#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_১৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
দুপুরের ত্যাছরা আলো গ্রাম্য উঠোনে ঝড়ে পড়ছে। আভা মাত্রই গোসল করে বের হলো। মাথায় খোঁপার মত করে গামছা পেঁচানো। ভেজা জামা-কাপড় একটা ছোট্ট বালতিতে করে নিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালো ও। রোদের জন্যে চোঁখ খুলে থাকা যাচ্ছে না। রোদের অদৃশ্য ভারে দু’চোঁখ আপনা-আপনি বুজে আসছে। আভা ভেজা জামা-কাপড় থেকে ভালো করে পানি ঝড়িয়ে দড়িতে মেলে দিলো। এরই মধ্যে আহনাফ আর মিনহাজ বাইরে থেকে এসে উঠোনে দাঁড়ালো। সেই সকালে দুজন নাস্তা খেয়ে গ্রাম দেখতে বেরিয়েছে। মাত্রই ফিরলো। আভা একনজর আহনাফের দিকে তাঁকালো। আহনাফের জিন্স টাকনুর উপরে বটে রাখা। পা’জোড়া তার কাদায় মাখামাখি। পায়ে থাকা সাদা রঙের জুতোও কাদা লেগে কালো হয়ে গেছে। সর্বোপরি ভীষণ বিদ্ধস্ত অবস্থা। আভা আহনাফের এমন করুন অবস্থা দেখে ফিক করে হেঁসে ফেললো। আভার হাসির শব্দ কানে যেতেই আহনাফ আভার দিকে তাঁকালো। আভাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিবে, চোঁখের দৃষ্টি যেনো এমন। আহনাফের কড়া দৃষ্টি দেখে আভা ফট করে চুপ হয়ে গেলো। মিনহাজ কপালের ঘাম আঙ্গুল দিয়ে মুছে আভার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” চান্দের রাইত, যা তো। চুলোয় গরম পানি বসা। গোসল করতে হবে। ”
আভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে কাপড়বিহীন শূন্য বালতি নিয়ে ঘরে চলে গেলো।
আহনাফের মুখের অভিব্যাক্তি অসহায়। জন্ম থেকে শহরে থাকায় গ্রামের কাদামাখা পরিবেশের সাথে সে খুব বেশি পরিচিত নয়। তার উপর পায়ে কাদা লেগে যাচ্ছেতাই অবস্থা। চুলকাচ্ছে খুব! জুতোটাও গেছে। তবে এত খারাপের মধ্যে একটা দিক খুব ভালো ছিলো। সেটা হলো,
‘ এই গ্রাম ‘। গ্রামটা অদ্ভুত সুন্দর ছিলো। গ্রামের মানুষজন ওকে দেখে খুব খুশিমনে কথা বলছিলো। বলাবাহুল্য, আভার বাবা গ্রামের খুব গণমান্য ব্যাক্তি ছিলেন।
আহনাফের ভাবনার ফাঁকে মিনহাজ তাড়া দিলো,
— ” আহনাফ, গরম পানি হয়ে গেছে। তুমি বড় বাথরুমে চলে যাও। আমি ছোটটায় গোসল সেরে নিবো। ”
আহনাফ মিনহাজের কথায় সায় দিয়ে পা থেকে কাদাযুক্ত জুতো খুলে ফেললো। জুতো থেকে কাদার বিশ্রী গন্ধ আসছে। আহনাফ জুতো ঘরের বাইরে একপাশে রেখে খালি পায়ে তার জন্যে বরাদ্দ করা রুমের দিকে চলে গেলো।
আহনাফ তার ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করছে, ঠিক তখন দরজায় টোকা পড়লো। বাইরে থেকে মেয়েলী নরম আওয়াজ আসলো,
— ” আসবো? ”
