ষা করলেন। দাঁতের ব্যথায় উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হলাম বাক্যটি। জবাব না পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে গেলেন তিনি। তিয়াস ভাই-কে আদেশ দিলেন ছোটো করে, “ট্রাভেলিং ব্যাগের ভেতরে ছোটো একটা ব্যাগ আছে। তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।”

তিয়াস ভাই পা বাড়ালেন। মাঝপথে থেমে গেলেন। ‘উফ্’ – মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন। পায়ে হাত দিয়ে বসলেন মেঝেতে। পায়ের পাতায় গেঁথে যাওয়া ছোটো দানার মতো বস্তুটা হাতে নিল। ওদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে শব্দ করেন, “এটা দাঁতের মতো দেখাচ্ছে না?”

“কোথায় দেখি।” তিয়াস ভাই অপূর্ব ভাইয়ের হাতে বস্তুটা দিলেন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “দেখ তো আরও আছে কি-না?”

সবাই একসাথে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠল। তুর বিছানার নিচে রক্তমাখা সুতা পেল। শেফালী পেল জমাটবাঁধা রক্তের হদিশ। তিস্তা খুঁজে পেল আরও দুটো দাঁত। অপূর্ব ভাইয়ের নিকট এগিয়ে দিয়ে বলে তিস্তা, “ভাই এগুলো দাঁতের মতো লাগছে। কাঁচা দাঁত। মনে হচ্ছে কেউ তার শক্তপোক্ত কাঁচা দাঁত সুতা দিয়ে টেনে তুলেছে।”

অপূর্ব ভাই ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন, “আরুর হাত পা চেপে ধর, যাতে একটুও নড়তে না পারে।”
বাক্য শেষ হওয়ার পূর্বেই আমাকে চেপে ধরল সকলে। জ্বর শরীর নিয়ে পেরে উঠলাম না। অপূর্ব ভাই স্পর্শ করলেন ওষ্ঠদ্বয়। মৃদু ফাঁক করে দেখলেন আমার দাঁতগুলো। সামনের দাঁত উধাও দেখে তার সন্দেহ পাকা পোক্ত হলো। গালটা চেপে ধরে রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “দাঁতগুলো ফেলেছিস কেন?”

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম। চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কাঁতরাতে লাগলাম ক্রমাগত। ছেড়ে দিলেন। ব্যাগ থেকে ইনজেকশন সিরিজ বের করলেন। ওষুধ বের করতে করতে বললেন, “পেছনে ঘুরে শুয়ে পড়। আজ তোর পেছনে গরুর ইনজেকশন দিবো। মানুষের চেয়ে তিন লাইন বেশি বুঝিস তুই। গরুকে গরুর ইনজেকশনে মানায়।”

লাফ দিয়ে মামির কোলে উঠে গেলাম। ঝাপ্টে ধরে বললাম, “আমি গরুর ইনজেকশন দিবো না মামি। ওটা দিলে আমার পিছন শেষ হয়ে যাবে।”

শেফালী বিদ্রুপ করে বলে, “পাঁচ আটা চল্লিশ। (৫×৮=৪০)”

আমি রাগান্বিত দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। তেজ দেখিয়ে বললাম, “তোরটা চল্লিশ।”

অপূর্ব ভাই নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “ওয়াক, থু, থু। এগুলো কোন দেশের ভাষা আরু? বাংলা নয়।”

কাঁচুমাচু মুখ করে ঠোঁট উঁচিয়ে বললাম, “আমি কিন্তু গরুর ইনজেকশন দিবো না।”

মামি আমার কান্না সহ্য করতে পারলেন না। বেলা তখন নয়টা বাজে। অপূর্ব ভাইকে নির্দেশ দিলেন তৈরি হতে। আমাকে নিয়ে সদরে জেতে ডাক্তার দেখাতে। মামুনি ধরে ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। মগে পানি নিয়ে ছাই দিয়ে দাঁত মেজে পরিষ্কার করলাম। মেজো চাচি মাটির চুলায় লাকড়ি দিচ্ছেন আগুন ধরাতে। ছোটো চাচি শিলপাটায় চাল পিষে এনেছেন। মেজো চাচির কাছে দিয়ে বলে, “ভাবী আমি ক্ষেত থেকে টাটকা কইল শাক তুলে আনি। খেতে বেশ লাগবে। তুমি গোলায় এক চিমটি হলুদ দিও, ঠান্ডা দূর হবে।”

