এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব -২৩+২৪+২৫

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৩

অপেক্ষার প্রহর,
হয় না-কো ভোর,
তবু পথো চেয়ে থাকা।
দিনগুলো ক্লান্তময়,
ক্লান্ত দীর্ঘ শ্বাস।

বিটিভিতে ‘অপেক্ষার প্রহর’ ধারাবাহিক চলছে। গ্ৰামের এক জনম দুখীনি মা তার সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে। তার ধারণা সন্তান আসবে‌। আগে এই ধারাবাহিকটির প্রতি অনুভূতি কাজ না করলেও আজ প্রবল করছে। বুঝতে পারছি কেন এতদিন সবাই এটি দেখেছে। আমিও অপেক্ষায় আছি, সবাইকে দেখার। আনমনে ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে থাকা অশ্রুটুকু মুছে নিলাম। দাদিজান তখন নিচে নামলেন। সবাইকে বিটিভি দেখতে দেখে ডাকলেন আবুল চাচাকে। আবুল চাচা দেখতে মোটাসোটা, আর বাদল চাচা চিকন আলীর মতো। দুজনেই উপস্থিত হলো সেখানে। দাদিমা চুপ থেকে বললেন, “তিনদিন আগে তোদের দু’জনকে ক্যাসেড আনতে বলেছিলাম। এনেছিস?

আবুল চাচা মাথা নেড়ে বলে, “জি বেগম সাহেবা। এনেছি।”

“তাহলে চালু কর। আমিও আজ ওদের সাথে টিভি দেখবো।”

দূর থেকে সবকিছু দেখে হাসলাম। শহরে থাকতে অপূর্ব ভাইয়ের ক্যাবল টিভিতে বিটিভি ছাড়া অন্য চ্যানেল দেখেছি। আজ সিডিতে দেখব। আবুল চাচা চালু করলেন সিডি। তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। আঁধারে তলিয়ে গেল সবকিছু। দাদিজান রেগে গেলেন, তার রাগ সবসময় নাকের ডগায় থাকে। সৌর বিদ্যুৎ চালু হলো। সবাই খেতে বসলাম। আমার খেতে ইচ্ছে করলো না। তাই ঘরে গেলাম। ঘুমের মতো লাগল চোখে। ঘুমিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি জানালার কাছে ময়না পাখিটা সুরেলা কণ্ঠে ডাকছে, “আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি। শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন।”

আমি হেসে ফেললাম। ময়নাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে তার ডানা দিয়ে আমাকে আগলে নিল। ডানার সাথে বাঁধা এক টুকরো কাগজ দেখতে পেলাম। লাল রঙের সুতা দিয়ে বাঁধা। কাগজটা খুলতে লেখা দেখতে পেলাম, “শুভ জন্মদিন আমাদের আরু পাখি। শুভ জন্মদিন।”

আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম। অপূর্ব ভাইকে আবছা দেখা যাচ্ছে। ময়না উড়ে চলে গেল সেদিকে। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। কাগজটা বুকে জড়িয়ে নিলাম। আমার জন্মদিন ধুমধাম করে হয়‌। কিন্তু এবার এই বাড়ির কেউ জানতেই পারবে না , আজ আমার জন্মদিন।

তখনি দরজায় করাঘাত পড়ল। দরজার করাঘাত শুনে উঠতে ইচ্ছে করল না। কাগজটা বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরপর তিনবার টোকা পড়ে থেমে গেল। অতঃপর পায়ের শব্দ শোনা গেল। অর্থাৎ সে চলে গেছে। আমি চোখ গ্ৰথণ করে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ার চেষ্টা করলাম। এক পর্যায়ে সক্ষম হলাম আচ্ছন্ন হতে। বিরতি নিল ক্লান্ত মন ও শরীর।

সকাল আটটা বাজে। সূর্যের আলো আমার ঘরে এসে পৌঁছেছে। অনেক আগেই তার আগমন ঘটেছে। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে। পুনরায় দরজা টোকা পড়ল। ব্যতিব্যস্ত হলাম এবার। মামা বাড়িতে নয়টা বেজে গেলেও ঘুম থেকে ডাক দিতো না, সাড়ে নয়টায় ঘুম থেকে উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে টেবিলে যেতাম। মামি তাড়াতাড়ি করে দুমুঠো ভাত মুখে তুলে দিলেন। কোনোরকম খেয়ে ছুটে যেতাম স্কুলে। রাস্তায় তুর ও শেফালীকে ধরতাম। আজকের দিনের তো কথাই নেই, মামি পায়েস রান্না করতেন। সবার প্রথমে আমার মুখে পায়েস তুলে দিতেন। উপহারে ভরে যেতো আমার ঘর। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। দরজা খুলে দেখলাম, দাদিজান দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “শুভ জন্মদিন আরশি মৃধা। বেঁচে থাকো এই দোয়া করি।”

আমি এক চিলতে হেসে ফেললাম। বললাম, “আজ আমার জন্মদিন, আপনি কীভাবে জানলেঞ?”