আভার কণ্ঠ শুনে আহনাফ মুঁচকি হাসলো। ব্যাগ থেকে একটা নেভি ব্লু টিশার্ট আর জিন্স বের করে বিছানায় রাখলো। তারপর দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে উচুঁ স্বরে বললো,
— ” না। ”
আহনাফের ‘ না ‘ শব্দ শুনে আভা খানিক অবাক হলো। ভিতরে কি করছেন? আসতে বারণ করলেন কেনো? হয়তো কাপড় বদলাচ্ছেন। কিন্তু এখনো তো গোসল করেন নি। তবে? অন্য কাজ করছেন? আভা দাঁড়িয়ে রইলো দরজার বাইরে। বেশ কিছুসময় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আভা একটা পর্যায়ে বিরক্ত হলো। ইতস্তত বোধ করে আবারও দরজায় টোকা দিতে উদ্যত হলে হঠাৎ করেই রুমের দরজা খুলে যায়। আভা এতে একটু ভয় পেয়ে দরজা থেকে পিঁছিয়ে যায়। আহনাফ দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কাধে টিশার্ট আর জিন্স ঝুলানো। আভা আহনাফের দিকে চোঁখ উচুঁ করে তাকালো। আহনাফের দৃষ্টি স্বাভাবিক। আভা আপাদমস্তক আহনাফের দিকে তাঁকিয়ে দেখলো। কোনো বদল নেই। আগে যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। আভা কণ্ঠ খানিক সন্দেহের করে বললো,
— “জুতো দিতে এসেছিলাম। এতক্ষণ রুমে কি করছিলেন?”
আহনাফ ভ্রু বাঁকা করে হেসে বললো,
— ” প্রেম করছিলাম।”
আভা আহনাফের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আহনাফের পাশ থেকে পা উঁচু করে সম্পূর্ণ রুমটায় একবার চোঁখ বোলালো। কিন্তু প্রেম করার মতো রুমে কেউ নেই। আহনাফের বলা তথাকথিত প্রেম নামক রহস্যের সমাধান করতে না পেরে আভা তেতে উঠে বললো,
— ” মজা করছেন? ”
আহনাফ উত্তর দিলো না। বরং আভার হাত থেকে স্যান্ডেল নিয়ে পায়ে লাগালো। অতঃপর আভাকে একহাত দিয়ে তার পাশে সরিয়ে বাথরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। আহনাফের ওমন গা ছাড়া ভাব দেখে আভার পিত্তি জ্বলে উঠলো। কি ভাব! গা জ্বলে যায় দেখলে! আভা মনে মনে আহনাফকে শখানেক গালি দিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো।
___________________
আর একটু পরই আহনাফ চলে যাবে। আস্ত একটাদিন আহনাফকে সচক্ষে দেখতে পেরে দাদুমনি এখন অনেকটাই সন্তুষ্ট। মহাভারত উদ্ধার করে ফেলেছেন, ভাবখানা এমন যেনো। আহনাফ যাওয়ার সময় দাদুমনি আহনাফের মাথায় হাত দিয়ে কতশত দোয়া পড়েছেন। এজীবনে নাত জামাইকে যেনো কোনো অশুভ শক্তি না ছোঁয়। আহনাফের কাধে ট্রাভেল ব্যাগ। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, যাবে ভাব। তবুও পা চলছে না তার। কারণটা, স্বয়ং আভা। বিদায় বেলায় এই মেয়েটা কোথায় গেলো কে জানে? তার সামনে এসে সামান্য বিদায়টুকু জানাতে পারছে না। আশ্চর্য!
