ওয়েডিং_স্টোরি পর্ব ৩৫+৩৬

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

আজ রঙ খেলা হবে। রঙ-বেরঙে সেজে উঠবে বিয়ের বাড়ির প্রতিটা সদস্য। হোটেলের রুফটপে বিশাল তোড়জোড় চলছে। ছাদের একপাশে সারি বেধে রাখা হয়েছে, লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী রং! অন্যপাশে একটা ফুলে ফুলে সাজানো সাদা রঙের দোলনা! যেখানে মিনহাজ আর আরোহীর রঙ মেখে বসবে। ফটোশট হবে। ছাদের আনাচে কানাচে গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে রাখা। একপাশে, ডেকোরেশন করা সেলফি স্টেজ! সর্বপরি, মারাত্মক আয়োজন বলা চলে। কিন্তু, এসবের মধ্যে আভা কোথায়? উত্তর হলো, আভা ঘুমিয়ে আছে। নিজের জন্যে বরাদ্দকৃত রুম লক করে শুয়ে আছে। সবাই ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে একে অপরের দিকে রঙ ছুঁড়াছুঁড়ি করছে। হঠাৎ, তারার বোধ হলো, আভা কই? তারা চারপাশে চোখ বুলালো। নাহ, আভা তো নেই! তারা সাথীকে জিজ্ঞেস করলো,
— ” সাথী, আভা কোথায়? ”
সাথী ফুলের মালা বানাচ্ছিল। সুতোতে একে একে ফুল পুড়তে পুড়তে সাথী উত্তর করলো,
— ” আবা? ও তো ঘুমাচ্ছে। ”
তারা বিরক্ত হলো, বটে। আজ এত মজা হচ্ছে আর এই আভার বাচ্চা আভা ঘুমাচ্ছে। মাইর দেওয়া উচিৎ একে। তারা কোলের উপর থেকে সব ফুল মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। সিনথিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” তোরা মালা বানা। আমি আসছি। ”
— ” কই যাস? ”
সিনথিয়া প্রশ্ন করলো,
— ” কুত্তারে ডাকতে। ওর মরার মত ঘুমানো বের করছি আমি। ওয়েট! ”
তারা চলে গেলো।
তারা আভার রুমে কয়েকবার বেল বাজালো। কিন্তু, ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারা ডাকও দিলো দুবার। কিন্তু, নিরুত্তর আভা। একসময় তারা হাল ছেড়ে দরজায় লাথি দিয়ে আবার ছাদে চলে এলো।
তারাকে একা ফিরে আসতে দেখে, বাকি সবাই একটু অবাক হলো। তাহমিদ জিজ্ঞেস করলো,
— ” আভা আসেনি? ”
তারা ধাম করে বসে পড়লো। হাতে একটা ফুল নিয়ে অযথাই তার সকল পাঁপড়ি ছিঁড়ে হাত দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কন্ঠে তেজ নিয়ে বললো,
— ” না। দরজাই খুললো না। বিরক্তিকর! ”
আবারো সবাই কাজে মন দিলো। আজকে প্রায় দশটা মালা বানাতে হবে। দুটো কনে আর বরের জন্যে। বাকিগুলো আভারা একে একে গলায় দিয়ে ছবি তুলবে। শুধু, বাড়তি মজার উদ্দেশ্যে!
