#ওগো_বধু_সুন্দরী
পর্ব—-১৭
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ
এই ভদ্রমহিলার সাথে নিজের ছবি দেখে যেন বজ্রপাত হলো শ্রেষ্ঠার মাথায়।ওর ছবি,এখানে এই মহিলার সাথে থাকার কোনো ব্যাখা খুঁজে পাচ্ছে না শ্রেষ্ঠা।তবে কি এই মহিলা কি ওর আসল মা,কিন্তু ছোটবেলা থেকে শ্রেষ্ঠা এটাই জেনে এসেছে ওর মা বাবা কেউ বেঁচে নেই।একটু বড়ো হবার পরে নিজের মামীকেই মা বলে ডাকতো ও,নিজের মায়ের স্থান দিয়েছিলো তাকে।শুধু মা বাবা নয়,আর কোনো ভাইবোনও ছিলো না শ্রেষ্ঠার।ছোটবেলা থেকে অনেকটা একাকীত্বর সাথে সহবাস করতে করতে শ্রেষ্ঠার ভেতরে প্রচন্ড ভীতু স্বভাবের সৃষ্টি হয়,সাথে অনেকটা বোকাও ছিলো বটে।বয়সে বড়ো হলেও ওর আচার আচরণ ছিলো শিশুদের মতো।যদিও জীবনের একটা কঠিন অধ্যায় পার করে এখন শ্রেষ্ঠার অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে।
তার মানে,ছোটবেলা থেকে নিজের সম্পর্কে যা জেনে এসেছে পুরাটাই মিথ্যে ছিলো,শুধু মা নয়।ওর একজন বোনও আছে।যদি তাই হয়,তবে ওর মা এভাবে পরিত্যাগ করলো কেন ওকে।এদের কারণে অনেক বৃহৎ ক্ষতিসাধন হয়েছে শ্রেষ্ঠার।কোনো মা নিজের সন্তানের সাথে এমন ব্যবহার কিকরে করতে পারে??
—আমি জানি না,এই মহিলা আদৌ আমার মা কিনা?যদিও তাই হয়,আমার কিছু যায় আসে না।কিন্তু এর মুখ থেকে আসল সত্যটা বের করতেই হবে আমায়।তাতে যদি একে অস্ত্রের মুখে জব্দ করতে হয়,তাও করতে রাজি আমি।কিন্তু আমার ছবি ওনার আর ওনার মেয়ের ভেতরে এলো কিকরে এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আজ নিস্তার নেই তার!!
এই ভেবে ছবিটা হাতে নিয়ে স্টোররুমের বাইরের দিকে পা বাড়ালো শ্রেষ্ঠা।কিন্তু ওর পা আর সামনে অগ্রসর হলো না।কারন তখন সামনেই দরজা আগলে প্রজ্ঞার মা দাঁড়িয়ে!!
ওনাকে দেখতে পেয়ে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে শ্রেষ্ঠা।ভদ্রমহিলা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।শ্রেষ্ঠা বুঝতে পারছে না কি বলবে তাকে।
—-আমি জানতাম,তুই আমার মেয়ে নস।তুই আর যেই হোস আমার প্রজ্ঞা তুই নস!(ভদ্রমহিলার বেশ ঠান্ডা মাথায় কথাটা বললো)
—ওহহ,তার মানে তুমি বুঝতে পেরে গেছো?
—কি ভেবেছিলি,মা তার মেয়েকে চিনতে পারবে না?আসল,নকলের তফাত বুঝতে পারবে না।আমাকে সৌহার্দ্যের বাবার মতো বোকা পেয়েছিস তুই?
—যখন জানতেই পেরেছিলো আমি তোমার মেয়ে নই আগে কেন বললে না,এতো নাটক কেন করলে?