আহনাফকে অস্থির দেখে মিনহাজ এসে আহনাফের পাশে দাঁড়ালো। উত্তর জানতে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— ” কিছু হয়েছে, আহনাফ? অস্থির দেখাচ্ছে তোমাকে। ”
আহনাফ ঘাড় হালকা কাত করে মিনহাজের দিকে তাঁকালো। সহসা হেঁসে বললো,
— ” না, তেমন কিছু না। আচ্ছা, আসছি এখন। অলরেডী অনেক দেরি হয়ে গেছে। ”
মিনহাজ মাথা নেড়ে সায় দিলেও আহনাফের চোঁখ মুখ তার ঠিক মনে হচ্ছে না। ভিতরে ভিতরে এক ফোলা ফোলা ভাব। কার উপর রেগে আছে? আব.. আভার উপর? আরে, আহনাফ চলে যাচ্ছে, আভা কই? মিনহাজ চকিতে চারপাশে চোঁখ বুলালো। তবে আহনাফের ত্রিসীমানার মধ্যে আভাকে দেখতে না পেয়ে মিনহাজ আহনাফকে বললো,
— ” তুমি এগোও। আমি একটু আসছি। ”
মিনহাজ আহনাফকে রেখে রান্নাঘরের দিকে এগুলো। এই চান্দের রাইত যে কবে ঠিক হবে, খোদা জানে।
রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে চাচীদের কথা শুনছে আভা। তবে বারবার চোঁখ ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে ও। মিনহাজ তা দেখে হাসলো। বোনটা যে তার খুব একটা বোকা না, সেটা সে বুঝে গেছে। সবার সামনে আহনাফকে বিদায় দেওয়া একটু কঠিনই বটে। মিনহাজ এগিয়ে গেলো আভার দিকে।
মিনহাজ আভার পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় এক থাপ্পর দিলো। সঙ্গেসঙ্গে আভা ধ্যান থেকে বেরিয়ে কটমট চোঁখে ভাইয়ের দিকে তাকালো। এমন সময়ে কেউ থাপ্পড় দেয়? ভিতরে ভিতরে ও আহনাফের ভয়ে ক্ষয়। না জানি, আহনাফ ওর কি হাল করে বসে! আভা ভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিনহাজ মাংসের হাড়ির ঢাকনা খুলতে খুলতে বললো,
— ” আহনাফ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন গেট দিয়ে চলে যা। আমি এদিকটা দেখছি।”
একটু আগে যা বলার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল, মিনহাজের কথা শুনে আভা সেসব কঠিন কঠিন কথা গলাধঃকরণ করে ফেললো।
মিনহাজের কথা কানে যেতেই আভার গা গুলিয়ে এলো। ছিঃ! বড় ভাইয়ের সামনে আহনাফের সাথে দেখা করতে যাবে? মিনহাজের দিকে একঝলক তাকিয়ে মুখ লোকানোর চেষ্টা করলো। তবে এতে লাভ না হলেও ক্ষতি খুব একটা হলো না। মিনহাজ ধাম করে ঢাকনা লাগিয়ে মাংস খেতে খেতে আভাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। তার এভাবে চলে যাওয়ার কারণ, হয়তো বোনকে একটু স্বস্তি দেওয়ার ক্ষুদ্র চেষ্টা।
মিনহাজ চলে যেতেই আভা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। চাচীদের দিকে একপলক তাঁকিয়ে আস্তে আস্তে পিছন গেট দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। আজ কপালে নিশ্চয়ই শনি নাচছে। হায় আল্লাহ! রক্ষা করো।
দূরে আহনাফের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আহনাফ কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে গাড়ির পানেই এগিয়ে যাচ্ছে। আভা আহনাফের পিছন পিছন দ্রুত হাঁটা ধরলো। তবে আহনাফের ওমন লম্বা লম্বা পা ফেলার কারণে আভা কিছুতেই আহনাফের নাগাল পেলো না। আহনাফ ইতিমধ্যে গাড়িতে উঠে বসেছে। আভা এবার দৌঁড় লাগালো। আহনাফ গাড়ি চালু করবে তার আগেই আভা আহনাফের ড্রাইভিং সিটের পাশে দাঁড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বললো,
— “সরি, সরি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। ”
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আকাশটা সাদা, ফ্যাকাসে। ভোর ছয়টায় যেমন আকাশ কল্পনা করা যায়,তেমনের মতোই আকাশটা। একটা দুটো মেঘ আলপনা আঁকছে আকাশের বুকে। অদ্ভুত সুন্দর সেই সাদা রঙের আলপনা। বাতাসটাও শীতল, নরম তুলোর মতোই আদুরে। ভোরের হিম নামার পর মুহূর্তে বাতাস যেমন হয়,ঠিক তেমন। তবে সেই বাতাসেও আভা ঘামছে। কপালের উপর কয়েক ফোঁটা মুক্ত ঘাম জমেছে। নাকের উপরদিকটায়ও পানির উপস্থিতি। পানিভর্তি মাটির কলসির বাইরে যেমন বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে, তেমনই। আহনাফ এখনো আভার দিকে তাঁকায় নি।তার চোঁখের দৃষ্টি সামনে। রাগ করেছে খুব, মুখে স্পষ্ট। আভা এক ঢোক গিললো। গলা শুকিয়ে আসছিলো এতক্ষণ। আভা আহনাফের নির্লিপ্ততা দেখে আবারও বললো,
— ” সরি। আসলে সবাই আপনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কিভাবে আসতাম সেখানে বলেন? মানুষ ভাববে আমি বর পাগল। বিষয়টা খারাপ দেখাবে না, বলুন?