“হম। জানতাম। আমার নাতির জন্মদিন আর আমি জানবো না। তোর নাড়ি নক্ষত্র সব জানি। আমার সাথে এসো।” হাত ধরে নিয়ে গেল সবার কাছে। বৈঠকখানায় বাড়ির সবাই তখন উপস্থিত। শপিং ব্যাগের ছড়াছড়ি। যেন একটা মার্কেট বসেছে। দাদি জান হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলেন, “তোমার পরনের উপযোগী কোনো পোশাক নেই। তাই এগুলো তোমার জন্য। (সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোশাকটা আমার হাতে দিয়ে বলেন) আজ এটা পরবে। তোমাকে রাজকুমারীর মতো লাগবে।”

বাইরে চ্যাঁচামেচির আওয়াজে মুখরিত হলাম। দাদি জান আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন সেদিকে। বাইরে মানুষের ভিড়। দাদি জান হাতের ইশারা করতেই পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। নম্র গলায় বলতে শুরু করলেন, “আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনারা?”

সবাই সালামের উত্তর নিয়ে দাদি জান ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাইলেন। দাদি জান উত্তরে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। গতকাল গ্ৰামের সবাইকে বলে দিয়েছিলাম আজ সকাল আটটায় উপস্থিত হতে। আপনারা এসেছেন, আমার কথা রেখেছেন। আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। এবার আসা যাক মূল কথায়, কেন আমি আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি।” সবাই সায় দিল। দাদি জান আমাকে সবার সামনে নিয়ে এলেন। বললেন, “এই হচ্ছে আমার নাতি। আমার মেজো ছেলের একমাত্র মেয়ে আরশি মৃধা আরু। আমার পরে আমার এই নাতি নেতৃত্ব দিবে। আমার এই নাতির জন্মের পর আমি তাকে দেখিনি। গতকাল প্রথম দেখেছি। আরুর জন্মের এক বছর পর মামার বাড়িতে চলে গেছিল। যে আমাদের চির শ/ত্রু। আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আরুকে এই বাড়িতে ফিরে আনব। আমি কথা রেখেছি। কারো কাছে মাথানত করিনি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, আজ আরুর জন্মদিন। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।”

দাদি জান থামতেই উচ্চ ধ্বনিতে শুনতে পেলাম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সবকিছু আজ পূর্ণ মনে হলো। আমি হেসে দাদিজানকে জড়িয়ে ধরলাম।‌ দাদিজানও আমার পিঠে হাত রাখলেন।
___

দিঘির পাড়ে বসে ঢিল ছুড়ে দিচ্ছি জলে। পাশে কলস রাখা। পানি দিতে এসে আসন পেতে বসেছি। মনটা বড্ড অশান্ত। আজ স্কুলে যাবো না ভেবে নিয়েছি। এমন সময়ে একজন আগন্তুক পাশে বসল। ঘাড় কাত করে দেখলাম তাকে। অপূর্ব ভাই এসেছেন। আনমনে ভেবে হাতে চিমটি কে/টে পরখ করে নিলাম। সত্যি অপূর্ব ভাই এসেছেন। অভিমানী গলায় বললাম, “আপনি এখানে? কাল রাতে চো/রের মতো এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সামনাসামনি জানাতে পারেন নি?”

অপূর্ব ভাই তার ফোনটা বের করলেন। অন্যহাতে আমাকে ব্যঙ্গ করতে দিঘির জলে ঢিল ছুড়ছেন। উত্তর না পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে আমি বললাম, “কী হলো? বলছেন না কেন?”