হঠাৎ, তারার চোখ গেলো ছাদের একপাশে আহনাফের দিকে। আহনাফ একজন স্টাফকে দোলনায় কি করবে, কি করবে না সেটা বুঝাচ্ছে। তারার মুখে এবার হাসি ফুটলো। তারা এক মুহুর্তে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর, এক দৌঁড়ে চলে গেলো আহনাফের কাছে।

–” জিজু, জিজু! ”
পাশ থেকে হাপাতে হাপাতে বললো তারা। আহনাফ তারার দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় স্টাফকে বিদায় দিয়ে তারার মুখোমুখিও হলো। ডান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কিছু বলবে, শালিকা? ”
তারা তাকালো আহনাফের দিকে। নিজের দু গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করলো,
— ” আভা ঘুমাচ্ছে! ”
আহনাফ শুনলো। তবে, বুঝল না কিছু। ডান ভ্রু আগের ছেড়ে আরো একটু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” তো? ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক! ”
— ” আরে জিজু, আপনি বুঝছেন না। আরেকটু পরই রঙ খেলা শুরু হবে। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আভা ঘুম থেকে উঠবে কখন, আর রঙ খেলবেই বা কখন? আমাদের রঙ খেলা তো মাঠে মারা পড়বে তখন। বুঝতে পারছেন, আমি কি বলছি! ”
তারার মুখখানা ছোট হয়ে এটুকু হয়ে গেলো। চোখে কি নিদারুণ অসহায়ত্ব! যেন, আজ আভাকে ঘুম থেকে তোলাই তার একমাত্র ধর্ম। যে ধর্ম পালন না করলে ঘোর অনর্থ হয়ে যাবে। আর সেটা তারা কিছুতেই হতে দিবে না। এটা যেনো তার সংকল্প! আহনাফ তারার এমন অবস্থা দেখে হাসলো। ঠোঁট টিপে বললো,
— ” জ্বী, বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা। আচ্ছা, যাও। আমি দেখছি। নো টেনসন! ”
তারার মুখে এবার হাসি ফুটলো। আহনাফের দিকে তাকিয়ে প্রায় লাফিয়েই বলে উঠলো,
— ” থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ! ”
তারা চলে গেলো। আহনাফ ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে এবার পা বাড়ালো রিসিপশনের দিকে।
_____________________
আজ গরম পড়েছে খুব। রোদও উঠেছে! কিন্তু, সবচেয়ে বিরক্ত লাগে তখন, যখন রোদের হলদে আলো একদম মুখের চারপাশে লুটোপুটি খায়। তেমনি, আভা। ঘুমাচ্ছিল কি শান্তিমতে। কিন্তু, শান্তির মায়ের শুরু হলো অশান্তি! তাই, রোদ দিয়ে জ্বালিয়ে আভার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। আভা মিটিমিটিয়ে তাকালো। কিন্তু, ওর দম বন্ধ লাগছে কেন? শ্বাস নিতে পারছে না। তবে কি, আভা মারা যাচ্ছে? মৃত্যুর কথা মাথায় আসতেই আভা তুমুল ভয় পেলো। তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্কে চাপ দিতে লাগলো। ঘুমের ছোঁয়া কাটতে লাগলো, শরীর থেকে। আভার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে লাগলো। চোখ খুলেই দেখলো, আভার পেটের উপর কারো হাত। হাত’টাকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করলো আভা। লোমশ, পুরুষালি এক হাত। আভা ভয় পেয়ে গেলো।
‘ আল্লাহ!! ‘ বলে এক চিৎকার করে বড়বড় চোখ দিয়ে পাশে তাকালো। পাশের মানুষটিকে দেখে আভার ভয় পাওয়া চোখ শীতল হলো। বরং, সেই চোখে ভর করলো রাজ্যের বিরক্তি! আহনাফ আভাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে আছে। উনি কখন এলেন? দরজা তো লক করা। তবে? আভা আহনাফের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে, পারলো না। বরং, আহনাফ আরো শক্ত করে আভাকে জড়িয়ে ধরলো। আভার মনে হচ্ছে, আর একটু হলেই সে আহনাফের বুকের ভিতরে ঢুকে যাবে। আহনাফের ভারে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে ও। এসবের কোনো মানে হয়? কেউ দেখলে কি ভাববে? ছিঃ! আভা এবার আহনাফের কানের কাছে চিৎকার করলো,
— ” ছাড়ুন আমায়। শুনছেন, ছাড়ুন। ”
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এক সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। তার চোখের আকৃতি দেখেই মনে হচ্ছে, চোখ মেলে তাকাতে যেনো তার বিরাট আলসেমি! আভা ভ্রু কুঁচকে রাগ নিয়ে বললো,
— ” এটা কি ধরনের অসভ্যতা! আপনি আমার রুমে, আমার বিছানায় কিকরে এলেন? দরজা ত লক করা ছিলো! ”
আহনাফ আভাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় অন্য হাতে দিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করলো। আভার চোখের সামনে চাবিটা ঝুঁলিয়ে বাঁকা হেসে বললো,.