আহনাফের কপালের রগ ফুলে উঠলো। মুখের অভিব্যক্তি মুহূর্তের মধ্যেই পরিবর্তন হয়ে গেলো। চট করে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত দিলো আহনাফ। কোনো কথা বলবে না এই মেয়ের সাথে। তবে এই মিছে মিছে পণ যে খুব বেশিক্ষণ টিকবে না সেটা ও মানতেই নারাজ। আভা আহনাফকে গাড়ি ইঞ্জিন চালু করতে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না। ও সাতপাঁচ চিন্তা না করে আহনাফের দরজা খুলে পাশের সিটটায় ধাম করে বসে গেলো। দরজা খুলার শব্দে আহনাফ পাশ ফিরে তাঁকালো। আভা গাল ফুলিয়ে আহনাফের দিকেই তাঁকিয়ে আছে। আহনাফ আভার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় শোধালো,
— ” দেরি হচ্ছে আমার। নামো গাড়ি থেকে। ”
আভা নাছোড়বান্দার মত বসেই রইলো। আহনাফের শীতল গলায় বলা ছোটখাটো আগ্নেয়গিরির একবিন্দুও পরোয়া করলো না ও। আহনাফ সিটে হেলান দিলো। এক হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে চোঁখ বুজলো। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আভা আহনাফের স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে বাচ্চামো কণ্ঠে বললো,
— ” সরি বললাম তো। এত রাগ কিসের,হু?
আহনাফ এবারও কথা বললো না। চোঁখ’দুটো আগের মতই বুজে রাখা। শুধু চোঁখের পাঁপড়ি খানিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। আহনাফের এমন ব্যবহার দেখে আভার ছোট্ট মন হাসফাঁস করে উঠলো। বুকের ভিতরে অভিমানের পাহাড় একটু একটু করে জমতেই আভা এক তপ্ত নিঃশ্বাস নিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো,
–” থাকুন আপনি আপনার রাগ নিয়ে। আমি কখনোই আপনার রাগ ভাঙাতে আসবো না। এই,বলে দিলাম। সবসময় রাগ ভালো না। বুঝলেন? ”
আভা কথাটা বলেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোঁখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। গাড়ির দরজা খুলতেই হুট করে আহনাফ আভার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আভাকে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো। দ্রুত ব্যাপারটা ঘটায় আভা থতমত খেয়ে গেলো। পরিস্থিতি বুঝতে তার খানিক সময় তো লাগলো’ই। আভার এক হাত আহনাফের বুকের উপর, অন্য হাত আহনাফের কোমরের টিশার্ট খামচে ধরলো। কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো সব উলোটপালোট হয়ে আহনাফের বুকে ছড়িয়ে পড়লো।
আহনাফ আভার দিকে তাঁকিয়ে আস্তে করে একহাত দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। আভা মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাঁকালো। দু’চোখে তার এখনো অভিমানেরা খেলা করছে। আহনাফ মুঁচকি হেসে আভার চুল কানের পিছনে গুজে দিলো। একজন দায়িত্বশীল প্রেমিকের মত আঙুল দিয়ে আভার চোঁখের জল মুছে দিলো। নিজ চোখে আস্ত এক মায়ার সাগর পুষে নিয়ে বললো,
— ” এই সামান্য কারণে চোঁখের জল ফেলতে হয়? কিছু জল স্টকে রেখে দেওয়া ভালো, সুখের সময় কাজে লাগবে।”
আহনাফের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। তবে,কি ছিলো? যার কারণে আভার শক্ত রাগ, আদুরে অভিমান এক নিমিষেই দ্রবীভূত হয়ে গেলো? আভা থুতনি নামিয়ে ফেললো। আস্তে করে বললো,