“মা, নাও আরুর সাথে কথা বলো।”
মামিকে উদ্দেশ্য করে ফোনে কথাটা বললেন। অতঃপর ফোনটা এগিয়ে দিলেন। মামি ওপাশ থেকে আমার নাম জপে যাচ্ছেন। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে বললাম, “মামি।”

“তোকে কতদিন বলেছি, ফোন ধরার পর সাগে সালাম বিনিময় করবি। কথা মনে থাকে না?”

“স্যরি!” ছোটো করে।

“অপূর্ব কাছে পায়েস পাঠিয়েছি তোর জন্য। খেয়ে নিস। এবার নিজ হাতে খাওয়াতে পারিনি, তাতে কী? অপু খাইয়ে দিবে। আর মামির উপর রাগ করিস না।” অপূর্ব ভাইয়ের অন্যপাশে টিফিন ক্যারিয়ার রাখা। খেতে ইচ্ছে করছে ভিশন। তবুও বললাম, “নিজ হাতে যখন খাওয়াতে পারবে না, তাহলে কষ্ট করে রান্না করতে গেলে কেন?”

“ওটা অভ্যাস, ভালোবাসা। তুই বুঝবি না।বড়ো হ, তখন বুঝবি।” কল বিচ্ছিন্ন হলো। অপূর্ব ভাই ফোনটা নিয়ে পকেটে রেখে দিলেন। দিঘির এদিকে কেউ আসবে না। মামাদের বাড়িতে ওয়াশরুম ঘরে নেই বিধায় সবাই দিঘিতে গোসল করতে আসে। এখানে ঘরে ঘরে ওয়াশরুম, তাই নিশ্চিন্ত। অপূর্ব ভাই টিফিন ক্যারিয়ার খুললেন। চামচ দিয়ে মুখে দিলেন পায়েস। আমার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছিল। আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে পা/গ/লীটা আমার। কাঁদছিস কেন? সবকিছু খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪

ঘরের বসে বসে ফোনে গেমস খেলছি। অপূর্ব ভাই যাওয়ার পূর্বে তার ব্যবহৃত স্মার্টফোন আমাকে দিয়ে গেছেন। সাথে লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি মনমরা হয়ে গেম খেলতে খেলতে পার করছি। এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে থেকে গানের সুর ভেসে এলো। ফোনটা লুকিয়ে রেখে সেই ঘরের দিকে গেলাম। সিঁথি সাথি ও মেঘলা নাচছে। সাথে একজন নাচের শিক্ষিকা। কীভাবে স্টেপ ফেলতে হয় সবাইকে শেখাচ্ছেন। আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি। মামা বাড়িতে নাচ নিষিদ্ধ থাকলেও এই বাড়িতে সবার শীর্ষে। আমাকে দেখে সিঁথি নাচ থামিয়ে বলে,

সিঁথি: ভেতরে এসো আরু।

আমি ভেতরে গেলাম। নাচের শিক্ষিকার নাম ইতিকথা সরকার। হিন্দু তিনি। সিঁথি কলেজে পড়ে। দ্বিতীয় বর্ষে। তাদের কলেজে ফাংশান রয়েছে। সেই ফাংশানে অংশ নিতে দুই বোন চেষ্টা করছে। আমারও শখ জাগলো। ছুটে গেলাম দাদি জানের কাছে। দাদি জান পান খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, “কী হয়েছে আরু? দৌড়াচ্ছো কেন?”

“পাশের ঘরে সিঁথি আপু ও সাথি নাচ শিখছে, আমিও শিখব।” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম। দাদিজান পান চিবুতে চিবুতে বললেন, “যাও। ইতিকথাকে বলো, তুমিও নাচ শিখবে।”

“আমার ভয় করছে, তুমি চলো না প্লীজ?”

“আচ্ছা চলো।” বলে দাদি জান আমায় নিয়ে পূর্বের কক্ষে ফিরত এলেন। নাচের শিক্ষিকাকে বুঝিয়ে বললেন আমাকে নাচ শেখাতে তিনিও আমাকে নাচ শেখাতে শুরু করলেন।
__
যদি রাত পোহালে শোনা যেতো, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির চাই, মুক্তি চাই
তবে বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।
যদি রাত পোহালে শোনা যেতো বঙ্গবন্ধু মরে নাই।