—নাটক,আমি নাটক করেছি।নাটক তো করছিস তুই।বল আমার বাড়িতে আমার মেয়ে সেজে কেন এসেছিস??তার আগে ঐ বোকা বুড়ো লোকটাকে আসল ঘটনাটা তো জানাতে দে , তাকে কেউ এতো বড়ো বোকা বানালো,আর সে কিনা জানতেই পারবে না।
এই বলে প্রজ্ঞার মা ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বর ডায়াল করতে যাবে,ঠিক তখন শ্রেষ্ঠা স্টোর রুম থেকে একটা ভাঙা ফুলদানি মহিলার কপাল বরাবর সজোরে ছুড়ে মারলো।অস্ফুট চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।সেই সুযোগে শ্রেষ্ঠা তার দিকে ছুটে যায়,সবার আগে তার থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।প্রজ্ঞার মা আবারো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে শ্রেষ্ঠা তাকে আবারো আঘাত করে ফেলে দেয়।আঘাতের চোটে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে।
শ্রেষ্ঠার সেই সুযোগে তার হাত পা বেঁধে ফেলে।তারপর দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসালো।কিচেন থেকে পানি নিয়ে এসে মুখমন্ডলে ছিটিয়ে দেয়।একটু পরেই জ্ঞান ফিরলো ভদ্রমহিলার।ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো।কিন্তু তখন সে নিদারুণ অহসায়।অগ্যতা হাত পা বাঁধা অবস্থায় একলা অশক্ত মেঝের ওপরে বসে আছে।সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শ্রেষ্ঠা।ওর হাতে একটা ছুড়ি!
—-এইটা কি দেখতে পাচ্ছো?
(ছুড়িটা দেখিয়ে ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করে)
—আমাকে বেঁধেছিস কেন, তুই নিজেও জানিস না এটা করে কতোবড়ো সর্বনাশ ডেকে আনলি নিজের।
—সর্বনাশ,আর কি সর্বনাশ করতে বাকি রেখেছে তুমি আর তোমার মেয়ে আমার।আমাকে সর্বনাশের ভয় দেখাচ্ছো,
—কি চাস তুই আমার কাছে বল, আর তাড়াতাড়ি ছেড়ে দে আমায়।
—এই ছবিটা ভালো করে দেখো,,এখানে তোমাকে দেখা যাচ্ছে,সাথে তোমার মেয়ে আর তার সাথে আমি!!তোমাদের মা মেয়ের ভেতরে আমার ছবি আসলো কিকরে এই প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।
শ্রেষ্ঠার প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা চুপ করে রইলো।তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না।এটা দেখে শ্রেষ্ঠা ছুড়িটা তার গলা বরাবর চেপে ধরলো,
—কি হলো,কথা বলছো না কেন,আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে এই ছুড়ি তোমার গলায় চালিয়ে দিতে হাত কাঁপবে না আমার।তাড়াতাড়ি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, নয়তো তোমার সাথে কি কি ঘটবে ভাবতেও পারছো না তুমি!?
—না,আমায় এভাবে মেরো না,হ্যাঁ…সব বলবো আমি,সব বলবো।আগে এইটা সরাও আমার গলার ওপর থেকে।(বেশ ভয়ে ভয়ে বলতে লাগলো)
—ঠিক আছে সরিয়ে নিলাম,এবার বলো।আর একটা কথা আমায় মিথ্যে বলার চেষ্টা একদম করবে না।যদি সেরকম কিছু বুঝতে পারি,আর আস্তো রাখবো না তোমায়।
—বল, কি জানতে চাও।
—এক প্রশ্ন কতোবার করবো, বললাম তো। আমার ছবি তোমাদের সাথে এলো কিকরে?
—এই যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছো,এটা কে তুলেছে তুমি জানো না হয়তো।এটা তোমার বাবার তোলা ছবি।
—আমার বাবার,,,আমার বাবার সাথে কি সম্পর্ক ছিলো তোমার??
—কি সম্পর্ক ছিলো মানে,উনি স্বামী ছিলেন আমার… আল্লাহকে স্বাক্ষী করে বিয়ে করেছিলেন উনি আমায়।যখন ওনার স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন বাধ্য হয়ে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে উনি বিয়ে করলেন আমায়।আর সেই সন্তান আর কেউ না তুমি নিজে।
যখন তোমার মা সাত মাসের গর্ভবতী, তখন একটা জটিল সমস্যার কারনে ডেলিভারি করা হয়েছিলো তার।ডাক্তার অনেক চেষ্টা করে তোমাকে বাঁচাতে পারলেও তোমার মাকে বাঁচাতে পারেননি।
এরপর তোমার বাবা আমাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসলেন।তোমায় তুলে দিলেন আমার হাতে।ওনার একটাই দাবি ছিল আমার কাছে,আমি যেন তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে না দেই।মায়ের ভালোবাসা দিয়ে সবসময় আগলে রাখি।
—আর তুমি, তার সেই সামান্য চাওয়ার সম্মান করতে পারলে না??