— ” আপনিই দায়ী এই কান্নার জন্যে। এত রাগ! বাপরে! আর একটু হলেই কেঁদে কেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলতাম আমি। ”
আহনাফ আরো দু একটা কথা বলতে যাবে তার আগেই ওর মুঠোফোন বেজে উঠলো। মুঠোফোনের শব্দ কানে প্রবেশ করতেই আভা তড়িৎ গতিতে সরে এলো আহনাফের কাছ থেকে। অস্থির হয়ে গেলো চাহনি। এই প্রথম,এই প্রথম আহনাফের এত কাছে ছিলো ও। ভাবতেই পেটের ভিতরে গুড়ুম গুড়ুম করছে। সর্বাঙ্গে আড়ষ্ট ভাব ঘিরে ধরেছে। মুখখানা কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ ধারণ করেছে। উফ! আহনাফের সামনে আর বসে থাকা যাচ্ছে না।
আভা যখন লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খেতে মগ্ন তখন আহনাফ ফোন হাতে নিতে নিতে আরো একবার লজ্জা দিলো তাকে,
— “থাক। গাল আর লাল করতে হবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। সে সম্পর্কে এত গভীরে যাওয়ার কিছু নেই। বি নরমাল। ”
আহনাফ ফোন রিসিভ করলো। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। আহনাফ ফোন কানে ধরে অপরপাশের মানুষের কথা শুনলো। তারপর গম্ভীর সুরে বললো,
— ” উনাকে বিকেলের দিকে আসতে বলো। আমি এসেই প্রথমে উনাকে দেখে নিবো। এখন গাড়িতে আছি আমি। ”
আহনাফ ফোন কেটে সামনে রাখলো। আভাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আভা বলে উঠলো,
— ” সাবধানে যাবেন। আর হ্যাঁ, গাড়িতে ঘুম পেলে রাস্তায় কোনো রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়ে নিবেন। ঘুম ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। ঘুম চোঁখ নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। ওকে?”
আহনাফ কিছুক্ষণ আভার দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। এই মুহূর্তে আভার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, কোনো বুঝদার মেয়ে তাকে উপদেশ দিচ্ছে। আচানক আহনাফ আভার গাল টেনে দিলো। আভা গালে হাত দিয়ে অবাক চোঁখে আহনাফের দিকে তাঁকালে আহনাফ হেসে বললো,
— ” হুয়াই সো কিউট? ”
আভা হেসে ফেললো। যে হাসিতে আহনাফ মুগ্ধ হয়, বারংবার, বারংবার, বারংবার।
_______________________
খাবার টেবিলে বসে আছে আভাদের পুরো পরিবার। আভার মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে মাত্রই চেয়ারে বসলেন। দাদুমনি পালং শাক দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুললেন ভাতের লোকমা। মিনহাজ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। আভার বাবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও খাওয়ায় মন দিলেন।
এসবের মধ্যে হুট করে দাদুমনি বলে উঠলেন,
— ” এ জুনায়েদ, আভার তো বাগদান হইয়া গেলো। এখন ওরে বিয়ে দিবি কবে? কিছু ভাবসস ? ”
আভার বাবা মোহাম্মদ.জুনায়েদ ইসলাম ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই যাচ্ছিলেন। মায়ের কথা শুনে তার হাত থেমে গেলো। গম্ভীর সুরে তিনি বলেন,
— ” আম্মা, আভার আটারো বছর হয়নি এখনো। আগে ভার্সিটি উঠুক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। ”