আজ ১৫ ই আগষ্ট। পতাকার আদলে গড়ে উঠেছে কলেজের চত্ত্বর। লাল সবুজ রঙের আলো। ভিড় জমেছে কলেজ চত্ত্বরে। তিনটা গাড়ি এসে পরপর থামল কলেজের সামনে। দাদি জান সবার আগে নেমে দাঁড়ালেন। তারপরে বাকি সদস্যরা। হা/ম/লা করার ভয়ে সবাই একসাথে আসেনি। দাদি জান প্রধান অতিথির ভূমিকায় রয়েছেন। দুই পাশে মানুষ ভাগ হয়ে আমাদের বরণ করে নিল। আমরা প্রথম সারিতে বসলাম। প্রধান শিক্ষক তখন মাইক্রোফোনে বলছেন, “ইতোমধ্যে কলেজ চত্বরে এসে পৌঁছেছে আমাদের প্রধান অতিথি সাহারা মৃধা। আমরা তাকে বরণ করে নিয়েছি। এবার আমরা যাবো মূল অনুষ্ঠানে।”

গান দিয়ে শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। দেশত্ববোধক গান, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান। অতঃপর শুরু হলো গ্ৰুপ নাচ। মাইক্রোফোনে ডেকে উঠল, “সিঁথি, সাথি ও আরু।”

আমরা একসাথে উঠলাম স্টেজে।

পাগলা হাওয়ার বাদল নেমে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে,
চেনা শোনার কোন বাইরে, যেখানে পথ নাই, নাইরে।
চেনা শোনার কোন বাইরে, যেখানে পথ নাই, নাইরে।
সেখানে চল যাই ছুটে।
পাগলা হাওয়ার বাদল নেমে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।

গানের তালে কোমর দুলিয়ে চলেছি আমি। হাজার হাজার দর্শক দেখে যাচ্ছে আমাদের। দাদি জান সামনের সারিতে বসা। আমার নাচে বাহবা দিতে একমাত্র তিনিই করতালি দিচ্ছেন। নাচ শেষ হতেই স্টেজ থেকে নেমে গেলাম। দাদিজান আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “খুব ভালো হয়েছে।”

“মোটেও ভালো হয়নি। তুমি আমাকে শান্তনা দিয়েছ।” আমার উত্তরে দাদি জান টু শব্দটি করলেন না। আলগোছে গাল ছুঁয়ে উঠে চলে গেলেন।
প্রথমবার নেচেছি, তেমন ভালো হয়নি। কিছু কিছু জায়গা স্টেপ ভুলে গিয়েছিলাম। তখন থেমে গেছি আবার শুরু করেছি। একে একে সবাই নাচ পরিবেশন করল। গ্ৰুপ চ্যাম্পিয়ান হয়েছি আমরা ও প্রথম পুরস্কার পেয়েছি আমি। চমকে উঠলাম তখন যখন পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমার নাম ঘোষণা করল। পিলে চমকে দাদি জানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি স্বাভাবিক। একজন শিক্ষিকা বেশ কয়েকবার আমার ডাকল।

“আরশি মৃধা আরু কে আছেন? তাড়াতাড়ি স্টেজে আসার জন্য অনুরোধ করা গেল।” দাদি জান ততক্ষণে এসে নিজের জায়গা দখল করেছেন। আমাকে বললেন, “কী হয়েছে আরু, তোমাকে ডাকছে। যাও পুরষ্কার নিয়ে এসো। বলেছিলাম না, তুমি ভালো নেচেছ।”

আমি স্টেজে গিয়ে পুরষ্কার নিলাম। আড়চোখে প্রতিযোগীদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। আমাকে খেয়ে ফেলার মতো। আমি হেসে পুরষ্কার গ্ৰহণ করে নেমে এলাম। নামার সময় এক অভিভাবক বললেন, “এই মেয়েটা কি নাচল আপনারাই বলুন। দু/র্নী/তি হয়েছে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বড়ো বাড়ির মেয়ে বলে ক্ষমতা দেখিয়ে পুরষ্কার হাসির করে নিয়েছে।”

আমার মন ভেঙে গেল। নিজেকে ছোটো লাগল। আমার মুখে হাসি ফোটাতে দাদিজান এমন করেছেন এতে সন্দেহ নেই। আমার সম্মান যে খোয়া গেল। আমারই ভুল হয়েছে নাচে অংশগ্রহণ করতে চাওয়া।
___
বিছানায় শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না। নিঃপ্রান লাগছে। দাদি জানের সাথে শুয়েছি আজ। দাদি জান চুলে বিলি কে/টে দিতে দিতে বললেন, “আমার নাম সাহারা মৃধা। এই নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন কেন করলে না নাতনি? মেয়েরা বাবার পরিচয়ে পরিচিত হয়, আমি কেন স্বামীর বাড়ির টাইটেল ব্যবহার করছি।

“কেন?”