চলে গেলেন ক্ষেত থেকে কলই শাক তুলতে। মুখ ধুয়ে বসলাম মাটির চুলার কাছে। শীত শীত লাগছে। গরম গরম খেতে ও তাপ পোহাতে সবাই চুলার কাছাকাছি বসেছে। আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম, “মামি তোমার সাথে আমিও যাই।”

“চুপ.. এখানে বসে থাক। কুয়াশা পড়ছে, গেলেই ঠান্ডা লাগবে। আরেকটু বেলা হলে অপুর সাথে সোজা ফার্মেসিতে যাবি।”

মামি চলে গেলেন। তাল দিয়ে চাপটি খেতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পর মামি হাজির হলেন আমার স্কুল ফ্রক ও জুতা নিয়ে। গ্রামীণ শাড়ির আঁচলে কলই শাক। মাটিতে বসে বলে, “এগুলো তোর না-কি দেখ তো।”

আমি এপাশ ওপাশ করে বললাম, “হ্যাঁ, মামি। দুইটাই আমার। কোথায় পেলে তুমি, ঘর খুঁজে ফাতাফাতা করছি। পাইনি।”

খুঁজতে খুঁজতে ছেঁড়া পেলাম দু জায়গায়। যেন দাঁত দিয়ে কে/টে/ছে‌। মামি কলই শাক কুচি করতে বসলেন। বললেন, “কইল ক্ষেতে ইঁদুরের ধুলের ভেতরে। ইঁদুরেই এই কাজ করেছে। জামা কাপড় যেখানে সেখানে ফেলে রাখিস।”

ফ্রক রেখে জুতা হাতে নিলাম। তলা কেটে ফেলেছে। গালে হাত দিয়ে গান ধরলাম, “আমার জামা কাইট্টা করলি কী? জুতা কাইট্টা করলি কী? ওরে আমার ওন্দুর বাবা ঝিঁ..
আমি হাইকোর্টেতে বিচার দিমু, হাইকোর্টেতে বিচার দিমু, সাক্ষী রাখমু টিকটিকি। ওরে আমার ওন্দুর বাবা ঝিঁ।”

অপূর্ব ভাই ব্রাশ করে বসলেন টুল টেনে। চাপটি পেঁচিয়ে খেতে খেতে বলেন, “ওন্দুর বানান টা কী, জানিস?”

“অবশ্যই, ইঁ-দু-র = ওন্দুর।”

অপূর্ব ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কোন গ্ৰুপে পড়িস তুই?”

“বিজ্ঞান গ্ৰুপ।”

“তুই যদি ক্লাস নাইনে পড়তি, তাইলে এক্ষুনি গ্ৰুপ চেঞ্জ করতাম। কী দেখে বিজ্ঞান শাখা নিলি?”

“মামা বলেছে তোমার মতো ডাক্তার হতে।”

“আচ্ছা। না পড়েই আমার মতো বড়ো ডাক্তার আর হাতির পাঁচ পা দেখা সমান।”

__

গ্ৰামীণ হাটবাজার। এক কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। অপূর্ব ভাই গেলেন বাজার করতে। একদল যুবক দেখে রীতিমতো ভীত হলাম আমি। হাতে ক্রিকেট ব্যাট বল। ওড়না টেনে ঝোপঝাড়ের আড়ালে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে শিষ দিল। অন্যজন হেসে বলে, “দেখেছিস মেয়েটাকে? ঝাক্কাস কিন্তু।”

পাশে অন্য একটি ছেলে‌। বয়স কম নয়, আমার চেনা। তবে আমাকে চেনে কি-না, জানা নেই। গতবার হওয়া চেয়ারম্যানের ছেলে। আমাদের শ/ত্রু পক্ষ। আমাদের এলাকায় ক্ষমতাসীন দুই দল রয়েছে। এক দলে আমাদের আহসান বাড়ি, অন্যপক্ষে মৃধা বাড়ি। ছেলেটি কিছুক্ষণ অনুভূতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, “নাম কী তোমার?”