— ” ডুপ্লিকেট চাবি! ইউ নো হোয়াট, বুদ্ধি থাকলে উপায়ের অভাব হয়না! কিন্তু আফসোস! তোমার মাথায় সেটা নেই। সো..! ”
আভা চোখ সরু করে আহনাফের দিকে তাকালো। ঝগড়া করার মতো মুড তার নেই। তাই ও ছটফট করে বললো,
— ” হ্যাঁ, আমি জানি আপনি অনেক বুদ্ধিমান। মিস্টার ইন্টেলিজেন্ট, এবার আমাকে ছাড়ুন। আপনি রুম থেকে বের হন। কেউ দেখে নিলে খারাপ ভাববে। সো, গো! ”
আহনাফ হাসলো। আভার দিকে খানিক ঝুঁকে এসে শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কেউ দেখলে কি ভাববে? ”
আহনাফের ওমন ফিসফিসানি আওয়াজ শুনে আভার শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো। ঘন ঘন চোখের পল্লব ফেললো ও। বললো,
— ” আ.আপনি একটু দ.দূরে স.সরুন। ”
আভার কণ্ঠ তিরতির করে কাঁপছে। একটা শব্দ আরেকটা শব্দের সাথে মিশে নতুন এক ছন্দ তৈরি করছে। আহনাফ আভার দিকে আরও একটু ঘন হয়ে পুনরায় ফিসফিসালো,
— ” বলো..! কেউ দেখলে কি ভাববে? ”
আভার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। আহনাফের ফিসফিস আওয়াজ তার বুকের ভিতরে ঝড় তুলছে। মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ আহনাফ এমন করলে আভা নির্ঘাত মারা যাবে আভা তাকালো আহনাফের দিকে। স্থির চোখে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়ালো,
— ” ভাববে…ভাববে, আমরা…আমরা..”
আভা হঠাৎ আহনাফের বুকে ধাক্কা দিয়ে আহনাফকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে পাশে ফেলে দিলো। আচমকা আভার এমন ধাক্কায় আহনাফের কিছুটা সময় লাগলো নিজেকে সামলাতে। ততক্ষণে, আভা বিছানা ছেড়েছে। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে একবার বললো,
— ” মানুষের ভাবার দিন শেষ, নারীশক্তির বাংলাদেশ! ”
আভা হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আহনাফ হতভম্ভ চোখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা এত ফাজিল কেনো? আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। বিছানা, রুম গুছিয়ে আভার উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখলো। তারপর, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা লক করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

‘ তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি, ভেঙেচুরে শতবার! ‘

রুফটপে গান বাজছে। সকল মেয়েজাতি নেমেছে রং খেলায়। বাচ্চাদের হাতে লম্বা লম্বা কালার গান। সবার মুখে আনন্দ-উচ্ছাস! আভা ও তার সঙ্গপাঙ্গ একপাশে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ রং খেলতে খেলতে ক্লান্ত তারা। হাসাহাসির এক পর্যায়ে আভা বলে উঠলো,
— ” আমি ড্রেস চেঞ্জ করে আসছি। তোরাও চেঞ্জ করে আমার রুমে চলে আসিস। গল্প করা যাবে। ”
সবাই সায় দিলো আভার কথায়। আসলে, কারোর শরীরেই এখন আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। সব নিঃশেষ হয়ে শূন্যের কোটায়। আভা জামার রং ঝাড়তে ঝাড়তে নিচে নেমে গেলো।