“কারণ আমার বিয়ে হয়েছে চাচাতো ভাইয়ের সাথে, তাই। আমি তোমার নানা ভাইকে ভালো..

আর বলতে পারলেন না। আবুল চাচা হাজির হলেন তৎক্ষণাৎ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, “করিম চৌধুরী এসেছে তার মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে। আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন বেগম সাহেবা।”

“তাকে বসতে বল। আমি আসছি।”

আবুল চাচা চলে গেলেন। দাদি জান আমাকে ঘুমাতে বলে তিনিও চলে গেলেন। চোখের আড়াল হতেই দৃষ্টি সরু করলাম। লুকিয়ে রাখা মুঠোফোন বের করলাম। অচেনা নাম্বার থেকে পনেরোটা মিসড কল। পুনরায় আবার বেজে উঠল। কাঁথা মুড়ি দিয়ে রিসিভ করলাম। ফিসফিস করে বললাম, “আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”

“ওয়া আলাইকুম সালাম। ফোন রিসিভ করতে দেরি হলো কেন?” অপূর্ব ভাইয়ের গলা। নিজেকে সামলে বললাম, “দাদি জান ঘরে ছিলেন।”

“এখন নেই?”

“না।”

“তোর দাদি জানের একটা শাড়ি বারান্দার রেলিং-এ গিঁট দিয়ে নিচে ফেল। আর দরজাটা বন্ধ করে নিস।”

“আপনি নিচে।”

“কথা না বলে যা বলেছি, তাই কর।” অপূর্ব ভাইয়ের কথা মেনে আলমারি থেকে শাড়ি নিয়ে বারান্দার রেলিং-এ গিঁট দিয়ে নিচে ছুড়ে দিলাম। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন নিচে। শাড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলেন। কড়া গলায় বললেন, “তোকে নিজের ফোন দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। বরং আমার ক্ষতি হয়েছে। এখন থেকে বাঁশি বাজলে দিঘির পাড়ে চলে আসবি।”

“আমার কাছে এত কীসের প্রয়োজন আপনার? মামাতো বলেই দিয়েছিলেন, আমি আহসান বাড়ির কেউ নই। তাহলে কেন আসেন।

অপূর্ব চুপ করে আছেন। মুখটা লুকিয়ে গেছে। নীরবতার পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
“শুনলাম, তুই না-কি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিস? কথাটা কী সত্যি?”

মন খা/রা/প হয়ে গেল। মাথাটা আলতো নিচু করে নিলাম। অপূর্ব ভাই উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন। গালে হাত দিয়ে বললেন, “কী হয়েছে আরু? মন খারাপ কেন?”

আমি কেঁদে ফেললাম। অপূর্ব আবদ্ধ করে নিলেন নিজের সাথে। শীতল সেই স্পর্শ। দরজার খোলার শব্দ পেলাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]
পরবর্তী পর্বে কি-যে অপেক্ষা করছে। 😙😙#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫

আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম দাদি জান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বিয়ের কার্ড। অপূর্ব ভাই তখনও দাঁড়িয়ে আছে নিকটে। ক্রমাগত ঘামছি আমি। দাদি জান চশমা খুলে চোখ পরিষ্কার করে তাকালেন। পুনরায় আবার পরিধান করলেন। অপূর্ব ভাইকে দেখিয়ে বললেন, “ইনি কে আরু? আমাদের দাদি নাতনির ঘরে কী করছে?”

আমি জবাব খুঁজে পেলাম না। আমতা আমতা করে কিছু বলার পূর্বেই অপূর্ব ভাই মুখ খুললেন, “আরু, আপনি কি তার জন্যই আমাকে আসতে বলেছিলেন?”

“মানে?” দ্বিধান্বিত কণ্ঠস্বর। অপূর্ব দাদিজানের অগোচরে আমার হাতে একটা চিমটি দিলেন। ‘আহ’ করতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি। পুনরায় তিনি বললেন, “এটা কোন ধরনের মজা? আপনার দাদির মনের অসুখ করেছে বলে আমাকে ফোন করে আসতে বললেন, এখন বলছেন মানে? এটা কোন ধরনের অস/ভ্য/তামি?”