—না,আমার কথা মানো।আমি প্রথম মেনেই নিয়েছিলাম তোমায়,নিজের মেয়ের মতোই তোমায় লালন পালন করতে থাকি।কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা।এরপর আমার কোল আলো করে প্রজ্ঞা এলো।অদ্ভুত বিষয়,ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া সত্তেও তোমাদের দুজনের চেহারা হুবহু একই রকমের ছিলো।তার কারণ ছিল তোমাদের বাবা।মা আলাদা হলেও বাবা তো একজনই ছিলো তোমাদের।তাই জিনগত কারণে তার থেকেই এক রকম চেহারা পেয়েছিলে তোমরা দুজন।আর হ্যাঁ,দুটো জন্মদাগ নিয়েই জন্ম হয়েছিলো তোমাদের দুজনের।তোমার জন্মদাগটা ঘাড়ের দিকে ছিলো,আর আমার মেয়েরটা ওর কানের ওপরে ছিলো,দেখলে একটা কাটা দাগের মতো মনে হয়।
যখন আমার কোলে প্রজ্ঞা এলো,আমার আর তোমার ভেতরে একটা অদৃশ্য দূরত্বের দেয়াল সৃষ্টি হতে লাগলো।বিশ্বাস করো,আমি কখনো কষ্ট দিতে চাইনি তোমায়।কিন্তু তোমায় সবসময় নিজের মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতাম আমি।যখন বাবা তোমাকে কোলে নিয়ে আদর করতো সেটা দেখে ভীষণ রাগ হতো আমার,একটা অনিশ্চয়তার ভেতরে দিন কাটতে লাগলো আমার।কিন্তু তোমার বাবার কারণে হাত বা বাঁধা ছিলো না আমার।
এর কিছু বছর পরে…..
তোমার বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন।এরপর তোমার ওপর আমার অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগলো। আমি জানি সেগুলো এখন কিছুই মনে নেই তোমার।এরপর একদিন তোমার মামা আমার তোমার প্রতি করা সকাল অত্যাচারের কথা জেনে ফেলে।হাতে নাতে ধরে ফেলেন উনি আমায়।এরপর আমায় রাগবশত তোমার বাবার বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।আমার সেই সময়ে বেরিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। কারণ আমি তোমার মামার কথা না মানলে আমাকে জেলের ভাতে খেতে হতো।আর তখন আমার মেয়ের কি হতো জানি না।প্রজ্ঞার কথা ভেবেই সমস্ত সহায় সম্পত্তির বাসনা ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আমি।আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রইলো না তোমার।এদিকে মামাই তোমায় আদর যত্ন দিয়ে বড়ো করে তুললেন। কখনো জানতে দেননি আমার আর প্রজ্ঞার কথা।কারণ উনি চাননি আমাদের কোনো ছায়া পড়ুক তোমাদের ওপর।
তোমার মামা যতোই আমাকে আলাদা করার চেষ্টা করুক না কেন,আমি কিন্তু তোমার সমস্ত খোঁজখবর ঠিক রাখতাম।তোমাকে নিজের নজরের আওতার বাইরে যেতে দেই নি।
—সেসব না হয় বুঝলাম,কিন্তু আমার বিয়ের সময়ে তুমি আমার সাথে এতো বড়ো একটা ষড়যন্ত্র কেন করলে বলো?
—একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে সৌহার্দ্যের বাবা আমার বাড়িতে আসেন,তিনি আমার সাথে কথা বলেন।আমাকে আশ্বাস দেন যে প্রজ্ঞার বিয়ে তোমার হবু বরের সাথে করিয়ে দিবেন উনি।আর তার ফলে তোমার ভাগ্যে নেমে আসবে অবর্ননীয় দুঃখ আর কষ্ট।ওনার কথা শুনে পুরনো সকল প্রতিশোধ তখন যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আমার।ভাবলাম তোমাকে জব্দ করে আমার মেয়েকে জিতিয়ে দেবার এই তো সুযোগ।তাই সৌহার্দ্যের বাবার কথায় রাজি হয়ে যাই আমি।আমি জানতাম না,উনি আসলে আমাকে চিনলেন কিকরে,বা আমার বিষয়ে এতো কিছু জানলেন কিকরে?তখন নিজের মেয়ের জিত আর তোমার সর্বনাশ দেখে ভেতরে এতোটাই উত্তেজনা কাজ করছিলো এতো কিছু ভাবার সময় পাই নি।
এরপর সমস্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী বিয়ের দিন তোমাকে কিডন্যাপ করা হলো,আর তোমার জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হলো আমার মেয়ে প্রজ্ঞাকে।অথচ বেচারা সৌহার্দ্য এর কিছুই জানতে পারলো না।ও নিজের অগোচরে আমার মেয়ের সাথেই বিয়েটা করে নিলো।
–
–
–
–
চলবে……