আহনাফের রুম পেরিয়েই আভার রুম। আভা অন্যমনস্ক হয়ে আহনাফের রুম পেরিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিল। কিন্তু, হুট করে ঘটলো এক বিপত্তি। আচানক, আহনাফের রুমের দরজা খুলে গেল। আভা সেদিকে তাকাতেই আহনাফ হাত বাড়িয়ে আভাকে হেচকা টান দিয়ে নিজের রুমে নিয়ে এলো। আভা যখন সম্পূর্ণ অবাক, তখন আহনাফ দরজায় সিটকিনি আটকে দিলো। সিটকিনির শব্দে আভার ঘোর ভাঙলো। কি হচ্ছে, সবই ধীরে ধীরে বোধগম্য হলো। আভা আহনাফের দিকে তাকালো। চোখে রাগ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে। এই লোকের কবে বুদ্ধি হবে? কখন কোন কাজ করতে হয়, সেটা কখন বুঝতে শিখবেন? এই যে একটু আগে, ওভাবে টেনে নিয়ে আসলো, কেউ দেখে ফেললে? ছিঃ! আভা বললো,
— ” আপনি কি কখনোই শুধরাবেন না? কেউ দেখে নিলে কি হতো? আপনার তো কিছু না, নাক কাটা যাবে আমার! ”
আভার কণ্ঠ থেকে রাগ বালির মত ঝরে ঝরে পড়ছে। তবে, আহনাফ স্বভাবসুলভ সেসব পাত্তা দিলো না। বরং, আভার দিকে পূর্বের চেয়ে আরো একটু ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
— ” সবাই আমার বউকে রং মাখালো। শুধু আমিই বাদ পড়ে গেলাম। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তো, এখন আমি…? ”
— ” এখন আপনি? ”
আভা ভ্রু উচুঁ করে বললো। আহনাফ আভার কোমরে নিজের এক হাত গলিয়ে দিলো। আভার কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলেও, মুখখানা থমথমে করেই রাখলো। আহনাফ আভার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্য হাত দিয়ে পাশে থাকা রঙের ঢালায় হাত ডুবিয়ে দিলো। পুরুষালি হাতে মাখামাখি হলো, গোলাপি রং। আহনাফ সেই রঙ মাখা হাত নিজের দুগালে ছোঁয়ালো। আভা ভ্রু কুঁচকে আহনাফের একেকটা গতিবিধি লক্ষ্য করছে। কি করতে চাইছে এই লোক? বুঝা মুশকিল! আহনাফের গাল ভর্তি রঙ। যেনো মাত্রই রঙের নদীতে গোসল সেরে এসেছে ও। রঙ মাখা অবস্থায় আহনাফকে মারাত্মক সুন্দর লাগছে। আভার কুঁচকালো ভ্রু ক্রমশ স্বাভাবিক হলো। চোখে ভর করলো, প্রেমিক পুরুষ নামক মুগ্ধতা! আহনাফের গায়ে জড়ানো সাদা রঙের টিশার্ট রঙের ছোপ ছোপ ছিঁটে’তে গোলাপি হচ্ছে। আহনাফ আভার দিকে তাকিয়ে আছে, নিস্পলক! চোখের পল্লব ফেলছে ধীরে ধীরে। আহনাফ ধীরে ধীরে নিজের মুখটা আভার দিকে এগিয়ে আনলো। আভা কিঞ্চিৎ ভয় পেলো। তবে, আহনাফের প্রতি জন্মানো এতদিনের বিশ্বাস আভার ভয়কে কাবু করে ফেললো। আভা আলগোছে বুজে রাখা চোখ নিয়ে বললো,
— ” ক.কি ক.ক.করছেন? ”
আহনাফ উত্তর দিল না। আসলে, কথাটা কানে প্রবেশ করে নি তার। মত্ত হয়ে গেছে সে আভাতে। আহনাফ চোখ বন্ধ করে নিজের গাল আভার গালে ঘষলো। আভা কেঁপে উঠে চোখ খিঁচলো। আহনাফের গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ফুটছে আভার গালে। আভা এতে ব্যথা পাচ্ছে। তবে, সেই ব্যথা চাপা পড়ছে সুপ্ত এক ভালোলাগায়। মনে হচ্ছে, আভা নিজের মাঝে নেই। আড়াল হয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে। মত্ত হয়ে গেছে তার ‘ উনাতে ‘ ! আহনাফ আভার অপর গালেও নিজের গাল ঘষলো। আভা আবারও কেঁপে উঠলো। চোখ খিঁচে খামচে ধরলো আহনাফের বুকের কাছের টিশার্ট। আহনাফ মুচকি হাসলো। ধীরে ধীরে সরে এলো আভার থেকে। তাকালো আভার খিঁচে রাখা চোখের দিকে। আভার গালে লজ্জার রঙ! তাতে মেশানো দু’ফোঁটা আবির! উফ! মারাত্মক সুন্দর সেই মুখশ্রী। আভা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। আহনাফ আভার কানে ফিসফিসালো,