অপূর্ব সামলে নিলেন সবটা। আলগোছে হেসে বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে প্রথম তার জন্য আসতে বলেছি। (দাদি জানকে উদ্দেশ্য করে) ঐ বাড়ি থেকে আসার পর থেকে কিছু ভালো লাগছে না। তাই ডা. অপূর্বকে ফোন দিয়েছি। তিনি মনোচিকিৎসক। ঢাকাতে চেম্বার আছে। ফুফুকে তিনিই চিকিৎসা দেন।”

দাদি জান অবিলম্বে বিশ্বাস করে নিলেন এবং অপূর্ব ভাইকে চিনতে পারলেন। ডা অপূর্ব হিসেবে এই বাড়িতে তার যাতায়াত রয়েছে। কারণ ফুফুজান মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিতেন। দাদি জান বললেন, “তা এতো রাতে কেন এসেছেন? এখন সবাই শুয়ে পড়েছে।”

“আসলে আমি শহরে থাকি। ট্রেনে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।” অপূর্ব ভাইয়ের উত্তরে দাদি জান বললেন, “আগের মতো এখন আর খেয়াল রাখতে পারি না। তা কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তা এখন কি বাড়িতে যাবে? না গেলে এখানে থাকো। কাল সকালে আরুকে দেখে একসাথে বাড়িতে যেও।”

অপূর্ব ভাই রাজি হলেন। মনে মনে যেন এটা তিনি চেয়েছিলেন। আমাদের বাড়িতে অপূর্ব ভাইকে একমাত্র বাবা চিনে, এছাড়া কেউ চিনে না। তাই স্বস্তি পেলাম। বাবা বাড়িতে নেই। প্রায় দিনেই বাড়ির বাইরে থাকেন।
___
বাঁশির সুর কানে পৌঁছে গেল।
ঘুম থেকে জেগে দেখলাম অপূর্ব ভাই নিচে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছেন। এমন সময়ে কেউ উঠে না সচরাচর। এইমাত্র আমিই উঠেছি। ধীর পায়ে নেমে গেলাম নিচে। আকাশে হবে সূর্য উদিত হয়েছে। অপূর্ব ভাইয়ের পিছনে গিয়ে ‘ভাউ’ করে উঠলাম। তিনি স্বাভাবিক ভাবেই আমার দিকে তাকিয়ে ব্রাশ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি মন খা/রা/প করে বললাম, “ভয় পেলেন না কেন?”

“আমি কি মেয়ে মানুষ, যে ভয় পাবো? আশ্চর্য!”

“এতো সকালে একা বসে আছেন। যদি শাতচুন্নিতে ধরে।”

“শাতচুন্নি এতোদিন বাড়িতে ছিল। সেই তো ধরে ছিল। শাতচুন্নিটা বাড়িতে নেই, পরিবেশ ফাঁকা লাগছে। কারো মন ভালো নেই। তাই তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি।” তার কথায় মাথা নেড়ে ‘হম’ বললাম। ব্রাশটা হাত থেকে নিয়ে ব্রাশ করতে যাবো এমন সময়ে ধমকে উঠলেন, “এটা কি করছিস তুই? ওয়াক থু। আমার ব্রাশ দে।”

ভেংচি দিয়ে বললাম, “এইযে ব্রাশটা দেখছেন। এটা আপনার হতে পারে কিন্তু এটা দিয়ে আমিও ব্রাশ করেছি। তাই এটা আমারও ব্রাশ।”

আমি জোর করলাম। অপূর্ব হাত থেকে টেনে নিলেন ব্রাশটা। ছুড়ে দিলেন দূরে। আমার মুখ ভার হলো। কালো হলো মন। উঠে গেলাম জায়গা ছেড়ে। দুকদম ফেলতেই হাতটা ধরে ফেললেন অপূর্ব ভাই। না তাকিয়েই বললাম, “হাত ছাড়ুন। একদম আমার সাথে কথা বলবেন না, হাতও ধরবেন না।”

“আরু, বাবা তুরের বিয়ে ঠিক করেছে।” চমকে উঠলাম আমি। আমি শেফালী আর তুরের বয়স একই। এসএসসি পরীক্ষার এখনো অনেক সময় বাকি। তুরের বিয়ে কীভাবে সম্ভব। উত্তেজিত হয়ে বললাম, “আপনি আমার সাথে মজা করছেন, তাই না?”