বিয়ের কথা শুনে আভার হাত থেমে গেলো। বুকের ভিতর এক সর্বগ্রাসী তুফান শুরু হয়ে গেলো। কেনো জানেনা, যখনই তার বিয়ের কথা উঠে তখনই আভা খুব বেশি নার্ভাস হয়ে যায়। এই সমস্যার যথাযথ কারন আভার জানা নেই। হতে পারে, এই সমস্যা সকল হবু বউদের জন্যেই কার্যকর। দাদুমনি একটু থেমে শ্বাস নিয়ে বলেন,
— ” তয়, মেয়েরে এত জলদি বাগদান করে দিলি কেন? বিয়ের কদিন আগেই নাহয় বাগদান করতি। এত তাড়ার কি আছিল? ”
জুনায়েদ একবার স্ত্রীর দিকে তাঁকালেন। আভার মা নির্দ্বিধায় ভাত খাচ্ছেন। যেন এই ব্যাপারে তার মত প্রকাশের কোনো ইচ্ছাই নেই। এই বাগদান নিয়ে মেয়ের বাবারই তো যত তাড়াহুড়ো ছিলো। সময় থাকতেই মেয়ে পর হয়ে যাচ্ছে, আভার মা এসব ভেবেই নিজের স্বামীর উপর রেগে যেতে লাগলেন। জুনায়েদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— ” আহনাফের পরিবার খুব তাগাদা দিচ্ছিলো। তাই বাগদান করিয়ে রেখেছি। সময় আসলে বিয়ের কথাটাও পাঁকা হবে। মেয়ে আমার এখনো ছোট, আম্মা। ”
দাদুমনির নজর এবার মিনহাজের উপর পড়লো। মিনহাজকে শান্ত থাকতে দেখে দাদুমনি এবার কথা তুললেন,
— ” মেয়ের নাহয় বিয়ের বয়স হয়নি। তা ছেলেরও কি বয়স হয়নি? মিনহাজের তো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। ওরে বিয়ে দিবি কবে? ”
দাদুমনির কথা শুনে মিনহাজের হেঁচকি উঠে গেলো। নাকে মুখে পানি উঠে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেলো তার। আভা তাড়াহুড়ো করে মিনহাজের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। মিনহাজ চকিতে ছুঁ মেরে আভার থেকে পানি নিয়ে এক ঢোকে সমস্ত পানি খেয়ে নিলো। মিনহাজের ওমন অদ্ভুত আচরনে টেবিলে বসে থাকা সবাই হতবম্ব। তবে,জুনায়েদ ছেলের এহেন আচরনেও স্বাভাবিক হয়ে বসে রইলেন। মিনহাজার বিয়ের কথা মায়ের আগে তার মাথায় এসেছিলো। ছেলের সামনে বিয়ের কথা তুলেছেন বটে। তবে ছেলে তার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
‘ বিয়ে ‘ বিষয়টা মনঘটিত ব্যাপার। তাই এই বিষয়টি জুনায়েদ ছেলে-মেয়ে কারো উপরই চাপিয়ে দেননি। বাবা হিসেবে তারও সন্তানের খুশির দিকটা খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়।
দাদুমনি মিনহাজের এমন আচরণে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন না। বরং ধীরে সুস্থে জিজ্ঞেস করলেন,
— ” দাদু, তোমার কোনো মেয়ে পছন্দ আছে? থাকলে আমারে বলতে পারো। আমাদের তোমার পছন্দের উপর পুরা সমর্থন আছে। ”
মিনহাজ মাথা নিচু করে আরো এক ঢোক পানি খেলো। মা-বাবার, বোন, দাদুর সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে আড়ষ্টভাব কাজ করছে তার। তবুও বলতে হবে। কারণ, সে একজন প্রেমিক। প্রেমিকার খুশির দিকটাও তাকে বিবেচনা করতে হয়। আর তার প্রেমিকা যে তার সান্নিধ্যেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী মনে করে,সেটা সে হলপ করে বলতে পারে।
— ” দাদু, আছে কোনো পছন্দের মেয়ে? বলো? ”
দাদুমনির কথায় মিনহাজ একটু থেমে নিজেকে ধাতস্থ করলো। ভারী নিঃশ্বাসের বহর ত্যাগ করে বললো,
— ” পছন্দের কিনা সেটা বলতে পারিনা। তবে একজনকে ভীষন ভালোবাসি। বিয়ে করলে তাকেই করবো।”
#চলবে
খুব