— ” যাও, রাঙিয়ে দিলাম তোমায়, আমার রঙে। আমার ভালোবাসার রঙে! যে রঙ কখনোই ক্ষয় হওয়ার নয়। যে ভালোবাসা কখনো নিঃশেষ হওয়ার নয! ”
আভা আহনাফের চোখে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আহনাফের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে একদমে সরিয়ে ফেললো। অতঃপর, এক দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো সেই হৃদ কাঁপানো ঘর থেকে। আহনাফ সেদিকে তাকিয়ে শুধু হাসলো। মাথার ঘন চুলে হাত চালিয়ে বিড়বিড় করলো,
— ” তুমি ফেঁসে গেছো, বউফ্রেন্ড! এবার শুধু মুখে বলার পালা। আমি অপেক্ষা করছি, সেই সুন্দর মুহূর্তের! খুব করে অপেক্ষা করছি! ”
_____________________
আজ হলুদের দিন। আগামীকাল বিয়ে। তারপরই, সব আয়োজন ফিকে। মিনহাজের ঘরে আসবে টুকটুকে এক নারী! তার ছোট্ট দুনিয়া মেতে উঠবে সেই নারীরা নূপুরের ঝনঝনাতে। তার এলোমেলো দুনিয়া আবারও গোছালো হবে,সেই কোমলবতি নারীর নরম নরম হাতে। মিনহাজ রেডি হয়ে নিচে নামলো।
হলুদের স্টেজে কনে আর বর পাশাপশি বসবে। মাঝখানে থাকবে হলুদ রঙের পর্দা। এই পর্দা দ্বারাই কনে,বরকে আলাদা করা হবে। দারুন নিয়ম! কিন্তু নিয়মটা যে মিনহাজের ভালো লাগলো না। কে বের করেছে এই অদ্ভুত নিয়ম? পাশাপশি বসবো, কিন্তু মুখ দেখব না। এ কেমন অত্যাচার! মিনহাজ মুখখানা হুতুম পেঁচার মত করে বসে রইলো।
হলুদের দিনে, আজ সবাই হলুদ আর সাদার মধ্যে লেহেঙ্গা পড়েছে। মেয়েরা সাদা টপস, হলুদ ঘাগড়া, সাথে জর্জেটের হলুদ ওড়না। ছেলেরা সাদা পাঞ্জাবি, তার উপর হলুদ কটি, সাথে সাদা পায়জামা। সবাই ম্যাচ করে জামা-কাপড় পড়েছে। আভা একহাত দিয়ে লেহেঙ্গা সামলিয়ে হেঁটে আসলো স্টেজে। ভাইকে দুগালে হলুদ লাগিয়ে দাঁত কেলালো,
— ” হলুদ লাগলাম।এবার দোয়া দাও। ”
মিনহাজ ভ্রু উচুঁ করে ডান হাত আভার মাথার উপর রেখে হাবিজাবি বিড়বিড় করে বললো,
— ” যা দিলাম। এবার বিদায় হ। ”
আভা মাথার ওপর থাকা মিনহাজের হাত এক টানে সরিয়ে ফেললো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
— ” তোমার মুখে বলা দোয়া চায়নি। এত কষ্ট করে তোমাকে হলুদ লাগালাম। দোয়া হিসেবে, টাকা দাও। ”
মিনহাজ বিরক্ত চোখে তাকালো। মুখে কৃত্রিম রাগ নিয়ে বললো,
— ” কোনো টাকা না। ফুট এখান থেকে। ”
আভা মুখ কালো করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। যাওয়ার আগে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কালো মুখে বললো,
— ” তোমার মানিব্যাগ ফাঁকা হোক, তোমার বউ তোমাকে ফতুর করে দিক। আমিন, আমিন। ”
আভা চলে গেলো। মিনহাজ কিছু বললো না, হাসলো শুধু!