“না। সত্যি। প্রয়াস ভাইয়ের সাথে। প্রয়াস ভাইয়ের বাবা আমার বাবাকে হুমকি দিয়েছে তিস্তা আপুকে এনে দিতে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। আর পাওয়া গেলেও বিয়ে হতো না। তাই বাবা নিজের সম্মান রাখতে তুরের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। আজ তুরের বিয়ে। পরীক্ষার পর তুলে নিয়ে যাবে। হঠাৎ করেই আমাদের পরিবারটা কেমন অগোছালো হয়ে গেল।”

চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। তুরের শুভ পরিণয় অথচ আমি তার পাশে বোন বা বন্ধু হিসেবে থাকতে পারব না। এমন সময়ে অপূর্ব ভাই আশ্বাস দিলেন, “আমি তোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তুই বরং একটা বোরখা পড়ে তৈরি হয়ে নে।”

অপূর্ব ভাই ব্রাশ করতে করতে দিঘির দিকে গেলেন। আমি সেখানেই কিছুক্ষণ বসে রইলাম। এই বাড়িতে একটা কুকুর আছে, তার নাম রিংকু। মৃধা বাড়ির বিদেশি কুকুর। একটা পাতা পড়লেও রাতে ঘেউ ঘেউ করে উঠে। প্রচণ্ড ভালোবাসে সবাই। বেশ কিছুদিন আগের কথা। শখের তাড়নায় দিঘির পাড়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসেছিলাম। ছিপে গরুর মাংসের টুকরো দিয়েছি। রিংকু ছুটে এসে ঘেউ ঘেউ করা লেজ নাড়ালো। লোকে বলে কুকুরের ঘ্রান শক্তি বেশি। তা সেদিন আমি লক্ষ্য করেছিলাম। কুকুরটি আমার থেকে গোস্তের টুকরোগুলো কে/ড়ে খেয়ে নিয়েছিল। ওড়না পেঁচিয়ে পাক করে কুকুর তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। কুকুরটি সরে নি। বরং সবগুলো খেয়ে নিয়েছিল। খাওয়া শেষ হতেই তাড়া করল আমায়। আমি ছুটে গিয়েছিলাম বাড়িতে। লাফ দিয়ে দাদি জানের কোলে উঠে বলেছিলাম, “দেখো দাদি জান, কু/ত্তা আমাকে লড়াচ্ছে।”

দাদি জান একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ও রিংকু। আমাদের বাড়ির সদস্য। ওকে কু/ত্তা বলবে না।”

আমি ভেংচি দিয়েছিলাম সেদিন। আমার থেকে কুকুরটার বয়স অনেক বেশি।
___

মাটির রাস্তা দিয়ে চিরচেনা সেই বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি কিছুক্ষণের জন্য। দাদি জান অনুমতি দিয়েছেন। অপূর্ব ভাই বলেছেন, আমাকে জরুরি হাসপাতালে কিছু টেস্ট করতে হবে। তাই অনুমতি দিয়েছেন। আবুল চাচাকে পাঠিয়েছেন সাথে। হাঁটতে হাঁটতে অপূর্ব ভাই বললেন, “আবুল চাচা আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে তোমাকে।”

“কী সাহায্য ডাক্তার সাহেব?” আবুল চাচা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।

“আরুকে আমি আমার সাথে নিয়ে গেলাম। তিন ঘণ্টা পর ওকে নিয়ে এখানে আসবো। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।” আড়ালে আবুল চাচার হাতে টাকা গুঁজে দিলেন অপূর্ব ভাই। তা আমার দৃষ্টি থেকে এড়িয়ে গেল না। তিন রাস্তার মোড়ে আসতেই আবুল চাচা অন্য পথ ধরলেন। অপূর্ব ভাই নামলেন ঝোপঝাড়ে। একটি বাইক লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। দু’জনে বাইকে উঠে চললাম আহসান বাড়ির উদ্দেশ্যে। চিরচেনা সেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল‌। ধুক ধুক করে ছন্দ তুলে চলেছে। পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি, “আপনি কাছে এলে আমার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে না। আমি অনুভব করতে পারি আমার রক্তচাপ রয়েছে। আপনি তো মনোচিকিৎসক, আমার মনের এই অসুখ সারিয়ে দিন না? আমি ঐ বাড়িতে এক দন্ড থাকতে পারি না।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here