ভীত হয়ে প্রত্যুত্তর করলাম না। ততক্ষণে অপূর্ব ভাই ফিরে এসেছেন বাজার সমেত। থমথমে গলায় বলেন, “এখানে এতো ভিড় কীসের? যাও..

ছেলেটিকে দেখে খানিকটা সময় থমকে গেলেন। আমার হাতটা মুঠো করে ধরে মৃদু স্বরে বললেন, “আরু চল।”

অবাক করে ছেলেটি বলে, “ও আমাদের সেই আ..

অপূর্ব ভাই ফট করে বললেন, “ও তোমাদের কেউ না। ও আমাদের বাড়ির মেয়ে, আমাদের বোন।”

ভ্যানগাড়ি থামল বড়ো রাস্তার মোড়ে। শহর থেকে ফিরেছি। ইনজেকশন পুশ করার দরুন জ্বর কমেছে। অপূর্ব ভাই পাশাপাশি হাঁটছে আমার। হাতে ওষুধপথ্য। গায়ের শাল জড়িয়ে বললাম, “অপূর্ব ভাই, চুলের তেল ফুরিয়ে গেছে। কিছুটা তেল নিতে হবে।”

অপূর্ব ভাই পাশের মোদি দোকানে গেলেন। দোকানদার চাচার কাছে তেল চাইলেন। গ্ৰামে বোতলজাত করা তেল নেই, খোলা তেল। অপূর্ব ভাই চিন্তাগ্রস্থ হয়ে বললেন, “তোদের জন্য বোতলজাত ‘প্যারাসুট নারিকেল’ তেল কিনেছিলাম। ভুলে ঢাকাতে রেখে এসেছি। কাউকে পেলে পাঠিয়ে দিবো।
তুই কি এখন এই তেল নিবি, না-কি কালকে সদর থেকে এনে দিবো?”

“ছোটো থেকে খোলা তেল ব্যবহার করে আসছি। আপনি এটাই আধ কেজি নিয়ে নিন।” অপূর্ব ভাই আধ কেজি তেল নিলেন। তেলে কোনোক্রমে কেক পরেছে। কেকের গন্ধ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে খেয়ে নেই।
পথ ধরলাম বাড়ির। মাটির রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় খেজুর গাছের সামনে দাঁড়ালেন অপূর্ব ভাই। খেজুরের রস নামাচ্ছে চাষিরা। অপূর্ব ভাই হাড়ি হাতে তুলে অনুমান করলেন। কেজি খানেক আছে। উৎফুল্লিত মনে বলেন, “কেজি কত চাচা?”

“টাকা লাগবে না, আপনি এমনেই নিয়ে যান। টাটকা আছে। রাতে শরীরটা ভালো ছিল না, তাই নামাতে পারিনি।”

অপূর্ব ভাই হাতে টাকা গুঁজে দিলেন। চাষা হাসলেন। হাড়ি নিয়ে অগ্ৰসর হলাম। কিছুটা থেমে পিছিয়ে গেলেন। চাষাকে উদ্দেশ্যে করে অপূর্ব ভাই বললেন, “আমি দুটো খেজুরের পাতা নিতে পারি?”

“জি সাহেব।”
আপু ভাই খেজুর পাতা ছিঁড়ে চড়কি বানালেন। হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি ফুঁ দিলাম। ঘুরছে।
পাশ দিয়ে একটি যাত্রীবাহী ভ্যানগাড়ি অতিক্রম করল। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে আমাকে তুলে দিলেন ভ্যানে। তিনিও চড়লেন। মুক্ত বাতাসে খেজুর গাছের চড়কি ভনভনিয়ে ঘুরতে লাগল।

[চলবে .. ইন শা আল্লাহ]
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here