আভা গল্প করছে কয়েকটা মেয়ের সাথে। দূরে একপাশে দাড়িয়ে আহনাফের মা, আভার মা, আরো দুজন মহিলা গল্প করছেন। এই বিয়েতে অ্যাটেন্ড করার কারণে, আহনাফ, আর ওর বাবা হসপিটাল কদিন অন্যের দায়িত্বে রেখে এখানে এসেছেন। তবে, এখানেও তাদের ডিরেকশনের কাজটা অনলাইনে করতে হচ্ছে। আর পেশেন্ট দেখার কাজ, এ কদিন অন্যের দায়িত্বে দিয়ে এসেছেন। তবে, সবকিছু এত সহজ মনে হলেও, ব্যাপারটা মোটেই সহজ না। এজন্যে, দুজনকেই বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। তবে, আভার বাবার অতি মাত্রার অনুরোধের কাছে তাদের সব কাজ হার মানতে বাধ্য হয়েছে।
আভা সবার সাথে গল্প করলেও তার চোখদুটি আহনাফকে খুঁজছে! কোথায় গেলেন উনি? আভা চারপাশে তাকালো। নাহ, নেই তো! আভা হতাশ হয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— ” আমার তৃষ্ণা পেয়েছে। ঠান্ডা কিছু খেয়ে আসি। তোরা গল্প কর। ”
আভা চলে এলো ওদের থেকে।
দুজন স্টাফরা সবাইকে কোল্ড ড্রিংকস সার্ভ করছে। আভা ওদের থেকে এক গ্লাস কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে। একসময় পা স্থির হলো আভার। দাঁড়ালো একপাশে। আহনাফ দাড়িয়ে আছে, একটু দূরে। নিজের বাবার সাথে কথা বলছে। আহনাফকে কথা বলতে দেখে আভা আর এগুলো না। হেঁটে অন্যপাশে চলে গেলো।

— “তোমায় ভয়াবহ ‘ আমিময় ‘ লাগছে, মিস বউফ্রেন্ড! ”
কানের কাছে আহনাফের ওমন ঝুঁকে কথা বলতে দেখে আভা তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ালো। খানিক ভয় পেয়ে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফের ঠোঁটে ঘায়েল করা মুচকি হাসি। যা দেখে, আভা অজান্তেই গলে গেল। কোল্ড ড্রিংকসে ঠোঁট দ্বারা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” ‘ আমিময় ‘ মানে? ”
আহনাফ আভার দিকে আরও একটু ঘন হয়ে দাঁড়ালো। আভার ছটফটে চোখে চোখ রেখে বললো,
— ” আমিময় মনে আমার একান্ত ব্যক্তিগত নারী, আমার সর্বস্ব, আমার বুকের স্পন্দন, আমার নিঃশ্বাস, আমার হৃদয়রানী।আমিময় মানে, আভা নামক এই আস্ত মেয়েটাই। যার অস্থিত্ব আমার মনের প্রতিটা অঞ্চল জুড়ে। ”

আভা পুনরায় কাঁপলো। আহনাফ ওমন করে কথা বলেন কেনো? সে কি জানে না, তার ওমন কথা শুনে আভার দম বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভিতর তবলা বাজে। নৃত্য করতে থাকে তার মনের প্রতিটা উচুঁ নিচু স্তর। হয়তো সে জানে। আর জানে বলেই তার এমন ব্যবহার! আভাকে নিজের ওমন কথা দ্বারাই মেরে ফেলতে চান, পণটা যেমন এরূপ!

— ” হ্যাই, রাত্রি! ”
পিছন থেকে পুরুষালি ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আভা আর আহনাফ দুজনই পিছন ফিরলো। কে ডাকলো আভাকে?

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here